তৃতীয়ত, ঘটাকাশ—ঘটের ভেতরে যে আকাশ রয়েছে। এটি জীবাত্মা, অর্থাৎ ব্যক্তিগত চেতনা, যা নিজেকে সীমিত মনে করে। অথচ এই ঘটাকাশ মহাকাশের বাইরে নয়; পাত্র ভেঙে গেলে জানা যায়—দুইয়ের কোনো ভেদই নেই।
বেদান্তীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়, দেহ ও মন উপাধি (Upādhi)—যা আত্মার ওপর সীমাবদ্ধতার ছাপ ফেলে। এই উপাধির কারণেই আত্মা মনে করে, “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি পৃথক চেতনা।” কিন্তু আসলে উপাধি আকাশকে যেমন ভাগ করতে পারে না, তেমনি দেহ ও মনও আত্মাকে ভাগ করতে পারে না।
শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.১.১৪) এই ন্যায়ের উল্লেখ করেছেন—“যেমন এক আকাশ অনেক পাত্রে সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে একই, তেমনি এক চেতনা বহু-দেহে প্রতিফলিত হয়ে বিভাজিত বলে প্রতীয়মান হয়।” অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের ভেদ কেবল প্রতীতি, বাস্তব নয়।
এই ন্যায়ের দার্শনিক তাৎপর্য গভীর। যতক্ষণ দেহ নামক পাত্র অটুট, ততক্ষণ জীব ভাবছে, সে সীমিত, সুখী বা দুঃখী; কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে এই উপাধি-ঘট ভেঙে যায়। তখন জীব বুঝতে পারে, “আমি কোনো পৃথক চেতনা নই, আমি সেই এক চিরচেতনা ব্রহ্ম।”
ঘট-আকাশ-মহাকাশ-ন্যায় শেখায়—ব্রহ্ম অপরিমেয় মহাকাশ, জীব কেবল ঘটাকাশ; দেহ ও মন সেই ঘট, যা সীমারেখা সৃষ্টি করে। উপাধি ভেঙে গেলে বোঝা যায়—চেতনা কখনও বন্দি ছিল না, বরং সর্বত্র বিরাজমান, অবিভক্ত, নিরাকার ও চিরশান্ত। জীব তখন উপলব্ধি করে—“সো’হম্”—আমি-ই সেই ব্রহ্ম।
উপাধি শব্দের অর্থই হলো সংযোজন, অর্থাৎ এমন কিছু, যা মূল সত্তার সঙ্গে মিশে না থেকেও তাকে নির্দিষ্ট সীমা ও গুণের মতো দেখায়। বেদান্তে এটি একধরনের অধ্যাস বা অধ্যারোপ—অর্থাৎ অপরের উপর এমন কিছু আরোপ করা, যা আসলে তার নিজের নয়। অসীম, নির্গুণ, নির্লিপ্ত আত্মার উপর যখন মায়া বা অবিদ্যার প্রক্ষেপণ ঘটে, তখনই তাকে নানা সীমারূপে দেখা যায়—যা আসলে আত্মার নয়, কেবল তার উপর আপাত-আরোপ।
যখন চৈতন্য মায়ার উপাধিতে প্রতিফলিত হয়—অর্থাৎ সমষ্টিগত, বিশ্বব্যাপী শক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়—তখন সেটিকে ঈশ্বর বলা হয়। এই ঈশ্বর সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, সৃষ্টির নিয়ামক, কারণ তিনি মায়ার অধিপতি। যেমন আয়নায় প্রতিফলিত সূর্য পুরো আলোকময় আকাশকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মনে হয়, তেমনি ঈশ্বর আসলে সেই চৈতন্যই, যিনি মায়ার মাধ্যমে জগতের মধ্যে কার্যকারণ স্থাপন করেন।
অন্যদিকে, যখন একই চৈতন্য অবিদ্যা—অর্থাৎ ব্যক্তিগত মনের সীমিত আয়নায় প্রতিফলিত হয়—তখন তা জীব নামে পরিচিত হয়। এই জীব নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে; ফলত অজ্ঞান, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদিতে আবদ্ধ থাকে। সে মনে করে, “আমি ক্ষুদ্র”, “আমি দুঃখী”, “আমি কর্তা”, যদিও আসলে সে সেই এক অচঞ্চল চৈতন্য।
ঈশ্বর ও জীব—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য শুধুমাত্র উপাধি-বৈচিত্ৰ্যে। ব্রহ্ম নিজে অপরিবর্তিত, অদ্বিতীয়, কিন্তু উপাধির প্রতিফলনে তিনি দুই রূপে দেখা দেন—এক সর্বশক্তিমান, অপর সীমাবদ্ধ। এই ভেদ তাই পরমার্থত সত্য নয়; এটি কেবল মায়ার প্রতিফলনমাত্র।
যখন এই উপাধি বা আপাত-সংযোজন বিলীন হয়—অর্থাৎ, মায়া ও অবিদ্যা উভয়ের আচ্ছাদন সরিয়ে যায়—তখন অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই এক শুদ্ধ ব্রহ্ম: নির্গুণ, নির্লিপ্ত, অনাদি ও অপরিবর্তনীয়। যেমন আয়নায় প্রতিচ্ছবি আসে ও যায়, কিন্তু আয়না নিজে কখনো পালটায় না, তেমনি নাম-রূপের সমগ্র খেলা বিলীন হলেও আত্মা বা ব্রহ্ম চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর থেকে যায়।
ব্রহ্মসূত্র (২.৩.৫০) সম্পর্কে শঙ্করের ভাষ্য—এখানে জীবকে ব্রহ্মের অংশ বলা হলেও, সেই অংশত্বকে উপাধি বা প্রতিবিম্বের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মুণ্ডক উপনিষদ (৩.১.১)-এ, "দ্বা সুপর্ণা" রূপকের মাধ্যমে যেখানে জীবাত্মা (ফলভোক্তা) এবং পরমাত্মা (সাক্ষী) একই বৃক্ষে থাকলেও, তাদের মধ্যে ভেদের প্রতীতি হয়। জ্ঞান হলে সেই একত্ব (অনন্যঃ) উপলব্ধ হয়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৪.২)-এ, বলা হয়েছে, আত্মাই দ্রষ্টা, আর তাঁর থেকে ভিন্ন কিছু নেই (নান্যদতোঽস্তি দ্রষ্টৃ)।
এই কারণেই বিভিন্ন বেদান্ত-পরিভাষা গ্রন্থ বা প্রকরণ-গ্রন্থে পাওয়া যায়—“উপাধি-ভেদে ভেদপ্রতীতি, তত্ত্বত একত্ব নিত্যং।” অর্থাৎ, উপাধি যতদিন আছে, ততদিন বিভেদের প্রতীতি থাকে, কিন্তু উপাধি লোপ পেলে দেখা যায়—ঈশ্বর, জীব ও ব্রহ্ম আসলে এক এবং অভিন্ন।
অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞাতা (Knower) ও জ্ঞেয় (Known)-এর সম্পর্ক শুধুমাত্র জ্ঞানতত্ত্বের সীমায় আবদ্ধ নয়—এটি আত্মা ও মায়ার পারস্পরিক প্রতিফলনের সূক্ষ্ম রহস্য। সাধারণ দর্শনে যেখানে জ্ঞান মানে “কোনো বস্তুর সম্পর্কে সচেতন হওয়া”, সেখানে অদ্বৈত বলে—জ্ঞান আসলে চৈতন্যের নিজস্ব বিকিরণ, আর জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান—এই তিন বিভেদই অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট।
ব্যাবহারিক স্তরে মানুষ জগৎকে জানে তিনটি প্রধান প্রমাণের (প্রমাণত্রয়ী) মাধ্যমে—প্রত্যক্ষ (Perception), অনুমান (Inference), ও শাস্ত্র (Scriptural Testimony)।
প্রত্যক্ষ হলো ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা; অনুমান হলো যুক্তি ও সম্পর্ক দ্বারা পরোক্ষভাবে উপলব্ধ জ্ঞান; আর শাস্ত্র হলো এমন জ্ঞানের উৎস, যা ইন্দ্রিয় ও যুক্তির ঊর্ধ্বে—যেমন ব্রহ্ম বা আত্মার স্বরূপ।
তবে এই তিন প্রমাণই মায়ার স্তরে সীমাবদ্ধ, কারণ তারা সবই দ্বৈততার শর্তে কাজ করে। যেখানে “আমি জানি” ও “যা জানা যায়”—এই বিভাজন থাকে, সেখানেই জ্ঞান সীমিত। প্রত্যক্ষ কাজ করে ইন্দ্রিয়ের উপর, অনুমান নির্ভর করে বুদ্ধির বিশ্লেষণের উপর, আর শাস্ত্র, যদিও মায়াতীত সত্যের ইঙ্গিত দেয়, তবুও তার প্রতীতি প্রথমে মনেই ঘটে—অর্থাৎ অবিদ্যার ক্ষেত্রেই।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, প্রকৃত জ্ঞান—যাকে অপরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়—এই তিনের অতীত। কারণ তা কোনো দ্বৈত কাঠামোর মধ্যে সংঘটিত হয় না; সেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ভেদ বিলুপ্ত হয়, এবং জ্ঞান নিজেই নিজের বিষয় হয়ে ওঠে। ব্রহ্মজ্ঞানে আত্মাই জ্ঞাতা, আত্মাই জ্ঞেয়, আত্মাই জ্ঞান—এই ত্রিবিধ ভেদ মুছে যায়।
আমাদের সাধারণ জ্ঞানলাভের মাধ্যম, যেমন—চক্ষু (দর্শন), বাক্ (কথা/বর্ণনা) এবং মন (চিন্তা/ধারণা), সবই সীমিত বা উপাধিযুক্ত। ব্রহ্ম এই সব কিছুর অতীত। তাঁকে কোনো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে দেখা যায় না, কোনো ভাষার মাধ্যমে বর্ণনা করা যায় না, এবং মন দিয়ে ধারণা করাও যায় ন। ব্রহ্ম বা পরমাত্মা হলেন সেই সত্তা, যিনি সকল ইন্দ্রিয় ও মনের কার্যকারিতার মূলে বিদ্যমান। এই ব্রহ্মকে কেবল হৃদয়ের মাধ্যমে, অর্থাৎ শুদ্ধজ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা উপলব্ধি করা যায়।
উপনিষদে তাই বলা হয়েছে—“ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি, ন বাগ্ গচ্ছতি, ন মনঃ” (কঠোপনিষদ, ২.৩.১১-১২)—যেখানে আত্মা আছে, সেখানে ইন্দ্রিয়, বাক্ বা মন পৌঁছাতে পারে না। কারণ আত্মা কোনো জ্ঞেয় বস্তুর মতো নয়; সে নিজেই সব জ্ঞানের ভিত্তি। তাই অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—“জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় একই চৈতন্যের প্রতিফলন।”
যেমন সূর্যের আলোয় সব দেখা যায়, কিন্তু সূর্যকে দেখার জন্য আলোর প্রয়োজন হয় না, তেমনি আত্মা দ্বারা সব কিছু প্রকাশিত হয়, অথচ আত্মাকে প্রকাশ করার মতো আর কোনো আলো নেই। এই অবস্থাতেই জ্ঞানের সমস্ত মাধ্যম ও ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে তা হল এক, অখণ্ড, স্বপ্রকাশ চৈতন্য—যিনি একই সঙ্গে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান।
অদ্বৈত বেদান্তে আত্মজ্ঞানকে বলা হয় অপরোক্ষানুভূতি—অর্থাৎ, এমন জ্ঞান, যা কোনো প্রমাণের (প্রত্যক্ষ, অনুমান বা শাস্ত্র) সাহায্যে নয়, বরং আত্মার নিজস্ব স্বরূপের প্রকাশের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়। এখানে “জ্ঞাতা”, “জ্ঞেয়” এবং “জ্ঞান”—এই তিনটি বিভাজন একাকার হয়ে যায়। কারণ আত্মা কখনও জ্ঞেয় নয় যে, তাকে অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে জানা যায়; আত্মা নিজেই সেই আলো, যার দ্বারা সব জানা যায়।
শঙ্করাচার্য এই অবস্থাকে বলেছেন “আত্ম-সাক্ষাৎকার” (Ātma–Sākṣātkāra)—যেখানে আত্মা নিজে নিজের প্রকাশ। এটি কোনো ধারণা, চিন্তা বা তত্ত্ব নয়; এটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের নয়—চৈতন্যের প্রত্যক্ষতা। যেমন কেউ ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠে এবং বুঝতে পারে “আমি আছি”—এই “আছি”-বোধ কারও দ্বারা প্রমাণিত নয়, বরং আত্মার নিজস্ব প্রকাশ বা স্বপ্রকাশ; তেমনি আত্মজ্ঞানও নিজের মধ্যে থেকেই উদ্ভাসিত।
এই উপলব্ধির পথে অদ্বৈত বেদান্ত শ্রেণীভুক্ত করেছে তিনটি ধারাবাহিক অনুশীলন—শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন।
শ্রবণ (Śravaṇa) হলো শাস্ত্র ও গুরুর বাণী শোনা—বিশেষত মহাবাক্য “তৎ ত্বম্ অসি” (“তুমি সেই ব্রহ্ম”) বা “অহং ব্রহ্মাস্মি” (“আমি ব্রহ্ম”)। এই শ্রবণে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা জন্মায়। এটি কেবল শোনা নয়, অর্থগ্রহণ—শব্দের অন্তর্নিহিত সত্যটি উপলব্ধি করা।
এরপর আসে মনন (Manana)—অর্থাৎ, যুক্তি, বিচার ও চিন্তার মাধ্যমে সমস্ত সন্দেহ দূর করা। বেদান্তে সন্দেহ (সংশয়) অজ্ঞানতার পর্দা। যখন শ্রবণের মাধ্যমে যে-সত্য জানা যায়, তা মননের দ্বারা সমস্ত বুদ্ধিবিরোধী প্রশ্ন মিটিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়, তখন আত্মজ্ঞান বৌদ্ধিক পর্যায়ে স্থিত হয়।
শেষ ধাপ হলো নিদিধ্যাসন (Nididhyāsana)—যেখানে সেই জ্ঞান ধ্যানের মাধ্যমে জীবনের অন্তঃস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কেবল চিন্তা নয়, অন্তঃস্থিতি—দ্বৈততার সমস্ত অবশিষ্ট ছায়া বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত একাগ্রভাবে সেই ব্রহ্মবোধে স্থিত থাকা। মন শান্ত হলে আত্মার স্বরূপ স্বয়ং প্রকাশিত হয়।
‘মাণ্ডুক্য কারিকা’-র অদ্বৈত প্রকরণ (তৃতীয় অধ্যায়)-এর শ্লোক ৪৬ বলে—“মনঃপ্রশমো হ্যেষ ব্রহ্মাভেদন অবস্থিতিঃ। / নির্বিকল্পো হ্যয়মজোঽস্পর্শয়োগো দুরূহকঃ।।”—মন প্রশমিত হলে ব্রহ্মের সঙ্গে ঐক্য অনুভূত হয়। এই শ্লোকটি অদ্বৈত জ্ঞান এবং যোগের চরম লক্ষ্যকে তুলে ধরে। এর মূল তাৎপর্য:
মনোবৃত্তি নিরোধ: যখন মন সম্পূর্ণভাবে শান্ত হয় এবং তার সমস্ত প্রকার চঞ্চলতা (বৃত্তিসমূহ) নিবৃত্ত হয় (মনঃপ্রশমো)।
ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদ: সেই অবস্থাই হলো আত্মার ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্নভাবে অবস্থান (ব্রহ্মাভেদেন অবস্থিতিঃ)।
অস্পর্শ যোগ: গৌড়পাদ এই অবস্থাকেই অস্পর্শ যোগ বলে বর্ণনা করেছেন, যা পুরোপুরি নির্বিকল্প (বিকল্পহীন), জন্মরহিত (অজ) এবং উপলব্ধির দিক থেকে অত্যন্ত কঠিন (দুরূহকঃ)।
এই শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসনের পথেই জ্ঞান ধারণা থেকে অনুভূতিতে, আর অনুভূতি থেকে স্থিতিতে রূপান্তরিত হয়। শেষাবধি আত্মা নিজেকে “ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কিছু নয়” বলে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে। তখন আর কোনো জ্ঞেয় অবশিষ্ট থাকে না; থাকে কেবল চৈতন্য, যা নিজে নিজের আলোয় জ্বলজ্বল করছে—যেমন সূর্য নিজেকে আলোকিত করতে অন্য আলো চায় না।
এই অবস্থাই আত্ম-সাক্ষাৎকার—যেখানে জ্ঞান আর কোনো প্রমাণের দ্বারা নয়, আত্মার নিজস্ব উপস্থিতিতেই সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, চূড়ান্ত সত্যরূপে প্রকাশিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা কোনো বস্তুগত অন্ধকার নয়, বরং এক জ্ঞানীয় বিকৃতি, যা চেতনার উপর এক পর্দা ফেলে বাস্তবের সত্যরূপকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই অবিদ্যা-জনিত বিকৃতি বা অজ্ঞান-বৃত্তি (Ajñāna-vṛtti) এমন এক মানসিক অবস্থান, যেখানে চৈতন্য নিজের প্রকৃত স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়। আত্মা কখনও আসলে আচ্ছন্ন হয় না—কিন্তু অবিদ্যার কারণে তার স্বয়ংপ্রকাশ ক্ষমতা আমাদের দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, যেমন সূর্য মেঘে ঢেকে গেলে পৃথিবী অন্ধকারে পড়ে, অথচ সূর্য নিজে অন্ধকারে নয়।
অবিদ্যা কাজ করে দুই স্তরে—একটি আবরণ-শক্তি (Āvaraṇa-śakti), অন্যটি বিক্ষেপ-শক্তি (Vikṣepa-śakti)। আবরণ-শক্তি আত্মার প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে, আর বিক্ষেপ-শক্তি তার উপর মিথ্যা রূপ আরোপ করে। ফলে চৈতন্য, যা অপরিমেয়, অবিকৃত ও এক, তা “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা” ইত্যাদি ভুল ধারণায় সীমাবদ্ধ হয়। এই ভুল ধারণার নামই মায়া বা অবিদ্যা।
অবিদ্যা দূর হয় বাধক-জ্ঞান (Bādhaka-jñāna) দ্বারা—অর্থাৎ, এমন জ্ঞান, যা ভ্রান্ত ধারণাকে নিবারণ করে। যেমন আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকার বিলীন হয়, তেমনি সত্য-জ্ঞান উদিত হলে অজ্ঞানতা স্বতঃবিলুপ্ত হয়। এখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই—আলো ও অন্ধকার পাশাপাশি থাকতে পারে না; একমাত্র আলোই অন্ধকারের বাধক। তেমনি, আত্ম-জ্ঞানই অবিদ্যার বাধক; অন্য কোনো বাহ্যিক শক্তি, সাধন বা ক্রিয়া অবিদ্যার পর্দা ভেদ করতে পারে না।