সদসদ্বিলক্ষণ: জগৎকে সৎ বলা যায় না, কারণ এটি ব্রহ্মের মতো নিত্য, অপরিবর্তনীয় ও স্বপ্রতিষ্ঠিত নয়। পারমার্থিক জ্ঞান হলে এর মিথ্যাত্ব প্রতিভাত হয়। আবার জগৎকে অসৎও বলা যায় না, কারণ আমরা আমাদের জাগতিক জীবনে এর প্রত্যক্ষ অনুভব করি এবং এর সাথে ব্যাবহারিক সম্পর্ক স্থাপন করি। এটি বন্ধ্যাপুত্র বা শশশৃঙ্গের মতো একেবারে অলীক নয়। একই সাথে এটি সৎ ও অসৎ উভয়ও নয়, কারণ এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণা একই বস্তুতে থাকতে পারে না। তাই জগৎকে সৎ বা অসৎ কোনোটিই বলা যায় না, এটি সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্ন।
অনির্বচনীয়: যেহেতু জগৎ সৎ বা অসৎ কোনোটিই নয় এবং সৎ ও অসৎ থেকে ভিন্নও, তাই এর স্বরূপকে কোনো নির্দিষ্ট শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। এটি 'অনির্বচনীয়'। এর অর্থ হলো, জগৎ আমাদের বুদ্ধি বা ভাষার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায় না, এটি মায়ার সৃষ্টি এবং মায়া নিজেই অনির্বচনীয়।
মায়া ও জাগ্রৎ-স্বপ্ন অবস্থার মিথ্যাত্ব: অদ্বৈত বেদান্ত মায়াকে অনির্বচনীয় শক্তি হিসেবে বর্ণনা করে, যা ব্রহ্মকে জগৎরূপে প্রতিভাত করে। এই মায়াই জগতের সকল বৈচিত্র্য ও ভেদের কারণ। মায়ার প্রভাবেই আমরা ব্রহ্মকে জগৎরূপে দেখি এবং নিজেদের জীবাত্মা বলে মনে করি।
জাগ্রৎ অবস্থা (ব্যাবহারিক সত্য) এবং স্বপ্ন অবস্থা (প্রাতিভাসিক সত্য) উভয়ই এই অনির্বচনীয় মায়ার ক্ষেত্র।
জাগ্রৎ অবস্থা: আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যে-অভিজ্ঞতা, যা আমরা বাস্তব বলে মনে করি, তা হলো জাগ্রৎ অবস্থা। অদ্বৈত বেদান্তে এই অবস্থাকে ব্যাবহারিক সত্য বলা হয়। এই অবস্থায় আমরা বিভিন্ন বস্তু, ব্যক্তি ও ঘটনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি। এই জগতের কার্যকারণ সম্পর্ক, নৈতিক নিয়মাবলী সব কিছু এই ব্যাবহারিক স্তরে সত্য।
স্বপ্ন অবস্থা: ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন হলো প্রাতিভাসিক সত্য। স্বপ্নে আমরা যে-জগৎ দেখি, তা জাগ্রৎ জগতের মতো দৃঢ় নয় এবং ঘুম ভাঙলে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। স্বপ্নের বস্তুগুলো জাগতিক বস্তুর মতো বাস্তব মনে হলেও, সেগুলোর পারমার্থিক অস্তিত্ব নেই।
অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে, জাগ্রৎ এবং স্বপ্ন উভয় অবস্থাই পরমার্থে মিথ্যা বা অসৎ বলে গণ্য হয়। জাগ্রৎ অবস্থা স্বপ্ন অবস্থার চেয়ে অধিকতর দৃঢ় ও সুসংগত হলেও, পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ই মায়ার সৃষ্টি এবং ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে উভয়ই মিথ্যা বলে প্রতিভাত হয়। যেমন, স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলে স্বপ্নের জগৎ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়, তেমনই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে জাগ্রৎ জগৎও মায়িক ও মিথ্যা বলে উপলব্ধি হয়। একমাত্র ব্রহ্মই পরম সত্য।
অদ্বৈত বেদান্তে বাস্তবতার এই তিন স্তরকে (Satya Traya) শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। এই স্তরগুলি হলো: পারমার্থিক সত্য (Pāramārthika Satya), যা চূড়ান্ত সত্য বা Ultimate Reality—অদ্বৈত ব্রহ্মের স্বরূপ। এটি অবাধিত, স্ব-অস্তিত্বশীল এবং এখানে দ্বৈততা অনুপস্থিত; এটি চেতনার তুরীয় (Turīya) অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় স্তরটি হলো ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika Satya) বা আপেক্ষিক বাস্তবতা (Relative Reality), যা মায়া দ্বারা সৃষ্ট জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং যেখানে কার্য-কারণ সূত্র বিদ্যমান। এটি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ না হওয়া পর্যন্ত সত্য বলে মনে হয় এবং এটি জাগ্রৎ (Jāgrat) অবস্থার অভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করে। তৃতীয় স্তরটি হলো প্রতিতিভাসিক সত্য (Prātibhāsika Satya) বা মায়িক বাস্তবতা (Illusory Reality), যা কেবল মনোজগতে প্রতিভাত ভ্রম, যা জাগ্রৎ জ্ঞান দ্বারা খণ্ডিত হয়। স্বপ্ন (Svapna) অবস্থাটি এই প্রতিতিভাসিক স্তরের অন্তর্গত।
তুরীয় চেতনার স্বরূপ—অজ্ঞানতার বীজ থেকে মুক্তি: জাগ্রৎ (বৈশ্বানর), স্বপ্ন (তৈজস) এবং সুষুপ্তি (প্রাজ্ঞ), এই তিনটি অবস্থাই মানুষের চেতনার ভিন্ন ভিন্ন উপাধিযুক্ত প্রকাশ মাত্র। এই অবস্থাগুলি জাগতিক অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তরকে নির্দেশ করে, যেখানে মন এবং ইন্দ্রিয়গুলি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ক্রিয়াশীল থাকে। জাগ্রত অবস্থায় আমরা স্থূল জগৎকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করি, স্বপ্নে সূক্ষ্ম মানসিক জগৎ ক্রিয়াশীল থাকে, আর সুষুপ্তিতে সব কিছুর নিবৃত্তি ঘটে, কেবল অজ্ঞানতার বীজ সুপ্ত থাকে।
এই তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে চতুর্থ যে-অবস্থা, তাকে বলা হয় তুরীয় (Turīya)। এটি চেতনার আদি, মৌলিক এবং উপাধি-মুক্ত স্বরূপ। তুরীয়কে ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন বলে বর্ণনা করা হয়, যা চূড়ান্ত পারমার্থিক সত্য। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে জাগতিক বন্ধন, দ্বৈততার অনুভূতি এবং অজ্ঞানতার বীজ সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ হয়ে যায়। তুরীয় কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র নয়, বরং এটি সকল অভিজ্ঞতার পটভূমি—চেতনার অসীম, নিরবচ্ছিন্ন অবস্থা। এটিই আত্মজ্ঞান বা মোক্ষের চূড়ান্ত গন্তব্য।
তুরীয়ের নিবৃত্তিবাচক সংজ্ঞা (Neti, Neti): মাণ্ডূক্য উপনিষদের ৭ম শ্লোকে তুরীয়ের বর্ণনা করা হয়েছে প্রধানত নিবৃত্তিবাচক শব্দের মাধ্যমে, যা 'নেতি, নেতি' (এটি নয়, ওটি নয়) পদ্ধতির প্রতিফলন। এই পদ্ধতিটি আধ্যাত্মিক দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক, যা দেখায় যে, তুরীয়কে মনের বা বুদ্ধির সীমিত ধারণার মাধ্যমে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা হিসেবে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তুরীয়কে কোনো বিশেষ গুণ, অবস্থা বা বস্তুর দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, মন দ্বারা ধারণযোগ্য নয়, বুদ্ধির দ্বারা বিচার্যও নয়। এটি স্থূল নয়, সূক্ষ্ম নয়, এমনকি কার্যকারণ সম্পর্কযুক্তও নয়। এটি এমন কিছু, যা সমস্ত পরিচিত বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে যায়।
'নেতি, নেতি' পদ্ধতির মাধ্যমে তুরীয়ের স্বরূপকে নেতিবাচকভাবে নির্দেশ করা হয় এই কারণে যে, এর প্রকৃত প্রকৃতি ইতিবাচকভাবে বর্ণনা করা হলে তা আমাদের সীমিত বোধগম্যতার দ্বারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি আমাদের মনকে সমস্ত প্রচলিত ধারণা ও উপাধি থেকে মুক্ত করে সেই অদ্বৈত সত্যের দিকে পরিচালিত করে, যা সকল সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এটি উপলব্ধির একটি অবস্থা, জ্ঞানের একটি বিশেষ রূপ নয়।
উপনিষদ ঘোষণা করে যে তুরীয়:
অন্তরস্থ ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নন (তৈজস নন), বাইরের ঘটনা সম্পর্কেও সচেতন নন (বৈশ্বানর নন)।
জাগ্রৎ ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যবর্তী কোনো কিছু সম্পর্কেও সচেতন নন।
প্রজ্ঞানঘন (শুধু চেতনার সমষ্টি, প্রাজ্ঞ নন) বা জড় (অপ্রাজ্ঞ) নন।
তুরীয়ের এই বৈশিষ্ট্যগুলি, অর্থাৎ অদৃষ্টম (কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা অপ্রাপ্য), অব্যবহার্যম (কোনো ব্যাবহারিক লেনদেনের ঊর্ধ্বে), অগ্রাহ্যম (ধারণার অযোগ্য), অননুমেয় (অনুমানের অতীত), অচিন্ত্যম (চিন্তার অতীত), এবং অব্যপদেশ্যম (ভাষার মাধ্যমে অনির্দেশ্য), এটি প্রতিষ্ঠা করে যে, তুরীয় হলো একটি বিশুদ্ধ নিবৃত্তিবাচক ধারণা। এর অর্থ হলো, তুরীয়কে কোনো ইতিবাচক গুণাবলী বা বিশেষ রূপ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। বরং, এটিকে সমস্ত সম্ভাব্য অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রকে অতিক্রমকারী এক অবস্থা হিসেবে বোঝানো হয়।
এই নিবৃত্তিবাচক সংজ্ঞাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তুরীয়কে সাধারণ জাগতিক বা মানসিক অবস্থার বাইরে স্থাপন করে। এটি কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নয়, মন দ্বারা অনুমেয় নয়, বুদ্ধির দ্বারা বিচার্য নয় এবং ভাষার মাধ্যমে বর্ণনাযোগ্য নয়। তুরীয় হলো এমন এক অবস্থা, যা আমাদের চেতনার তিনটি পরিচিত অবস্থা—জাগ্রত (জাগরণ), স্বপ্ন (স্বপ্নাবস্থা) এবং সুষুপ্তি (গভীর নিদ্রা)—থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই তিনটিরও অতীত। এটি হলো চরম চেতনা, যা কোনো দ্বৈততা বা বিভেদ থেকে মুক্ত। এই অবস্থাটি কোনো সাকার রূপ বা বিশেষ গুণের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমস্ত সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এক অসীম, অবিনশ্বর এবং অপরিবর্তনীয় সত্য।
তুরীয়ের এই বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে আধ্যাত্মিক সাধনার এক উচ্চ লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে সমস্ত প্রকার জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং আত্মগত ধারণা বিলীন হয়ে যায় এবং কেবল বিশুদ্ধ চেতনার অভিজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে।
সুষুপ্তি এবং তুরীয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো 'বীজনিদ্রা বর্জন'। এই পার্থক্যটি ঔপনিষদ দর্শনে আত্মার বিভিন্ন অবস্থা বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুষুপ্তি আত্মার তৃতীয় পাদ হিসাবে বিবেচিত, যাকে 'প্রাজ্ঞ' নামে অভিহিত করা হয়। এটি ওঁ-কারের তৃতীয় মাত্রা 'ম'-এর সঙ্গে তুলনীয়, যা গভীর ঘুমের অবস্থাকে নির্দেশ করে।
সুষুপ্তির বৈশিষ্ট্য:
একীভূত অভিজ্ঞতা: সুষুপ্তি অবস্থায় সমস্ত জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান একীভূত হয়ে যায়। ব্যক্তি তখন কোনো পৃথক বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করে না, বরং সমস্ত অভিজ্ঞতা একটি অখণ্ড রূপে বিলীন হয়ে থাকে।
আনন্দভোগ: এই অবস্থায় জীব বিশুদ্ধ আনন্দ (Ānandamayaḥ) ভোগ করে। এটি ইন্দ্রিয়জ সুখের ঊর্ধ্বে এক স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিরালম্ব আনন্দ। যদিও এটি একটি আনন্দময় অবস্থা, তবুও এই আনন্দ অভিজ্ঞতার মূল কারণ সম্পর্কে অজ্ঞানতা বিদ্যমান থাকে।
কারণ শরীর (Kāraṇa Śarīra): সুষুপ্তি অবস্থাকে আত্মার কারণ শরীর বলা হয়। কারণ শরীর হলো সকল কর্মফল এবং ভবিষ্যৎ জাগতিক অভিজ্ঞতার বীজাবস্থা। এটি এমন একটি সূক্ষ্ম অবস্থা, যেখানে সুপ্ত সংস্কার (latent impressions) এবং কর্মের ফল নিহিত থাকে, যা থেকে পরবর্তীতে জাগতিক স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই কারণে একে 'বীজাবস্থা' বলা হয়। এই অবস্থায় জীব তার প্রকৃত আত্মস্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, যা 'বীজনিদ্রা' নামে পরিচিত। এই অজ্ঞতা সকল দুঃখ ও বন্ধনের মূল কারণ।
তুরীয়ের বৈশিষ্ট্য:
তুরীয় হলো আত্মার চতুর্থ অবস্থা, যা সুষুপ্তি, স্বপ্ন এবং জাগ্রত—এই তিন অবস্থার অতীত। এটি পরম চেতনার অবস্থা।
বীজনিদ্রা বর্জন: তুরীয় অবস্থায় 'বীজনিদ্রা' অর্থাৎ কারণ শরীরের মধ্যে নিহিত অজ্ঞতা সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়। এটি অজ্ঞানতা থেকে পূর্ণ মুক্তি এবং আত্মস্বরূপের উপলব্ধি। তুরীয় অবস্থায় কোনো প্রকার দ্বৈততা থাকে না; দ্রষ্টা, দৃশ্য এবং দর্শন একাকার হয়ে যায়।
নির্বিকল্প সমাধি: তুরীয় অবস্থা প্রায়শই নির্বিকল্প সমাধির সাথে তুলনা করা হয়, যা যোগ দর্শন ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি গভীরতম পর্যায়। এই অবস্থায় মন সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়, অর্থাৎ, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সকল প্রকার চিন্তা, অনুভূতি এবং অহংকারের বিলুপ্তি ঘটে। সাধক তখন কেবল তার আত্মসত্তা বা বিশুদ্ধ চেতনা রূপে অবশিষ্ট থাকেন।
এই স্তরে পৌঁছানোর জন্য গভীর ধ্যান এবং একাগ্রতার প্রয়োজন হয়। নির্বিকল্প সমাধিতে কোনো প্রকার বিকল্প বা দ্বৈততা থাকে না; দ্রষ্টা, দর্শন ও দৃশ্য একীভূত হয়ে যায়। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে সমস্ত জাগতিক বন্ধন ছিন্ন হয় এবং ব্যক্তি পরম শান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করে। এই অবস্থাকে প্রায়শই 'আমিই ব্রহ্ম' বা 'সোহম' অনুভূতির চরম প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ব্যক্তি তার ক্ষুদ্র আত্মাকে মহাবিশ্বের পরমাত্মার সাথে অভিন্ন বলে উপলব্ধি করে। এটি মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বন্ধনমুক্তি: এই অবস্থায় জীব জাগতিক সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং পরম শান্তি ও আনন্দের উপলব্ধি করে, যা সুষুপ্তির আনন্দ থেকেও উচ্চতর। এটি কোনো অভিজ্ঞতার অবস্থা নয়, বরং স্বয়ং অভিজ্ঞতা-সত্তা।
সুতরাং, সুষুপ্তি অবস্থায় জীব আনন্দ ভোগ করলেও অজ্ঞতার বীজ (বীজনিদ্রা) বিদ্যমান থাকে, যা ভবিষ্যতের পুনর্জন্ম ও কর্মফলের কারণ। পক্ষান্তরে, তুরীয় অবস্থায় এই বীজনিদ্রা সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়, ফলে জীব অজ্ঞানতা ও বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্ত হয়ে তার প্রকৃত ও পরম আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই সুষুপ্তি থেকে তুরীয়ের মূল পার্থক্য।
গৌড়পাদ কারিকা, শ্লোক ১৩-তে সুষুপ্তি (প্রাজ্ঞ) এবং তুরীয়ের মধ্যেকার সূক্ষ্ম কিন্তু মৌলিক পার্থক্যটি স্পষ্ট করেছেন:
উভয় অবস্থাতেই দ্বৈততার জ্ঞান অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু প্রাজ্ঞের সঙ্গে বীজনিদ্রা (Bīja Nidrā) বা কারণের উপাধি যুক্ত থাকে। এই বীজটিই হলো অবিদ্যা (Ignorance) যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই বীজনিদ্রা বিদ্যমান থাকার ফলেই প্রাজ্ঞাবস্থা থেকে জীবকে পুনরায় জাগ্রৎ বা স্বপ্নাবস্থায় ফিরে আসতে হয় এবং বহুত্বের জগৎ পুনরায় প্রকট হয়।