অবিদ্যা-বিদ্যা: ২৩



জ্ঞানের প্রকৃতি: জাগ্রৎ অবস্থায় জ্ঞানের প্রকৃতি হলো বহিঃপ্রজ্ঞ (Bahiṣprajñaḥ)। এর অর্থ হলো, আত্মা বাহ্যিক বিষয়ে সচেতন থাকে। আমাদের সমস্ত জ্ঞান বাহ্যিক বস্তু এবং ঘটনা থেকে অর্জিত হয়। সূর্যোদয়, পাখির গান, খাদ্যের স্বাদ—এই সবই বহিঃপ্রজ্ঞ জ্ঞানের অংশ।

ভোগের প্রকৃতি: এই অবস্থায় আত্মা স্থূলভুক (Sthūlabhuk)—অর্থাৎ, স্থূল বস্তু ভোগ করে। স্থূল বস্তু বলতে সেই সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থকে বোঝায়, যা আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, জিভ দিয়ে আস্বাদন করি, নাক দিয়ে শুঁকি এবং ত্বক দিয়ে স্পর্শ করি। খাদ্যগ্রহণ, শব্দশ্রবণ, দৃশ্যদর্শন—এগুলি সবই স্থূল ভোগের উদাহরণ।

শারীরিক উপাধি: জাগ্রৎ অবস্থায় আত্মা স্থূল শরীর (Sthūla Śarīra) দ্বারা উপাধিত হয়। স্থূল শরীর হলো পঞ্চ মহাভূত (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) দ্বারা গঠিত এই দৃশ্যমান দেহ, যা জন্ম, বৃদ্ধি, পরিবর্তন, ক্ষয় এবং বিনাশের অধীন। এই স্থূল দেহের মাধ্যমেই আত্মা জাগতিক অভিজ্ঞতা লাভ করে।

বাস্তবতার স্তর: অদ্বৈত বেদান্তে জাগ্রতের এই বাস্তবতা ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika Satya) নামে পরিচিত। ব্যাবহারিক সত্য হলো সেই বাস্তবতা, যা আমাদের জাগতিক লেনদেনের জন্য সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অজ্ঞানের দ্বারা আবৃত থাকি, ততক্ষণ এই জগৎ সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। এর একটি নির্দিষ্ট শুরু এবং শেষ আছে।

স্বপ্ন-অবস্থা (তৈজস): স্বপ্ন-অবস্থা হলো ঘুমন্ত অবস্থায় অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত মানসিক জগতের অবস্থা, যেখানে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা থাকে না।

ভোগস্থান: স্বপ্নাবস্থার ভোগস্থান হলো স্বপ্ন জগৎ বা মানসিক জগৎ। এই অবস্থায় আত্মা নিজের মনের সৃষ্টিতে বিচরণ করে। স্বপ্নের বস্তুসমূহ বাহ্যিক নয়, বরং মনের অন্তঃকরণে সৃষ্ট হয়।

জ্ঞানের প্রকৃতি: স্বপ্ন-অবস্থায় জ্ঞানের প্রকৃতি হলো অন্তঃপ্রজ্ঞ (Antaḥprajñaḥ)—অর্থাৎ, অভ্যন্তরীণ বা মানসিক বিষয়ে সচেতনতা। এই অবস্থায় জ্ঞান বাহ্যিক ইন্দ্রিয় নির্ভর নয়, বরং মনের বৃত্তি (চিন্তা, কল্পনা, স্মৃতি) থেকে উদ্ভূত হয়। স্বপ্নের দৃশ্য, শব্দ, অনুভূতি সবই আত্মার নিজস্ব মন দ্বারা সৃষ্ট হয়।

ভোগের প্রকৃতি: তৈজস আত্মা প্রবিবিক্তভুক (Praviviktabhuk)—সূক্ষ্ম বাসনা/সংস্কার ভোগ করে। প্রবিবিক্তভুক শব্দের অর্থ হলো "বিচ্ছিন্নভাবে ভোগকারী" বা "একাকী ভোগকারী"। এই অবস্থায় স্থূল বস্তুর ভোগ থাকে না, বরং বিগত দিনের অভিজ্ঞতা, অব্যক্ত বাসনা, অসম্পূর্ণ ইচ্ছা এবং সংস্কারগুলিই স্বপ্নে নানা রূপ ধারণ করে প্রতীয়মান হয়। এটি জাগতিক ভোগের স্থূলতা থেকে মুক্ত।

শারীরিক উপাধি: স্বপ্ন অবস্থায় আত্মা সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma Śarīra) দ্বারা উপাধিত হয়। সূক্ষ্ম শরীর হলো ১৭টি উপাদানের সমষ্টি—পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান) এবং মন ও বুদ্ধি। এই সূক্ষ্ম শরীরই লিঙ্গ শরীর নামেও পরিচিত, যা এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে আত্মার সঙ্গে পরিভ্রমণ করে এবং কর্মফল বহন করে।

বাস্তবতার স্তর: স্বপ্নের এই বাস্তবতা প্রাতিভাসিক সত্য (Prātibhāsika Satya) নামে পরিচিত। প্রাতিভাসিক সত্য হলো সেই বাস্তবতা, যা কেবল তার নিজস্ব অস্তিত্বের মুহূর্তের জন্য সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন স্বপ্ন মিথ্যা হয়ে যায়। এটি ব্যাবহারিক সত্যের চেয়েও নিম্নস্তরের বাস্তবতা, কারণ এর স্থায়িত্ব আরও কম এবং এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত ও আত্মগত।

জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার তুলনামূলক তাৎপর্য: অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিকোণ থেকে, জাগ্রৎ এবং স্বপ্ন উভয় অবস্থাই অবিদ্যা বা অজ্ঞান দ্বারা সৃষ্ট। যদিও জাগ্রৎ অবস্থা প্রাতিভাসিক সত্যের চেয়ে অধিকতর স্থিতিশীল (ব্যাবহারিক সত্য), তবুও এটি পরমার্থিক সত্য নয়। জাগ্রৎ অবস্থায় আমরা স্থূল দেহের সঙ্গে নিজেকে একীভূত মনে করি এবং বাহ্যিক জগতকে পরম সত্য বলে ধরে নিই। স্বপ্ন অবস্থায় আমরা সূক্ষ্ম দেহের সঙ্গে একীভূত হয়ে মানসিক জগৎকে সত্য বলে উপলব্ধি করি।

এই দুই অবস্থার বিশ্লেষণ আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয় যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং মানসিক অভিজ্ঞতাগুলি আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। আত্মা এসব উপাধি থেকে ভিন্ন এবং বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। যখন আমরা জাগ্রৎ বা স্বপ্নের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তুরীয় অবস্থায় উন্নীত হই, তখনই আমরা আত্মস্বরূপের পরম সত্য উপলব্ধি করতে পারি, যেখানে কোনো ভোগ, জ্ঞাতা, জ্ঞেয় বা জ্ঞানের দ্বৈততা থাকে না। এই কারণেই এই দুই অবস্থা আত্মজ্ঞানের পথে প্রাথমিক সোপান হিসাবে বিবেচিত হয়, যা চরম সত্যের দিকে ধাবিত করে।

জাগ্রৎ ও স্বপ্নের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলির বিশ্লেষণ: জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার মধ্যেকার পার্থক্য সূক্ষ্ম হলেও, অদ্বৈত বেদান্তে এদের বাস্তবতার স্তরের উপর ভিত্তি করে এই ভেদাভেদ করা হয়।

উপাধি এবং ভোগের পার্থক্য: মূল পার্থক্যটি উপাধি এবং ভোগের প্রকৃতিতে নিহিত। জাগ্রৎ অবস্থায় বৈশ্বানরের উপাধি হলো স্থূল শরীর, যা পঞ্চ স্থূল উপাদানের (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী) সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া করে। অন্যদিকে, স্বপ্নে তৈজসের উপাধি হলো সূক্ষ্ম শরীর (যা পঞ্চীকৃত নয়), এবং এটি কেবল অভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা বা বাসনার উপর নির্ভর করে।

জাগ্রতে দেখা বস্তুগুলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং স্থান-কাল-কার্যকারিতার (space-time-causality) কাঠামোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে সুসংগঠিত। কিন্তু স্বপ্নে-দেখা বস্তুগুলি সম্পূর্ণ মনোজাত, যেখানে দেশ, কাল বা বস্তুর সঙ্গে কোনো কার্য-কারণের সম্পর্ক থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, স্বপ্নে একজন ব্যক্তি তাঁর দেহের অভ্যন্তরে পর্বত দেখতে পারেন বা স্বল্প সময়ের মধ্যে হাজার মাইল ভ্রমণ করতে পারেন, যা জাগ্রৎ জগতের নিয়মের সম্পূর্ণ বিরোধী।

সত্তার স্তরের পার্থক্য (Satya Traya): অদ্বৈত বেদান্ত এই পার্থক্যকে 'বাস্তবতার তিন স্তর' (Three Levels of Reality) নামক তত্ত্বের মাধ্যমে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করে।

ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika Satya): জাগ্রৎ অবস্থাটি এই স্তরের অন্তর্গত। এই জগৎটি আপেক্ষিক বাস্তবতার ক্ষেত্র, যা কার্য-কারণ (cause-effect) সূত্রের অধীন। যারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেননি, তাদের কাছে এই জগৎ চূড়ান্ত সত্য বলে মনে হয়। এই বাস্তবতা কেবল ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারাই খণ্ডিত হতে পারে।

প্রতিতিভাসিক সত্য (Prātibhāsika Satya): স্বপ্ন অবস্থাটি এই স্তরের অন্তর্গত। এটি মায়িক বা বিভ্রমাত্মক বাস্তবতা। স্বপ্নের বাস্তবতা শুধু সেই ব্যক্তির মনোজগতে সীমাবদ্ধ এবং জাগ্রৎ জ্ঞান দ্বারা খণ্ডিত হয়। যেমন, জাগ্রত অবস্থায় ফিরে এলে স্বপ্নকে মিথ্যা বলে মনে হয়। এই স্তরের বাস্তবতা তার অস্তিত্বের জন্য ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে, কারণ স্বপ্নের বিষয়বস্তু (যেমন 'ফুল') জাগ্রৎ জগৎ থেকেই গৃহীত হয়।

এই শ্রেণিকরণের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় যে, জাগ্রৎ ও স্বপ্নের মধ্যেকার মূল পার্থক্যটি বস্তুর বা ঘটনার প্রকৃতির মধ্যে নয়, বরং অভিজ্ঞতার বাধন (Sublation) বা খণ্ডন-এর সময়কালের মধ্যে। প্রাতিভাসিক সত্যকে ব্যাবহারিক সত্য দ্বারা খণ্ডন করা যায়, তাই জাগ্রৎ আপেক্ষিকভাবে স্বপ্নের চেয়ে বেশি বাস্তব। কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাবহারিক সত্যও পারমার্থিক জ্ঞান ছাড়া চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না, যা পরবর্তী অংশে গৌড়পাদের যুক্তিতে স্পষ্ট হবে।

গৌড়পাদ কারিকার ভিত্তিতে জাগ্রৎ ও স্বপ্নের পরমার্থে মিথ্যাত্ব: জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার মধ্যকার আপেক্ষিক পার্থক্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, অদ্বৈত সিদ্ধান্তমতে উভয়কেই চরম বা পরমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ্যা (mithyā বা anirvacanīya) বলা হয়। এই সিদ্ধান্ত গৌড়পাদ তাঁর কারিকার দ্বিতীয় প্রকরণ, বৈতথ্য প্রকরণে সুদৃঢ় যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

স্বপ্নের মিথ্যাত্বের প্রতিষ্ঠা: গৌড়পাদ প্রথমে স্বপ্নের মিথ্যাত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। স্বপ্নে দৃশ্যমান বস্তুর তুলনায় স্বপ্নদ্রষ্টার দেহের ক্ষুদ্রতা এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশাল দেশ ও কাল অতিক্রমের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, স্বপ্নের বাস্তবতা মনোজাত এবং বাহ্যিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন, স্বপ্নে দেখা সকল বস্তুই মিথ্যা (vaitathyaṁ sarvabhāvānāṁ svapna āhur manīṣiṇaḥ)।

জাগ্রৎ জগৎকে স্বপ্নসম প্রমাণের যুক্তি (Jāgrat-Svapna Sāmyam): গৌড়পাদের মূল বক্তব্য হলো, জাগ্রৎ অবস্থা এবং স্বপ্নাবস্থার বস্তুসমূহ তাদের অভিজ্ঞতার স্তরে ভিন্ন হলেও, উভয়েরই পরমার্থিক সত্যের অভাব রয়েছে।

বাধাপ্রাপ্তির যুক্তি (Contradiction/Bādha): যেমনিভাবে স্বপ্নাবস্থার অভিজ্ঞতা জাগ্রৎ জ্ঞান দ্বারা খণ্ডিত হয়, তেমনি জাগ্রৎ অবস্থার অভিজ্ঞতাও সুষুপ্তি ও তুরীয় চেতনার স্তরে বিলীন হয়ে যায়। একটি অভিজ্ঞতা যখন অন্য কোনো অভিজ্ঞতা দ্বারা বাধিত হয় বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তখন তা চরম সত্য হতে পারে না। চূড়ান্ত জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, জাগ্রৎ ও স্বপ্নের অভিজ্ঞতা বাস্তবতার মাত্রায় সম্পূর্ণ অভিন্ন বলে বিবেচিত হয়। শ্রী রমণ মহর্ষি বলেন, জাগ্রৎ দীর্ঘ ও স্বপ্ন সংক্ষিপ্ত; এর বেশি অন্য কোনো পার্থক্য নেই।

আদি ও অন্তের যুক্তি (Ādi-Anta-Yukta): গৌড়পাদ একটি মৌলিক দার্শনিক মাপকাঠি উপস্থাপন করেন: "যদি কোনো বস্তু আদি বা শুরুতে এবং অন্তে অনস্তিত্বশীল হয়, তবে তা বর্তমানেও অনস্তিত্বশীল"। জাগ্রৎ জগৎ তার উৎপত্তি (সৃষ্টি) এবং বিনাশ (লয়) দ্বারা সীমিত। যেহেতু এটি চিরন্তন নয়, তাই এটি অবাধিত বা পরমার্থ সৎ হতে পারে না। তাই চূড়ান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে জাগ্রৎ ও স্বপ্ন উভয়ই মিথ্যা বা মায়া।

বিবর্ত ও অনির্বচনীয়তা—অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে ব্রহ্ম ও জগতের স্বরূপ: অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের এক মৌলিক ধারণা হলো ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্তা এবং জগতের ব্যাবহারিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য। এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য হলো ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য (পারমার্থিক সৎ), আর জগৎ হলো ব্রহ্মের বিবর্ত বা আপাত-প্রকাশ (apparent manifestation)।

ব্রহ্মের স্বরূপ—পারমার্থিক সৎ: অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে, ব্রহ্মই একমাত্র পারমার্থিক সৎ অর্থাৎ পরম সত্য। ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব এবং সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। ব্রহ্ম অসীম, অদ্বিতীয়, নিরবয়ব এবং নির্গুণ। এই ব্রহ্ম দেশ, কাল ও নিমিত্তের অতীত। তিনিই জগতের মূল কারণ, কিন্তু তিনি নিজে কোনো কার্য নন। ব্রহ্ম কোনো প্রকার পরিবর্তন বা বিকারের অধীন নন। তিনিই একমাত্র বস্তুতন্ত্র সত্তা, যার সত্তা অন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়।

জগতের স্বরূপ—ব্যাবহারিক সৎ ও বিবর্ত: জগৎকে অদ্বৈত বেদান্ত ব্যাবহারিক সৎ হিসেবে গণ্য করে। এর অর্থ হলো, জাগতিক বস্তুর অস্তিত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত পারমার্থিক জ্ঞান উদয় না হয়। ব্যাবহারিক স্তরে জগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয়, আমরা এর মধ্যে কাজ করি, সুখ-দুঃখ ভোগ করি। কিন্তু এই জগৎ ব্রহ্মের মতো স্বয়ংসিদ্ধ নয়; এর সত্তা ব্রহ্মের সত্তা থেকে ভিন্ন ও অসম।

অদ্বৈত বেদান্ত জগৎকে ব্রহ্মের 'পরিণাম' (transformation) না বলে 'বিবর্ত' (apparent manifestation or illusion) বলে। পরিণাম বলতে বোঝায়, যখন একটি কারণ তার নিজের স্বরূপ পরিবর্তন করে কার্যে পরিণত হয়, যেমন দুধ দইয়ে পরিণত হয়। কিন্তু ব্রহ্ম নিজে কোনো পরিবর্তনশীল সত্তা নন। জগৎকে ব্রহ্মের পরিণাম বললে ব্রহ্মের নির্বিকারত্ব নষ্ট হয়, যা অদ্বৈতবাদের মূল ভিত্তি।

অন্যদিকে, বিবর্ত মানে হলো, যখন একটি বস্তু অপরিবর্তিত থেকেই অন্যরূপে প্রতিভাত হয়, যেমন দড়িকে সাপ বলে ভ্রম হয়। এখানে দড়ির কোনো প্রকৃত পরিবর্তন হয় না, কেবল একটি ভ্রমের কারণে তাকে সাপ বলে মনে হয়। ঠিক তেমনই, ব্রহ্ম অপরিণামী ও নির্বিকার থাকা সত্ত্বেও মায়ার প্রভাবে জগৎরূপে প্রতিভাত হন। জগৎ ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি মিথ্যা প্রতীতি মাত্র।

জগতের অনির্বচনীয়তা ও সদসদ্বিলক্ষণতা: অদ্বৈত বেদান্তে জগৎকে 'সদসদ্বিলক্ষণ' (না সৎ, না অসৎ, না দুইয়ের কোনোটিই) এবং 'অনির্বচনীয়' (indescribable) বলা হয়।