অবিদ্যা-বিদ্যা: ২২



বৈতথ্য প্রকরণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: এই প্রকরণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে জগতের মিথ্যাত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এখানে এই বক্তব্যটি স্থাপন করা হয়েছে যে, আমরা জাগ্রত অবস্থায় যে দ্বৈত জগৎকে সত্য বলে মনে করি, তা চরম সত্য ব্রহ্মের তুলনায় অবাস্তব বা মিথ্যা (ইল্যুশন)। স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থার সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বৈতথ্য প্রকরণ স্বপ্নাবস্থা এবং জাগ্রত অবস্থার মধ্যে সাদৃশ্য দেখায়। যুক্তি দেওয়া হয় যে—স্বপ্নাবস্থায় দেখা বস্তুগুলি যেমন শরীরের অভ্যন্তরে থাকে এবং জেগে উঠলে মিথ্যা প্রমাণিত হয়; ঠিক একইভাবে, জাগ্রত অবস্থায় দেখা দৃশ্যমান জগৎও চূড়ান্ত সত্য ব্রহ্মের দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ্যা। জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাই শুরু এবং শেষে অনিত্য হওয়ায়, মাঝখানেও (বর্তমানে) তাদের বাস্তব অস্তিত্ব নেই।

জগতের এই মিথ্যাত্বকে প্রমাণ করার মাধ্যমে প্রকরণটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল তত্ত্ব—একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, আর জগৎ মিথ্যা—এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। বৈতথ্য প্রকরণ মূলত প্রমাণের ভিত্তিতে এই দৃশ্যমান জগতের মায়াময় প্রকৃতিকে তুলে ধরে এবং পরম সত্যের (ব্রহ্মের) দিকে ইঙ্গিত করে।

চেতনার অবস্থার শ্রেণিকরণ—স্বরূপ ও উপাধি: বেদান্ত মতে, জীবের সমস্ত অভিজ্ঞতা জাগ্রৎ (Jāgrat), স্বপ্ন (Svapna), ও সুষুপ্তি (Suṣupti) এই তিনটি অবস্থার অধীনে আসে। এই অবস্থাগুলি আত্মার উপর তিনটি ভিন্ন উপাধি বা শরীরের (স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ) প্রভাবকে নির্দেশ করে। যখন ব্রহ্মনের প্রতিফলন অবিদ্যার (অজ্ঞান) ক্ষুদ্র হ্রদে পড়ে, তখন জীবাত্মার (Jiva) সৃষ্টি হয়। এই জীবাত্মা তিনটি শরীর দ্বারা উপাধিত: স্থূল শরীর (Sthūla Śarīra), সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma Śarīra), এবং কারণ শরীর (Kāraṇa Śarīra)। এই উপাধিগুলির মাধ্যমেই জীব ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করে, যা নিচে জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হলো।

জাগ্রৎ অবস্থা (বৈশ্বানর)—স্থূল জগতের উপাধি: মাণ্ডূক্য উপনিষদের ৩য় শ্লোকে আত্মার প্রথম পাদ হিসেবে জাগ্রৎ অবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার নাম বৈশ্বানর। এই পাদটি ওঁকারের প্রথম মাত্রা 'অ'-এর সঙ্গে তুলনীয়। বৈশ্বানর হলো ব্যষ্টি (individual) জীবের স্থূল দেহাভিমানী রূপ, যা সমষ্টিগতভাবে বিরাট পুরুষের সঙ্গে অভিন্ন বলে কল্পনা করা হয়। জাগ্রৎ অবস্থায় জীব পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) এবং পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (হাত, পা, বাক্, পায়ু, উপস্থ) দ্বারা বাহ্যিক জগতের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। এই অবস্থায় মন বুদ্ধি অহংকার সহকারে বাহ্যিক বস্তুকে অনুভব করে এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। বৈশ্বানরের অভিজ্ঞতা বাস্তব এবং দ্বৈত। এই অবস্থায় নামরূপাত্মক জগৎ সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। এটি জাগতিক অস্তিত্বের প্রথম এবং সবচেয়ে মৌলিক স্তর, যেখানে চেতনার পরিসর বাহ্যিক এবং বস্তুকেন্দ্রিক। এই অবস্থাটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত জাগতিক কার্যকলাপ ও উপলব্ধির ভিত্তি স্থাপন করে।

বহিঃপ্রজ্ঞা ও স্থূল ভোগ (Bahiṣprajñaḥ Sthūlabhuk): জাগ্রৎ অবস্থা অদ্বৈত বেদান্তের মতে অভিজ্ঞতার প্রথম এবং সবচেয়ে প্রত্যক্ষ স্তর। এই অবস্থায় আত্মা বা জীব বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকে (Bahiṣprajñaḥ)। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সেই অবস্থা, যখন আমরা আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়—চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, এবং ত্বক—এবং কর্মেন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে বাহ্যিক জগৎকে অনুভব করি এবং তার সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করি। এই স্তরে, জীব স্থূল বিষয় ভোগ করে (Sthūlabhuk)। 'স্থূল ভোগ' বলতে কেবল শারীরিক বা ইন্দ্রিয়গত সুখ-দুঃখ ভোগ করা বোঝায় না, বরং জগৎকে একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা হিসেবে উপলব্ধি করা এবং তার সাথে সংযুক্ত থাকা বোঝায়। আমরা যা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, স্বাদ গ্রহণ করি এবং গন্ধ পাই—তার সবই এই স্থূল ভোগের অংশ।

এই অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা অদ্বৈত বেদান্তে 'ব্যাবহারিক সত্যের' (Vyāvahārika Satya) স্তরে অবস্থান করে। এর অর্থ হলো, এই জগৎ আমাদের ইন্দ্রিয় এবং মনের জন্য বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয় এবং দৈনন্দিন জীবনে এর কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্মজ্ঞান লাভ না হয়—অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত পরম সত্যের উপলব্ধি না ঘটে যে, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং জগৎ মিথ্যা—এবং যতক্ষণ কার্য-কারণ সূত্রটি (causality) কার্যকর থাকে, ততক্ষণ এই জগৎ আপেক্ষিকভাবে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। এটি এমন একটি স্তর, যেখানে আমাদের জাগতিক কার্যকলাপ, নৈতিকতা এবং জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াগুলি অর্থপূর্ণ। ব্যাবহারিক সত্য পরম সত্যের (Pāramārthika Satya) চেয়ে নিম্নতর হলেও, এটি অনস্বীকার্য একটি বাস্তবতা, যা আমাদের কর্মফল এবং অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে।

এই অবস্থাকেই বিশ্বের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে 'বিরাট' এবং ব্যষ্টি প্রাণীর (individual being) ক্ষেত্রে 'বৈশ্বানর' বলা হয়েছে। 'বৈশ্বানর' শব্দটি বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন অগ্নিকেও নির্দেশ করে, যা সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে উপস্থিত এবং যা বাহ্যিক জগতকে আলোকিত করে। এটি সেই সমষ্টিগত চেতনা, যা জাগ্রৎ অবস্থায় সমগ্র বিশ্বকে উপলব্ধি করে। অন্যদিকে, 'বিরাট' হলো স্থূল ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ, যেখানে সমস্ত বস্তুগত বাস্তবতা বিদ্যমান। এই অবস্থায় জীব নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সাথে একীভূত মনে করে এবং বাহ্যিক জগতের সাথে নিজের একটি পৃথক অস্তিত্ব অনুভব করে। এই বৈশ্বানর বা বিরাট অবস্থাই আমাদের পার্থিব অভিজ্ঞতার ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে আমরা সুখ, দুঃখ, লাভ, ক্ষতি, জন্ম এবং মৃত্যুর দ্বৈততার মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত রাখি। এই স্তর থেকেই ধীরে ধীরে উচ্চতর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিকে যাত্রা শুরু হয়, যখন জীব ব্যাবহারিক সত্যের সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে শুরু করে এবং পরম সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়।

সপ্তাঙ্গ ও উনিশ মুখের তাৎপর্য: মাণ্ডূক্য উপনিষদ বৈশ্বানরকে তার অভিজ্ঞতার পূর্ণতা বোঝাতে 'সপ্তাঙ্গ' (seven limbs) এবং 'একোনবিংশতিমুখ' (nineteen mouths/instruments) বিশিষ্ট বলে বর্ণনা করেছে।

সপ্তাঙ্গ: এই সাতটি অঙ্গ বৈশ্বানরকে মহাজাগতিক বিরাট পুরুষের সঙ্গে একীভূত করে, যা ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে। এই অঙ্গগুলি হলো: দ্যুলোক বা স্বর্গ (মাথা), সূর্য (চোখ), বায়ু (প্রাণ/নিঃশ্বাস), আকাশ (শরীর), জল (মূত্রাশয়/পেট), পৃথিবী (পা), এবং আহ্বান করার অগ্নি (মুখ/হৃদয়)। এই বর্ণনাটি ইঙ্গিত করে যে, জাগ্রৎ অবস্থাটি কেবল ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়, বরং নিখিল নরস্বরূপ বা সর্বজীবাত্মার সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা।

উনিশটি মুখ: এগুলি হলো জাগ্রৎ অবস্থায় ভোগ বা অভিজ্ঞতার সেই উনিশটি উপায়, যা স্থূল বস্তুকে জানতে ও ব্যবহার করতে সাহায্য করে। এগুলি হলো: দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়—কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও নাসিকা এবং পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়—হস্ত, পদ, বাক, পায়ু, উপস্থ), পাঁচটি প্রাণ (Prāṇa, Apāna, Vyāna, Udāna, Samāna), এবং অন্তঃকরণ চতুষ্টয় (মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, ও চিত্ত)।

জাগ্রৎ অবস্থায় আত্মা স্থূল শরীরকে উপাধি (সীমাবদ্ধতা বা বাহ্যিক আবরণ) রূপে ধারণ করে। এই স্থূল শরীর, যা আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতাগুলোর মূল ভিত্তি, ছয়টি মৌলিক রূপান্তরের অধীন। ভারতীয় দর্শনে এই ছয়টি রূপান্তরকে 'ষড় ভাব-বিকার' (Ṣaḍ Bhāva-Vikāras) বলা হয় এবং এগুলো সকল সসীম সত্তার ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে নির্দেশ করে।

প্রথমত, অস্তি (বিদ্যমানতা): এটি সত্তার প্রাথমিক অবস্থা, যখন কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রথম উপলব্ধ হয়। এটি কেবলমাত্র অস্তিত্বের সূচনা, কোনো আকার বা গুণাবলি ধারণ করার পূর্বের অবস্থা।

দ্বিতীয়ত, জায়তে (জন্ম): এই ধাপে সত্তা একটি নির্দিষ্ট রূপে জন্মলাভ করে বা প্রকটিত হয়। এটি নতুনত্বের সূচনা, যেখানে একটি অস্তিত্ব পূর্বে অপ্রকাশিত অবস্থা থেকে প্রকাশ্য জগতে আসে।

তৃতীয়ত, বর্ধতে (বৃদ্ধি): জন্মের পর সত্তা তার আকার, ক্ষমতা বা জটিলতায় বৃদ্ধি লাভ করে। এটি বিকাশমান পর্যায়, যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্তা তার পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়।

চতুর্থত, বিপরিণমতে (পরিবর্তন): বৃদ্ধিলাভের পর সত্তা নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই পরিবর্তনগুলো গুণগত বা পরিমাণগত হতে পারে এবং সময়ের সাথে সাথে সত্তার রূপ ও প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য আনে। এটি স্থিতাবস্থা নয়, বরং নিরন্তর অভিযোজন ও রূপান্তরের প্রক্রিয়া।

পঞ্চমত, অপক্ষীয়তে (ক্ষয়): একসময়, বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের পর সত্তার অবনতি বা ক্ষয় শুরু হয়। এটি বার্ধক্য বা ক্ষয়ের পর্যায়, যেখানে সত্তার শক্তি, কার্যকারিতা বা উপাদান হ্রাস পেতে থাকে।

এবং ষষ্ঠত, বিনশ্যতি (মৃত্যু): পরিশেষে, ক্ষয়ের চূড়ান্ত পরিণতি হলো বিনাশ বা মৃত্যু। এটি সত্তার বিলুপ্তি, যেখানে তার বর্তমান জাগতিক রূপের অবসান ঘটে এবং এটি অস্তিত্বের অন্য কোনো অবস্থায় বিলীন হয়ে যায় অথবা তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়।

এই ছয়টি রূপান্তর স্থূল শরীরের অনিত্যতা এবং ক্ষণভঙ্গুরতার প্রতীক। জাগ্রৎ অবস্থায় আত্মা এই শরীরকে ধারণ করলেও, এটি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ নয়, বরং একটি অস্থায়ী আধার। এই দার্শনিক ধারণাটি মানব অস্তিত্বের বাস্তবতা এবং চক্রাকার প্রকৃতির উপর গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যেখানে জন্ম, বৃদ্ধি, পরিবর্তন, ক্ষয় এবং মৃত্যু একটি অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে।

স্বপ্ন অবস্থা (তৈজস)—সূক্ষ্ম দেহের উপাধি: আত্মার দ্বিতীয় পাদ হলো স্বপ্নাবস্থা, যা তৈজস নামে পরিচিত এবং ওঁকারের দ্বিতীয় মাত্রা 'উ'-এর সঙ্গে তুলনীয়। তৈজস শব্দের অর্থ 'আলোকসদৃশ', যা বোঝায় যে, এই অবস্থায় মন নিজস্ব বাসনা ও সংস্কারের আলোয় অভ্যন্তরীণ জগতকে প্রকাশ করে। এই অবস্থার উপাধি হলো সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma Śarīra) বা লিঙ্গ-শরীর, যা মন, বুদ্ধি, প্রাণ এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়-কর্মেন্দ্রিয় সহ বিভিন্ন সূক্ষ্ম উপাদান নিয়ে গঠিত।

অন্তঃপ্রজ্ঞা ও সূক্ষ্ম ভোগ (Antaḥprajñaḥ Praviviktabhuk): তৈজস অবস্থায় জীব অন্তঃস্থ মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে জানে (Antaḥprajñaḥ)। তৈজস স্থূল বস্তুর পরিবর্তে প্রবিবিক্তভুক (Praviviktabhuk)—অর্থাৎ সূক্ষ্ম বিষয় বা কেবল বাসনা ভোগ করে। স্বপ্ন হলো জাগ্রত অবস্থায় সঞ্চিত বাসনা ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ মনের কার্যকলাপ মাত্র, যেখানে বাহ্যিক জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও এই বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।

সপ্তাঙ্গ ও উনিশ মুখের পুনরাবৃত্তি: এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, তৈজসকেও বৈশ্বানরের মতোই সাতটি অঙ্গ এবং উনিশটি মুখ বিশিষ্ট বলা হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, জাগ্রৎ ও স্বপ্নাবস্থা উভয়ই স্থূল বা সূক্ষ্ম উপাধিযুক্ত হলেও, উভয়ের মূলে একই আত্মতত্ত্বের প্রতিফলন বিদ্যমান। তৈজস এই উনিশটি মুখের মাধ্যমে ভোগ করে, তবে তা স্থূল বস্তুর নয়, কেবল মনের দ্বারা সৃষ্ট সূক্ষ্ম বাসনার ভোগ। এটি দেখায় যে সূক্ষ্ম শরীর, যা জাগ্রতে স্থূল শরীরের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে, স্বপ্নে স্বাধীনভাবে মনের অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়।

আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি অদ্বৈত বেদান্তের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়, এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদে আত্মার চারটি পাদ বা অবস্থা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই পাদগুলির মধ্যে প্রথম দুটি, অর্থাৎ জাগ্রৎ (বৈশ্বানর) এবং স্বপ্ন (তৈজস) অবস্থা, মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ হলেও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এই দুই অবস্থার বিশ্লেষণ করলে ভোগস্থান, জ্ঞানের প্রকৃতি, ভোগের প্রকৃতি, শারীরিক উপাধি এবং বাস্তবতার স্তরের দিক থেকে স্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, যা আত্মস্বরূপের ক্রমান্বয়িক উপলব্ধির পথ খুলে দেয়।

জাগ্রৎ অবস্থা (বৈশ্বানর) হলো আমাদের দৈনন্দিন বাহ্যিক জগত সম্পর্কে সচেতনতার অবস্থা, যেখানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাহ্যিক বস্তুসমূহকে প্রত্যক্ষ করা হয়।

ভোগস্থান: জাগ্রৎ অবস্থার ভোগস্থান হলো জাগতিক বা বাহ্যিক জগৎ। এই অবস্থায় আমরা পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক) এবং পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ) দ্বারা বাহ্যিক জগতের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করি।