অহংকার হলো ভুল “আমি”-বোধ—আত্মার পরিবর্তে দেহকে “আমি” ভাবা; মমতা হলো ভুল “আমার”-বোধ—অস্থায়ী জগতকে নিজের সম্পত্তি ভাবা। এই দুই-ই অবিদ্যার দোলাচলে আত্মাকে ঘোরায়; আর যখন জ্ঞান উদিত হয়, তখন বোঝা যায়—আত্মা কর্তা নয়, ভোক্তা নয়; কিছুই “আমার” নয়, সবই সেই এক ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলন। তখন অহংকার ও মমতা নিজের থেকেই লুপ্ত হয়ে যায়, যেমন সূর্য উঠলে কুয়াশা মিলিয়ে যায়।
অবিদ্যার কারণে চেতনা ও বস্তুর সীমারেখা মুছে যায়, এবং আমরা যা নই, তা-ই বলে মনে করি। জ্ঞানই সেই আলোক, যা এই আরোপণ ভেঙে সত্যকে পৃথক করে দেয়—যেখানে দ্রষ্টা কেবল চিরন্তন সাক্ষী, আর দৃশ্য কেবল তার প্রতিফলিত ছায়া।
দৃষ্টিসংযোগ তাই কেবল দেখা নয়, এটি চেতনার অভ্যন্তরীণ বিন্যাস—এক দিক থেকে জ্ঞানের জন্মস্থল, অন্য দিক থেকে বন্ধনের মূল। যতক্ষণ দ্রষ্টা ও দৃশ্যকে আমরা এক বলে দেখি, ততক্ষণ অবিদ্যা থাকে; কিন্তু যখন জানা যায় যে, দ্রষ্টা (আত্মা) ও দৃশ্য (জগৎ) আসলে পৃথক, তখনই সংযোগ ভেঙে যায়—এবং সেই অবস্থাই মুক্তি, দ্রষ্টার স্বরূপে প্রতিষ্ঠা। এটি চেতনার সেই সূক্ষ্ম মুহূর্ত, যেখানে অনন্ত আত্মা নিজেই নিজের প্রতিবিম্ব তথা জগৎ দেখে। আর আত্মজ্ঞান মানে সেই সংযোগের ছেদ, যেখানে দেখা, দ্রষ্টা ও দৃশ্য—এই তিনের ভেদ বিলীন হয়ে যায় এক চৈতন্যময় ঐক্যে।
কৃকর উপপ্রাণ মুখ ও গলাস্থলে সক্রিয়। এটি ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও হাঁচির সঙ্গে যুক্ত। যখন দেহে অশান্তি বা অপ্রয়োজনীয় পদার্থ প্রবেশ করে, কৃকর তা নির্গমন ঘটায়—যেমন হাঁচি, কাশি বা বমি। এটি শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অংশ।
দেবদত্ত উপপ্রাণ হলো ক্লান্তির সময় দেহকে বিশ্রাম দিতে সাহায্যকারী শক্তি। এটি হাই তোলা, ঘুমের সূচনা ও শরীরের শিথিলতা নিয়ন্ত্রণ করে। যখন মন ও ইন্দ্রিয় ক্লান্ত হয়, দেবদত্ত উপপ্রাণ দেহকে নিদ্রামুখী করে দেয়।
ধানঞ্জয় উপপ্রাণ সবচেয়ে স্থায়ী; এটি মৃত্যুর পরেও কিছু সময় দেহে অবস্থান করে। এর কাজ দেহের আকার ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্থিত রাখার, দেহের গন্ধ ও পচনের গতি নিয়ন্ত্রণের। ধানঞ্জয় মৃত্যুর পরেও দেহে থাকে, তাই শরীর তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয় না।
আয়ুর্বেদের সূত্রগ্রন্থ চরক সংহিতা এবং অষ্টাঙ্গ হৃদয়ম্–এ পাওয়া যায়—“ধানঞ্জয় মৃত্যুত্তরং দেহে তিষ্ঠতি”। এখানে “ধানঞ্জয়” শব্দটি “বায়ু”র এক বিশেষ উপপ্রকারকে নির্দেশ করে। আয়ুর্বেদে বায়ু বা “প্রাণবায়ু” পাঁচ ভাগে বিভক্ত—প্রাণ, অপান, উদান, ব্যান, সমান। এর সঙ্গে আরও একটি বিশেষ বায়ুর নাম বলা হয়েছে ধানঞ্জয় বায়ু, যা মৃত্যুর পরও কিছু সময় পর্যন্ত দেহে স্থির থাকে।
চরক সংহিতা, সূত্রস্থান (অধ্যায় ১২, শ্লোক ৮–৯)-এ বলা হয়েছে—“প্রাণ, অপান, উদান, ব্যান, সমান—এই পাঁচটি প্রধান বায়ুর বিভাগ। এদের অতিরিক্ত আরেকটি বিশেষ বায়ু আছে, যার নাম ধানঞ্জয়; সে মৃত্যুর পরেও দেহে অবস্থান করে।” অর্থাৎ, ধানঞ্জয় বায়ু মৃত্যুত্তর অবস্থায়ও শরীরে থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই বায়ু দেহে বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ দেহ সম্পূর্ণরূপে বিলয়প্রাপ্ত হয় না।
অষ্টাঙ্গ হৃদয় সূত্রস্থানেও (অধ্যায় ১২, শ্লোক ৯-১০) একই কথা বলা হয়েছে—“ধানঞ্জয় বায়ু হৃদয় ও শঙ্খদেশে অবস্থান করে; এটি মৃত্যুর পরও দেহে স্থিত থাকে এবং কিছু সময় পর্যন্ত দেহকে ধারণ করে রাখে।” এখানে “শঙ্খদেশ” বলতে কর্ণ ও কণ্ঠের সংযোগস্থান বোঝানো হয়েছে।
আয়ুর্বেদের ব্যাখ্যানুযায়ী, ধানঞ্জয় বায়ু দেহের হৃদয় ও বক্ষদেশে কাজ করে, এবং মৃত্যুর পরও এই বায়ুর কার্যকলাপ সম্পূর্ণ থেমে যায় না। মৃত্যুর পর দেহে কিছু সময় ধরে যে স্পন্দন, প্রসারণ বা পচন প্রক্রিয়া দেখা যায়, তা এই ধানঞ্জয় বায়ুর কারণেই। চরক বলেন, যখন এই বায়ু শরীর ত্যাগ করে, তখনই দেহের সম্পূর্ণ বিলয় ঘটে।
বেদান্তীয় ব্যাখ্যায়ও এই ধারণাটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাণশক্তির শেষ অবশিষ্টাংশ দেহে বিরাজমান, ততক্ষণ আত্মা ও দেহের সংযোগ সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয় না। যখন সেই প্রাণবায়ু বা জীবশক্তির চূড়ান্ত ক্ষয় ঘটে, তখনই চেতনা দেহত্যাগ করে এবং দেহ পরিপূর্ণভাবে নিষ্প্রাণ হয়।
ধানঞ্জয় বায়ু মৃত্যুর পরও দেহে কিছু সময় স্থির থাকে; এই বায়ু দেহকে অল্প সময়ের জন্য প্রাণময় রাখে এবং দেহের স্বাভাবিক বিলয়প্রক্রিয়া এর নিয়ন্ত্রণে চলে। আয়ুর্বেদ মতে, এই বায়ুর অপসারণই মৃত্যুর চূড়ান্ত পর্ব।
দার্শনিকভাবে এই পাঁচ উপপ্রাণ দেখায়—জীবন কেবল শ্বাসপ্রশ্বাস নয়, বরং অসংখ্য সূক্ষ্ম সমন্বিত ক্রিয়া। যেমন মূল প্রাণশক্তি দেহে জীবনস্রোত বইয়ে রাখে, তেমনি এই উপপ্রাণেরা দেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম—চোখের পলক থেকে শুরু করে নিঃশ্বাসের সূক্ষ্ম সমন্বয় পর্যন্ত—সব নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলির ভারসাম্য নষ্ট হলে দেহ ও মন উভয়েরই অসামঞ্জস্য ঘটে।
উপপ্রাণ মানে সেই সূক্ষ্ম প্রাণপ্রবাহের সহায়ক শাখাগুলি, যেগুলি দেহের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্রিয়াকে সুসমন্বিত করে রাখে। এই উপপ্রাণগুলির সমতা বজায় থাকলেই দেহে স্বাস্থ্য, মনে স্থিরতা, আর চেতনায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
আপান (Apāna) নিচের দিকে প্রবাহিত জীবনশক্তি। এটি নির্গমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত—যেমন বর্জ্য নির্গমন, প্রস্রাব, প্রসব ইত্যাদি। এটি নাভির নীচে, মলদ্বার ও জননেন্দ্রিয় অঞ্চলে কার্যকর। আপানই শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ দূর করে ভারসাম্য রক্ষা করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১.৫.৩) বলা হয়েছে—“আপানেন হি পচতি যৎ খাদতি”—আপানের দ্বারাই খাওয়া জিনিস (খাদ্যদ্রব্য) হজম হয়।
উদান (Udāna) হলো ঊর্ধ্বগামী প্রাণশক্তি, যা কণ্ঠ ও মাথার দিক দিয়ে কাজ করে। এটি বাক্-প্রকাশ, উদ্যম, স্মৃতি, চেতনা ও মৃত্যুকালে আত্মার ঊর্ধ্বগমন নিয়ন্ত্রণ করে। গীতা (৮.১২) বলে—“মূর্ধ্ন্যাধায় আত্মনং প্রানম্”—মৃত্যুর সময় সাধক উদানবায়ুর মাধ্যমে প্রাণকে মস্তিষ্কে স্থাপন করে। তাই উদান বায়ু চেতনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ ও মুক্তির সঙ্গে যুক্ত।
সমান (Samāna) হলো সমবণ্টনকারী শক্তি, যা নাভি অঞ্চলে অবস্থিত। এটি পাচন, বিপাক ও খাদ্যরসের সমবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দেহে উষ্ণতা ও শক্তির সামঞ্জস্য রাখে, অগ্নির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। প্রশ্ন উপনিষদে (৩.৫) বলা হয়েছে—“সমানো’গ্নিমধ্যস্থঃ, পচতি অন্নং”—সমান বায়ু অগ্নির মধ্যে অবস্থান করে খাদ্যকে পরিপাক করে।
ব্যান (Vyāna) সর্বব্যাপী জীবনপ্রবাহ। এটি সমগ্র দেহে চলাচল করে ও প্রাণ, আপান, উদান, সমান—সব বায়ুকে সংযোগ দেয়। এটি রক্তসঞ্চালন, স্নায়ুবিক কার্য ও দেহের সমন্বয় রক্ষা করে। প্রশ্ন উপনিষদে (৩.৬) বলা হয়েছে—“ব্যানো হি এতান্ প্রানান্ অন্যৎ চ প্রেষয়তি”—ব্যানই সমস্ত প্রাণশক্তিকে যুক্ত করে ও সমন্বয় ঘটায়।
অর্থাৎ, প্রাণ উপরের দিকে জীবনীশক্তি জাগায়, আপান নিচের দিকে নিঃসরণ ঘটায়, উদান ঊর্ধ্বমুখী করে, সমান ভারসাম্য রাখে, এবং ব্যান সর্বত্র গতিশক্তি ছড়িয়ে দেয়। এই পঞ্চপ্রাণের মধ্যেই জীবনের সূক্ষ্ম ছন্দ স্পন্দিত—এরা সূক্ষ্ম শরীরের পাঁচ ধারা, যাদের সমন্বয়ে দেহ, মন ও আত্মার সংযোগ স্থিতিশীল থাকে।
এই স্থূল দেহ জাগ্রত অবস্থায় সক্রিয় থাকে। যখন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা বাহ্যজগৎ অনুভব করি, দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, তখন এই দেহই সেই অভিজ্ঞতার বাহন। মাণ্ডূক্য উপনিষদে (২) বলা হয়েছে—“জাগরিত অবস্থায় আত্মা বৈশ্বানর নামে পরিচিত—যিনি বাহির্মুখ চেতনা, একুশটি অঙ্গসহ স্থূল ভোগী।” অর্থাৎ, আত্মা যখন জাগ্রত অবস্থায় থাকে, তখন সে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্থূল জগতের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে, কিন্তু আসলে তা আত্মার নিজের কার্য নয়—এটি দেহ ও ইন্দ্রিয়ের স্তরে ঘটে।
আত্মা এই দেহ নয়। অবিদ্যার ফলে মানুষ ভাবে—“আমি দেহ, আমি দেখি, আমি চলি, আমি কাজ করি।” বাস্তবে আত্মা কেবল সাক্ষী ও আলোকদাতা। যেমন সূর্য পৃথিবীকে আলোকিত করে কিন্তু মাটির সঙ্গে মিশে যায় না, তেমনি আত্মা দেহকে চেতনা দেয়, কিন্তু নিজে দেহের কোনো ক্রিয়ায় অংশ নেয় না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৩.৭) বলা হয়েছে—“চোখ দিয়ে আত্মা দেখে না, বরং চোখকেই দেখার শক্তি দেয়।” অর্থাৎ, আত্মা দেহের কোনো অঙ্গ নয়, বরং দেহ ও ইন্দ্রিয়ের পেছনের সচেতন নীতি। গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (১৩.৩) শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাম বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত”—প্রত্যেক দেহে যে-চেতনা বিরাজমান, সেটিই আত্মা, এবং সে প্রত্যেক দেহে এক ও অভিন্ন, দেহভেদে ভিন্ন নয়।
‘ক্ষেত্রজ্ঞ’ শব্দটি সংস্কৃত মূল “ক্ষেত্র” এবং “জ্ঞ” থেকে গঠিত। ক্ষেত্র মানে শরীর, মন, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিসহ সমস্ত পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চ—যা চেতনার অবলম্বন, যা দেখা যায়, জানা যায়, অনুভূত হয়। জ্ঞ মানে জানা বা জ্ঞাতা। সুতরাং ক্ষেত্রজ্ঞ মানে সেই চেতনা, যিনি এই দেহ–মন–বুদ্ধির ক্ষেত্রকে জানেন, প্রত্যক্ষ করেন, কিন্তু নিজে পরিবর্তিত হন না।
ভগবদ্গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন— “ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাং বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত” (গীতা, ১৩.৩)—অর্থাৎ, হে ভারত, সকল ক্ষেত্রেই আমিই ক্ষেত্রজ্ঞ। এখানে ক্ষেত্র বলতে প্রত্যেক জীবের শরীর এবং ক্ষেত্রজ্ঞ বলতে সেই চেতনা, যিনি দেহের ভিতরে জ্ঞাতা হিসেবে অবস্থান করেন। শ্রীকৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন, প্রতিটি জীবের ভেতরে যে-চেতনা সক্রিয়, সেই চেতনা এক এবং সর্বব্যাপী; সেই পরম চেতনা বা আত্মাই ব্রহ্ম।
দেহ, মন ও বুদ্ধি পরিবর্তনশীল—তারা কখনো অসুস্থ, কখনো সুখী, কখনো দুঃখী হয়। কিন্তু যে তা দেখে, জানে, অনুভব করে, সে নিজে অপরিবর্তিত। এই অপরিবর্তনীয় সচেতন উপস্থিতিই ক্ষেত্রজ্ঞ। শরীর যেমন দেখা যায়, মন যেমন অনুভূত হয়, তেমনি এই সমস্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হিসেবে যে স্থির চেতনা অবস্থান করে, সেটিই ক্ষেত্রজ্ঞ।
শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে বলেন—ক্ষেত্রজ্ঞ হলেন দেহ-ইন্দ্রিয়-সংঘাতের সাক্ষী, অবিকারী ও চৈতন্যময়। অর্থাৎ, তিনি কখনও পরিবর্তিত হন না, তিনি কেবল জানেন। যেমন দেহ জন্ম নেয় ও নষ্ট হয়, মন ওঠানামা করে, কিন্তু চেতনা সবসময় সমান থাকে, তেমনি ক্ষেত্রজ্ঞ এই সমস্ত পরিবর্তনের সাক্ষীমাত্র।
কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে—“একো চেতনঃ” (কঠ উপনিষদ, ২.২.১৩)—অর্থাৎ সেই এক চেতনা অনেক দেহে প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু স্বরূপে তিনি এক। যেমন সূর্যের আলো অসংখ্য জলে প্রতিফলিত হলেও সূর্য এক ও অবিভাজ্য, তেমনি ক্ষেত্রজ্ঞ বহু জীবের ভিতরে প্রকাশ পেলেও তিনি অবিভক্ত ও সর্বব্যাপী আত্মা।
এই ধারণার মূল নিহিত আছে বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩.৭.২৩)—“যঃ সর্বাণি ভূতান্যন্তরো যময়তি, ন তু যময়্যো, যস্য ভূতানি শরীরম্, যঃ ভূতানামন্তর আত্মা, তমাৎমানং বিদ্ধি।” অর্থাৎ—যিনি সকল জীবের মধ্যে অন্তর্নিহিত থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন, অথচ তিনি নিজে কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন—তাঁকেই অন্তরাত্মা, ক্ষেত্রজ্ঞ বা সাক্ষীচেতা বলা হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে ক্ষেত্রজ্ঞ মানে আত্মা—যিনি প্রত্যেক দেহে অবস্থান করেন, কিন্তু দেহনিরপেক্ষ। তিনি প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উৎস, চিরসাক্ষী। ক্ষেত্র অর্থাৎ শরীর, মন ও ইন্দ্রিয় যা পরিবর্তনশীল, তা জড়। ক্ষেত্রজ্ঞ অর্থাৎ চেতনা, যা জানে কিন্তু পরিবর্তিত হয় না, তা চিরচেতন। ক্ষেত্র ভোগের স্থান, ক্ষেত্রজ্ঞ সাক্ষী। ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ, ক্ষেত্রজ্ঞ অসীম।
যে-ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই দুইয়ের ভেদ বোঝে—ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ—সে প্রকৃত জ্ঞানী। এই উপলব্ধিই আত্মজ্ঞান, যা শেষপর্যন্ত মানুষকে মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে (২.২৩-২৪) আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“অস্ত্র আত্মাকে কাটতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না, জল ভিজাতে পারে না, বাতাস শুকাতে পারে না।” অর্থাৎ, আত্মা কখনও কাটা যায় না, পোড়ে না, ভিজে না, শুকোয় না; সে স্থূল দেহের পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে, শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়। পরের শ্লোকে তিনি বলেন—“আত্মা অচ্ছেদ্য, আদাহ্য, আক্লেদ্য, অশোষ্য; সে নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল ও অনাদি।” এই বাণী দ্বারা গীতা স্পষ্ট করে জানায় যে আত্মা দেহের মতো পরিবর্তনশীল নয়—সে চিরন্তন সত্তা, যাকে কোনো ভৌত উপাদান ছুঁতে পারে না।