অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৬



লোভ মানে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, যেখানে আত্মার পূর্ণতা ভুলে মানুষ বাহ্য বস্তুতে সুখ খোঁজে। গীতা (১৬.২১) ও মনুস্মৃতি (৭.৪৫) উভয়েই লোভকে নরকের দ্বার বলেছেন। এটি কামের সম্প্রসারণ—যখন কাম পূর্ণ হলেও তৃপ্তি আসে না; বরং আরও চাই। লোভ আসলে আত্মার অভাববোধের বহিঃপ্রকাশ, যা মানুষকে অন্তহীন সংগ্রামে ঠেলে দেয়।

ক্রোধ মানে ইচ্ছা ব্যর্থ হলে যে রাগ বা প্রতিশোধস্পৃহা জাগে। গীতা (২.৬২-৬৩) অনুযায়ী, কাম অপূর্ণ হলে ক্রোধ জন্মায়। ক্রোধ মনকে দগ্ধ করে, জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে এবং আত্মসংবরণশক্তিকে নষ্ট করে ফেলে। শঙ্করাচার্য বলেছেন, ক্রোধ রজোগুণের অগ্নি, যা চেতনার স্বচ্ছতা নষ্ট করে।

মোহ মানে বিভ্রান্তি ও অজ্ঞান, অনিত্যকে নিত্য ভাবার ভুল দৃষ্টি। গীতা (২.৬৩) এবং মহাভারত (১২.১৭১) উভয়েই মোহকে জ্ঞানের প্রতিবন্ধক বলেছেন। মোহ হচ্ছে সেই মানসিক অন্ধতা, যা সত্য ও মায়ার পার্থক্য মুছে দেয়। যখন চেতনা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়কে আত্মা বলে ভুল করে, তখনই মোহ জন্মায়।

মদ মানে অহংকার বা গর্ব, যা আত্মাবোধকে আচ্ছন্ন করে। মনুস্মৃতি (৭.৪৫) এবং মহাভারত (১২.১৭১) অনুযায়ী মদ হলো আত্মপ্রশস্তি—দেহ, সম্পদ, জ্ঞান বা অবস্থান নিয়ে আত্মতৃপ্তি। এটি “আমি”-ভাবের ফুলে ওঠা, যার ফলে মানুষ নিজেকে অন্যের উপরে ভাবতে শুরু করে এবং ব্রহ্মবোধ থেকে দূরে সরে যায়।

মাৎসর্য মানে ঈর্ষা, অর্থাৎ অন্যের সাফল্যে দুঃখবোধ। মনুস্মৃতি (৭.৪৫) ও মহাভারত (১২.১৭১)-এ এটি ষড়রিপুর একটি হিসেবে উল্লেখিত। মাৎসর্য হচ্ছে আত্মঅসন্তোষের প্রকাশ—যেখানে ব্যক্তি নিজের পরিপূর্ণতা না জেনে অন্যের প্রাপ্তিতে দগ্ধ হয়। এটি মানুষকে পরের সুখে ব্যথিত ও নিজের মধ্যে শূন্য করে তোলে।

এই ছয়টি—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—হলো মানবচিত্তের ষড়রিপু বা ছয় অন্তঃশত্রু। বেদান্ত বলে, যতক্ষণ এই ষড়রিপু মন থেকে সম্পূর্ণ দূর না হয়, ততক্ষণ আত্মা নিজের শুদ্ধ স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। গীতা (৫.২৩) বলে—“ক্নোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ। কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ।।”—যে-ব্যক্তি দেহত্যাগের আগেই কাম ও ক্রোধের প্রবলতা সহ্য করতে পারে, সেই সত্যিকার অর্থে যুক্ত ও সুখী। এইভাবে বেদান্ত শেখায়, এই ছয় অন্তঃশত্রুকে জয় করলেই মন হয় প্রশান্ত, আর প্রশান্ত মনেই আত্মা নিজের আনন্দে জেগে ওঠে—যেটিই মুক্তির সূচনা।

শঙ্করাচার্যের ভাষ্য (ব্রহ্মসূত্র ৪.১.১৫-১৬) তে বলা হয়েছে—“জ্ঞানোত্তরকালে আপাতদেহাভিমানিনঃ ব্রহ্মবিধোঃ প্রারব্ধফলম্ অবশিষ্টম্। তস্য ন তু নূতনকর্মফলসংযোগঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞানপ্রাপ্ত হওয়ার পরও যতদিন শরীর থাকে, ততদিন প্রারব্ধ কর্মের ফল ভোগ হয়, কিন্তু নতুন কর্ম জন্মায় না। তাই জীবন্মুক্ত কর্মে যুক্ত থেকেও কর্মফলে আবদ্ধ হন না; তিনি কর্তা নন, সাক্ষীমাত্র।

যোগবাসিষ্ঠ (উত্তর ৫.৮.১২৬) বলে—“যদা চিত্তং প্রশান্তং স্যান্নির্বিকল্পমতন্দ্রিতম্, তদা ব্রহ্মাভবদ্ ব্রহ্মৈকবুদ্ধির্নিরাসয়াঃ।” অর্থাৎ, যখন মন সম্পূর্ণ প্রশান্ত, নিরবিকল্প, এবং সতত জাগ্রত থাকে, তখন সেই ব্যক্তি ব্রহ্মভাবপ্রাপ্ত হয়। এই অবস্থায় মন চিন্তা করে না, বরং চেতনা স্বয়ং জেগে থাকে—এটাই জীবন্মুক্তির চেতনার স্বরূপ।

জীবন্মুক্তির প্রধান নিদর্শনগুলি হলো—কামনা, অহঙ্কার, রাগ, ক্রোধ, ভয় প্রভৃতি সম্পূর্ণ বিলোপ; সুখ-দুঃখে সমভাব ও অনাসক্তি; কর্মে অংশগ্রহণ কিন্তু কর্তা-ভাবের অনুপস্থিতি; মন-ইন্দ্রিয়-চিত্তের নিস্পন্দতা ও স্বচ্ছতা; আত্মায় আত্মায় তৃপ্তি—অন্য কোনো নির্ভরতা নেই; জ্ঞান ও আনন্দের অভেদ অনুভব—“ব্রহ্মবিত্ ব্রহ্মৈব ভবতি।” (মুণ্ডক উপনিষদ, ৩.২.৯)

অর্থাৎ, যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান। এখানে “ব্রহ্মবিত্” মানে যিনি ব্রহ্মকে আত্মজ্ঞানরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং “ব্রহ্মৈব ভবতি” মানে সেই জ্ঞানী আর সীমিত ব্যক্তি থাকেন না—তিনি নিজ চেতনার পরম স্বরূপ, অর্থাৎ ব্রহ্মে একীভূত হয়ে যান।

শঙ্করাচার্য মুণ্ডকভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—“ব্রহ্মবিদ্যা ব্রহ্মণৈক্যফলা; তদ্বিদ্যা ন হি ব্রহ্মাতিরিক্তম্।” অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান সেই জ্ঞান, যা ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব ঘটায়; কারণ ব্রহ্মজ্ঞান আত্মার বাইরে অন্য কোনো সত্তাকে উপলব্ধি করে না।

এখানে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—সব একীভূত হয়। জ্ঞানী তখন আর “ব্রহ্মকে জানে” না, বরং “ব্রহ্ম হয়ে যায়।” যেমন আলো সূর্য থেকে আলাদা নয়, তেমনি জ্ঞান ও ব্রহ্মও অভিন্ন।

এই বাক্যটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল স্তম্ভ—জ্ঞানই মুক্তি, আর জানাই হওয়া। যে জানে, সে আর জানার প্রয়াসী নয়; সে স্বরূপে পরিণত হয়। জীবন্মুক্তি কোনো মৃত্যুর পরের মুক্তি নয়, বরং জীবিত অবস্থায় অবিদ্যা-নাশের পর চেতনার সম্পূর্ণ মুক্ত প্রস্ফুটন—যেখানে মানুষ দেহে থেকেও দেহাতীত, কর্মে থেকেও কর্ম-অপ্রবৃত্ত, জীবনে থেকেও অমর-মৃত্যুহীন।

বেদান্তে কর্ম, প্রারব্ধ ও মুক্তির সম্পর্ক বোঝা মানে জীবনের সম্পূর্ণ রহস্য অনুধাবন করা। এখানে বলা হয়েছে—কোনো মানুষ জন্মগ্রহণ করেই জ্ঞানী বা মুক্ত হন না; জন্ম মানেই কর্মফলের প্রকাশ, আর কর্ম মানেই অবিদ্যা ও বাসনার বন্ধন। কিন্তু এই চক্র ভাঙাও সম্ভব—জ্ঞান দ্বারা। এই তত্ত্বটি অদ্বৈত বেদান্তে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, গীতা ভাষ্য এবং উপনিষদসমূহে।

বেদান্ত প্রথমে কর্মকে তিন ভাগে বিভক্ত করে—সংচিত, প্রারব্ধ ও আগামী। সংচিত কর্ম হলো অসংখ্য জন্মের সঞ্চিত ফল, যা এখনও প্রকাশ পায়নি। প্রারব্ধ কর্ম সেই অংশ, যা ফল দিতে শুরু করেছে এবং বর্তমান দেহের কারণ হয়েছে। আগামী বা ক্রিয়মান কর্ম হলো বর্তমান জীবনে নতুন করে সঞ্চিত কর্ম, যা ভবিষ্যতের জন্মে ফল দেবে। শঙ্করাচার্য বলেন—“জ্ঞানোত্তরকালে প্রারব্ধফলমবশিষ্টম্, ন তু নূতনকর্মফলসংযোগঃ” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৪.১.১৫)। অর্থাৎ জ্ঞানীর ক্ষেত্রে কেবল প্রারব্ধ ফল টিকে থাকে; নতুন কোনো কর্মফল আর যুক্ত হয় না। বেদান্তসার (৬২-৬৪)-এও কর্মত্রয়ের এই বিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।

গীতায় বলা হয়েছে—“যথৈধাংসি সমিদ্ধো’গ্নিঃ ভস্মসাৎ কুরুতে’র্জুন, জ্ঞানেরাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।” (৪.৩৭)। যেমন আগুন কাঠকে ভস্মে পরিণত করে, তেমনি আত্মজ্ঞান সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে ফেলে। এই দগ্ধ হওয়া মানে কর্মবীজের কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া। শঙ্কর বলেন—“জ্ঞানেনৈব তু কৃতস্নকারণভ্যো মুক্তিঃ।” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৪.১.১৫)—অর্থাৎ মুক্তির একমাত্র কারণ জ্ঞান। গীতায় কৃষ্ণ আবার বলেন—“জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ।” (৪.১৯)—যার কর্ম জ্ঞানের আগুনে দগ্ধ হয়েছে, তাঁকেই মুনি বলা হয়।

প্রশ্ন আসে—জ্ঞান জন্মালে দেহ কেন টিকে থাকে? শঙ্করাচার্য এর উত্তর দিয়েছেন—“যথা ছিন্নাঃ তৃণবল্লর্যঃ প্রারব্ধফলপ্রবাহে প্রতিপন্নাঃ, তদ্বৎ জ্ঞানিনো’পি শরীরম্ প্রারব্ধান্তমবতিষ্ঠতে।” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৪.১.১৫)। অর্থাৎ ঘাস কেটে ফেলার পরও শিকড়ে শক্তি থাকা অবস্থায় তা কিছুক্ষণ সবুজ থাকে; তেমনি জ্ঞানীর শরীরও প্রারব্ধ ফুরোনো পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই গীতায় বলা হয়েছে—“যঃ সর্বত্রানভিস্নেহঃ তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্, না অভিনন্দতি ন দ্বেষ্ঠি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।” (২.৫৭)—জ্ঞানী শুভাশুভ ফলের মুখেও নির্বিকার থাকেন, কারণ তিনি জানেন—এসব প্রারব্ধের খেলা।

জন্মান্তরের কারণ হলো অবিদ্যা ও বাসনা। যতক্ষণ বাসনা অবশিষ্ট, ততক্ষণ জন্মও অনিবার্য। কিন্তু যখন জ্ঞান জাগে—“আমি দেহ নই, আমি ব্রহ্ম”—তখন সব বাসনা নিঃশেষ হয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.৬)-এ বলা হয়েছে—“তদা বিদ্বান্ পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে”—যিনি জেনেছেন, তাঁর পুনর্জন্ম নেই। মুণ্ডক উপনিষদ (২.২.৮)-এ বলা হয়েছে—“ভিদ্যত তদ্ ব্রহ্মণি নিশ্কলম্ অমৃতম্… ন স পুনরাবর্ততে”—যিনি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন, তিনি আর সংসারে ফিরে আসেন না। কৈবল্য উপনিষদ (১.১৫)-এ বলা হয়েছে—“যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা, যে’স্য হৃদি শ্রিতাঃ, অথ মর্ত্যো’মৃতো ভবতি”—যখন হৃদয়ের সব কামনা লুপ্ত হয়, তখনই মানুষ অমর হয়ে ওঠে।

এই জ্ঞানের দগ্ধতা তিন স্তরে ঘটে—প্রথমত সংচিত কর্ম সম্পূর্ণ দগ্ধ হয়; দ্বিতীয়ত আগামী কর্ম আর জন্মায় না, কারণ কর্তা-ভাব বিলুপ্ত; তৃতীয়ত প্রারব্ধ কর্ম দেহ থাকা পর্যন্ত চলে। গীতায় বলা হয়েছে—“কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্, আকর্মণি চ কর্ম যঃ, স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু, স যুক্তঃ কৃত্স্নকর্মকৃত্।” (৪.১৮)—যিনি কর্মের মধ্যেও অকর্ম দেখেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী।

জ্ঞানী ব্যক্তি শরীর-সহ থেকেও অন্তরে মুক্ত—এ অবস্থাকে জীবন্মুক্তি বলা হয়। তাঁর জন্য কর্ম আর বন্ধন নয়, লীলা। মুন্ডক উপনিষদ (৩.২.৮)-এ বলা হয়েছে—“যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রেণ সংযন্তে… তদ্বিদ্বান্ নামরূপাদ্বিমুক্তঃ পরমম্ পুরুষম্ উপৈতি”—যেমন নদীগুলি সাগরে মিশে যায়, তেমনি জ্ঞানী নামরূপের সীমা পেরিয়ে পরম পুরুষে মিশে যান। যখন প্রারব্ধও শেষ হয়, তখন তিনি বিদেহমুক্ত—সম্পূর্ণ ব্রহ্মে লীন।

কেউ কেউ জন্মগতভাবেই জ্ঞান-সংস্কার নিয়ে আসে—অর্থাৎ, কিছু আত্মা পূর্বজন্মে এত গভীর সাধনা, ধ্যান ও আত্মচিন্তন করেছে যে, সেই অনুশীলনের ছাপ বা সংস্কার তার চিত্তে অমোচনীয়ভাবে থেকে যায়। মৃত্যুর পর দেহ নষ্ট হলেও, মন ও বুদ্ধির সূক্ষ্ম সংস্কারগুলি লীন হয় না; তারা কারণ শরীরে সুপ্ত থাকে এবং পরবর্তী জন্মে পুনরায় প্রকাশ পায়। এই কারণেই একেকজন মানুষ জন্ম থেকেই আধ্যাত্মিক প্রবণতা, বৈরাগ্য বা জ্ঞানলোভ নিয়ে আসে, আর একেকজন সম্পূর্ণ ভোগপ্রবণ হয়ে জন্মায়।

ভগবদ্‌গীতায় (৬.৪৫) কৃষ্ণ এই অবস্থার কথাই স্পষ্ট বলেছেন—“প্রয়ত্নাত যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধ-কিল্বিষঃ। অনেকজন্ম-সংসিদ্ধস্ততো যাতি পরং গতিম্।।” অর্থাৎ, যে-যোগী বহু জন্ম ধরে সাধনা করে মনকে শুদ্ধ করেছে, সে জন্মমাত্রেই জ্ঞানলাভের উপযুক্ত হয় এবং পরম গতি, অর্থাৎ মুক্তির দিকে অগ্রসর হয়।

শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—এই যোগী আসলে পূর্বজন্মের সংস্কারের বলেই সহজে জ্ঞানপথে প্রবেশ করতে পারে। তিনি বলেন, “পূর্বসাধনসংস্কারবলে বর্তমানজন্মে তদ্ভাবনায় সহজতরঃ।” অর্থাৎ, পূর্বজন্মে যে-সাধনা সম্পূর্ণ হয়নি, তার সংস্কার পরজন্মে সঙ্গে আসে, ফলে মন ইতিমধ্যেই আত্মজ্ঞান-উন্মুখ থাকে।

এই অবস্থাকে বলা হয় “সঞ্জাতজ্ঞান” বা জ্ঞান-সংস্কারযুক্ত জন্ম। এর অর্থ, জ্ঞান এখনও সম্পূর্ণ উদিত হয়নি, কিন্তু তার বীজ মনের গভীরে সক্রিয়। সামান্য সৎসঙ্গ, গুরু-উপদেশ বা শাস্ত্রশ্রবণেই সেই বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং আত্মজ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, কেউ ছোটবেলা থেকেই ধর্ম, ধ্যান, দর্শন বা আত্মচিন্তায় গভীর আকর্ষণ অনুভব করে, আবার কেউ একই বয়সে কেবল ইন্দ্রিয়সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই পার্থক্যের মূল কারণই হলো—পূর্বজন্মের সংস্কারভেদ। যারা জ্ঞান-সংস্কার নিয়ে জন্মায়, তাদের চেতনা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত; তাই এই জীবনে তাদের মুক্তিলাভ তুলনামূলকভাবে সহজ হয়।

জন্মগত জ্ঞান-সংস্কার মানে এই নয় যে, কেউ জন্মেই মুক্ত বা সম্পূর্ণ জ্ঞানী; বরং বোঝায়, তার অন্তঃকরণ পূর্বজন্মের সাধনার দ্বারা এতটাই পরিশুদ্ধ হয়েছে যে, সে অল্প উপদেশেই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম। এই কারণেই গীতা বলে—“অনেকজন্ম-সংসিদ্ধঃ”—বহু জন্মের প্রস্তুতি ছাড়া পরম জ্ঞান উদিত হয় না; কিন্তু যখন সেই সংস্কার পরিপূর্ণ হয়, তখন জ্ঞান মুহূর্তেই প্রস্ফুটিত হয়, যেমন শুষ্ক ঘাসে স্ফুলিঙ্গ পড়লে আগুন সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে।

মুক্তি মানে অবিদ্যা-শূন্য অবস্থা—যেখানে বাসনা, কর্ম ও জন্ম, সব লুপ্ত। এই অবস্থাটি হল পরম জ্ঞান ও চেতনার এক উচ্চতর স্তর, যেখানে আত্মা তার প্রকৃত স্বরূপে প্রকাশিত হয়। ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত বেদান্ত মতে, মুক্তিকে মোক্ষ বা নির্বাণ নামেও অভিহিত করা হয়। এটি কেবল দুঃখের অনুপস্থিতি নয়, বরং তা হল এক নির্বাসনা, নিষ্কাম ও আনন্দময় অবস্থা। এই অবস্থায় জীব জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অসীমের সাথে একীভূত হয়।