অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৪



শ্লোক ২.৫৫: "প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্, আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।" এই শ্লোকে বলা হয়েছে, সেই ব্যক্তিই স্থিতপ্রজ্ঞ বলে অভিহিত হন, যিনি মনোজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন। "পার্থ" সম্বোধন দ্বারা অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, যখন একজন মানুষ তার মনের গভীরে লুকিয়ে-থাকা সমস্ত কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হন, তখন তিনি এক অভ্যন্তরীণ শান্তিতে স্থিতি লাভ করেন। এই অবস্থায়, তিনি বাইরের কোনো বস্তু বা ঘটনার উপর সুখের জন্য নির্ভরশীল থাকেন না, বরং নিজের আত্মায় নিজেই তৃপ্ত হন। এই আত্ম-তৃপ্তি কোনো বাহ্যিক প্রাপ্তি বা ভোগের ফল নয়, বরং আত্ম-জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত এক স্থির অবস্থা। এটি মানসিক মুক্তি এবং আত্ম-নির্ভরতার চূড়ান্ত প্রকাশ।

শ্লোক ২.৫৬: "দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ, বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীরমুনিরুচ্যতে।" এই শ্লোকটি স্থিতপ্রজ্ঞের মানসিক স্থিতিশীলতার আরও গভীরে প্রবেশ করে। এখানে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিকে "স্থিতধীরমুনি" (স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন ঋষি) বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো, যিনি দুঃখের সময় বিচলিত হন না, অর্থাৎ কোনো প্রকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার মন উদ্বিগ্ন হয় না। একইভাবে, সুখের সময়ও তিনি কোনো প্রকার স্পৃহা বা অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন না। তার কাছে সুখ ও দুঃখ উভয়ই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র, যা তার অভ্যন্তরীণ শান্তিকে প্রভাবিত করতে পারে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি রাগ, ভয় এবং ক্রোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকেন। এই তিনটি রিপু মানুষের মনকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে। রাগ মানুষকে উত্তেজিত করে, ভয় মানুষকে দুর্বল করে এবং ক্রোধ বিচারবুদ্ধি লোপ করে। যিনি এই তিনটি রিপু জয় করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে স্থিতপ্রজ্ঞ।

এই শ্লোকগুলোর মূল বার্তা হলো, স্থিতপ্রজ্ঞ বা জীবন্মুক্ত ব্যক্তি সেই মহাপুরুষ, যিনি শুধুমাত্র বাহ্যিক জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন না, বরং তার ভেতরের জগতকেও সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার মন কোনো প্রকার কামনার দ্বারা কলুষিত হয় না, এবং তিনি আত্মায় আত্মায় পরম তৃপ্তি অনুভব করেন। জীবনের সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়—কোনো কিছুই তার মানসিক শান্তিকে বিচলিত করতে পারে না। রাগ, ভয়, এবং ক্রোধের মতো প্রবৃত্তিগুলি তার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না, কারণ তিনি এই সমস্ত আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে এক স্থির এবং প্রশান্ত অবস্থায় বাস করেন।

এই অবস্থাটি কেবলই একটি মানসিক অবস্থা নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির চূড়ান্ত ফল। যিনি এই স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা লাভ করেন, তিনি জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেন। তার মন আর বাহ্যিক ঘটনাবলির দ্বারা আন্দোলিত হয় না, যা জীবন্মুক্তির মানসিক পরিচয়। এটি আত্মসংযম, আত্মজ্ঞান এবং আত্মানুভূতির এক পরম স্তর, যেখানে ব্যক্তি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম শান্তিতে অবস্থান করেন। এই স্থিতপ্রজ্ঞের ধারণা আমাদের শেখায় যে, প্রকৃত সুখ এবং শান্তি বাইরের জগতে নয়, বরং আমাদের নিজেদের ভেতরের জগতে নিহিত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.৬–৭) ঘোষণা করে, "ব্রহ্মবিত্ ব্রহ্মৈব ভবতি।" অর্থাৎ, যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে ওঠেন। এই শাশ্বত উক্তিটি কেবল একটি তথ্যগত জ্ঞান অর্জনের কথা বলে না, বরং সত্তার গভীর রূপান্তর এবং অস্তিত্বের মৌলিক ঐক্য অনুধাবনের উপর জোর দেয়। এটি এমন এক আধ্যাত্মিক যাত্রার পথনির্দেশ করে, যেখানে প্রচলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সীমা অতিক্রম করে এক মহত্তর চেতনার স্তরে আরোহণ সম্ভব।

এই "জ্ঞান" কোনো বই পড়ে বা শুনে অর্জিত তথ্য বা বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা নয়। এটি প্রজ্ঞা, এক নিগূঢ় উপলব্ধি, যা ব্যক্তির সমগ্র অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে। এটি কেবল ব্রহ্ম সম্পর্কে জানা নয়, বরং ব্রহ্ম হয়ে ওঠা। এই রূপান্তর প্রক্রিয়াটি সাধারণ অর্থে জ্ঞাতাকে জ্ঞেয় থেকে পৃথক করে না, বরং উভয়কে এক অবিচ্ছিন্ন সত্তায় বিলীন করে দেয়। যখন একজন সাধক এই স্তরে পৌঁছান, তখন দ্বৈততার সমস্ত বিভাজন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

জীবন্মুক্ত অবস্থা হলো সেই পরম দশা, যেখানে জ্ঞাতা (জানার বিষয়), জ্ঞান (জানার প্রক্রিয়া) এবং জ্ঞেয় (যা জানা হচ্ছে)—এই তিনের ভেদ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। এই ত্রিমুখী বিভাজন, যা আমাদের সাধারণ জাগতিক অভিজ্ঞতাকে সংজ্ঞায়িত করে, তা তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে। জীবন্মুক্ত পুরুষ বা নারী বিশ্বকে এক অখণ্ড চৈতন্য রূপে অনুভব করেন, যেখানে প্রতিটি কণা এবং প্রতিটি মুহূর্ত সেই পরম ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই উপলব্ধি কেবল তাত্ত্বিক নয়, এটি গভীরতম আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। যখন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে যায়, তখন কোনো পৃথক 'আমি' বা 'আমার' থাকে না, যা জানার জন্য অবশিষ্ট থাকে। প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি অস্তিত্ব সেই এক পরম চৈতন্যের প্রকাশ হয়ে ওঠে। এটি অহং-এর বিলুপ্তি এবং মহাজাগতিক চেতনার সাথে একাত্মতা অর্জনের চূড়ান্ত অবস্থা।

উপনিষদের এই শিক্ষাটি প্রাচীন ভারতের গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের একটি মৌলিক দিক। এটি মানব অস্তিত্বের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্দেশ করে—মুক্তির পথ, যেখানে ব্যক্তি তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অসীমতার সাথে একীভূত হয়। ব্রহ্মের জ্ঞান তাই কেবল একটি বিদ্যা নয়, এটি মুক্তির সাধনা, আত্মোপলব্ধির চরম শিখর এবং মহাজাগতিক ঐক্যের জীবন্ত অভিজ্ঞতা। এই অবস্থায় সবই এক চৈতন্য, সবই ব্রহ্ম।

মুণ্ডক উপনিষদ (৩.২.৯) জীবন্মুক্তির এক গভীর চিত্র তুলে ধরে—"ভিদ্যাতে হৃদয়গ্রন্থিঃ, ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়া, ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি, তস্মিন্ দ্রষ্টে পরাবরে।" এই শ্লোকটি মানব জীবনের পরম লক্ষ্য এবং আধ্যাত্মিক যাত্রার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নির্দেশ করে।

যখন কোনো ব্যক্তি পরম ব্রহ্মকে, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পরম সত্যকে প্রত্যক্ষ করেন, তখন তাঁর হৃদয়ের গ্রন্থিগুলি (অহঙ্কার ও কামনা) ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই হৃদয়গ্রন্থিগুলি হলো আমাদের জাগতিক বন্ধন, যা অহংকার, মোহ, রাগ, দ্বেষ, এবং বিভিন্ন কামনা-বাসনার আকারে আমাদের আত্মাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এগুলিই আমাদের দুঃখ ও কষ্টর মূল কারণ। পরম জ্ঞান লাভের ফলে এই গ্রন্থিগুলি সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যার ফলে মন সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়।

একই সাথে, সমস্ত সন্দেহ নাশ হয়। জীবনের উদ্দেশ্য, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, কর্মের ফল, মোক্ষের স্বরূপ—এই সমস্ত বিষয়ে যত সংশয় মানুষের মনে থাকে, পরম ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষ করার পর সেগুলির আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ার সাথে সাথে সকল অজ্ঞতা ও ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়, এবং ব্যক্তি এক অটল বিশ্বাস ও স্পষ্টতার স্তরে উন্নীত হয়।

সর্বোপরি, কর্মের বন্ধন বিলুপ্ত হয়। হিন্দু দর্শনে কর্মফলকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। প্রতিটি কর্মের একটি ফল আছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জন্ম এবং বর্তমান জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু যখন ব্যক্তি পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি কর্মফলের চক্র থেকে মুক্ত হন। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি কর্ম করা ছেড়ে দেন, বরং তিনি নিরাসক্তভাবে কর্ম করেন, যার ফল তাঁকে আর বাঁধতে পারে না। এটি এমন এক অবস্থা যেখানে কর্মফল জমা হয় না, এবং পূর্বের সঞ্চিত কর্মফলও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

বেদান্তে “কর্মফলও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়”—এই কথাটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর তত্ত্বের ইঙ্গিত বহন করে। দেখা যাক, “কর্মফল” কী, এবং কীভাবে তা আত্মাকে স্পর্শ করে।

প্রত্যেক কাজ—চিন্তা, বাক্য বা দেহগত ক্রিয়া—একটি সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই প্রতিক্রিয়াই কর্মফল। এটি সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় না; কারণ প্রতিটি ক্রিয়ার পরিণতি মন ও সূক্ষ্ম শরীরে একটি ছাপ ফেলে—এটাই কর্মের বীজ। সেই বীজ পরবর্তী কালে, উপযুক্ত অবস্থায়, এই জন্মে বা পরের জন্মে, ফল দেয়। যেমন একটি বীজ মাটির নিচে অদৃশ্য থাকে কিন্তু সময়মতো অঙ্কুরিত হয়, তেমনি কর্মও গোপনে সঞ্চিত থাকে এবং সুযোগ পেলে জীবনের ফল রূপে প্রকাশিত হয়।

কিন্তু শাস্ত্র বলছে, কর্মফল চিরন্তন নয়; এটি নশ্বর। যেমন বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গাছ হয়, ফল দেয় এবং শেষে শুকিয়ে যায়—তেমনি কর্মও একবার ফল দিলে তার ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়। এই অবস্থাকে বলে কর্মক্ষয়, অর্থাৎ কর্মের কার্যক্ষমতা বা বন্ধনের শক্তি লুপ্ত হওয়া।

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—“যস্তু আত্মরতি রেব স্যাদ্ আত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ। / আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টঃ তস্য কার্যং ন বিদ্যতে।।” (ভগবদ্‌গীতা, ৩.১৭)। এর অর্থ হলো, যে-ব্যক্তি আত্মায় সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত, আত্মাতেই যার একমাত্র আনন্দ এবং আত্মাতেই যিনি পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন, তাঁর জন্য কোনো জাগতিক কর্ম আর অবশিষ্ট থাকে না। এই শ্লোকের গভীর তাৎপর্য হলো, যখন একজন মানুষ আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন, তখন তাঁর কাছে জাগতিক সকল কর্মের ফল নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

আত্মজ্ঞান লাভ করার পর ব্যক্তির মধ্যে 'আমি কর্তা', এই ভাব লুপ্ত হয়ে যায়। তিনি তখন নিজেকে শুধুমাত্র কর্মের নিমিত্ত মনে করেন, কিন্তু কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত থাকেন। এই অবস্থাকেই স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা বলা হয়, যেখানে ব্যক্তি সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে এক অনাবিল শান্তি ও আনন্দ উপভোগ করেন। কর্ম করা সত্ত্বেও তিনি কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না, কারণ তাঁর সমস্ত কর্মই নিষ্কামভাবে ঈশ্বরকে সমর্পণ করা হয়। এই ধরনের ব্যক্তি জগৎ-সংসারে বাস করেও জগতের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেন, ঠিক যেমন পদ্মফুল কাদামাটিতে জন্মেও জলের দ্বারা অস্পৃষ্ট থাকে।

এই শ্লোকটি নিষ্কাম কর্মের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটি বোঝায় যে, প্রকৃত আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষ্য হলো আত্ম-উপলব্ধি এবং পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতা। যখন এই অবস্থা অর্জিত হয়, তখন বাইরের কোনো কর্মই ব্যক্তিকে আর প্রভাবিত করতে পারে না, কারণ তাঁর সমস্ত চেতনা তখন আত্মাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। এটি মুক্তি বা মোক্ষের একটি পথ, যেখানে ব্যক্তি কর্মের ফলস্বরূপ জন্মানোর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং পরম শান্তি লাভ করে।

এখানে “ক্ষয়” মানে ধ্বংস নয়, বরং অপ্রযোজ্যতা—কর্মফল তখন আর প্রযোজ্য হয় না, কারণ “আমি কর্তা”, এই ভ্রান্তি তখন আর থাকে না। যখন কেউ জানেন—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১০)—আমি ব্রহ্ম, তখন তার মধ্যে কর্তার ধারণা বিলুপ্ত হয়। আর কর্তা না থাকলে কর্মফল ভোগ করারও কেউ থাকে না।

গীতায় বলা হয়েছে—“যথৈধাংসি সমিদ্ধো’গ্নিঃ ভস্মসাৎ কুরুতে’র্জুন, জ্ঞানেরাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।” (গীতা, ৪.৩৭)। এই শ্লোকটি এক অসাধারণ উপমা—এতে বলা হয়েছে, যেমন আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে সম্পূর্ণ ভস্মে পরিণত করে, তেমনি জ্ঞানের অগ্নি সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে ফেলে।

এখানে “কর্ম দগ্ধ হওয়া” মানে কোনো বাহ্যিক ধ্বংস নয়। কর্মফল কোনো পদার্থ নয় যে, আগুনে পুড়ে যাবে; এটি মানসিক ও সূক্ষ্ম স্তরের একটি সম্ভাবনা—একটি বীজের মতো। জ্ঞান সেই বীজকে অঙ্কুরিত হওয়ার অযোগ্য করে দেয়।

ধরা যাক, শুকনো বীজ যদি পুড়ে যায়, তাহলে তা আর মাটিতে ফেললে গাছ হবে না। তেমনি, আত্মজ্ঞান যখন জেগে ওঠে, তখন পূর্বকৃত কর্মের বীজ তার কার্যক্ষমতা হারায়। সেই কর্মফল তখন আর ভবিষ্যৎ জন্মের কারণ হতে পারে না—এটাই কর্মক্ষয়।

জ্ঞান মানে শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়; জ্ঞান মানে নিজের সত্য স্বরূপকে জানা—“আমি দেহ নই, আমি কর্তা নই, আমি ব্রহ্ম।” এই জ্ঞান জন্মালে ‘কর্তা-ভাব’ (আমি করছি, আমি ভোগ করব) সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। আর কর্তা না থাকলে কর্মফল ভোগ করারও কেউ থাকে না। তাই কর্ম থাকলেও তা ফল দিতে পারে না, যেমন ছাই থেকে আর আগুন জ্বলে না।