যেমন জাগ্রত অবস্থায় আত্মা দেহে প্রকাশিত হয়ে খাদ্য হজম করে, শক্তি উৎপন্ন করে, চিন্তা ও কর্মে প্রকাশ পায়—এই সক্রিয় আত্মাই বৈশ্বানর। সূক্ষ্ম জগতে এই অগ্নি তৈজস নামে মন-চেতনার সূক্ষ্ম তাপে রূপ নেয়, যা স্বপ্নে জগৎ রচনা করে। কারণ স্তরে, অর্থাৎ সুষুপ্তিতে, এই অগ্নি সুপ্ত থাকে, যেন ছাইয়ের নিচে চাপা আগুন—বাইরে নিস্তব্ধতা, ভেতরে সম্ভাবনা। আর তুরীয়ে, এই অগ্নি আর কোনো জ্বালানির প্রয়োজন করে না; সে নিজেই দীপ্ত, নিজেই ব্রহ্ম।
অগ্নির এই বৈশ্বানর রূপ বোঝায় যে, চেতনা কখনও নিভে যায় না—কেবল তার প্রকাশরূপ পরিবর্তিত হয়। যেমন একই সূর্য জলে প্রতিফলিত হলে শীতল মনে হয়, আয়নায় প্রতিফলিত হলে উজ্জ্বল, আর মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়লে ম্লান—তেমনি আত্মাও দেহ, মন ও অবিদ্যার স্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।
বৈশ্বানর মানে সেই এক জীবন্ত অগ্নি, যা আমাদের শরীরের পাচক তাপ, মনের চিন্তা-শক্তি, ও আত্মার জ্ঞান-শক্তি—সব কিছুতে একাত্মভাবে বিরাজমান। এই উপলব্ধিই মানুষকে শেখায়—অগ্নি কোনো বহির্বস্তু নয়, বরং আমাদের নিজের অন্তঃস্থিত ব্রহ্মচেতনার প্রতীক।
যখন কেউ উপলব্ধি করেন, “এই অগ্নি আমিই—যে শক্তি সব কিছুকে চালিত করে,” তখন তিনি আর পৃথক সত্তা নন; তখন তাঁর মধ্যে ফুটে ওঠে সেই বোধ—“অহং বৈশ্বানরঃ”—আমি সেই অগ্নি, যে ব্রহ্মরূপে সমস্ত জগতে প্রবাহিত।
বায়ুর প্রধান গুণ স্পর্শ। এটি গতিশক্তি ও প্রাণশক্তির উৎস। বায়ু চলন সৃষ্টি করে, জীবনে প্রাণ সঞ্চার করে। শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, রক্তসঞ্চালন—সবই বায়ুতত্ত্বের কার্য। দেহে এটি পাঁচ প্রকার প্রাণবায়ু—প্রাণ, আপান, উদান, সমান, ব্যান—এইভাবে বিভক্ত। প্রশ্ন উপনিষদে (২.৫) বলা হয়েছে—“প্রাণ এষ যঃ সর্বান্ ভূতান্যধিতিষ্ঠতি”—“এই প্রাণই সমস্ত জীবকে অধিষ্ঠিত রাখে।” গীতায় (৭.৯) শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“প্রাণঃ শরীরেষু কৌন্তেয়”—“আমি সকল জীবের প্রাণশক্তি।” অর্থাৎ, বায়ুই সেই চেতনার গতি, যার দ্বারা জীবন সচল থাকে।
আকাশ সবচেয়ে সূক্ষ্ম উপাদান। এর প্রধান গুণ শব্দ। আকাশই স্থান ও ধারণক্ষমতার প্রতীক, যেখানে অন্য চারটি উপাদান অবস্থান করে। এটি অদৃশ্য, সর্বব্যাপী ও স্পর্শহীন। আকাশের মাধ্যমেই শব্দের প্রকাশ ঘটে—তাই শ্রবণেন্দ্রিয় আকাশের সঙ্গে যুক্ত। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১-২) বলা হয়েছে—“আকাশাদ্ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী”—আকাশ থেকেই প্রথমে বায়ু, তারপর অগ্নি, তারপর জল, এবং শেষে পৃথিবীর সৃষ্টি। এই ক্রমে সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের বিকাশ ঘটে—এটাই সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বেদান্তের ভাষায়।
আকাশ থেকেই প্রথমে বায়ু, তারপর অগ্নি, তারপর জল, এবং শেষে পৃথিবীর সৃষ্টি—এই কথাটি বেদান্তে সৃষ্টির ক্রম (সৃষ্টি-পরম্পরা) বা ‘পঞ্চীভূত প্রক্রিয়া’ নামে পরিচিত। এটি উপনিষদে বর্ণিত সেই সূক্ষ্ম দর্শন, যেখানে বিশ্বজগতের বিকাশকে এক চৈতন্যমূল নীতি থেকে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত বলে দেখানো হয়েছে।
এর দার্শনিক তাৎপর্য হলো—সৃষ্টি কোনো হঠাৎ উদ্ভব নয়; এটি সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের ধাপে ধাপে প্রকাশ। আকাশ সবচেয়ে সূক্ষ্ম—এটি নিস্পন্দ স্থান বা ধারণক্ষমতা, যেখানে কিছুই ঘটে না, কিন্তু সব কিছুর সম্ভাবনা নিহিত থাকে। এই সম্ভাবনাই যখন প্রথমে আন্দোলিত হয়, তখন সৃষ্টি হয় বায়ু—গতি বা স্পন্দনের নীতি।
বায়ুতে যখন গতি তীব্র হয়, তখন ঘর্ষণ ও তাপ জন্মায়, ফলে উদ্ভব হয় অগ্নির—রূপ ও শক্তির প্রতীক। অগ্নি থেকে সঞ্চিত তাপ ও শক্তি ঘনীভূত হয়ে জলের সৃষ্টি করে, যা শীতল, তরল ও সংযোজক প্রকৃতির। জল আরও ঘনীভূত হয়ে দৃঢ় রূপ নিলে গঠিত হয় পৃথিবী—স্থিতি, আকার ও কঠোরতার প্রতীক।
এইভাবে সূক্ষ্ম আকাশ থেকে ক্রমে ঘন ও দৃশ্যমান পৃথিবীর সৃষ্টি ঘটে। বেদান্ত এই ক্রমকে কেবল রূপকভাবে নয়, নীতিগতভাবে “ব্রহ্ম থেকে জগতের বিকাশ”-এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে মেনে নেয়। কারণ, প্রতিটি স্তরে শক্তির ঘনত্ব ও প্রকাশের পার্থক্য আছে—যা আধুনিক বিজ্ঞানের শক্তি ও পদার্থরূপান্তরের ধারণার সঙ্গে তুলনীয়।
আকাশে ছিল কেবল সম্ভাবনা (space), বায়ু সেই সম্ভাবনাকে আন্দোলনে রূপ দিল (motion), অগ্নি তাকে শক্তিতে পরিণত করল (energy), জল সেই শক্তিকে সংযোজনে পরিণত করল (fluidity), আর পৃথিবী তাকে দৃঢ় আকার দিল (matter)।
বেদান্তের এই সৃষ্টি-ক্রম শুধু ধর্মীয় কাহিনি নয়, বরং চেতনা থেকে পদার্থে রূপান্তরের এক সূক্ষ্ম দর্শন—যেখানে সর্বপ্রথম ছিল আকাশ, আর শেষবিন্দুতে এসে গঠিত হলো পৃথিবী, স্থূল জগত ও আমাদের দেহ।
বায়ু ও আকাশ—দুটিই সূক্ষ্ম তত্ত্ব, কিন্তু তাদের প্রকৃতি ও কার্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। আকাশ হলো স্থান বা ধারণক্ষমতা, আর বায়ু হলো গতি বা চলনশক্তি।
আকাশ সব কিছুকে স্থান দেয়, নিজে স্থির ও সর্বব্যাপী। এটি স্পর্শহীন, কিন্তু শব্দের আধার—শব্দ তার প্রধান গুণ। তাই শ্রবণেন্দ্রিয় আকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১) বলা হয়েছে—“আকাশাদ্ বায়ুঃ”—অর্থাৎ, আকাশ থেকেই বায়ুর সৃষ্টি; তাই আকাশ বায়ুর কারণ, ধারণক্ষেত্র ও আশ্রয়। আকাশ নিস্পন্দ—এতে গতি নেই, কিন্তু সব গতির স্থান সেটিই।
অন্যদিকে, বায়ু হলো গতি, প্রাণ ও স্পর্শের প্রতীক। এটি আকাশে অবস্থান করে, কিন্তু স্থির নয়—চলমান ও কার্যকর। এর প্রধান গুণ স্পর্শ, তাই ত্বকেন্দ্রিয় বায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রশ্ন উপনিষদে (২.৫) বলা হয়েছে—“প্রাণ এষ যঃ সর্বান্ ভূতান্যধিতিষ্ঠতি”—বায়ুতত্ত্বই জীবনের ধারক।
“বায়ুতত্ত্বই জীবনের ধারক”—এই বাক্যের তাৎপর্য বুঝতে হলে প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে, বায়ু এখানে কেবল বাহ্যিক হাওয়া নয়, বরং সেই সূক্ষ্ম শক্তি, যা জীবনের মূল গতি। উপনিষদে বলা হয়েছে—“প্রাণো হি ভূতানামায়ুষঃ” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৭.১৫.১)—প্রাণই সমস্ত জীবের আয়ু। এই প্রাণই বায়ুতত্ত্বেরই প্রকাশ, যা জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রবাহিত।
যখন মানুষ শ্বাস নেয়, তখন বাহ্য বায়ু শরীরে প্রবেশ করে এবং সেই সঙ্গে অন্তঃস্থিত প্রাণশক্তি সক্রিয় হয়। এই বায়ুতত্ত্বই হৃৎস্পন্দন চালায়, রক্তপ্রবাহ সচল রাখে, হজম ঘটায়, মস্তিষ্কে চিন্তা ও সাড়া জাগায়। অর্থাৎ জীবন চলার প্রতিটি ক্রিয়ার মূলে রয়েছে বায়ুর গতি। তাই একে বলা হয়—জীবনের ধারক।
যেমন প্রদীপে তেল ও সলতে থাকলেও বাতাস না থাকলে শিখা জ্বলবে না, তেমনি দেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকলেও বায়ুতত্ত্ব না থাকলে দেহ জড় হয়ে যায়। দেহের সব কার্যকলাপই বায়ুতত্ত্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; এটি না থাকলে প্রাণের প্রবাহ থেমে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে জীবনও নিভে যায়।
বেদান্তে বায়ুতত্ত্বকে কেবল শারীরিক নয়, আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবেও দেখা হয়েছে। এটি চেতনার বাহক—যে-আত্মা স্থির, সেই আত্মা দেহে নিজের প্রকাশ ঘটায় এই বায়ুতত্ত্বর মাধ্যমে। তাই বলা হয়, প্রাণই আত্মার স্পন্দন, আর বায়ু সেই প্রাণের বাহন।
যেমন বায়ু দৃশ্যমান নয়, তবু তার উপস্থিতি অনুভূত হয় প্রতিটি গতিতে, তেমনি আত্মাও অদৃশ্য, কিন্তু তার শক্তি প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে, প্রতিটি চিন্তায় প্রকাশ পায়।
এখানে “তত্ত্ব” শব্দটিরও বিশেষ অর্থ আছে। “তত্ত্ব” এসেছে “তৎ + ত্ব” থেকে, যার অর্থ—“যা আসলে সত্যরূপে আছে”—অর্থাৎ কোনো কিছুর মৌলিক সত্তা বা অস্তিত্বের নীতি। তাই “বায়ুতত্ত্ব” মানে কেবল বাতাস নয়, বরং বায়ুর মূল বাস্তব নীতি—যে-নীতি গতি, প্রাণ, ও চেতনার স্পন্দনের উৎস।
যেমন অগ্নিতত্ত্ব কেবল আগুন নয়, বরং তাপ ও রূপান্তরের নীতি; জলতত্ত্ব কেবল পানি নয়, বরং সংযোগ ও প্রশমনের নীতি; তেমনি বায়ুতত্ত্ব মানে সেই চেতনা-গতি যা জীবনের মূল স্পন্দন।
তাই, “বায়ুতত্ত্বই জীবনের ধারক” মানে এই—যে সূক্ষ্ম চেতনা বা প্রাণশক্তি বায়ুর রূপে প্রবাহিত, সেটিই জীবনকে ধারণ করে। বায়ু কেবল বাহ্যিক উপাদান নয়; এটি জীবনের গতি, চেতনার স্পন্দন এবং ব্রহ্মের নিঃশ্বাস—যার ছন্দেই সমগ্র বিশ্বে জীবন চলমান।
দর্শনের দৃষ্টিতে আকাশ হলো সম্ভাবনার স্থান, আর বায়ু সেই সম্ভাবনাকে ক্রিয়ায় রূপ দেয়। যেমন শূন্য-স্থান (পাত্র বা ধারক) গানের স্থান দেয়, কিন্তু শব্দ জন্মায় কণ্ঠের বায়ুপ্রবাহে—তেমনি আকাশ নিস্তরঙ্গ অস্তিত্ব, আর বায়ু তার মধ্যে চেতনার আন্দোলন। আকাশ ধারণক্ষম, বায়ু কর্মক্ষম; আকাশ নিস্পন্দ, বায়ু স্পন্দমান; আকাশ শ্রবণের ভিত্তি, বায়ু স্পর্শের আধার।
আকাশ হলো সর্বব্যাপী নীরব উপস্থিতি, যা সব কিছুকে ধারণ করে; বায়ু সেই উপস্থিতির প্রথম আন্দোলন—চেতনার স্পন্দন, যা জীবন ও কার্যকলাপের সূচনা করে।
বেদান্ত বলে—এই পাঁচ মহাভূতই স্থূল জগতের উপাদান, কিন্তু আত্মা এদের ঊর্ধ্বে। আত্মা কোনো উপাদান নয়; সে চিরন্তন, নিরাকার ও সর্বব্যাপী চৈতন্য। কঠ উপনিষদে (২.১৮) বলা হয়েছে—“নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ”—অর্থাৎ, আত্মা কোনো ভৌত উপাদানের প্রভাবে পরিবর্তিত হয় না। উপনিষদ আবার বলে—“ন তৎ তেজো, ন বায়ু, ন আকাশঃ”—আত্মা তেজ, বায়ু বা আকাশ নয়; সে এদের আলোকদাতা, এদের ভিত্তি, কিন্তু এদের দ্বারা স্পৃষ্ট নয়।
পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পাঁচ মহাভূতই সমস্ত সৃষ্টির ধারা ও দেহের গঠনমূল। এই উপাদানগুলির মধ্যেই সমগ্র বিশ্ব বিকশিত হয়েছে, কিন্তু আত্মা এই পাঁচ উপাদানের ঊর্ধ্বে থেকে তাদের প্রত্যক্ষ করে, তবু কোনো কিছুর দ্বারা স্পৃষ্ট হয় না। আত্মাই সেই চৈতন্য, যার আলোকেই এই পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ প্রতিফলিত হয়।
‘পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ’ শব্দের অর্থই বলছে—পাঁচটি ভূত বা উপাদান (পঞ্চ মহাভূত) থেকে উদ্ভূত প্রপঞ্চ, অর্থাৎ জগৎ বা দৃশ্যমান বিশ্বব্যবস্থা। “ভূত” মানে এখানে উপাদান বা element; আর “প্রপঞ্চ” মানে প্রকাশিত বহুত্ব—সেই বহিরঙ্গিক জগৎ, যেখানে এক ব্রহ্মচেতনা নানা রূপে প্রতিফলিত হয়।
বেদান্ত বলে—ব্রহ্ম একমাত্র সত্য, কিন্তু সেই ব্রহ্মের মধ্যেই মায়া বা অবিদ্যার প্রভাবে সৃষ্টি ঘটে। এই সৃষ্টি চৈতন্যের বিকাশ নয়, বরং প্রতিফলন; আর সেই প্রতিফলনেই ধীরে ধীরে পাঁচটি মূল তত্ত্বের উদ্ভব—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী। এগুলির থেকেই গঠিত সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ—দেহ, প্রাণ, মন, প্রকৃতি, পদার্থ, গ্রহ, তারকা, প্রাণী—সবই এই পঞ্চভূতের সমন্বয়ে তৈরি। এই প্রকাশই পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ—পাঁচ তত্ত্বের পরিণতিতে গঠিত বিশ্বপ্রপঞ্চ।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.১.১-২) এই প্রক্রিয়াকে বোঝাতে বলে—“আকাশাদ্ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী।” অর্থাৎ, আকাশ থেকে বায়ু, বায়ু থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে জল, জল থেকে পৃথিবী। এখানে ব্রহ্ম বা চেতনা থেকেই আকাশের উদ্ভব, আকাশ থেকে গতি (বায়ু), গতি থেকে তাপ (অগ্নি), তাপ থেকে তরলতা (জল), আর তরল থেকে স্থিতি (পৃথিবী)।
এই ক্রমে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল, ধারণক্ষম থেকে দৃঢ়, সম্ভাবনা থেকে প্রকাশে রূপান্তর ঘটে। আকাশ ধারণ করে, বায়ু চালায়, অগ্নি রূপান্তর করে, জল সংযোজিত করে, পৃথিবী স্থির করে—এভাবেই সৃষ্টি সম্পূর্ণতা পায়। এই জগৎ, দেহ, ইন্দ্রিয়, মন—সবই সেই পঞ্চতত্ত্বের প্রকাশ।
ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-তে শঙ্করাচার্য বলেন—“পঞ্চভূতানাম্ বিকারেণ ইদং শরীরাদি জগৎ উৎপন্নম্”—অর্থাৎ, পাঁচ ভূতের বিকারে থেকেই শরীর ও জগতের উৎপত্তি। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেন—এটি ব্রহ্মের সত্য পরিবর্তন নয়; এটি কেবল মায়িক প্রতিফলন, যেমন আয়নায় প্রতিবিম্ব।
দার্শনিক দিক থেকে, পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ মানে চৈতন্যের প্রথম পর্যায়ে সীমাবদ্ধতার প্রকাশ। ব্রহ্ম যখন নিজের সীমাহীন স্বরূপে থাকে, তখন কোনো বহুত্ব নেই; কিন্তু অবিদ্যার আচ্ছাদনে সেই চৈতন্য যখন নিজেকে “দ্রষ্টা”, “জগৎ” ও “দেহ” বলে ভাবতে শুরু করে, তখন এই পাঁচ উপাদান ক্রমে জাগ্রত হয় এবং বহুরূপে বিশ্ব প্রকাশ পায়।
পঞ্চভূত-প্রপঞ্চ মানে শুধু পাঁচটি উপাদানের জগৎ নয়—এটি সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একক চেতনা নিজেই বহুরূপে প্রসারিত হয়। আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত এই ধারা সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের যাত্রা, আর আত্মজ্ঞান হলো তার বিপরীত পথ—স্থূল থেকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম থেকে চেতনায়, আর চেতনা থেকে আবার নিজের স্বরূপে ফিরে যাওয়া।