অবিদ্যা-বিদ্যা: ৬



এই আত্মা সমস্ত উপমা, চিহ্ন, ধারণা ও ভাষার সীমার বাইরে। তাকে কোনো বস্তুর মতো “জানা” যায় না; বরং সে-ই জানার মূল চেতনা। তাই বলা যায়—তুরীয় আত্মা হলো অভিজ্ঞতার নিখাদ কেন্দ্র, যেখানে জানা, জানার প্রক্রিয়া ও জানার বস্তু—এই তিনের কোনো পৃথকতা থাকে না, কেবল এক অখণ্ড চেতনা স্থিত থাকে।

মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম মন্ত্রে আত্মার চতুর্থ অবস্থার বর্ণনায়, “একাত্মপ্রত্যয়সারং”-এর অর্থ—যেখানে কেবল একত্ববোধ থাকে। সেখানে দ্বৈততা বা “আমি ও অন্য”—এই বিভাজন নেই। আত্মা কেবল নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে—“আমি আছি” এই নিখাদ চৈতন্যই সেখানে একমাত্র সত্য। এই অবস্থায় সমস্ত প্রপঞ্চ, অর্থাৎ নাম-রূপ, সৃষ্টি ও বিভেদ সম্পূর্ণ লীন হয়ে যায়; একে বলা হয়েছে “প্রপঞ্চোপশম”—প্রপঞ্চ-উপশম—যেখানে সমস্ত প্রকাশ শান্ত হয়ে যায়।

মন্ত্রটি অনুসারে, এই চেতনা “শান্তং”—কারণ সেখানে কোনো তরঙ্গ বা কামনা নেই; “শিবং”—কারণ সেটি পরম কল্যাণ ও আনন্দ; “অদ্বৈতং”—কারণ সেখানে কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই, সব এক অখণ্ড চৈতন্যে মিলিত। এই অবস্থাকেই উপনিষদ বলে “স ঐষ তুরীয়ঃ”—এটাই চতুর্থ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সব অবস্থার ভিত্তি, কারণ জাগ্রত, স্বপ্ন ও নিদ্রা—সবই এই তুরীয় চৈতন্যে উদ্ভূত ও তাতে লীন।

তুরীয় অবস্থায় জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—এই তিনটির পার্থক্য সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। সাধারণ অবস্থায় আমরা ভাবি, কেউ জানছে (জ্ঞাতা), কিছু জানা হচ্ছে (জ্ঞেয়), আর জানার প্রক্রিয়া (জ্ঞান) আলাদা। কিন্তু তুরীয় অবস্থায় এই ত্রিত্ব একত্রে মিলিত হয়—সেখানে জানার আর জানার বস্তু বলে কিছু থাকে না; থাকে কেবল নিখাদ চেতনা, যা সকল জানার ঊর্দ্ধে।

এখানে আত্মা আর কোনো কিছুর সাক্ষী নয়, কারণ সাক্ষী হওয়ার জন্যও “অন্য” কিছু থাকা প্রয়োজন। তুরীয়ে সেই অন্যতা নেই। আত্মা তখন নিজের স্বরূপে স্থিত—যেমন সূর্য নিজের আলোয় স্বয়ংপ্রকাশিত, তেমনি আত্মা নিজের দীপ্তিতেই প্রকাশমান।

এই অবস্থা কোনো অভিজ্ঞতার নয়, কারণ অভিজ্ঞতা মানেই দ্বৈততা—অভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতার বিষয়। তুরীয় অবস্থা সেই দ্বৈততারও অতীত। এটি অস্তিত্বের অবস্থা—যেখানে আত্মা নিজের অস্তিত্বের মধ্যেই পূর্ণ, আর কিছু প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

এখানে চেতনা তার চরম বিশুদ্ধ রূপে প্রকাশিত হয়—চিরশান্ত, কারণ কোনো তরঙ্গ বা পরিবর্তন নেই; চিরশুভ, কারণ কোনো বিরোধ বা দুঃখ নেই; অদ্বিতীয়, কারণ সেখানে দ্বিতীয় কিছুই নেই।

এই অবস্থাতেই আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে—জানে যে, সে ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নয়। এই উপলব্ধিই “অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি ব্রহ্মই—এই মহাবাক্যের জীবন্ত প্রতিফলন।

আত্মার চার অবস্থার মধ্যে প্রথম তিনটি—বৈশ্বানর, তৈজস ও প্রাজ্ঞ—মায়ার পরিসরে পড়ে, কারণ সেখানে চেতনা কিছু-না-কিছু অভিজ্ঞতালাভ করছে, অর্থাৎ দ্বৈততা আছে। কিন্তু তুরীয় অবস্থায় পৌঁছলে সব অভিজ্ঞতা ও দ্বৈততা লীন হয়, আর আত্মা নিজ স্বরূপে জাজ্বল্যমান হয়—যা ব্রহ্মজ্ঞানের চূড়ান্ত উপলব্ধি।

মানুষ স্বপ্ন দেখে আত্মার দ্বিতীয় অবস্থায়, অর্থাৎ তৈজস অবস্থায়—যাকে স্বপ্নাবস্থা (সপ্ন-অবস্থা) বলা হয়। মাণ্ডূক্য উপনিষদে এই অবস্থার বর্ণনা রয়েছে—“স্বপ্নস্থানো’ন্তঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ সূক্ষ্মভুক্ তৈজসো দ্বিতীয়ঃ পাদঃ।” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ, মন্ত্র ৪) অর্থাৎ—“দ্বিতীয় অবস্থা হলো স্বপ্ন, যেখানে আত্মা অন্তর্মুখী জ্ঞানসম্পন্ন (অন্তঃপ্রজ্ঞ), সূক্ষ্ম বস্তুসমূহ ভোগ করে, এবং তার নাম হলো তৈজস।”

এই অবস্থায় বাহ্য ইন্দ্রিয়গুলো নিস্ক্রিয় থাকে, জাগতিক দেহ স্থির থাকে, কিন্তু মন নিজেই সক্রিয় হয়। মন নিজের ভিতরে জমে-থাকা সংস্কার, ইচ্ছা ও স্মৃতি থেকে এক সম্পূর্ণ জগৎ সৃষ্টি করে—এটাই স্বপ্ন। অতএব, স্বপ্নে-দেখা দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, ভাব—সবই মনের সূক্ষ্ম সৃষ্টির ফল, বাহ্য বাস্তবতার নয়।

বৈশ্বানর বা জাগ্রত অবস্থায় আত্মা স্থূল দেহ ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জগৎকে অনুভব করে, তৈজস বা স্বপ্নাবস্থায় আত্মা সূক্ষ্ম দেহের মাধ্যমে মনের ভেতরের জগৎকে অনুভব করে, প্রাজ্ঞ বা সুষুপ্তি অবস্থায় আত্মা সব অভিজ্ঞতা থেকে লীন হয়, আর তুরীয় অবস্থায় সে তিন অবস্থারও সাক্ষী হয়ে থাকে। স্বপ্ন দেখা হয় তৈজস অবস্থায়—যেখানে বাহ্য জগৎ নিস্তব্ধ, কিন্তু চেতনা নিজের অন্তঃপ্রকাশে আলোয় ভরপুর, তাই এই অবস্থার নামই রাখা হয়েছে “তৈজস”—অর্থাৎ “আলোকময় চেতনা।”

বেদান্তে ‘সাক্ষী’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও, তা আক্ষরিক অর্থে কোনো “অন্য পর্যবেক্ষক সত্তা” বোঝায় না—এটি কেবল ভাষার সীমার মধ্যে আত্মার চৈতন্যস্বরূপ অনিত্যহীন উপস্থিতিকে বোঝানোর একটি উপায়।

যখন বলা হয় “তুরীয় অবস্থায় আত্মা বাকি তিন অবস্থার সাক্ষী”, এর অর্থ এ নয় যে, কোনো পৃথক সত্তা বসে আছে এবং জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিনটি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। বরং এর অর্থ হলো—এই তিন অবস্থাই চৈতন্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, আর চৈতন্য নিজে কোনো পরিবর্তনের অংশ নয়।

শঙ্করাচার্য আত্মবোধে বলেছেন—“দ্রষ্টা শুদ্ধো নাভিসংবদ্ধঃ দ্রশ্যৈঃ স্বপদবিব্রমৈঃ।” (আত্মবোধ, শ্লোক ১৯) অর্থাৎ—“দ্রষ্টা (আত্মা) শুদ্ধ ও নির্লিপ্ত; দৃশ্যমান জগতের বিভ্রমের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।” এখানে ‘দ্রষ্টা’ মানে এমন চেতনা, যা দেখা বা পর্যবেক্ষণের কোনো কর্ম করে না, বরং যার উপস্থিতিতেই দেখা সম্ভব হয়।

এই ধারণাটির ভিত্তি বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৩.২৩) স্পষ্টভাবে বলা আছে—“ন দ্রষ্টৃবেদিতব্যমস্তি দ্রষ্টা।” অর্থাৎ—“দ্রষ্টা নিজে কখনও দেখার বস্তু হয় না (তাকে দেখা যায় না), কারণ সে দেখার কার্যের ঊর্ধ্বে।” এখানে বোঝানো হয়েছে যে, আত্মা কোনো কার্যের অংশ নয়; সে নিজে কার্যের কারণও নয়, সে কেবলই নিখাদ উপস্থিতি।

একইভাবে কঠ উপনিষদে (২.২.৯) বলা হয়েছে—“ন তত্র সূর্যো ভাতি, ন চন্দ্রতারকং, ন ইমা বিদ্যুতো ভান্তি, কূতো’য়মগ্নিঃ। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং, তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।” অর্থাৎ—“সেখানে সূর্য, চন্দ্র, তারা বা আগুন কিছুই আলো দেয় না; কেবল তার (আত্মার) আলোকেই সব আলোকিত।” এখানে ‘ভান্ত’ বা ‘প্রকাশিত’ হওয়া মানে—আত্মা কিছু দেখে না, বরং তার স্বপ্রকাশেই সব কিছু দেখা যায়।

তাই, ‘সাক্ষী’ শব্দটি কোনো সম্পর্কযুক্ত পর্যবেক্ষক নয়, বরং নির্বিকার চৈতন্যের নাম—যে নিজে কিছু দেখে না, কিন্তু যার উপস্থিতিতে দেখা, জানা ও ভাবনা সম্ভব হয়। যেমন সূর্য নিজে কিছু দেখে না, কিন্তু তার আলোয় সব দেখা যায়; তেমনি আত্মা নিজে কোনো কর্ম করে না, তবু তার উপস্থিতিতেই সব কর্ম ঘটে।

এই অর্থেই মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৭) বলে—“অদৃশ্যং, অব্যবহার্যং, অগ্রাহ্যং, আলক্ষণং, অচিন্ত্যং, অব্যপদেশ্যং, একাত্মপ্রত্যয়সারং, প্রপঞ্চোপশমং, শান্তং, শিবং, অদ্বৈতং—স ঐষ তুরীয়ঃ।” অর্থাৎ—তুরীয় আত্মা এমন এক চেতনা, যা কোনো জানার, দেখার বা ভাবার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নয়; সে নিজেই জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের অতীত চিরনির্মল চৈতন্য।

‘সাক্ষী’ বলা হয় শুধু ইঙ্গিতের জন্য, প্রকৃত অর্থে আত্মা সেখানে আর “সাক্ষী” নয়—কারণ তুরীয় অবস্থায় সাক্ষী ও দৃশ্য—উভয়ই মিলে যায় এক চিরপ্রকাশমান, অবিভক্ত, অদ্বিতীয় চেতনার মধ্যে।

বেদান্তে “প্রাজ্ঞ” আত্মার তৃতীয় অবস্থা—যা সুষুপ্তি (গভীর নিদ্রা) অবস্থায় প্রকাশিত চেতনার রূপ। এই অবস্থায় মানুষ না জাগ্রত, না স্বপ্নদর্শী; বরং সমস্ত জ্ঞান, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি—সব নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়।

মাণ্ডূক্য উপনিষদে (মন্ত্র ৫) বলা হয়েছে—“যত্র সুপ্তো না কঞ্চন কামং কাময়তে, না কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুপ্তম্।” অর্থাৎ, যে-অবস্থায় কেউ কোনো কামনা করে না, কোনো স্বপ্নও দেখে না, সেটিই সুষুপ্তি। এই অবস্থায় আত্মা “প্রাজ্ঞ” নামে পরিচিত—চৈতন্য তখন লীন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিলীন নয়; কারণ অভিজ্ঞতার অভাব থাকা সত্ত্বেও চেতনার অস্তিত্ব থাকে, যিনি পরে জাগরণের পর বলেন—“আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম, কিছু জানতাম না।” চেতনা কখনও ঘুমোয় না, অনুপস্থিত থাকে না, সাক্ষী হিসেবে সবসময়ই বিরাজমান—যদি থাকত, তবে এটা জানতেই পারত না যে, স্থূল শরীর ঘুমিয়ে ছিল।

সুষুপ্তি বা প্রাজ্ঞ অবস্থায় চেতনা লীন থাকে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিলীন হয় না—এর মানে হলো, আত্মা তখন জ্ঞানের প্রকাশ থেকে বিরত থাকে, কিন্তু অস্তিত্বে অব্যাহত থাকে। এই অবস্থা একেবারেই নিদ্রার মতো, যেখানে জাগ্রতের কর্ম ও স্বপ্নের ভাবনা—সব নিস্তরঙ্গ। মানুষ ঘুম থেকে উঠে বলে—“আমি কিছু জানতাম না, কিন্তু খুব ভালো ঘুমিয়েছিলাম।” এই বাক্যই প্রমাণ দেয় যে, সুষুপ্তিতে চৈতন্য নিভে যায়নি, কেবল প্রকাশ বন্ধ ছিল।

“আমি কিছু জানতাম না”—এতে বোঝা যায় যে, অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা ছিল, কারণ জ্ঞান প্রকাশ পায়নি; কিন্তু “আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম”—এতে বোঝা যায় যে, চেতনা ছিল, কারণ অচেতনে কেউ সুখের স্মৃতি রাখতে পারে না। অর্থাৎ, আত্মা তখন উপস্থিত ছিল, কিন্তু কার্যরূপে প্রকাশিত ছিল না।

সুষুপ্তি অবস্থা নিয়ে উপনিষদে বলা হয়েছে—“যত্র সুপ্তো না কঞ্চন কামং কাময়তে, না কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুপ্তম্।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৩.১৯)। এখানে দুটি শব্দ—“না পশ্যতি” এবং “সুপ্তো”—চৈতন্যের প্রকৃতি বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “না পশ্যতি” মানে, ঘুমন্ত অবস্থায় কোনো কিছু দেখা যায় না, অর্থাৎ জ্ঞান প্রকাশিত হয় না। এখানে “দেখা” বলতে কেবল চোখের দেখা নয়, বরং সমস্ত প্রকার জ্ঞানের প্রকাশ—চিন্তা, অনুভব, ইচ্ছা, জ্ঞানার্জন—সব বোঝানো হয়েছে। সুষুপ্তিতে মন, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি নিস্ক্রিয় হয়ে যায়, ফলে চেতনা কিছুই “জানে” না। এটি বোঝায় যে, আত্মার জ্ঞানশক্তি তখন অপ্রকাশিত—জ্ঞান নেই, কিন্তু জ্ঞানের আধার আছে।

অন্যদিকে “সুপ্তো” শব্দটি জানায় যে, একজন ঘুমন্ত “সত্তা” তখনও আছে। যদি চেতনা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেত, তবে ঘুম থেকে জেগে কেউ বলতে পারত না—“আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম” বা “আমি কিছু জানতাম না।” জাগরণের পর এই স্মৃতি নিজেই প্রমাণ করে যে, ঘুমন্ত অবস্থায়ও আত্মা ছিল—সে অজ্ঞানতাকেও প্রত্যক্ষ করেছিল, কিন্তু কোনো প্রকাশ ঘটেনি।

বেদান্তে এই আত্মাকে বলা হয় “সাক্ষী চৈতন্য”—যিনি সকল অবস্থায় উপস্থিত থাকেন, কিন্তু কোনো অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হন না। যেমন সূর্য মেঘে ঢাকা থাকলে তার আলো দেখা যায় না, কিন্তু সূর্য কোথাও যায় না, তেমনি সুষুপ্তিতে অবিদ্যা আত্মার দীপ্তিকে আড়াল করে রাখে, অথচ আত্মা থেকে যায় অবিকৃত ও অচল।

“না পশ্যতি” মানে—জ্ঞানের প্রকাশ নেই; “সুপ্তো” মানে—সত্তা বা আত্মা আছে। চেতনা তখন লীন, অর্থাৎ কার্যরূপে অচল, কিন্তু বিলীন নয়, অর্থাৎ অস্তিত্বে অক্ষয়। যেমন ঢেউ থেমে গেলেও সাগর থাকে, তেমনি জ্ঞানের তরঙ্গ থেমে গেলেও চেতনা থাকে নিস্তরঙ্গ শান্তিতে। সুষুপ্তি তাই নিদ্রিত চৈতন্যের অবস্থা—যেখানে জ্ঞান অপ্রকাশিত, কিন্তু আত্মা অবিকৃতভাবে বিদ্যমান।

শঙ্করাচার্য বলেন—“অবিদ্যা–উপাধিনিমিত একীবূতাভাসঃ প্রাজ্ঞঃ” (মাণ্ডূক্য-ভাষ্য, মন্ত্র ৫)। অর্থাৎ, প্রাজ্ঞ সেই আত্মা, যিনি অবিদ্যার আচ্ছাদনে একীভূত প্রতীয়মান। তাঁর চেতনা নিস্তরঙ্গ, অবিদ্যার আবরণে লুকানো, কিন্তু মুছে যায়নি।

এ অবস্থাকে বোঝাতে শাস্ত্র প্রায়ই সূর্য ও মেঘের উদাহরণ দেয়। যেমন মেঘ সূর্যের আলো আড়াল করে রাখে, কিন্তু সূর্য কোথাও যায় না—তেমনি সুষুপ্তিতে অবিদ্যা আত্মার দীপ্তি ঢেকে রাখে, অথচ আত্মা থাকে, অচল ও শুদ্ধ।

“চৈতন্য তখন লীন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিলীন নয়” কথাটির অর্থ হলো—সুষুপ্তিতে আত্মা কার্যত অপ্রকাশিত, কিন্তু অস্তিত্বে অমর। তার জ্ঞান প্রকাশিত নয়, কিন্তু তার সত্তা চিরস্থায়ী। তুরীয় অবস্থায় অবিদ্যার সেই পর্দা সরে গেলে, এই লীন চেতনা আবার নিজের পূর্ণ দীপ্তিতে জেগে ওঠে—তখন আত্মা জানে, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি-ই সেই চিরপ্রকাশমান ব্রহ্ম।

‘প্রাজ্ঞ’ শব্দটি এসেছে “প্রা + জ্ঞা” থেকে—যেখানে “জ্ঞা” মানে জ্ঞান, আর “প্রা” মানে পূর্ণতা বা পরিপূর্ণ অবস্থা। তাই ‘প্রাজ্ঞ’ অর্থ “যিনি জ্ঞানপূর্ণ”। তবে এই পূর্ণতা জাগ্রতের সচেতন জ্ঞানের মতো নয়; বরং এটি অবিদ্যা-আবৃত, নিস্পন্দ, সম্ভাবনাময় চেতনা—যেখানে সমস্ত জ্ঞানের বীজ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে।