অবিদ্যা-বিদ্যা: ৫



অগ্নির প্রধান গুণ রূপ। এটি আলোক, তাপ ও রূপান্তরের প্রতীক। দেহে অগ্নিতত্ত্ব প্রকাশিত হয় পাচনশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও উষ্ণতায়। অগ্নিই রূপান্তরের শক্তি, যা খাদ্যকে শক্তিতে পরিণত করে এবং অন্ধকারকে আলোকিত করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৫.৭.১) বলা হয়েছে—“অগ্নিরূপং বৈ দেবতা”—অগ্নিই সেই শক্তি, যা রূপ ধারণ করে ও পরিবর্তনের প্রেরণা দেয়। গীতায় (১৫.১৪) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—“অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ, প্রাণাপানসমায়ুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্”—“আমি বৈশ্বানর অগ্নিরূপে দেহে অবস্থান করি, এবং প্রাণ ও আপানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে খাদ্য পরিপাক করি।” অগ্নি তাই দেহ ও জগতের উভয় স্তরে রূপান্তরমূলক চেতনার প্রতীক।

বৈশ্বানর অগ্নি (Vaiśvānara Agni) বেদান্ত ও উপনিষদীয় দর্শনে এক অত্যন্ত গভীর প্রতীক—এটি একই সঙ্গে শরীরস্থ জৈব অগ্নি, বিশ্বব্যাপী শক্তি এবং চেতনার ঐক্যরূপ আগ্নি। “বৈশ্বানর” শব্দটি এসেছে “বিশ্ব” (সকল) এবং “নার” (মানব, প্রাণী বা জাগতিক সত্তা) থেকে; অর্থাৎ “যে-অগ্নি সকল জীবের মধ্যে ব্যাপ্ত”, সে-ই বৈশ্বানর।

উপনিষদে বৈশ্বানরকে তিনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—(১) শরীরস্থ পরিপাক-অগ্নি, (২) বিশ্বরূপ ঈশ্বর, এবং (৩) সর্বজীবের মধ্যে একীভূত চেতনা।

প্রথমত, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেন—“অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। প্রাণাপানসমায়ুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।” (ভগবদ্গীতা, ১৫.১৪) অর্থাৎ, “আমি সেই বৈশ্বানর অগ্নি, যা প্রাণীদের দেহে অবস্থান করে; প্রাণ ও আপান বায়ুর সহিত মিলিত হয়ে চার প্রকার খাদ্য হজম করি।” এখানে ‘বৈশ্বানর’ মানে শরীরের ভিতরে থাকা সেই জীবনীশক্তি, যা খাদ্যকে রস, রক্ত, শক্তি ও বুদ্ধিতে রূপান্তরিত করে। এটি কেবল শারীরিক আগুন নয়, বরং জীবনের চলমানতা রক্ষা করা এক সূক্ষ্ম শক্তি।

দ্বিতীয়ত, ছান্দোগ্য উপনিষদে (৫.১৮.১) বৈশ্বানরকে বলা হয়েছে “বিশ্বরূপ ঈশ্বর”—“যো’য়ং বৈশ্বানরঃ পুমান্, তস্যায়ম্ আত্মা শরীরম্।” অর্থাৎ, “এই বৈশ্বানরই বিশ্বমানব, এবং এই বিশ্বই তাঁর শরীর।” এখানে বৈশ্বানরকে কেবল শরীরের আগুন নয়, বরং মহাকায় ব্রহ্মরূপ শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে—যিনি সমস্ত প্রাণী, উপাদান ও শক্তির মধ্য দিয়ে বিরাজমান। সূর্যতেজ, জ্বালানিশক্তি, পরিপাক, এমনকি চিন্তার উষ্ণতাও সেই এক অগ্নির বিভিন্ন রূপ।

তৃতীয়ত, বেদান্তের ব্যাখ্যায় বৈশ্বানর হলো চৈতন্যের সেই স্তর, যা জাগ্রত অবস্থায় অভিজ্ঞ হয়। আত্মার চার অবস্থার (বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ ও তুরীয়) মধ্যে বৈশ্বানর হলো প্রথম—জাগ্রত অবস্থা, যেখানে চেতনা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্থূল জগতকে অনুভব করে। মাণ্ডূক্য উপনিষদ (১–৩) বলে—“জাগরিতস্থানো বহিষ্প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভুক্ বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ।” অর্থাৎ, জাগ্রত অবস্থায় যে-আত্মা বাহ্যজগত অভিজ্ঞতা করে, তার নাম বৈশ্বানর। সে “স্থূলভুক্”—স্থূল দেহ ও জগতের ভোক্তা।

আত্মার চার অবস্থার ধারণাটি মাণ্ডূক্য উপনিষদে সর্বপ্রথম বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—আত্মা (বা ব্রহ্ম) একটাই, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা বা প্রকাশ চারভাবে অনুভূত হয়: বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ ও তুরীয়। এই চার অবস্থা আসলে চেতনার চার স্তর—যার মাধ্যমে একই আত্মা জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তার অতীত পরমাবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে।

প্রথম অবস্থার নাম বৈশ্বানর। এটি হলো জাগ্রত অবস্থা, যেখানে চেতনা বাহিরমুখী। এখানে আত্মা ইন্দ্রিয় ও মনকে ব্যবহার করে স্থূল জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করে। মানুষ যখন দেখে, শোনে, স্পর্শ করে, ভাবে—এই সমস্ত কর্ম বৈশ্বানর অবস্থার অন্তর্গত। মাণ্ডূক্য উপনিষদে (১-৩) বলা হয়েছে—“জাগরিতস্থানো বহিষ্প্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভুক্ বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ।” অর্থাৎ, জাগ্রত অবস্থায় যে-আত্মা বাহ্যজগৎ অভিজ্ঞতা করে (‘সাক্ষী থাকা’ অর্থে), সে স্থূল দেহের ভোক্তা—তাকে বৈশ্বানর বলে।

দ্বিতীয় অবস্থা তৈজস, যা হলো স্বপ্নাবস্থা। এখানে চেতনা অন্তর্মুখী; বাহ্য ইন্দ্রিয় নিস্তব্ধ, কিন্তু মন নিজের সংস্কার থেকে জগৎ সৃষ্টি করে। তৈজস মানে আলোকিত, কারণ মন এখানে নিজের আলোয় চলাফেরা করে। স্বপ্নে-দেখা রূপ, শব্দ, ভাব—সবই মনের অভ্যন্তরীণ সৃজন, যা সূক্ষ্ম জগতের অভিজ্ঞতা। তৈজস সূক্ষ্ম শরীরের ভোক্তা—“স্থূলভুক” নয়, “সূক্ষ্মভুক।”

তৃতীয় অবস্থা প্রাজ্ঞ, অর্থাৎ সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থা। এখানে চেতনা সম্পূর্ণ অন্তর্মুখী, সমস্ত অভিজ্ঞতা লীন। কেউ জানে না, কিন্তু অনুভব করে একপ্রকার নিস্তব্ধ আনন্দ—“আমি কিছু জানতাম না, কিন্তু ভালো ছিলাম।” এই অবস্থায় মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়—সবই অবিদ্যায় লীন, কেবল আত্মা নিজের অচেতন শান্তিতে স্থিত। মাণ্ডূক্য উপনিষদে বলা হয়েছে—“যত্র সুপ্তো না কঞ্চন কামং কাময়তে, না কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি, তৎ সুপ্তম্।” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ, মন্ত্র ৫)—যেখানে কেউ কিছু কামনা করে না, কিছু দেখে না, সেটিই গভীর নিদ্রা। এই অবস্থার আত্মাকে বলে প্রাজ্ঞ, সে কারণ শরীরের মধ্যে থাকে।

চতুর্থ অবস্থা তুরীয়, যার অর্থ “চতুর্থ”, কিন্তু এটি আসলে চেতনার অতীন্দ্রিয় অবস্থা—সব অবস্থারও ঊর্ধ্বে। তুরীয় অবস্থায় আত্মা না জাগ্রত, না স্বপ্নমগ্ন, না নিদ্রিত—তিন অবস্থার সাক্ষী হিসেবে স্থিত। এটি না বহির্মুখী, না অন্তর্মুখী, না উভয়মুখী; এটি চিরশুদ্ধ, চিরসাক্ষী, নির্গুণ, অদ্বিতীয়।

মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে আত্মার চতুর্থ অবস্থা—তুরীয়, এমন এক চেতনা, যা না জাগ্রত, না স্বপ্ন, না নিদ্রা—বরং এই তিন অবস্থারও ঊর্ধ্বে। মন্ত্রে বলা হয়েছে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বহিঃপ্রজ্ঞং, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞং, অদৃশ্যং, অব্যবহার্যং, অগ্রাহ্যং, আলক্ষণং, অচিন্ত্যং, অব্যপদেশ্যং, একাত্মপ্রত্যয়সারং, প্রপঞ্চোপশমং, শান্তং, শিবং, অদ্বৈতং—স ঐষ তুরীয়ঃ।” এর অর্থ হলো—এই তুরীয় আত্মা কোনো সীমিত জ্ঞানের অবস্থা নয়। এটি না অন্তর্মুখী জ্ঞান, যেমন স্বপ্নাবস্থায় দেখা যায়; না বহির্মুখী জ্ঞান, যেমন জাগ্রত অবস্থায়; না উভয়মুখী। অর্থাৎ এটি জানার কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে না—না দেখা, না শোনা, না চিন্তা করা—কিছুই সেখানে প্রযোজ্য নয়।

তুরীয় আত্মা অদৃশ্য, কারণ ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে দেখা যায় না। চোখ, কান, স্পর্শ, গন্ধ বা স্বাদ—এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের কোনোটি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যেমন আলো দেখা যায়, কিন্তু যে-চোখ এই আলো দেখে, তাকেই দেখা যায় না; তেমনি আত্মা সব কিছুকে দেখায়, কিন্তু নিজে দৃশ্য নয়।

এটি অব্যবহার্য, কারণ তা কোনো প্রয়োগ বা ক্রিয়ার বস্তু নয়। আমরা যেভাবে কোনো জিনিস ব্যবহার করি—দেখি, ধরি, ভোগ করি—তুরীয় আত্মা তেমন কোনো “ব্যবহারযোগ্য বস্তু” নয়। সে নিজে কর্মের অতীত; সে সকল ক্রিয়ার সাক্ষী।

এটি অগ্রাহ্য, কারণ তাকে ধরা, ধরতে পারা, বা উপলব্ধ করা যায় না। কোনো যন্ত্র, বিজ্ঞান, বা মানসিক ক্রিয়ার দ্বারা আত্মাকে ধরা যায় না; কারণ সে নিজেই সমস্ত উপলব্ধির পটভূমি।

এটি আলক্ষণ, কারণ তার কোনো চিহ্ন, রূপ বা লক্ষণ নেই। আমরা যেভাবে কোনো বস্তুকে তার গুণে চিনে নিই, আত্মার এমন কোনো চিহ্ন নেই যা অন্যের থেকে আলাদা করে চেনা যায়। সে নির্গুণ, নিরাকার—তবে সব গুণ ও আকারের কারণ।

এটি অচিন্ত্য, কারণ মন তাকে ভাবতে বা ধারণ করতে পারে না। মন যতই ভাবুক, আত্মা সেই ভাবনার বাইরে, কারণ মন নিজেই আত্মার দ্বারা আলোকিত। যেভাবে প্রদীপের আলোকে সব দেখা যায়, কিন্তু আলোকে আরেক আলো দিয়ে দেখা যায় না, তেমনি আত্মাকে মন দিয়ে চিন্তা করা যায় না।

এটি অব্যপদেশ্য, কারণ ভাষা তাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। অব্যপদেশ্য শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “অ” + “ব্যপদেশ্য” থেকে। এখানে—“অ” মানে “নয়” বা “অভাব”; “ব্যপদেশ্য” এসেছে ধাতু “পদিশ্” (কথা বলা, বর্ণনা করা, নাম দেওয়া) থেকে, যার অর্থ “যাকে বলা যায়”, “যাকে নাম বা উপাধি দেওয়া যায়”। তাই, “অব্যপদেশ্য” অর্থ—“যাকে বলা যায় না”, “যার কোনো নাম বা বর্ণনা দেওয়া যায় না”। শব্দের সীমা যেখানে শেষ, আত্মা সেখান থেকে শুরু। বলা যায় না “এ রকম”, বা “ও রকম”—সব বর্ণনা তার তুলনায় অসম্পূর্ণ।

তুরীয় আত্মার চারটি বৈশিষ্ট্য—অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, অচিন্ত্য ও অব্যপদেশ্য—উপনিষদসমূহে নানা স্থানে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তুরীয় আত্মা অদৃশ্য, কারণ তাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা যায় না। কঠ উপনিষদে (১.৩.১২) বলা হয়েছে—“ন তত্র চক্ষুর্ গচ্ছতি, ন বাচো, ন মনঃ।” অর্থাৎ “সেখানে চোখ পৌঁছায় না, ভাষা নয়, মনও নয়।” এই মন্ত্র বোঝায় যে, আত্মা কোনো দৃশ্য বস্তু নয়; ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। সে দৃশ্য নয়, বরং সমস্ত দৃশ্যের আলোকদাতা।

তুরীয় আত্মা অগ্রাহ্য, কারণ তাকে কোনো উপায়ে ধরা, স্পর্শ করা বা ধারণ করা যায় না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৩.১৫) বলা হয়েছে—“অসঙ্গো হ্যায়ং পুরুষঃ।” অর্থাৎ “এই আত্মা অসঙ্গ, সে কখনও কিছুতে জড়িত নয়।” আত্মা সকল কর্ম, চিন্তা ও অনুভূতির সাক্ষী হলেও নিজে অগ্রাহ্য—যেমন আয়নায় প্রতিফলন দেখা যায়, কিন্তু আয়নাকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না।

এই উপমাটির অর্থ দেখা যাক। আয়নায় প্রতিফলন দেখা মানে, আমরা কোনো রূপ দেখি, যা আসলে আয়নার উপর ভেসে আছে, কিন্তু আয়নার নিজের কোনো বিকৃতি হয় না। মুখ আয়নায় দেখা যায়, কিন্তু কেউ সেই মুখটিকে ছুঁতে পারে না, কারণ সেটি কোনো বাস্তব বস্তুর স্পর্শযোগ্য অস্তিত্ব নয়—একটি প্রতিবিম্বমাত্র।

ঠিক তেমনই আত্মা—যাকে উপনিষদে বলা হয়েছে “অসঙ্গঃ হ্যায়ং পুরুষঃ” (বৃহদারণ্যক ৪.৩.১৫)—অর্থাৎ, “এই পুরুষ বা আত্মা সম্পূর্ণ অসঙ্গ, কিছুতেই জড়িত নয়।” জগৎ, দেহ, মন, চিন্তা—সবই আত্মার চেতনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়; কিন্তু আত্মা তাদের কোনো স্পর্শ পায় না। দেহে ব্যথা হলে, মন কষ্ট পেলে, চিন্তায় দুঃখ এলেও আত্মা নিজে অচঞ্চল থাকে—যেমন আয়না মুখের ময়লা বা হাসি–কান্নার সঙ্গে একত্রিত হয় না, কেবল প্রতিফলন দেখায়।

এই দৃষ্টান্ত দ্বারা বোঝানো হয় যে, আত্মা কখনও দেহ বা মন নয়, সে তাদের সাক্ষী মাত্র। দেহের পরিবর্তন, মনের ওঠা-নামা, ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ—সবই আত্মার আলোকেই ঘটে, কিন্তু আত্মা কখনো এতে আবদ্ধ হয় না। এই অর্থে বলা যায়—যেমন আয়নায় প্রতিফলন দেখা যায়, কিন্তু আয়নাকে কেউ (বস্তু তথা সত্তা) স্পর্শ করতে পারে না, তেমনি আত্মা সব কিছু অনুভব করায়, কিন্তু তাকে কিছু স্পর্শ করতে পারে না। সে চিরনির্মল, চিরঅস্পৃষ্ট, চিরসাক্ষী।

তুরীয় আত্মা অচিন্ত্য, কারণ তাকে মন দ্বারা ভাবা যায় না। “ন বাচা গ্রাহ্যম্, ন মনসা; ন চক্ষুষা; অস্তি ভূতসুখ্ষ্মম্।।” (কৈবল্য উপনিষদ, মন্ত্র ২) অর্থাৎ, “তাঁকে না বাক্য দ্বারা ধরা যায়, না মন দ্বারা, না চোখ দ্বারা দেখা যায়; কারণ তিনি সূক্ষ্মতর, সমস্ত স্থূল সত্তার অতীত।” চিন্তা সবসময় কোনো রূপ বা গুণকে ধরে; কিন্তু আত্মার কোনো রূপ বা সীমা নেই, তাই মন তাকে ধারণ করতে অক্ষম। সে চিন্তার বিষয় নয়, চিন্তার আলোকস্বরূপ।

তুরীয় আত্মা অব্যপদেশ্য, কারণ তাকে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (২.৪.১) বলা হয়েছে—“যতো বাকো নিবর্তন্তে, অপ্রাপ্য মনসা সহ।” অর্থাৎ “যার কাছে বাক্য ও মন পৌঁছাতে পারে না—সেখান থেকেই তারা ফিরে আসে।” আত্মা ভাষার সীমার বাইরে, কারণ ভাষা সবসময় দ্বৈততার উপর নির্ভরশীল—কথক ও কথার বস্তু আলাদা থাকতে হয়; কিন্তু আত্মা অদ্বৈত, তাই সেখানে ভাষার কোনো অধিকার নেই।

এই চারটি মন্ত্র একত্রে আত্মার তুরীয় স্বরূপকে নির্দেশ করে, যা মাণ্ডূক্য উপনিষদ (মন্ত্র ৭)-এ সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে—“অদৃশ্যং, অব্যবহার্যং, অগ্রাহ্যং, আলক্ষণং, অচিন্ত্যং, অব্যপদেশ্যং…” অর্থাৎ, “এই আত্মা অদৃশ্য, অব্যবহার্য, অগ্রাহ্য, আলক্ষণ, অচিন্ত্য ও অব্যপদেশ্য”—যা সমস্ত প্রপঞ্চের ঊর্ধ্বে, শান্ত, শিবময় ও অদ্বৈত। এই চারটি বৈশিষ্ট্যই বোঝায় যে, তুরীয় চেতনা কোনো জানা বা ভাবনার বস্তু নয়, বরং সমস্ত জানার পটভূমি—নিজে অবর্ণনীয়, কিন্তু সকল বর্ণনার উৎস।