“নাহং দেহঃ, নাহং কর্তা, নাহং সুখী দুঃখী; অহং ব্রহ্মাস্মি”—এটি আধুনিক কালে বহুচলিত এক অদ্বৈত-ধ্যানবাক্য; ‘মহাবাক্য-রত্নাবলী’ নামে কিছু সংকলনে এটি ছাপা হয়েছে।
এখানে, “অহং ব্রহ্মাস্মি”—বৃহদারণ্যক উপনিষদের মহাবাক্য (১.৪.১০), যা মূলত আত্মা-ব্রহ্মের ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক মন্ত্ররূপের শেষ অংশটি এই উপনিষদীয় বাক্যেরই পুনরুক্তি।
“নাহং দেহঃ”—শরীর-অহংকারের নশ্বরতার এই ঘোষণাটি শ্রীশঙ্করাচার্যের বিখ্যাত ‘নির্বাণ-ষট্কমে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত; সেখানে বার বার “চিদানন্দরূপঃ শিবো’হম্” বলে দেহ-ইন্দ্রিয়-মন—সব কিছুকেই নিত্যসাক্ষী চৈতন্য থেকে পৃথক করা হয়েছে। একই সুর ‘অষ্টাবক্রগীতা’-তেও আছে—“নাহং দেহো ন মে দেহো… বোধো’হম্”—যা “আমি দেহ নই, দেহ আমারও নয়; আমি চৈতন্য”—এই প্রত্যয়কে সরাসরি উচ্চারণ করে।
“নাহং কর্তা, নাহং সুখী দুঃখী”—এ অংশের দার্শনিক ভিত্তি ‘আত্মবোধ’-এ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: কর্তা-ভোক্তার ধর্ম আসলে মনের; অজ্ঞানবশত তা আত্মার উপর আরোপ হয়—ঠিক যেমন জলে প্রতিবিম্বিত চাঁদের সাথে জলের কাঁপুনিকে যুক্ত করে দেখা হয়। ফলে জ্ঞানোদয়ের সাথে “আমি কর্তা/ভোক্তা” ধারণার অবসান ঘটে।
এই “দেহ নই—চিদ্রূপ আমি”-এর ধারা ‘যোগবাসিষ্ঠ’-তেও বারবার ধ্বনিত—যেমন এক স্থানে আছে: “নাহং দেহো… ন কিঞ্চিত্ সর্বমেব চ”—অর্থাৎ, “আমি দেহ নই; আবার শূন্যও নই—আমি সব কিছুর ভিত্তি চৈতন্য”—এই উক্তি দেহ-অভিমান ভেঙে সাক্ষী-চৈতন্যে প্রতিষ্ঠা ঘটায়।
প্রচলিত “নাহং দেহঃ… অহং ব্রহ্মাস্মি” বাক্যবন্ধটি কোনো একটি প্রাচীন শাস্ত্রের মৌলিক শ্লোক নয়; বরং উপনিষদের “অহং ব্রহ্মাস্মি”, শঙ্করের ‘নির্বাণ-ষট্কম্’, অষ্টাবক্রগীতা-র “নাহং দেহো ন মে দেহো”, আত্মবোধ-এর কর্তা-ভোক্তা-নিরাসন এবং যোগবাসিষ্ঠ-এর দেহ-অভিমান-বিলোপ—এই পাঁচ ধারার ভাবকে একত্রে, ধ্যানোপযোগী সংক্ষিপ্ত রূপে বাঁধা এক সমন্বিত আধুনিক অদ্বৈত-স্তব।
অবিদ্যা চৈতন্যের স্বরূপকে আচ্ছাদিত করে নানা স্তরে প্রকাশিত হয়—এ যেন এক পর্দা, যা আত্মার অন্তর্গত দীপ্তিকে ক্রমে আড়াল করে রাখে। এই আচ্ছাদন তিনটি দেহের মাধ্যমে গঠিত—স্থূল, সূক্ষ্ম এবং কারণ শরীর—যাদের সম্মিলিত নাম শরীরত্রয় (Śarīra–Traya)। এই তিনটি স্তর আত্মার অভিজ্ঞতার তিন অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—সঙ্গে সম্পর্কিত। আত্মা সব অবস্থার সাক্ষী, কিন্তু অবিদ্যার কারণে নিজেকে এই অবস্থাগুলির সঙ্গে একীভূত ভেবে ফেলে।
স্থূল শরীর বা স্থূল দেহ হচ্ছে সেই দৃশ্যমান, স্পর্শযোগ্য ও পরিবর্তনশীল দেহ, যা আমরা ‘আমি’ বলে ভাবি। এটি গঠিত পাঁচটি স্থূল উপাদান—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পাঁচ মহাভূতের সংঘাতে। তত্ত্ববোধ গ্রন্থে বলা হয়েছে—“স্থূল শরীর পাঁচ মহাভূতের সংঘাতে গঠিত, কর্মফলের ভোগের উপায়রূপে।” (তত্ত্ববোধ, শ্লোক ৭) অর্থাৎ, দেহ কোনো চিরন্তন সত্তা নয়; এটি কর্মফল ভোগের মাধ্যম, যা পূর্বকর্মের দ্বারা সৃষ্ট এবং সেই কর্মের ফলভোগ শেষে নশ্বর হয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১) এই দেহকে বলা হয়েছে “অন্নময় আত্মা”—খাদ্য বা স্থূল উপাদান দ্বারা গঠিত দেহ, যা খাদ্য থেকেই জন্মায় ও খাদ্যেই ফিরে যায়।
“ভূত” শব্দের অর্থ হলো যা অস্তিত্বে এসেছে, কিন্তু এখনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে প্রকাশিত হয়নি; আর “মহাভূত” মানে সেই উপাদান, যা পরিপূর্ণ বিকাশ পেয়ে দৃশ্যমান বা স্থূল জগতে প্রকাশিত হয়েছে।
বেদান্তে বলা হয়, সৃষ্টি শুরু হয় সূক্ষ্ম স্তর থেকে, যেখানে উপাদানগুলি থাকে অব্যক্ত অবস্থায়—এদের বলা হয় ভূত, অর্থাৎ সম্ভাব্য বা কারণরূপ উপাদান। এই সূক্ষ্ম উপাদানগুলো হলো তন্মাত্র—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—যেগুলি একে একে আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবীর কারণ।
“তন্মাত্র” মানে “মাত্র সেই”—অর্থাৎ কোনো একটি গুণ বা অনুভূতির সূক্ষ্মতম কারণরূপ উপাদান। এগুলি এমন সূক্ষ্ম উপাদান, যা এখনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের মূল কারণ। শব্দটি এসেছে “তৎ” অর্থাৎ “তা” এবং “মাত্র” অর্থাৎ “শুধু সেটাই” থেকে; তাই তন্মাত্র মানে “শুধু সেইটুকু” বা “শুদ্ধ সেই গুণ।”
সৃষ্টি যখন শুরু হয়, তখন প্রথমে প্রকৃতি থেকে মহৎ বা মহৎত্ত্ব (বুদ্ধিতত্ত্ব) প্রকাশিত হয়, তারপর অহংকার, এবং অহংকার থেকে এই তন্মাত্রগুলি জন্ম নেয়। এগুলিই জগতের সূক্ষ্ম ভিত্তি, যেগুলি পরে মিশে স্থূল উপাদানে পরিণত হয়।
বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনের মতে, প্রকৃতি বা প্রকৃতিতত্ত্ব হলো সমগ্র সৃষ্টির মূল উপাদান—অব্যক্ত, সূক্ষ্ম, সম্ভাবনার অবস্থায় থাকা সেই শক্তি, যেখান থেকে সমস্ত প্রকাশ (সৃষ্টি) শুরু হয়। প্রকৃতি নিজে চৈতন্যময় নয়, কিন্তু চৈতন্যের উপস্থিতিতে (পুরুষ বা আত্মার সান্নিধ্যে) সে আন্দোলিত হয়ে ওঠে, এবং সেই আন্দোলনের ফলেই সৃষ্টি-প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই সৃষ্টির প্রথম প্রকাশিত স্তরকে বলা হয় মহৎ বা মহৎ-তত্ত্ব বা মহৎত্ত্ব, যাকে বুদ্ধিতত্ত্ব নামেও ডাকা হয়। “মহৎ” (মহান) শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “মহ্” ধাতু থেকে, যার অর্থ “বিস্তার লাভ করা” বা “বৃদ্ধি পাওয়া”—অর্থাৎ যখন অব্যক্ত প্রকৃতি প্রথম প্রকাশিত বা প্রসারিত হয়, তখনই মহৎ জন্ম নেয়।
মহৎত্ত্ব হলো প্রকৃতির প্রথম বিকার বা রূপান্তর। প্রকৃতি অব্যক্ত অবস্থায় যেমন একটি স্থির, ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণে সমাবিষ্ট), তেমনি চৈতন্যের স্পর্শে এই সমতা ভেঙে যায়, এবং প্রকৃতি প্রথম প্রকাশিত হয় “মহৎ” হিসেবে।
সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে—“প্রকৃতির্ মহদাদি পরিণামঃ, পরমপুরুষঃ বিকার্যবিহীনঃ।” (কারিকা ২২) অর্থাৎ, “প্রকৃতি থেকে মহৎ ইত্যাদি তত্ত্বসমূহের পরিণাম (উৎপত্তি) ঘটে, কিন্তু পরম পুরুষ (চৈতন্য) অপরিণামী ও বিকারশূন্য থাকে।” প্রকৃতি থেকে প্রথমে “মহৎ” প্রকাশিত হয়; এরপর মহৎ থেকে অহংকার, অহংকার থেকে তন্মাত্র (ভূত), এবং তন্মাত্র থেকে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি হয়।
এ হচ্ছে অব্যক্ত প্রকৃতির প্রথম জাগরণ বা প্রথম বিকাশ, যেখানে চৈতন্যের প্রতিফলনে জ্ঞানের বীজ প্রকাশিত হয়। এটাই সেই মুহূর্ত, যখন জড় প্রকৃতি প্রথমবার সচেতন সৃষ্টির সম্ভাবনা ধারণ করে, এবং বুদ্ধিতত্ত্ব হিসেবে জ্ঞানের সূচনা ঘটে।
এই মহৎই বুদ্ধি বা জ্ঞানের মূলতত্ত্ব। এটি সেই স্তর, যেখানে চেতনা প্রথম বার নিজের প্রতিফলন উপলব্ধি করে—“আমি জানি”, “আমি চিন্তা করি”, “আমি অভিজ্ঞতা করি”—এই ধারণার সূচনা এখানেই। তাই বেদান্তে একে বলা হয় বুদ্ধিতত্ত্ব—যা সকল জ্ঞান, সিদ্ধান্ত, ও বিচারের মূলে রয়েছে।
এই অবস্থায় মহৎ বা বুদ্ধি এখনও ব্যক্ত নয়, কিন্তু এতে সমস্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা নিহিত থাকে। যেমন ভোরের প্রথম আলোয় সূর্য এখনও ওঠেনি, কিন্তু আলোর ইঙ্গিত দেখা যায়, তেমনি প্রকৃতি যখন চৈতন্যের স্পর্শে প্রথম আলো পায়, তখন যে জ্ঞানোদ্ভব শুরু হয়, সেটিই মহৎত্ত্বের জন্ম।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ ও সাংখ্য কারিকা উভয়েই এই ধারা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে—প্রকৃতি থেকে মহৎ, তা থেকে অহংকার, তা থেকে তন্মাত্র, তা থেকে পঞ্চমহাভূত।
সাংখ্য কারিকা (সংস্কৃত: Sāṅkhya Kārikā) হলো ভারতীয় দর্শনের এক প্রাচীন ও মৌলিক গ্রন্থ, যা সাংখ্য দর্শনের মূল সূত্রগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এটি ঋষি ঈশ্বরকৃষ্ণ (Īśvarakṛṣṇa) রচিত, এবং প্রায় খ্রিষ্টীয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীতে সংকলিত হয় বলে পণ্ডিতমহলে ধারণা। “কারিকা” মানে সংক্ষিপ্ত শ্লোক বা সূত্ররূপে রচিত বাণী; এই গ্রন্থে মোট ৭২টি কারিকা বা শ্লোক রয়েছে, যেখানে সমগ্র সাংখ্য দর্শনের দার্শনিক কাঠামো গঠিত হয়েছে এক সুনির্দিষ্ট যুক্তিনিষ্ঠ পদ্ধতিতে।
সাংখ্য কারিকার মূল তত্ত্ব হলো—পুরুষ (চৈতন্য) ও প্রকৃতি (অচেতনা)—এই দুই নিত্য বাস্তবের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার জগৎ উদ্ভূত হয়। প্রকৃতি চৈতন্যের প্রতিবিম্বে বিকৃত হয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় ২৫টি তত্ত্বে—যা সাংখ্য দর্শনের পঞ্চবিংশতিতত্ত্ব (২৫ তত্ত্ব) নামে পরিচিত।
এই ২৫টি তত্ত্বের ক্রম এমন—প্রথমে প্রকৃতি, যাকে বলা হয় মূল কারণ বা অব্যক্ত অবস্থা। এরপরে প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত হয় মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, যা চেতনার প্রথম প্রতিফলন। মহৎ থেকে জন্ম নেয় অহংকার, অহংকার থেকে উৎপন্ন হয় পাঁচ তন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ—পাঁচ ভূত), এবং সেই তন্মাত্র থেকেই ক্রমে সৃষ্টি হয় পাঁচ মহাভূত—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, ও পৃথিবী। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয় পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন, রসনা, ঘ্রাণ), পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ), এবং সর্বশেষে মন, যা ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির মধ্যে সেতুবন্ধন করে।
বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনের মতে মানুষের শরীর ও অভিজ্ঞতা মূলত দশটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়—পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। এদের মাধ্যমে মানুষ জগতকে জানে ও নিজের ভাবকে প্রকাশ করে।
জ্ঞানেন্দ্রিয় মানে সেই ইন্দ্রিয়, যা জগৎ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করে, অর্থাৎ বাহ্যিক অভিজ্ঞতাকে মনের মধ্যে নিয়ে আসে। কর্মেন্দ্রিয় মানে সেই ইন্দ্রিয়, যা ভিতরের ভাব বা ইচ্ছাকে বাইরে প্রকাশ করে, অর্থাৎ কর্ম সম্পাদন করে।
পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় হলো—শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন, রসনা ও ঘ্রাণ। শ্রবণেন্দ্রিয় শব্দ গ্রহণ করে, এটি কর্ণের মাধ্যমে কাজ করে; স্পর্শনেন্দ্রিয় ত্বকের মাধ্যমে স্পর্শ ও তাপমাত্রা অনুভব করে; দর্শনেন্দ্রিয় চক্ষুর মাধ্যমে রূপ ও আকার উপলব্ধি করে; রসনেন্দ্রিয় জিহ্বার মাধ্যমে স্বাদ গ্রহণ করে; ঘ্রাণেন্দ্রিয় নাসিকার মাধ্যমে গন্ধ অনুভব করে। এই ইন্দ্রিয়গুলো প্রকৃতপক্ষে সূক্ষ্ম শক্তি, বাহ্য অঙ্গ কেবল তাদের যন্ত্র।
অন্যদিকে, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় হলো—বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ। বাক্ ইন্দ্রিয় শব্দ ও ভাব প্রকাশ করে; পাণি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ হাত ধরতে, সৃষ্টি করতে ও দান করতে সাহায্য করে; পাদ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ পা গমন বা চলাচলের কাজ করে; পায়ু ইন্দ্রিয় বর্জ্য নির্গমনের কাজ করে; উপস্থ ইন্দ্রিয় প্রজনন ও আনন্দের অনুভব ঘটায়।
এই দশ ইন্দ্রিয়ের সমন্বয় ঘটায় মন, যা তাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। মন না থাকলে দেখা, শোনা, স্পর্শ বা কথা বলার অভিজ্ঞতা কখনও পূর্ণ হতো না। চোখ দেখতে পারে, কিন্তু মন না থাকলে দেখা বোঝা যায় না; মুখ আছে, কিন্তু মন না থাকলে কথা ফুটে না। তাই মন জ্ঞান ও কর্মের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক।
সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে, এই জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় উভয়ই অহংকার থেকে উৎপন্ন—অহংকারই সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়শক্তির উৎস। এগুলির মাধ্যমে জীব জগৎকে অনুভব করে ও কার্য সম্পাদন করে।
পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় হলো জ্ঞানের দ্বার—যা বাইরের জগৎকে অন্তরে আনে; আর পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় হলো কর্মের মাধ্যম—যা অন্তরের ভাবকে বাইরে প্রকাশ করে। এই দুইয়ের মিলেই জীবন সম্পূর্ণ হয়, আর মন সেই দুইয়ের সেতুবন্ধন হিসেবে জ্ঞান ও কর্মের ধারাকে সচল রাখে।
বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনের মতে, সমস্ত সৃষ্টি এক ধারাবাহিক বিকাশের ফল। প্রথমে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে প্রকৃতি, তারপর তার প্রথম বিকার হিসেবে প্রকাশ পায় মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, এবং সেই মহৎ থেকেই জন্ম নেয় অহংকার—অর্থাৎ “আমি”-বোধ। এই অহংকারই হলো সেই সূক্ষ্ম কেন্দ্র, যেখানে চেতনা প্রথম নিজেকে পৃথক সত্তা হিসেবে অনুভব করে।
অহংকার মানে “আমি আছি”, “আমি জানি”, “আমি করি”—এই ব্যক্তিগত চেতনার উত্থান। যখন এই “আমি-বোধ” জন্ম নেয়, তখনই চেতনা নিজের চারপাশে জগতের অভিজ্ঞতা গড়ে তুলতে শুরু করে। এই অহংকার তিন গুণে—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—প্রভাবিত হয় এবং প্রতিটি গুণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন বিকার সৃষ্টি করে।
অহংকারের সাত্ত্বিক অংশ থেকে উৎপন্ন হয় জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও মন—অর্থাৎ জানার শক্তি, করার শক্তি ও তাদের সমন্বয়ের কেন্দ্র। অহংকারের রাজসিক অংশ এই ইন্দ্রিয়গুলিকে কর্মক্ষম করে, তাদের ক্রিয়াশক্তি জোগায়। আর অহংকারের তামসিক অংশ থেকে জন্ম নেয় তন্মাত্র, অর্থাৎ সূক্ষ্ম উপাদান—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—যেগুলি পরে স্থূল মহাভূত হয়ে প্রকাশ পায়।