অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো তেইশ



“লীলা” শব্দটি সংস্কৃত “লল্” ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ খেলা, বিনোদন বা আনন্দের আত্মপ্রকাশ। বেদান্তে এই শব্দের অর্থ গভীরতর—এটি বোঝায় ব্রহ্ম বা চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যেখানে সৃষ্টি, পালন ও লয় কোনো উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন থেকে নয়, বরং স্বভাবগত আনন্দ থেকে ঘটে।

ব্রহ্মসূত্র, ২.১.৩৩-এ বলা হয়েছে—“লোকবৎ তু লীলাকৈবল্যম্”—অর্থাৎ, “জগৎ-সৃষ্টিতে ঈশ্বরের প্রেরণা কেবল লীলা (খেলা/ক্রীড়া) মাত্র—জগতে তার প্রকাশ দেখা যায়।”—অর্থাৎ, ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্ম মানুষের মতো কোনো প্রয়োজনে নয়, এটি নিছক লীলা, আনন্দের প্রকাশ। শঙ্করাচার্য এর ব্যাখ্যায় বলেন—যেমন রাজা বিনা উদ্দেশ্যে বাগানে হেঁটে বেড়ান, তেমনি ব্রহ্মও নিজের আনন্দে এই সৃষ্টিকে প্রকাশ করেন। সৃষ্টি তাঁর কাছে কোনো কর্তব্য নয়, কোনো প্রয়োজনে চালিত কাজ নয়।

গীতায় এই ভাবই অন্যভাবে প্রকাশিত হয়েছে—শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “প্রকৃতিই সব কাজ করে, মূর্খ ব্যক্তি অহংকারে ভাবে—আমি করছি।” (গীতা, ৩.২৭)। এখানে বলা হয়েছে, জগৎ যা-কিছু করছে, তা প্রকৃতির দ্বারা চালিত, আর ব্রহ্ম সেই ক্রিয়ার নিঃস্পন্দ সাক্ষী। তাঁর কোনো আসক্তি নেই, কোনো লক্ষ্যও নেই; তিনি আনন্দস্বরূপ, আর সৃষ্টি তাঁর লীলাস্বরূপ প্রকাশ।

উপনিষদেও একই সুর শোনা যায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদ–এর ব্রহ্মানন্দ-বল্লী (৩.৬.১) অংশে আছে: “আনন্দাদ্ ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি।” অর্থাৎ, “আনন্দ থেকেই সত্যিই সকল ভূতানির (সত্তা-সম্বলিত সমস্ত প্রাণ বা বস্তুসমূহ) জন্ম; আনন্দেই তারা স্থিত ও জীবিত থাকে; আনন্দেই তারা লয় প্রাপ্ত হয়।”

ভাগবত পুরাণে লীলার ভাব রসধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে কৃষ্ণের জীবনের ঘটনাগুলো—রস, প্রেম, সংগীত, নৃত্য—সবই লীলা, কারণ সেগুলো উদ্দেশ্যহীন পরম আনন্দের প্রকাশ। কৃষ্ণ কোনো কাজ করেন না বাধ্যবাধকতা থেকে; তাঁর প্রতিটি ক্রিয়া নিজস্ব চেতনার আনন্দের ছন্দ।

বেদান্তে লীলার দার্শনিক অর্থ হলো—ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্ম অনর্থক নয়, আবার উদ্দেশ্যপ্রসূতও নয়। এটি তাঁর স্বাভাবিক পরিপূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। যে-চেতনা অসীম, তার থেকে স্বতঃসিদ্ধভাবেই নানা নাম-রূপ প্রকাশিত হয়, যেমন সূর্যের আলো নিজের থেকে ছড়ায়। সূর্য আলোকিত করে কোনো উদ্দেশ্যে নয়, সে স্বভাবেই উজ্জ্বল; তেমনি ব্রহ্মও নিজের আনন্দে সৃষ্টিতে প্রকাশিত হন—এটাই লীলা।

জীবনের স্তরেও এই লীলা ধারণা প্রযোজ্য। যখন ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, সমস্ত ক্রিয়া, কর্ম ও পরিবর্তনই চেতনার স্বতঃসিদ্ধ প্রকাশ, তখন সে নিজেকে কর্তা ভাবে না। তার কাছে জীবনও তখন লীলা—চলমান কিন্তু মুক্ত, সক্রিয় কিন্তু নির্লিপ্ত।

“লীলা” মানে ব্রহ্মের আনন্দময় প্রকাশ, যা কোনো প্রয়োজন, উদ্দেশ্য বা দায় দ্বারা নয়, বরং চেতনার স্বরূপ থেকে নিজে থেকেই প্রবাহিত হয়। জগৎ, মানুষ, কর্ম—সবই সেই পরম আনন্দের খেলা, যেখানে সব কিছুই ঘটছে, কিন্তু কিছুই বন্ধনে বাঁধা পড়ছে না।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞান তিন রকম—প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ এবং অপরোক্ষ। এই তিনটি স্তর চেতনার প্রকাশের ধাপ। একটিই সত্য (ব্রহ্ম) ভিন্ন ভিন্ন স্তরে প্রতীয়মান হয়; কখনো বাহ্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, কখনো বুদ্ধির মাধ্যমে, আর সর্বশেষে, নিজের মধ্যেই—প্রত্যক্ষভাবে।

প্রথম স্তর হলো প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এটি ইন্দ্রিয় ও মন-নির্ভর জ্ঞান, যেখানে বস্তু সরাসরি দেখা, শোনা, স্পর্শ, গন্ধ বা রসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। যেমন চোখে ফুল দেখা, কানে সংগীত শোনা, হাতে ঠান্ডা অনুভব করা—এ সবই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞান আপেক্ষিক, কারণ এটি ইন্দ্রিয়-সংযোগের উপর নির্ভর করে। আলো, দূরত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে জ্ঞানও বদলে যায়। তাই বেদান্ত বলে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান ব্যাবহারিক জগতে যথার্থ হলেও পরমার্থিক সত্য নয়; এটি পরিবর্তনশীল, এবং ইন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ।

দ্বিতীয় স্তর হলো পরোক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞান প্রত্যক্ষ নয়, বরং শাস্ত্র, যুক্তি বা অন্যের বচনের মাধ্যমে জানা যায়। যখন কোনো বস্তুকে নিজে দেখা বা অনুভব না করেও তার অস্তিত্ব জানা যায়, তখন সেটি পরোক্ষ জ্ঞান। যেমন কেউ বলে, “হিমালয় আছে”—আমরা বিশ্বাস করে জানতে পারি যে, হিমালয় আছে। অথবা দূর থেকে ধোঁয়া দেখে বোঝা, “ওখানে আগুন আছে”—এটিও পরোক্ষ জ্ঞান। ব্রহ্মজ্ঞান প্রথমে এই স্তরেই আসে। শাস্ত্র ও গুরুর বচনে যখন শুনি, “তুমি ব্রহ্ম”—তখন সেই জ্ঞান পরোক্ষ, কারণ তা নিজের অভিজ্ঞতায় প্রতিফলিত হয়নি।

শঙ্করাচার্য বলেন—ব্রহ্মজ্ঞান দুই স্তরে উদিত হয়। প্রথম স্তর হলো পরোক্ষ (শাস্ত্র ও গুরুর উপদেশে উদিত ধারণাগত জ্ঞান), দ্বিতীয় স্তর অপরোক্ষ (নিজ চেতনায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান)।

শঙ্কর প্রথমে ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য (১.১.৪, শাস্ত্রযোনিত্বাধিকারণ)-এ বলেন—“শাস্ত্রাচার্যোপদেশাবধারিতঃ ব্রহ্মবিষয়ঃ বুদ্ধিবিশেষঃ প্রথমতঃ পরোক্ষো ভবতি, অনন্তরং তু নিদিধ্যাসনপ্রবণচিত্তস্য অপরোক্ষঃ।” অর্থাৎ, শাস্ত্র ও আচার্যের উপদেশ থেকে যে ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞানবৃত্তি জন্ম নেয়, তা প্রথমে পরোক্ষ। এটি কেবল শ্রবণ ও চিন্তার স্তরে থাকে। পরে যখন মন নিদিধ্যাসনে স্থির হয়, তখন সেই জ্ঞান অপরোক্ষ হয়—নিজস্ব চেতনায় প্রত্যক্ষ উপলব্ধি রূপে প্রকাশিত হয়।

এরপর বৃহদারণ্যক উপনিষদ-ভাষ্য (২.৪.৫)-এ শঙ্কর বলেন—“শাস্ত্রোপদেশজনিতঃ ব্রহ্মবিষয়ঃ বুদ্ধিবিশেষঃ পরোক্ষঃ, অনন্তরং তু স্বানুভবসিদ্ধঃ অপরোক্ষঃ।” অর্থাৎ, শাস্ত্র ও গুরুর উপদেশ থেকে যে ব্রহ্মবিষয়ক বোধ জন্মে, তা প্রথমে পরোক্ষ, কিন্তু পরে আত্মানুভব দ্বারা তা অপরোক্ষ হয়ে ওঠে। এখানে তিনি বোঝাচ্ছেন—শাস্ত্র পথ দেখায়, কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আসে কেবল অবিদ্যার পর্দা সরে গেলে।

একই তত্ত্ব মাণ্ডূক্য উপনিষদ-কারিকা (৩.৩৫) ভাষ্যে আরও সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে—“শ্রবণাদিনৈব পরোক্ষব্রহ্মজ্ঞানম্, নিদিধ্যাসনাত্ তু অপরোক্ষব্রহ্মসাক্ষাত্কারঃ।” অর্থাৎ, শ্রবণ ও মননের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান প্রথমে পরোক্ষ রূপে উদিত হয়, কিন্তু নিদিধ্যাসনের ফলে সেই জ্ঞান অপরোক্ষ ব্রহ্মসাক্ষাৎকারে পরিণত হয়।

এই তিনটি উদ্ধৃতি একত্র করলে শঙ্করের অবস্থান পরিষ্কার হয়।

শাস্ত্র ও গুরুর উপদেশে ব্রহ্মজ্ঞান প্রথমে জন্ম নেয়, কিন্তু তা ধারণাগত—পরোক্ষ। এটি ব্রহ্মকে কোনো বস্তুর মতো জানায় না, বরং মনের দৃষ্টিকে প্রস্তুত করে। যখন মন নিদিধ্যাসনে স্থির হয়ে অবিদ্যার আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলে, তখন আত্মা নিজের মধ্যে জ্বলে ওঠে। এই অবস্থায় জ্ঞান আর ধারণা নয়, অভিজ্ঞতা; ব্রহ্ম আর জ্ঞেয় নয়, স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা। তখন জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়, এবং যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিই অপরোক্ষ ব্রহ্মসাক্ষাৎকার—নিজস্ব চৈতন্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।

তৃতীয় স্তর হলো অপরোক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞান কোনো ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি বা বাহ্য মাধ্যম ছাড়া ঘটে। এটি নিজের চেতনার মধ্যেই, নিজের আলোয় জানা। অপরোক্ষ মানে ‘অ-পর-অক্ষ’ অর্থাৎ অন্য ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়; আত্মা নিজেকে নিজের মধ্যে জানে। যেমন আমি যখন জানি, “আমি আছি”—এই জ্ঞান কোনো প্রমাণ বা অন্যের কথায় নয়, নিজের মধ্যেই প্রত্যক্ষ। যখন এই আত্ম-বোধ দেহ-মন-অহংকার অতিক্রম করে স্থিত হয় “আমি চেতনা-স্বরূপ ব্রহ্ম”—এই উপলব্ধিতে, তখন সেটিই অপরোক্ষ জ্ঞান। এই জ্ঞানেই মুক্তি নিহিত, কারণ এটি কেবল ধারণা নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এখানে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান একাকার হয়ে যায়।

আগুনের দৃষ্টান্তে তিন স্তর সহজে বোঝা যায়। দূর থেকে ধোঁয়া দেখে বোঝা—“ওখানে আগুন আছে”—এটি পরোক্ষ জ্ঞান। কাছে গিয়ে আগুন দেখা—এটি প্রত্যক্ষ জ্ঞান। নিজের হাতে আগুনের তাপ অনুভব করা—এটি অপরোক্ষ জ্ঞান। তেমনি ব্রহ্মজ্ঞানও প্রথমে শোনা ও ভাবনার মাধ্যমে জানা যায় (পরোক্ষ), পরে চেতনায় দৃঢ়ভাবে ধরা পড়ে (প্রত্যক্ষের অনুরূপ), এবং শেষে নিজের মধ্যে সেই ব্রহ্ম-চেতনার সরাসরি অভিজ্ঞতা ঘটে (অপরোক্ষ)।

সারমর্ম এই—প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জ্ঞান বাহ্য জগৎ ও বুদ্ধির স্তর; তারা বস্তু বা ধারণাকে প্রকাশ করে। অপরোক্ষ জ্ঞান চেতনার নিজ প্রকাশ—যেখানে জানা, জানা যায় ও জানন—এই তিনের ভেদ মুছে যায়। এই অপরোক্ষ জ্ঞানই অদ্বৈতের লক্ষ্য, যেখানে জানা যায়—“ব্রহ্মই সর্বস্ব, আমিই সেই ব্রহ্ম”—এবং সেই জানা আর কখনও নিবারিত হয় না।

অদ্বৈত বেদান্তে “জ্ঞান উদিত হওয়ার পর শাস্ত্রের প্রয়োজন কী?”—এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে প্রমাণের সীমা ও চেতনার স্বয়ংপ্রকাশতা (svayam-prakāśatā)-র মূলে।

এই ভাবটি শঙ্করাচার্যের বহু ভাষ্যে প্রকাশ পেয়েছে—বিশেষত ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য, বৃহদারণ্যক-ভাষ্য, গীতা-ভাষ্য এবং উপনিষদীয় শ্রুতি-গুলিতে।

যতদিন অবিদ্যা বিদ্যমান, ততদিন শাস্ত্রই একমাত্র প্রমাণ। শাস্ত্র তখন আয়না—নিজে কিছু দেখায় না, কিন্তু স্বরূপের প্রতিফলন ঘটায়। শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে এটি মনকে দিশা দেয় ও ভুল ধারণা ভাঙে।

শঙ্কর বলেন—“শাস্ত্রং অবিদ্যা-নিবর্তকং, ন তু ব্রহ্ম-প্রতিপাদকম্।” (শঙ্করাচার্য, মন্তব্য সংকলিতভাবে বৃহদারণ্যক-ভাষ্য ২.১.২০ প্রসঙ্গে) অর্থাৎ, শাস্ত্র ব্রহ্মকে “জানায়” না; এটি কেবল অবিদ্যার পর্দা সরায়। এই অবস্থায় শাস্ত্রের প্রমাণ-শক্তি কার্যকর, কারণ তখন চেতনা নিজের স্বরূপে প্রকাশিত নয়।

যখন জ্ঞান উদিত হয়—অর্থাৎ আত্মা নিজের আলোয় উদ্‌ভাসিত হয়—তখন শাস্ত্র আর প্রমাণ থাকে না; কারণ প্রমাণ কেবল অজানা বস্তু প্রকাশ করে; ব্রহ্ম তো কখনও অজানা ছিল না, কেবল আচ্ছন্ন ছিল। এভাবেই শঙ্কর বলেন—“ন হি ব্রহ্ম জ্ঞানে নূতনং ভবতি, কেবলম্‌ অবিদ্যা-নিবৃত্তিঃ।” (শঙ্কর-ভাষ্যে সংক্ষিপ্তার্থে, ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য ১.১.৪ ও মাণ্ডূক্য-ভাষ্য ৩.৩৫ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত) অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান নতুন কিছু উৎপন্ন করে না; কেবল অজ্ঞানের নিবারণ ঘটায়। এখানেই শাস্ত্রের কার্য সমাপ্ত—যেমন নৌকা পার করে দিলে তাকে ছেড়ে দিতে হয়।

নৌকার উপমা—শাস্ত্রের উপায়-রূপ—এই উপমা শ্রুতিতে আছে। উপনিষদ ও বেদান্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে—“যথা নৌনাং প্লবঃ পরং পারং গচ্ছতি, নৌ ত্যজতি।” (প্রবচন-সংগৃহীত বেদান্তসূত্রার্থে, অনন্তগিরি-টীকায় উদ্ধৃত, গীতাভাষ্য ৪.৩৪-এর প্রসঙ্গে) অর্থাৎ, নৌকা পার করে দিলে তাকে ফেলে দিতে হয়। তেমনি শাস্ত্র, গুরু, যুক্তি—সবই উপায়মাত্র; ব্রহ্মজ্ঞানে পৌঁছালে উপায়ের আর প্রয়োজন থাকে না।

গীতায়ও বলা হয়েছে—“যথাঽঽর্হণং শস্ত্রসিদ্ধম্‌ তত্ত্বজ্ঞানম্‌ সর্বকর্মসংন্যমকারণম্।” (গীতা-ভাষ্য ৪.৩৭ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য) অর্থাৎ, শাস্ত্র-নির্দিষ্ট জ্ঞান একবার উদিত হলে সব কর্ম ও প্রমাণের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।

প্রমাণ-অতিক্রম (Pramāṇa-atikrama): অদ্বৈতের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় প্রমাণ-অতিক্রম—অর্থাৎ প্রমাণের সীমা অতিক্রম। শাস্ত্র তখনও সত্য, কিন্তু তার কার্য শেষ হয়েছে। যেমন দীপ জ্বালাবার পরে তার তেল ফুরিয়ে গেলেও আলো থেকে যায়—তেমনি শাস্ত্রের শক্তি নিঃশেষ হলে আত্মা নিজেই জ্বলে ওঠে।

শঙ্কর এই প্রক্রিয়াকে বোঝাতে বলেন—“শ্রবণাদিনৈব পরোক্ষব্রহ্মজ্ঞানম্, নিদিধ্যাসনাত্ তু অপরোক্ষব্রহ্মসাক্ষাৎকারঃ।” (মাণ্ডূক্য-কারিকা ভাষ্য, ৩.৩৫) অর্থাৎ, শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন দ্বারা জ্ঞান প্রথমে পরোক্ষ হয়; অবিদ্যা সরে গেলে সেটিই অপরোক্ষ ব্রহ্মসাক্ষাৎকারে পরিণত হয়।

স্বয়ং-প্রকাশ চেতনার উদ্‌ভাস—জ্ঞান উদিত হলে, চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে প্রকাশিত হয়—আর কোনো মাধ্যম বা প্রমাণের প্রয়োজন থাকে না।

শ্রুতি বলে—“ন তত্র চক্ষুর্ গচ্ছতি, ন বাচো, ন মনঃ।” (কেন উপনিষদ, ১.৩) অর্থাৎ, সেখানে চোখ, বাক্য, মন কিছুই পৌঁছায় না। চেতনা নিজেই জ্ঞাপক, অন্য কিছু দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয়।

তাই শাস্ত্রও নীরব হয়ে যায়—“যত্র বেদাঃ অবেদাঃ ভবন্তি।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৩.২৩) অর্থাৎ, যেখানে আত্মা নিজে স্বপ্রকাশ, সেখানে বেদও “অবেদ” হয়ে যায়—জানার উপকরণ আর থাকে না, কারণ জানার কিছুই অবশিষ্ট নয়।