অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো দশ



প্রথমে বলা হয়, ব্রহ্ম জগতের কারণ, পরে বলা হয়, ব্রহ্মের কোনো কারণত্ব নেই। এভাবেই অধ্যারোপ—প্রথমে ভুলটি অনুমোদিত করে জ্ঞানীকে সত্যের দিকে টেনে আনা হয়, আর অপবাদ—শেষে সেই অনুমোদনও বিলোপিত হয়। এই পদ্ধতিই একমাত্র বুদ্ধিকে সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কারণ মন “ধরলে” শেখে; কিন্তু সত্যে পৌঁছালে সেই ধরা হাত নিজে থেকেই ছেড়ে দিতে হয়।

অদ্বৈত শিক্ষাপদ্ধতিতে অধ্যারোপ ও অপবাদ একাধিক ধাপে ঘটে—এই ধারণার ভিত্তি শঙ্করাচার্যের নিজস্ব রচনায় ছড়িয়ে আছে।

ব্রহ্মসূত্রভাষ্যের ভূমিকা, অর্থাৎ অধ্যাসভাষ্যে, শঙ্কর বলেন—অধ্যাস বা অধ্যারোপ মানে পূর্বদৃষ্ট কোনো জিনিসের অন্যত্র আরোপ। আত্মা ও অনাত্মার এই পারস্পরিক আরোপই সংসারের মূল কারণ। শাস্ত্রের উদ্দেশ্য এই অধ্যাসের নিরাস—আত্মা-অনাত্মার অধ্যাসের জ্ঞানে বিলোপ—কর্ম নয়, জ্ঞানই তার উপায়। এখানেই অধ্যারোপ (ভুল আরোপ) ও অপবাদ (সেই আরোপ প্রত্যাহার)-এর মূল ধারণা গঠিত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদভাষ্যে (২.৩.৬) তিনি “নেতি নেতি”-কে অপবাদ-পদ্ধতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। উপাধির ধর্মগুলো একে একে নেতি নেতি বলে অপসারিত হলে অবশিষ্ট থাকে অখণ্ড চৈতন্য। একইভাবে ২.১.২০ ও ২.৪.১৪-এ তিনি বলেন—বহুভাবের অধ্যারোপ ভেঙে অদ্বৈত সত্যকে উদ্‌ভাসিত করাই এই পদ্ধতির লক্ষ্য।

ছান্দোগ্য উপনিষদভাষ্যে (৬.৮.৭ “তত্ত্বমসি”) শঙ্কর ভাগত্যাগ-লক্ষণা ব্যাখ্যা করেন। “তৎ” শব্দ থেকে মায়া-উপাধি, আর “ত্বং” শব্দ থেকে শরীর-মন-ইন্দ্রিয় উপাধি ত্যাগ করলে উভয়পক্ষেই অবশিষ্ট থাকে এক অখণ্ড চৈতন্য—এই অভিন্নতাই তত্ত্বমসির অর্থ। এটি অধ্যারোপ–অপবাদের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ।

মাণ্ডূক্য কারিকা-ভাষ্যে, গৌড়পাদের “প্রপঞ্চোপশম” তত্ত্ব অনুসরণ করে শঙ্কর দড়ি-সাপ, শুক্তি-রুপা ইত্যাদি উদাহরণ দেন। প্রথমে প্রতীতি স্বীকার করা হয় (অধ্যারোপ), পরে জ্ঞান উদিত হলে অপবাদে সেই প্রতীতি প্রত্যাহৃত হয়, এবং শেষে তুরীয়, নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্যে স্থিতি ঘটে।

গৌড়পাদের “প্রপঞ্চোপশম” তত্ত্ব অদ্বৈত বেদান্তের ইতিহাসে এমন এক গভীর মোড়, যেখানে বাস্তবতার সমস্ত দ্বৈত ধারণা—সৃষ্টি, লয়, কর্ম, মুক্তি—সব কিছুকে সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধিক ও তাত্ত্বিক স্তরে বিলোপ করা হয়েছে। তাঁর মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, এবং যাকে আমরা “বিশ্ব” বা “প্রপঞ্চ” বলে জানি, তা কেবল চৈতন্যে প্রতীয়মান এক অবাস্তব প্রতিফলন, যেমন স্বপ্নে-দেখা জগৎ।

প্রপঞ্চ মানে নাম-রূপ-গুণ-ভেদে বিভক্ত এই বহুবিধ বিশ্বপ্রতীতি। গৌড়পাদ বলেন, এই প্রপঞ্চ কখনও সত্যভাবে উদ্ভূত হয়নি; সৃষ্টি ও বিলয়, বন্ধন ও মুক্তি—সবই অবস্থানান্তরের ভ্রম। চেতনা নিজে অবিকৃত ও অচল; পরিবর্তন ঘটে শুধু প্রতীতিতে। তাই “প্রপঞ্চোপশম” বা “প্রপঞ্চ-উপশম” মানে, সেই প্রতীতির মিথ্যা প্রকৃতি জেনে বহুতার সম্পূর্ণ প্রশমন।

মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয় অবস্থা—যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুপ্তির অতীত—তাতেই এই প্রপঞ্চোপশমের অভিজ্ঞতা। জাগ্রত ও স্বপ্নে চেতনা অবলম্বন পায় বস্তুর; সুপ্তিতে সেই প্রতীতি বিলীন, কিন্তু অজ্ঞতা থাকে। তুরীয়ে না আছে বস্তুর প্রতীতি, না অজ্ঞতার আচ্ছাদন—অতএব সেটিই প্রপঞ্চনিবৃত চেতনা, অর্থাৎ ব্রহ্ম।

গৌড়পাদ এই অবস্থাকে বলেন অজাত—যার কোনো জন্ম নেই। তাঁর বিখ্যাত ঘোষণা, “নৈষা উৎপত্তির্থ নাশো, ন বদ্ধো ন সাধকঃ, ন মুমুক্ষুর্ ন বৈ মুক্তঃ”—অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে কিছুই জন্মায় না বা বিনষ্ট হয় না; কেউ আবদ্ধ নয়, কেউ মুক্তও নয়। এই অদ্বিতীয় চৈতন্যের স্বরূপই পরমার্থ, এবং সেই চেতনার অবস্থাই প্রপঞ্চোপশম।

এখানে মুক্তি মানে কোনো নতুন অবস্থা প্রাপ্তি নয়; বরং মিথ্যা ভ্রমের স্বয়ং বিলোপ। যেমন জাগরণের পর স্বপ্ন নিজে থেকেই নিঃশেষ হয়, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান জাগলে জগৎ-প্রপঞ্চ নিঃশেষ হয়—কোনো ধ্বংসের মাধ্যমে নয়, বরং জ্ঞানপ্রকাশে মায়ার অন্তর্ধানে।

এইভাবে “প্রপঞ্চোপশম” দর্শন বোঝায়—ব্রহ্মে স্থিত হওয়া মানেই সকল প্রপঞ্চের নিস্তব্ধতা। সেখানে নেই সৃষ্টি-লয়, কারণ-কার্য, কর্তা-ভোক্তা, মুক্ত-বন্ধ। কেবল আছে চৈতন্যের নিঃশব্দ ঐক্য, যেখানে সব বিভেদ ও ভাষা থেমে যায়।

গৌড়পাদের এই চিন্তা পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত ব্যাখ্যার ভিত্তি হয়, যেখানে ব্রহ্ম ও জগতের সম্পর্ককে “মায়া-অধ্যাস” দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়—অর্থাৎ, প্রপঞ্চোপশম মানেই মায়ার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি, আর তাতে প্রকাশ পায় অখণ্ড ব্রহ্মস্বরূপ চেতনা।

‘নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য’ অদ্বৈত বেদান্তে সেই পরম চেতনা, যা সমস্ত নাম-রূপ, কার্য-কারণ, জগৎ ও ব্যক্তিত্বের প্রপঞ্চ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি ব্রহ্ম বা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ—চিরচৈতন্য, চিরস্বতন্ত্র, চিরঅপরিবর্তনীয়।

“নিঃপ্রপঞ্চ” মানে যেখানে কোনো প্রপঞ্চ নেই, অর্থাৎ কোনো সৃষ্টি, গতি, পরিবর্তন, ভেদ বা সম্পর্কের উপস্থিতি নেই। “চৈতন্য” মানে, যে স্বপ্রভ, আত্মানুভূত, জ্ঞান-স্বরূপ। সুতরাং নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য অর্থ, এমন এক চেতনা, যা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ, অন্য কিছুর দ্বারা নির্ধারিত নয়, কোনো প্রপঞ্চে অংশ নেয় না, এবং সর্বপ্রপঞ্চের ভিত্তি হয়েও তার বাইরে অবস্থান করে।

প্রপঞ্চ মানে নাম-রূপ-গুণ-ভেদে বিভক্ত এই জগতের সমস্ত প্রকাশ, যা আসলে চেতনার উপর আরোপিত একটি অবিদ্যা-প্রসূত প্রতীতি। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে মনে হয়, তেমনি অবিদ্যার কারণে ব্রহ্মচেতনার উপর এই বহুতার প্রতীতি দেখা দেয়। যখন জ্ঞানের আলো জ্বলে ওঠে, তখন যেমন সাপের ভ্রম মুছে যায়, তেমনি জগতের প্রপঞ্চও বিলীন হয়—তখন যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিই নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য।

মাণ্ডূক্য উপনিষদ, কারিকা ২.৩৫ (গৌড়পাদীয় কারিকা)-তে দেখছি—
নিঃপ্রপঞ্চো হ্যায়ম্ আত্মা, প্রপঞ্চোপশমো’দ্বয়ঃ।
শান্তো নিঃসঙ্কল্পো নিঃশব্দো নিঃপ্রপঞ্চঃ শুভো’দ্বয়ঃ।।

অর্থ: “এই আত্মা (চৈতন্য) নিঃপ্রপঞ্চ, সমস্ত প্রপঞ্চ থেকে মুক্ত; সে প্রপঞ্চোপশম, অর্থাৎ সমস্ত বিভেদের প্রশমন; শান্ত, ইচ্ছাহীন, শব্দাতীত ও অদ্বৈত।” (মো’দ্ব—মম অদ্বৈত—আমি অদ্বৈত—আত্মোপলব্ধি)

প্রেক্ষাপট: গৌড়পাদ এখানে তুরীয় আত্মা-র বর্ণনা দিচ্ছেন—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির অতীত যে-চৈতন্য, তা কোনো প্রপঞ্চে অংশ নেয় না। সুতরাং আত্মা “নিঃপ্রপঞ্চ”—অচল, অজ, অদ্বৈত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (২.৪.১৪) ঘোষণা করছে—
যত্র ত্বস্য সর্বম্‌ আত্মৈবাভূৎ, তৎ কেং কম্‌ পশ্যেত্‌, কং জুঘন্যাত্‌, কং জ্ঞানুয়াত্‌?

অর্থ: “যেখানে সবই আত্মা হয়ে যায়, সেখানে কে কাকে দেখে, কে কাকে শুনে, কে কাকে আঘাত করে, বা কে কার সঙ্গে কথা বলে?”

প্রেক্ষাপট: ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বোঝাচ্ছেন যে, পরম জ্ঞান-অবস্থায় সব দ্বৈততা বিলীন হয়—তখন দ্রষ্টা, দর্শন ও দৃশ্যের ভেদ থাকে না। এটি “নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য”-এর সরাসরি বর্ণনা—যেখানে দেখা বা দেখার বস্তু, উভয়ই আত্মায় লীন।

মাণ্ডূক্য কারিকা, ২.৩২ (বা ৩.৩৮ অনুযায়ী, কিছু সংস্করণে)—গৌড়পাদীয় কারিকা-তে—
অজাতং জ্ঞানমাদ্বৈতং প্রপঞ্চোপশমং শিবম্‌।
নৈষা উৎপত্তির্থ নাশো, ন বদ্ধো ন সাধকঃ, ন মুমুক্ষুর্‌ ন বৈ মুক্তঃ।।

অর্থ: “ব্রহ্ম অজাত—তার কোনো সৃষ্টি নেই; সে অদ্বৈত, প্রপঞ্চনিবৃত, এবং শিব বা কল্যাণময়। প্রকৃতপক্ষে এখানে কোনো জন্ম, বিনাশ, বন্ধন, সাধনা, মুক্তি বা মুক্তপ্রার্থী কিছুই নেই।”

প্রেক্ষাপট: এটি গৌড়পাদের অজাতবাদ-এর চূড়ান্ত ঘোষণা—যেখানে বলা হচ্ছে, প্রপঞ্চের উৎপত্তি বা লয় আসলে কখনও ঘটেনি; কেবল চেতনার ভ্রমমাত্র। ব্রহ্ম বা আত্মা চিরকাল নিঃপ্রপঞ্চ অবস্থাতেই থাকে।

“নিঃপ্রপঞ্চো হ্যায়ম্ আত্মা”—মাণ্ডূক্য কারিকা, ২.৩৫—আত্মা প্রপঞ্চাতীত—তুরীয়, অদ্বৈত চেতনা।
“যত্র ত্বস্য সর্বম্ আত্মৈবাভূৎ”—বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২.৪.১৪—সবই আত্মা; ভেদ বিলীন—জ্ঞানস্থিতির একত্ব।
“অজাতং জ্ঞানমাদ্বৈতং, প্রপঞ্চোপশমং শিবম্”—মাণ্ডূক্য কারিকা, ২.৩২ বা ৩.৩৮—প্রপঞ্চ কখনও জন্মায়নি—অজাত, নিঃপ্রপঞ্চ ব্রহ্ম।

এই অবস্থায় দ্রষ্টা-দৃশ্যের বিভাজন সম্পূর্ণ মুছে যায়। চেতনা শুধু নিজের মধ্যেই অবস্থান করে—না কোনো দ্বিতীয় বস্তুর জ্ঞান, না কোনো অজ্ঞতার আচ্ছাদন।

ব্রহ্মই নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য, যেখানে কোনো উৎপত্তি নেই, কোনো নাশ নেই, কেবল স্বপ্রকাশ চৈতন্য। শঙ্করাচার্যও একে ব্যাখ্যা করেছেন “সর্বানুভূতিসাক্ষী, সর্ববৃত্তিশূন্য, নিরুপাধিক ব্রহ্ম” হিসেবে—যে-চেতনা সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী, কিন্তু নিজে কখনও কোনো বৃত্তি বা ভাব দ্বারা স্পর্শিত হয় না।

অভিজ্ঞতার দিক থেকে ‘নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্য’ মানে—আমি দেহ, মন বা ইন্দ্রিয় নই; আমি সেই চেতনা, যার মধ্যে এই সমস্ত কিছু ঘটে এবং লয়প্রাপ্ত হয়। আনন্দ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু—এসব চেতনার উপর ভাসমান তরঙ্গ, কিন্তু চেতনা নিজে কখনও নড়ে না। যেমন আয়নায় প্রতিফলন আসে-যায়, কিন্তু আয়না অপরিবর্তিত থাকে—তেমনি চেতনা নিজে সর্বদা স্থির, প্রপঞ্চ কেবল তার প্রতিফলিত ছায়া। (প্রোজেক্টরের শুভ্র পর্দার বেলাতেও তা-ই—আয়নার মতন।)

অতএব, নিঃপ্রপঞ্চ চৈতন্যই হল সেই তুরীয় অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির অতীত চেতনা—যেখানে আর কোনো ভেদ বা গতি নেই। সেখানে ব্রহ্ম এক, অদ্বিতীয়, নির্গুণ, নিরাকার, স্বয়ং-উজ্জ্বল। এই চেতনার মধ্যে সব প্রপঞ্চ মিলিয়ে যায়, যেমন তরঙ্গ সাগরে লয়প্রাপ্ত হয়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই নীরব, অপরিসীম অস্তিত্ব—চেতনা, যা সব কিছুর ভিত্তি, অথচ নিজে সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

উপদেশসাহস্রী-তে শঙ্কর শ্রবণ-মনন-নিধিধ্যাসনের ক্রম নির্দেশ করে বলেন—অবিদ্যার আবরণ তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞান দ্বারা সরে, আর বিক্ষেপ বহু জন্মের সংস্কার-প্রবাহ; তা নিধিধ্যাসন ও জ্ঞাননিষ্ঠার দৃঢ়তায় ক্রমে স্তব্ধ হয়। এখানেই সদ্যোনিবৃত্তি (আবরণ নিবারণ) ও ক্রম-নিবৃত্তি (বিক্ষেপ ক্ষয়), এই দুই স্তর স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

গীতা-ভাষ্যে (১৩.২) শঙ্কর বলেন, আত্মা-অনাত্মার ভেদ না জানার ফলে ক্ষেত্রের ধর্ম আত্মায় আরোপিত হয়—এটাই বন্ধনের মূল; জ্ঞান দ্বারা এই অধ্যারোপের অপবাদ ঘটে। আবার ১৮.৬৬-এ তিনি স্পষ্ট করেন, জ্ঞানই মুক্তির প্রধান অবলম্বন—অনাত্মধর্ম ত্যাগ করে আত্মায় স্থিত হওয়াই মুক্তি।

আবরণ ও বিক্ষেপ বা পোড়া দড়ির উদাহরণের ভাবার্থ শঙ্করের ভাষ্যজুড়ে ছড়ানো। অবিদ্যার আবরণ জ্ঞান দ্বারা সরে, আর বিক্ষেপ নিধিধ্যাসন ও জ্ঞাননিষ্ঠা দ্বারা স্তব্ধ হয়। দড়ি-সাপ বা শুক্তি-রুপার উদাহরণও এই সত্য বোঝায়—দেখা যায়, কিন্তু আর বিভ্রান্তি জন্মায় না।

অধ্যাসভাষ্যে সমস্যার নকশা, বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্যে অপবাদ-পদ্ধতি, উপদেশসাহস্রী ও গীতাভাষ্যে সদ্যো ও ক্রমনিবৃত্তির সাধনা—সব মিলিয়ে শঙ্করের দৃষ্টিতে মুক্তির পথ হলো ক্রমবর্ধমান অধ্যারোপ ও অপবাদের ধারাবাহিক প্রয়োগ, যা শেষে সমস্ত ভেদ ও আরোপ বিলিয়ে দিয়ে অদ্বিতীয় চেতনায় স্থির করে।

এখন দেখা যাক, মানুষ কেন দেবদেবীকে ভগবান ভাবে, তা ভেবেই পূজা করে।

অধ্যারোপ ও অপবাদ একবারে ঘটে না; এটি বহুস্তরীয়, ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা একটি প্রক্রিয়া। যেমন শ্রবণ-মনন-নিধিধ্যাসন ক্রমে বুদ্ধি ধীরে ধীরে অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়, তেমনি অধ্যারোপ-অপবাদ পদ্ধতিও মনকে ভাষা ও ভাবের স্তর ধরে ধরে চেতনার অভেদ সত্যে স্থির করে।

প্রথম স্তরে, শাস্ত্র ভাষিক ও ভাবগত অধ্যারোপ করে—মানুষের জগৎবদ্ধ মনকে আরম্ভের জন্য একটি দেবতা বা সৃষ্টিকর্তার ধারণা দেয়। বলা হয়, “ঈশ্বরই সৃষ্টিকর্তা, পালনকারী, সংহারকারী।” পরমার্থে ব্রহ্ম সৃষ্টিকর্তা নন, কিন্তু সাধনার সুবিধার জন্য ঈশ্বরভাব স্বীকৃত হয়। দেবদেবী, শক্তি, ঈশ্বর—সবই প্রতীকমাত্র; এরা মানবচিত্তকে অভ্যন্তরীণ ঈশ্বরবোধের দিকে টানে।

দ্বিতীয় স্তরে, প্রথম অপবাদ ঘটে। মানুষ বুঝতে শেখে যে, ঈশ্বর কোনো ব্যক্তিসত্তা নন, বরং সর্বব্যাপী চেতনা। তখন বলা হয়, “ঈশ্বর এক, অখণ্ড চৈতন্য, যিনি সব রূপে প্রকাশিত।” এখানে নাম-রূপ-সৃষ্টিকর্তা ভাব গলে যায়; ঈশ্বরের প্রকৃত স্বরূপ—চৈতন্য বা ব্রহ্ম—প্রকাশ পায়।

তৃতীয় স্তরে, ব্যাবহারিক জগতে ফিরে এসে আবার একটি অধ্যারোপ হয়। বলা হয়, “ব্রহ্ম মায়া দ্বারা ঈশ্বররূপে প্রকাশিত; এই ঈশ্বরই জগতের কারণ।” এটি ব্যাবহারিক সত্য—যেখানে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি পরস্পর পরিপূরক। এখানে চেতনা ও শক্তির একীকৃত ধারণা জ্ঞানীর প্রস্তুতি ঘটায়।