অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো সাত



‘বাস্’ ধাতু থেকে “বাসনা”—অবশিষ্ট-সংস্কার—মানে, যে-ছাপটি থেকে যায়। অতীত চিন্তা, অনুভূতি ও কর্ম মন-চিত্তে সূক্ষ্ম গন্ধের মতো লেগে থাকে; ধোয়া-ধুয়ি শেষে যে-আভাস টিকে থাকে, সেটাই বাসনা।

প্রতিটি অভিজ্ঞতা একটি সংস্কার রেখে যায়। সেই সংস্কারগুলি ঘনীভূত হলে একই ধরনের চিন্তা-অভ্যাস ফের উত্থিত হয়—প্রবণতা তৈরি হয়—এ প্রবাহই বাসনা হিসেবে কাজ করে। ফলে বর্তমান মানসিকতা গতকালের ছাপে চালিত হয়।

দর্শনে বাসনাই ইচ্ছা-কর্ম-ফল-পুনর্জন্মের কৌণিক চক্রকে টিকিয়ে রাখে। যতক্ষণ বাসনা অবশিষ্ট, ততক্ষণ “আমি দেহ–মন” এই অভ্যাসগত পরিচয় ভাঙতে চায় না; কামনা-আকাঙ্ক্ষা নতুন কর্মে ঠেলে দেয়, আর কর্মফল নতুন অভিজ্ঞতার বীজ বুনে দেয়।

এই চক্র একটি ঘূর্ণায়মান, স্ব-চালিত কারণ-ফল-চক্র, যা নিজেই নিজের উপর নির্ভর করে ঘুরতে থাকে। অর্থাৎ: অবিদ্যা থেকে ইচ্ছা (তৃষ্ণা), তা থেকে কর্ম, তা থেকে ফল, তা থেকে নতুন বাসনা, তা থেকে আবার ইচ্ছা, তা থেকে আবার কর্ম—এইভাবে একধরনের circular self-propelling loop তৈরি হয়।

যেমন চাকা একবার ঘুরতে শুরু করলে গতি জড়তার কারণে গতি নিজেই নতুন গতি তৈরি করে, তেমনি অবিদ্যা ও বাসনা একে অন্যকে বাড়তে দেয়—অবিদ্যা থেকে বাসনা, বাসনা থেকে কর্ম, কর্ম থেকে পুনর্জন্ম, পুনর্জন্ম থেকে আবার অবিদ্যা।

এটাই সেই কৌণিক চক্র—অর্থাৎ “angular” বা “circular motion”-এর মতোই এক অন্তহীন পুনরাবৃত্তির চক্র, যার বন্ধন ভাঙে কেবল জ্ঞানে, যখন ঘূর্ণন থেমে আত্মা নিজের স্বরূপে স্থির হয়।

জ্ঞানোৎপন্ন সংস্কার (যোগসূত্র, ১.৫০-১.৫১): সমাধি থেকে উদিত যে-প্রজ্ঞা, তা নিজেই এক বিশেষ “সংস্কার” রেখে যায়—এটিই জ্ঞানোৎপন্ন সংস্কার। যোগসূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এই প্রজ্ঞা-সংস্কার অন্য সব পুরোনো সংস্কারকে “প্রতিবন্ধ” করে—অর্থাৎ তাদের উত্থান দুর্বল করে দেয়, দৌড় থামায়। ফলে চিত্তে যে অভ্যাসগত তরঙ্গ (বৃত্তি) ওঠার কথা ছিল, তা আর আগের মতো জোরে উঠতে পারে না।

কীভাবে পুরনো সংস্কার দমে? এটি ‘দমন’ অর্থে চাপা দেওয়া নয়; বরং স্বচ্ছ প্রজ্ঞার ভাবনা-ধারা এতটাই স্থির ও উজ্জ্বল হয় যে, পুরোনো ছাপগুলো “উদয়-ক্ষমতা” হারায়। যেমন খুব আলোয় ক্ষীণ প্রদীপের শিখা ম্লান হয়ে যায়—আলো প্রদীপকে “চাপা” দেয় না, কেবল অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়। তেমনি জ্ঞান-সমাধির ধারাবাহিকতার সামনে কাম-ক্রোধ-লোভজাত বাসনা প্রতিবারই কম জোর পায়।

বীজশূন্যতার ধারণা—নির্বীজ সমাধির দ্বার: “বীজ” মানে চিত্তে সুপ্ত বৃত্তির বীজত্ব—যেখান থেকে নতুন তরঙ্গ উঠতে পারে। জ্ঞান-সমাধি গাঢ় হলে এই বীজ শুকিয়ে যায় (বীজক্ষয়)। যখন বীজশূন্যতা আসে, তখন চিত্ত আর নতুন তরঙ্গ তোলে না—এ অবস্থাই নির্বীজ সমাধির দোরগোড়া (YS, 1.51)। এখান থেকে আচমকা লাফ নয়; ধীরে ধীরে “বীজ কেবল শুকোচ্ছে—ফুরোচ্ছে—ফল দিচ্ছে না”—এই প্রবণতা পাকা হয়।

যোগসূত্র ৩.৯-৩.১২ অংশটি যোগীর মানসিক প্রবাহের ক্রমাগত রূপান্তরকে ব্যাখ্যা করে, যাকে বলা হয় “সমাধি-পরিণাম”—অর্থাৎ সমাধি চর্চার ফলে চিত্তের প্রকৃতির পরিবর্তন।

প্রথমে, সাধারণ মন বিকারপরায়ণ—চিত্তের গতি সর্বদা ইন্দ্রিয়বস্তু ও বাসনায় ছুটে যায়। কিন্তু যোগাভ্যাস বাড়লে মন ধীরে ধীরে নিবৃত্তি-পরায়ণ হয়ে ওঠে, অর্থাৎ বিশ্রাম ও স্থিরতার দিকে ঝোঁকে।

এই অবস্থায় বিরাম-প্রত্যয় জন্মায়—একটি সূক্ষ্ম জ্ঞানাবস্থা, যেখানে চিত্ত নিজের চলাচলকে থামিয়ে একমুহূর্তের নিস্তব্ধতায় স্থির হয়। এই বিরামাবস্থা বার বার চর্চায় গভীর হলে, মন বিকার থেকে নিবৃত্তির অভিমুখে স্থায়ী পরিবর্তন পায়।

এই রূপান্তরই “সমাধি-পরিণাম”—মন ধীরে ধীরে বৃত্তিময়তা থেকে নিস্তব্ধতার দিকে গতি পরিবর্তন করে। ফলত, পুরোনো সংস্কারের ওঠানামা কমে যায়; নতুন জ্ঞান-সংস্কার, যা স্থিরতা ও স্বচ্ছতার, সেটি প্রধান প্রবাহ বা ডিফল্ট অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।

এই সূত্রগুলির সারকথা হলো—যোগাভ্যাসে মন আর প্রবণতা অনুযায়ী দৌড়োয় না; বরং অভ্যাসগতভাবে নিবৃত্তির দিকে প্রবাহিত হয়। এটিই যোগীর প্রকৃত “চিত্ত-পরিণাম”—যেখানে মানসিক তরঙ্গের প্রবাহ বদলে যায়, এবং মন ক্রমশ আত্ম-স্বরূপে বিশ্রাম নিতে শেখে।

অদ্বৈত সাধনায় “বাসনা-ক্ষয়” শুধু জ্ঞানার্জনের কাজ নয়—এটি জ্ঞানে স্থিত হওয়ার অবিরাম অনুশীলন। শ্রবণ ও মননে আত্মা-ব্রহ্মের একত্ব-বোধ জাগে, কিন্তু সেই বোধ স্থায়ী না হলে পুরোনো সংস্কার, অভ্যাস ও বাসনা বার বার চেতনার উপর ভেসে ওঠে।

অদ্বৈতের মতে, অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার দুটি দিক আছে—আবরণ (অগ্রহণ) ও বিক্ষেপ (অন্যথা-গ্রহণ)। শ্রবণ ও মননের মাধ্যমে যখন আবরণ সরে যায়, তখন আত্মা সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান জন্মায়। কিন্তু চিত্তের বিক্ষিপ্ত অভ্যাস, দেহ-মন-কর্তৃত্বের প্রবণতা তখনও রয়ে যায়—এগুলো নিঃশেষ হয় নিদিধ্যাসনে, অর্থাৎ গভীর চিন্তন ও আত্মনিষ্ঠ ধ্যানে।

অগ্রহণ ও অন্যথা-গ্রহণ—এই দুই শক্তিই মায়ার কার্যপ্রণালী সম্পূর্ণ করে।

অগ্রহণ মানে না-ধরা বা না-জানা। এটি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞানতা। আত্মা স্বয়ং শুদ্ধ চৈতন্য, কিন্তু অবিদ্যার আবরণশক্তি সেই সত্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফলে আত্মা নিজেকে নিজের মতো করে চেনে না, নিজের প্রকৃত সত্তা অজানাই থেকে যায়। যেমন কেউ আয়নায় নিজের মুখ চিনতে না পেরে অন্য কারও মুখ বলে ভুল করে, তেমনি আত্মা নিজের স্বরূপ না জেনে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কে “আমি” বলে ধরে। এই অবস্থাই অগ্রহণ—আত্মজ্ঞানহীনতার স্তর।

অন্যথা-গ্রহণ মানে ভুলভাবে ধরা বা অন্য কিছু সত্য বলে মনে করা। এটি ভ্রান্ত প্রতীতি বা বিভ্রমের স্তর, যেখানে আত্মা না জেনে ভুল জানে। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ধরা, তেমনি আত্মা দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও জগৎকে নিজের সত্য বলে গ্রহণ করে। এটি অবিদ্যার বিক্ষেপশক্তির কাজ—যেখানে আত্মার অজ্ঞতাকে ভিত্তি করে নাম-রূপ, কর্তা-ভোক্তা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি জগতপ্রপঞ্চের প্রক্ষেপ ঘটে।

অগ্রহণ অর্থে আত্মার অজ্ঞতা, আর অন্যথা-গ্রহণ অর্থে সেই অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ভ্রান্ত জগৎ-জ্ঞান। যখন শ্রবণ ও মননে জ্ঞান জাগে, তখন অগ্রহণ বা অজ্ঞতা দূর হয়; আর নিদিধ্যাসন বা ধ্যাননিষ্ঠায় বিক্ষেপশক্তি স্তব্ধ হলে অন্যথা-গ্রহণও লুপ্ত হয়। তখন আত্মা নিজের প্রকৃত চৈতন্যস্বরূপে উদ্‌ভাসিত হয়—এই অবস্থাই মুক্তি।

‘আত্মার অজ্ঞতা’ বলতে বোঝানো হয়—নিজের প্রকৃত স্বরূপকে না জানা, বা ভুলভাবে জানা।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, আত্মা হলো শুদ্ধ চৈতন্য, নিত্য, অসঙ্গ, অদ্বিতীয় ও স্বয়ংপ্রকাশমান—কিন্তু মানুষ সাধারণত এই আত্মাকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয় বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। এই ভুল পরিচয়ই আত্মার অজ্ঞতা।

অর্থাৎ, আত্মা নিজেকে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়-চিন্তা-স্মৃতি ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে এবং ভাবে—“আমি এই শরীর”, “আমি সুখী বা দুঃখী”, “আমি কর্তা বা ভোক্তা”। প্রকৃতপক্ষে এগুলো আত্মা নয়, বরং আত্মার উপরে প্রতিবিম্বিত জড় উপাধি।

এই অজ্ঞতা শুরু থেকে নয়, কিন্তু অনাদি (beginningless)—অর্থাৎ, এর কোনো শুরু ধরা যায় না; যতক্ষণ জ্ঞান না হয়, ততক্ষণ তা থাকে। তবে এটি অসত্তা-প্রবণ, কারণ জ্ঞান উদিত হলে অজ্ঞতা সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়, ঠিক যেমন অন্ধকার আলো এলে থাকে না।

অতএব, “আত্মার অজ্ঞতা” মানে আত্মা নিজেকে নিজের মতো না চিনে সীমিত উপাধিতে আবদ্ধ করে ফেলা। এই অজ্ঞানই সমস্ত বন্ধনের মূল—এ থেকেই কর্তা-ভোক্তা ভাব, কামনা-বাসনা, কর্ম ও দুঃখের চক্র শুরু হয়। যখন জ্ঞান জন্মায়—“আমি দেহ নই, আমি চৈতন্যস্বরূপ”—তখন এই অজ্ঞান সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়, এবং আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত হয়—এটাই মুক্তি।

বাসনা-ক্ষয়ের মানে এই—জ্ঞানটিকে ধারণ করা নয়, বরং সেই জ্ঞানে স্থিত থাকা, যতক্ষণ না কর্তা-ভোক্তা-ভাব, অহং-অভিমান, ইচ্ছা-আসক্তির ঢেউ নিজের ভারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এটি কোনো দমন নয়, বরং বোধের মধ্যে মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে পুরোনো অভ্যাসের গলন।

যখন এই স্থিতি গভীর হয়, তখন কর্ম করলেও “আমি কর্তা” বা “আমি ভোক্তা” এই ধারণা আর টিকে থাকে না। চেতনা নিজের স্বরূপে স্বতঃপ্রভা হয়ে ওঠে—এ অবস্থায় আবরণ-নিবৃত্তি ও বিক্ষেপ-নিবৃত্তি উভয়ই ঘটে, এবং আত্মস্বরূপে স্বাভাবিক স্থিতিই মুক্তির চিহ্ন।

বাস্তব অনুশীলনের রেখাচিত্রে অদ্বৈত ও যোগের সাধনাকে একত্রে মেলানো যাক।

দৈনিক ব্রহ্মাবিদ্যা-চিন্তা মানে নিয়মিতভাবে আত্ম-স্বরূপ ও ব্রহ্মতত্ত্বের ভাবনায় মন স্থাপন করা—“আমি দেহ নই, আমি চৈতন্যস্বরূপ”—এই স্মরণ জ্ঞানসংস্কারকে পুষ্ট করে।

প্রত্যহ স্ববীক্ষণ মানে প্রতিদিন নিজের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে দেখা—আমি কেমনভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছি, আমার চেতনা কোথায় মিশে যাচ্ছে। এতে আত্মচেতনা দৃঢ় হয় এবং বস্তু বা ভাবের অনিত্যতা স্পষ্ট হয়।

মানসিক জপ ও ধ্যান অভ্যন্তরীণ লয়ের অনুভব বাড়ায়—মনের অস্থিরতা প্রশমিত হয়, চিত্ত স্থির ও স্বচ্ছ হয়। এটি চেতনার কেন্দ্রীভবন ঘটায়, ফলে জ্ঞান-বীজ স্থায়ীভাবে স্থাপিত হয়।

কর্মে অ-কর্তৃত্ববোধ মানে কাজ করেও “আমি কর্তা” এই ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকা। যা করা হচ্ছে, তা ঈশ্বরার্পণ বা ব্রহ্মার্পণ হিসেবে দেখা—“আমি শুধু যন্ত্র, কর্তা ব্রহ্ম।” এই মানসিক ভঙ্গি অহং-দূষণ ও আসক্তি কমায়।

এই চার অনুশীলন একত্রে জ্ঞান-সংস্কারকে ঘন ও প্রাধান্যশীল করে তোলে। তখন বাসনা বা পুরোনো প্রবৃত্তি উত্থিত হলেও তা আর জড়িয়ে ফেলে না—মন তা দেখে, কিন্তু আটকে থাকে না; জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়। এভাবেই চিত্ত ক্রমে নির্বীজ অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়।

এই অবস্থার প্রধান লক্ষণ হলো—চিত্তের প্রবাহ উলটো ঘোরা, অর্থাৎ বহির্মুখ প্রবণতা অন্তর্মুখী হতে শুরু করা। যখন রাগ, দ্বেষ ও ভয় ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তখন বোঝা যায়, চিত্তে বৈরাগ্যের স্থিতি বাড়ছে। আকর্ষণ বা বিকর্ষণের পরিস্থিতিতে মন দ্রুত স্থির হয়ে যায়, ফলে স্থিতি বা স্থিরতা দ্রুত আসে—বিরোধ মেটে, প্রতিক্রিয়া কমে। অন্তরের গভীরে সমতা, করুণা, এবং একধরনের স্বচ্ছ নিঃস্পৃহতা জন্মায়। “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”—এই অহংবোধ ক্রমে হালকা হয়ে যায়। এই পরিবর্তনগুলো প্রমাণ করে যে, জ্ঞান-সংস্কার বা আলোকিত প্রবণতা ধীরে ধীরে পুরোনো বাসনা-সংস্কারের ওপর আধিপত্য নিচ্ছে।

যত বাসনা-বীজ শুকিয়ে যায়, তত প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কমে। কম প্রতিক্রিয়া মানে কম নতুন ছাপ—মন আর নিজেকে পুনরাবৃত্ত অভ্যাসের বৃত্তে ফেলে না। এতে চিত্তের গতি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়।

“দমন” (repression) আর “নিবৃত্তি” (cessation) এক নয়। দমন মানে জোর করে কোনো অনুভূতি বা বাসনাকে চাপা দেওয়া—এতে তার বীজ টিকে যায়, সুযোগ পেলে আবার জেগে ওঠে। কিন্তু জ্ঞান-সমাধির নিবৃত্তি মানে আলো ফেলে দেখা, স্বীকার করা, তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে দেওয়া। এখানে কোনো জোর নেই—শুধু চেতনার আলোকিত উপস্থিতি, যা অন্ধকারের মতো অজ্ঞান ও আসক্তিকে স্বাভাবিকভাবে বিলীন করে দেয়।

এই প্রক্রিয়াতেই চিত্ত পরিণত হয়—চাপা নয়, মুক্ত; প্রতিরোধ নয়, আত্মপ্রকাশ; এবং এই মুক্ত প্রবাহই শেষপর্যন্ত নিয়ে যায় নির্বীজ সমাধির দিকে।

কোনো কাপড়ে পারফিউম লাগানো থাকলে বহুবার ধুলেও একধরনের গন্ধের আভাস থেকে যায়, ঠিক তেমনই বহু জন্ম ও অভ্যাসের ফলে মনে জমে-থাকা বাসনাগুলো সহজে মুছে যায় না। বাহ্যত দমন করা গেলেও, অন্তর্লয়ে তারা টিকে থাকে—এটাই “বাসনা”।

যখন বার বার রোদ, হাওয়া ও ধোয়ার সংস্পর্শে কাপড়ের গন্ধ একসময় মিলিয়ে যায়, তখন সেই আভাসও আর টেকে না। এই প্রাকৃতিক মিলিয়ে যাওয়াই হলো “বাসনা-ক্ষয়”। ততদিন পর্যন্ত, আচমকা কোনো গন্ধ যেমন পুরোনো স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, তেমনি কোনো দৃশ্য, শব্দ বা চিন্তা পুরোনো বাসনাকে জাগিয়ে মনকে সেই চেনা পথে নিয়ে যায়।

কিন্তু যখন চিত্ত জ্ঞান-সমাধির “রোদ ও হাওয়া”—অর্থাৎ সচেতন প্রত্যক্ষ ও ধ্যানের আলোক-প্রবাহে পর্যাপ্তভাবে পরিশুদ্ধ হয়, তখন সেই আভাসও লোপ পায়। চিত্ত তখন স্বতঃনিবিড়, অচঞ্চল, স্বচ্ছ হয়ে যায়। এই অবস্থায় আত্মা নিজের অন্তর্নিহিত দীপ্তিতে, স্ব-প্রকাশিত চৈতন্যে, অবিচলভাবে স্থিত হয়—যাকে বলে “স্বরূপ-স্থিতি” বা “কৈবল্য।”