২. পরমার্থে (ব্রহ্মজ্ঞানে): কিন্তু পরমার্থিক সত্য, অর্থাৎ, ব্রহ্ম, ইন্দ্রিয়, যুক্তি বা ভাবনার গণ্ডি অতিক্রমী। ব্রহ্মকে সাধারণ প্রমাণের মাধ্যমে জানা যায় না। তাই শ্রুতি (বেদান্তিক শাস্ত্র) একমাত্র উপায়। এখানে শ্রুতি শুধু তথ্য দেয় না, বরং এটি একটি নির্দেশ, যা শেষপর্যন্ত অনুধ্যান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে “অর্থে” গলে যায়, অর্থাৎ, ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতে পরিণত হয়।
ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মবোধের এই তিন ধাপ—
প্রথম ধাপ—শ্রবণ (শ্রুতি বা উপদেশ শোনা): গুরু বা শাস্ত্রের মুখে মহাবাক্য শুনে প্রথম যে-উপলব্ধি জাগে, সেটাই ব্রহ্মাকৃতি-বুদ্ধি—অর্থাৎ “আমি-ই সেই ব্রহ্ম”, এই ধারণার প্রথম উদ্ভব। এখানে জ্ঞান তাত্ত্বিক বা বৌদ্ধিক স্তরে থাকে, কিন্তু মূল বীজটি রোপিত হয়।
দ্বিতীয় ধাপ—মনন (যুক্তিচিন্তা ও সংশয়-নিবারণ): শ্রবণে উদিত জ্ঞানে যদি সন্দেহ, বিভ্রান্তি বা দ্বন্দ্ব থাকে, মনন তা পরিষ্কার করে। যুক্তি ও শাস্ত্রসমর্থন দ্বারা নিশ্চিত হয়—“এই অর্থই যথাযথ, অন্য কোনো ব্যাখ্যা নয়।” এর ফল হলো স্থিরতা—ইদমর্থঃ এভাবঃ, “এই অর্থই এমন।”
তৃতীয় ধাপ—নিদিধ্যাসন (অন্তর্মুখ ধ্যান ও আত্ম-অভ্যাস): এটি গভীর অন্তঃসাধনা, যেখানে জ্ঞান শুধু ধারণা নয়—অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ধ্যান, স্মরণ ও চেতনার প্রশমন দ্বারা দেহ, মন, কর্তা-ভাবের ভ্রান্ত ধারণা গলে যায়। এখানে আত্ম-চৈতন্যে প্রত্যক্ষভাবে স্থিত হওয়া ঘটে—আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্য অনুভূত হয়।
এই তিন ধাপ মিলেই জ্ঞান-প্রক্রিয়ার পূর্ণতা—শ্রবণ জাগায় জ্ঞানের বীজ, মনন দেয় যুক্তির পুষ্টি, নিদিধ্যাসন ঘটায় আত্মবোধের বাস্তব রূপ। ফলত, “শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন” হল ব্রহ্মজ্ঞানের অপরিহার্য ক্রম, যা অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তির একমাত্র পথ বলে মান্য।
এই সাধনার ফলে দুটি প্রধান পর্যায় দেখা যায়:
১. প্রথমে আবরণ-নিবৃত্তি: ব্রহ্ম-স্বরূপ অপ্রচ্ছন্ন হয়। অবিদ্যার ‘আবরণ’ শক্তি দূর হয়, ফলে ব্রহ্মের প্রকৃত রূপটি আর ঢাকা থাকে না, প্রকাশিত হয়।
২. পরে বিক্ষেপ-নিবৃত্তি: চিন্তার ঢেউ স্তিমিত হয়, আকাঙ্ক্ষা-দ্বেষ-ভয় ক্ষীয়মান হয়। অবিদ্যার ‘বিক্ষেপ’ শক্তি দূর হয়, ফলে মনের চঞ্চলতা, ভোগবাসনা, ঘৃণা ও ভয় দূর হয়ে চিত্ত শান্ত হয়। প্রতিষ্ঠা ঘটে অখণ্ড-বোধের—অর্থাৎ, অখণ্ড আত্ম-স্বরূপের উপলব্ধি দৃঢ় হয়।
অদ্বৈত বেদান্ত ভ্রান্তিকে “বাধযোগ্য উপস্থিতি” হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যা জগতের ব্যাবহারিক উপলব্ধিকে মূল্য দেয়, কারণ ভ্রান্তি যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ তার একটি বাস্তব প্রভাব থাকে। আবার পরমার্থে জ্ঞান-প্রভায় তার মিথ্যাত্ব প্রকাশিত হয়, কারণ চরম সত্যের সামনে ভ্রান্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। শ্রুতি পথ দেখায়, মনন তা নিশ্চিত করে, নিদিধ্যাসন স্থিতি আনে—এই ক্রমেই অনির্বচনীয়ের গ্রন্থি খুলে যায়, অর্থাৎ, ব্রহ্মের অদ্বৈত স্বরূপের উপলব্ধি হয় এবং জন্ম-মৃত্যুচক্রের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ হয়। এটি শুধু একটি দার্শনিক তত্ত্ব নয়, বরং মানবজীবনের পরম লক্ষ্য অর্জনের একটি সুনির্দিষ্ট পথ।
অদ্বৈত বেদান্তের “অনির্বচনীয়-খ্যাতি” তত্ত্বকে বুঝতে হলে প্রথমে “খ্যাতি” বা ভ্রান্তিজ্ঞান-তত্ত্ব বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা জানা দরকার।
দর্শন-মতে, খ্যাতি মানে এমন জ্ঞান, যা কোনো বস্তুর প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে মেলে না—অর্থাৎ ভুল জ্ঞান বা বিভ্রম। যেমন, অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হওয়া, মুক্তোকে রুপো বলে ভ্রম করা।
এই ভ্রান্তি কীভাবে ঘটে, তা নিয়ে বিভিন্ন দর্শনের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে—
ন্যায়-মতে—এটি অন্যথা-খ্যাতি—বস্তু অন্য কিছুর রূপে ভুলভাবে প্রতীয়মান হয়। আমরা যা দেখি (দড়ি), সেটিকে অন্য কিছুর (সাপের) জ্ঞান দিয়ে আচ্ছাদিত করি। এখানে দুটি জিনিস আছে—বাস্তব দড়ি ও স্মৃতিজাত সাপ-ভাব।
মীমাংসা মতে—এটি অতিসংস্কার-খ্যাতি—মানসিক সংস্কার বা পূর্ব ধারণা এত প্রবল হয় যে, বাস্তব বস্তুটি তার দ্বারা ঢেকে যায়। অতীত অভিজ্ঞতার ছাপই বিভ্রমের কারণ।
বৌদ্ধ-মতে—এক্ষেত্রে পথ দুটি: আত্ম-খ্যাতি—জ্ঞান নিজেই নিজের বিভ্রম সৃষ্টি করে, বাহ্য বস্তু নেই; অসৎ-খ্যাতি—যা অনুভূত হচ্ছে, তা একেবারেই অবাস্তব; কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নেই।
অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাখ্যা—অনির্বচনীয়-খ্যাতি, অর্থাৎ “না সৎ, না অসৎ”। এখানে ভ্রান্ত বস্তু (যেমন দড়িতে সাপ-বোধ) সম্পূর্ণ বাস্তব নয়, কারণ জ্ঞান উদিত হলে তা লুপ্ত হয়; আবার সম্পূর্ণ অবাস্তবও নয়, কারণ তা প্রতীতি দেয়। এই দ্বৈত-অবস্থা—যেখানে বস্তুটি অনুভূত হলেও উচ্চতর জ্ঞান দ্বারা বিলুপ্ত—তাই তাকে বলা হয় অনির্বচনীয়, অর্থাৎ ভাষায় নির্ধারণ করা যায় না।
অদ্বৈতের মতে, জগতও তেমনই—প্রতীতি হয়, কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞানে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন দড়িতে সাপ দেখা মিথ্যা, তেমনি ব্রহ্মে জগতের ভেদও মিথ্যা। অতএব, অনির্বচনীয়-খ্যাতি তত্ত্বই অদ্বৈত বেদান্তে মায়া ও বিভ্রমের দর্শনীয় ভিত্তি—যেখানে ভ্রান্তি কোনো একক কারণে নয়, বরং চেতনার আংশিক আবরণ ও প্রকল্পনের যৌথ ফল।
এখানে বলা হয়—ভ্রমের যে-বস্তুটি দেখা যায় (যেমন দড়ির উপর সাপ), সেটি না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব, বরং “সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”—অর্থাৎ, এক অনির্ণেয়, অনির্বচনীয় অবস্থা। সাপটি অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান, তাই একে অসৎ বলা যায় না; কিন্তু জ্ঞানোদয়ে বিলুপ্ত হয়, তাই একে সত্যও বলা যায় না। এই মিশ্র অবস্থাই “অনির্বচনীয়”—যা ভাষা বা চিন্তায় নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না।
অদ্বৈত বলে, এই ভ্রমের কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যা বা মায়া ব্রহ্মের উপর মিথ্যা প্রক্ষেপণ ঘটায়—যেমন চৈতন্যের উপর দেহ, মন, নাম-রূপ ইত্যাদি আরোপিত হয়। সাপ-দড়ির উদাহরণে দড়ি হলো ব্রহ্ম, আর সাপ হলো মায়ার প্রক্ষেপণ। যতক্ষণ প্রকৃত জ্ঞান উদিত হয়নি, ততক্ষণ সেই মিথ্যা জ্ঞান বাস্তবের মতোই কার্যকর থাকে। জ্ঞান উদিত হলে বিভ্রম বিলুপ্ত হয়, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা অস্বীকার করা যায় না—এ কারণেই বলা হয় এটি “অনির্বচনীয়”।
অতএব, অনির্বচনীয়-খ্যাতি তত্ত্বে ভ্রম বাস্তবও (সৎও) নয়, আবার অবাস্তবও (অসৎও) নয়; এটি আপাত বাস্তব—যতক্ষণ অবিদ্যা বিদ্যমান, ততক্ষণ তা কার্যকর। এই ধারণা থেকেই অদ্বৈত জগৎকেও ব্যাখ্যা করে—যেভাবে সাপ দড়ির উপর অনির্বচনীয়ভাবে প্রতীয়মান, তেমনি জগৎও ব্রহ্মের উপর অনির্বচনীয়ভাবে প্রতীয়মান।
অতএব, অনির্বচনীয়-খ্যাতি মানে—“ভ্রম এমন এক জ্ঞান, যেখানে যে-বস্তুটি দেখা যায়, তা না সত্য, না মিথ্যা, বরং মায়াজাত অনির্বচনীয়”। এই তত্ত্বই অদ্বৈতের মায়া-সিদ্ধান্ত-এর যুক্তিগত ভিত্তি, যা বলে—জগৎ মিথ্যা নয়, আবার একেবারে শূন্যও নয়; এটি অনির্বচনীয়, ব্রহ্মের উপর অবিদ্যা-প্রক্ষেপিত এক আপাত বাস্তব প্রতীতি মাত্র।
ভারতীয় দর্শনে, ভ্রম বা মিথ্যা জ্ঞান কীভাবে ঘটে, তা ব্যাখ্যা করতে বিভিন্ন দর্শনশাখা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত তিনটি তত্ত্ব হলো আত্ম-খ্যাতি, অসৎ-খ্যাতি এবং অন্যথা-খ্যাতি।
আত্ম-খ্যাতি বা স্ব-উৎপাদ মতটি বৌদ্ধ যোগাচার (বিজ্ঞানবাদ) শাখার। এর মতে, কোনো বাহ্যবস্তু বাস্তবে নেই; যা-কিছু দেখা বা অনুভব করা যায়, তা মনের নিজস্ব উৎপাদন। অর্থাৎ, ভ্রমের বস্তু বাইরে নয়, মনের ভেতরেই তৈরি হয়। যেমন অন্ধকারে দড়ির উপর সাপ দেখা মানে বাইরের সাপ নয়, মনের মধ্যেই সেই সাপ-ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্বে বলা হয়—মন নিজেই সব কিছুর স্রষ্টা, বাহ্য জগৎ কেবল মানসিক প্রক্ষেপণমাত্র। তাই একে স্ব-উৎপাদ বলা হয়।
অসৎ-খ্যাতি মতটি বৌদ্ধ মধ্যমক বা শূন্যবাদ দর্শনের। এর মতে ভ্রমের বস্তু সম্পূর্ণভাবে অবাস্তব—যা দেখা যায়, তা আসলে আদৌ কোথাও নেই। দড়ির উপর সাপ দেখা মানে সাপ নামের কোনো সত্তা কোনো স্তরেই নেই; এটি নিছক অবিদ্যমান বস্তুর কল্পনা। এই তত্ত্বে বলা হয়, সব অভিজ্ঞতা ও সমস্ত জগৎ অনিত্য ও শূন্য; যা-কিছু প্রতীয়মান, তা মুহূর্তিক চেতনার স্রোত ছাড়া কিছু নয়।
অন্যথা-খ্যাতি মতটি ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের। এর মতে, ভ্রম মানে বাস্তব কোনো বস্তুকে ভুল স্থানে প্রতীয়মান হওয়া। যেমন, মুক্তোর মতো ঝিকমিক-করা জায়গায় রুপো দেখা মানে রুপো আসলে অন্য কোথাও আছে, কিন্তু ভুল সংযোগে সেটি এখানে দেখা গেল। তাই ভ্রমের বস্তু বাস্তব, কিন্তু তার উপলব্ধি অন্য স্থানে বা অন্য সময়ে ঘটেছে। তাই এই মতকে বলা হয় “একটিকে অন্য জ্ঞান”।
অতএব, আত্ম-খ্যাতি বলে, ভ্রম মনেরই সৃষ্টি; অসৎ-খ্যাতি বলে, ভ্রমের বস্তু আদৌ নেই; আর অন্যথা-খ্যাতি বলে, ভ্রমের বস্তু আছে, কিন্তু ভুল স্থানে প্রতীয়মান হয়েছে। এই তিন মত একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু তিনটিই ভ্রমের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। অদ্বৈত বেদান্ত এদের থেকে আলাদাভাবে বলে—ভ্রমের বস্তু না সত্য, না মিথ্যা, বরং অনির্বচনীয়; এই ব্যাখ্যাই অনির্বচনীয়-খ্যাতি-তত্ত্ব, যা মায়া-সিদ্ধান্তের মূল ভিত্তি।
এর বাইরে আরও কিছু খ্যাতি দেখা যায়, যেমন—
অতিসংস্কার-খ্যাতি (মীমাংসা): ঘন কুয়াশায় দূরের গাছকে মানুষ মনে হওয়া—ভ্রান্তি ঘটে অতীত সংস্কার বা স্মৃতির প্রভাবে। পূর্ব অভিজ্ঞতার ছাপ বর্তমান উপলব্ধিকে বিকৃত করে।
আকৃতিগত-খ্যাতি (প্রভাবাকর মীমাংসক): জলে বাঁকা দেখা যায় ডুবানো কাঠি—কাঠির রূপ বদলায় না, কিন্তু জ্ঞানের “আকৃতি” বদলে বিভ্রম ঘটে। জ্ঞানের আকৃতিই বিভ্রমের কারণ। বস্তু নয়, জ্ঞানের রূপের বিকৃতি থেকেই ভুল প্রতীতি জন্মায়।
অখণ্ড-খ্যাতি (ভামত-অদ্বৈত): দড়ি-সাপই উদাহরণ; কিন্তু এখানে বলা হয়—দড়ি ও সাপ আলাদা নয়, একই চেতনার মধ্যে অখণ্ডভাবে উভয় প্রতীতি ঘটে। বিভ্রম কোনো আলাদা বস্তুর জ্ঞান নয়; এক অখণ্ড চেতনার মধ্যেই সাপ ও দড়ি উভয়ের প্রতীতি ঘটে।
অতিভান্য-খ্যাতি (রামানুজ প্রবর্তিত বিশিষ্টাদ্বৈত): আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখা—বিভ্রম ঘটছে বাস্তবের (নিজের মুখ) ওপর ভিত্তি করে; মিথ্যা নয়, আংশিক প্রতিফলনমাত্র। ভুল জ্ঞান বাস্তব বস্তুর সীমিত প্রকাশমাত্র। বিভ্রমও কোনো বাস্তব অবলম্বনে ঘটে, সম্পূর্ণ শূন্য নয়।
সকল খ্যাতি বা ভ্রান্তির মূলে একই অভিজ্ঞতা—দেখা এক, জানা আরেক। কারণ-বিশ্লেষণেই যা পার্থক্য:
ন্যায় বলে, স্মৃতির ভুল;
মীমাংসা বলে, সংস্কারের প্রভাব;
বৌদ্ধ বলে, চেতনার নিজ বিভ্রম;
অদ্বৈত বলে, অনির্বচনীয় প্রতীতি;
বিশিষ্টাদ্বৈত বলে, বাস্তবের আংশিক প্রকাশ।
অর্থাৎ, ভ্রমের চেহারা একই, কিন্তু তার দর্শনীয় ব্যাখ্যা ভিন্ন। এই আটটি খ্যাতি-তত্ত্বই ব্যাখ্যা করে, ভ্রান্তি কীভাবে ঘটে; পার্থক্য কেবল এই প্রশ্নে—ভুলটা বস্তুর, স্মৃতির, সংস্কারের, না চেতনার নিজের।
আবরণ-শক্তি—এটি অবিদ্যার আচ্ছাদনক্ষমতা। আত্মা স্বয়ং চৈতন্যময়, কিন্তু এই শক্তি তার প্রকৃত স্বরূপকে ঢেকে দেয়। ফলে আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞান জন্মায়—“আমি দেহ-মন” এই ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়। আত্মার আসল প্রকৃতি গোপন থাকায় সে নিজেকে সীমিত বলে মনে করে।
বিক্ষেপ-শক্তি—এটি অবিদ্যার প্রক্ষেপণক্ষমতা। আত্মার স্বরূপ আচ্ছন্ন হলে এই শক্তি সেই অজ্ঞানভূমিতে নানা নাম-রূপ, কর্তা-ভোক্তা, সুখ-দুঃখ, অস্তি-নাস্তি প্রভৃতি বহুবিধ ভেদ ও প্রপঞ্চ তৈরি করে। এর ফলেই বহির্জগৎ, দেহ, মন ইত্যাদি প্রতীয়মান হয়।
অবিদ্যার দুই রূপ— অগ্রহণ—আত্মার প্রকৃত জ্ঞান না থাকা, অর্থাৎ আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞতা; এবং অন্যথা-গ্রহণ—আত্মা ছাড়া অন্য কিছুকে (যেমন দেহ, মন, জগৎ) আত্মা বলে ধরা।
প্রতিষেধ বা নিবৃত্তি—
আবরণ-নিবৃত্তি—শ্রবণ ও মননের মাধ্যমে আত্মা সম্পর্কিত অজ্ঞতা দূর করা।
বিক্ষেপ-নিবৃত্তি—নিদিধ্যাসন ও ধ্যানের মাধ্যমে প্রক্ষেপিত ভ্রান্ত জগৎ-ধারণা বিলোপ করা।
ফলে—যখন আবরণ ও বিক্ষেপ দুইই বিলুপ্ত হয়, তখন আত্মা নিজস্ব চৈতন্যস্বভাব হিসেবে উদ্ভাসিত হয়। তখন আর কোনো অজ্ঞান বা প্রপঞ্চ থাকে না—এই অবস্থাইয়, জ্ঞানের ফল হচ্ছে মুক্তি।
রজ্জু-সাপ দৃষ্টান্তে অন্ধকারই আবরণ, সাপ-দর্শন বিক্ষেপ; প্রদীপ জ্বলামাত্র আবরণ সরে যায়—এটাই আবরণ-নিবৃত্তি। কিন্তু দম-চেপে-ধরা ভয় বা দেহের কাঁপুনি খানিকক্ষণ টিকে গেলে সেটি বিক্ষেপ-নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত অবশিষ্ট-থাকা—অবশিষ্ট-সংস্কার (vāsanā) মাত্র।