অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: চুরানব্বই



শিষ্যও শুধু প্রশ্নকারী নন; তিনি যোগ্যতাসম্পন্ন অন্বেষী—বিবেক, বৈরাগ্য, ষট্‌সম্পদ (শম (মনের প্রশান্ত নিয়ন্ত্রণ), দম (ইন্দ্রিয় সংযম), উপরতি (বাহ্যকর্ম থেকে স্বতঃপ্রত্যাহার/নৈষ্কর্ম্যভাব), তিতিক্ষা (শীত-উষ্ণ-সুখ-দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা), শ্রদ্ধা (শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে অচঞ্চল আস্থা), সমাধান (একাগ্র চিত্তে ব্রহ্মতত্ত্বে স্থিতি)) ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রস্তুত, হাতে সমিত (ইন্ধন) নিয়ে গুরুকুলে উপস্থিত হওয়া সেই প্রস্তুতির প্রতীক। শিষ্য সন্দেহ তোলে, যুক্তি শোনে, বার বার পরীক্ষা করে; গুরুও প্রশ্নে উসকে দেন, কখনো নিস্তব্ধতা দিয়েই শেখান। তাই নচিকেতা-যম, উদ্দালক-শ্বেতকেতু, আঙিরস-শৌনক, যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী/গার্গী, প্রজাপতি-ইন্দ্র—এইসব সংলাপে দেখা যায়: অধ্যাপনা নয়, অনাবৃতকরণ; নির্দেশ নয়, নিগূঢ়তাকে নিজে দেখা ও শেখানো।

এই সম্পর্কের শাস্ত্রীয় মেরুদণ্ড দুইটি গুণে দাঁড়িয়ে—গুরুর মধ্যে শাস্ত্র-দক্ষতা ও আত্মস্থিতি, শিষ্যের মধ্যে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধানের ধৈর্য। গুরু মহাবাক্য উন্মোচন করেন, কিন্তু জ্ঞান ‘দেন’ না; শিষ্য নিজের চেতনার আলোয়ই দেখে নেয়। তাই উপনিষদীয় শিক্ষায় গুরু প্রকৃত অর্থে আয়না: প্রতিফলনে যে-মুখটি দেখা যায়, সেটিই স্বরূপ। নির্ভরতা নয়, নির্ভরতার অবসানই লক্ষ্য—বোধ উদিত হলে গুরুত্ব ব্যক্তিতে নয়, আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্যাবহারিক স্তরে গুরুর পথনির্দেশে কর্ম-উপাসনা মনকে শুদ্ধ করে, যোগ্যতা পাকাপোক্ত হয়; জ্ঞানোদয়ে দীক্ষার ফল সাজে—কর্তাভাব ক্ষয় হয়, সাক্ষীচেতনা স্পষ্ট হয়। তবু জগত চলতে থাকে; জ্ঞানীও চলেন, কিন্তু পোড়া দড়ির মতো তাঁর অহং আর বাঁধে না। শেষে এই গুরু-শিষ্য সম্পর্কও নিজের কাজ সেরে নিজেই লুপ্ত হয়—আঙুল সরে গেলে দিগন্তের চাঁদই কেবল থাকে। উপনিষদের গুরু-শিষ্য তাই কোনো বাহ্য কাঠামো নয়, মুক্তির অনুভবে পৌঁছোনোর সেই অন্তরঙ্গ সেতু—যেখানে “জানালেন” বা “শিখলাম”—এমন সব ভাষাই থেমে যায়, থেকে যায় কেবল আত্মার স্বপ্রকাশ।

এরপর আসে অপবাদ (apavāda)—অর্থাৎ সেই আরোপিত ধারণাকে প্রত্যাহার বা নিবারণ। শিক্ষক তখন বলেন, “যা-কিছু তুমি ঈশ্বর, জগৎ, কর্ম, উপাধি হিসেবে ভেবেছিলে—তা আসলে ব্রহ্মের উপর মায়াময় অধ্যারোপ মাত্র। ব্রহ্ম কখনও সৃষ্টি করে না, পরিবর্তিত হয় না, দ্বিতীয় কিছু নয়।” এইভাবে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত আরোপিত ভাবগুলি নিজেই পরিশোধনের জন্য ব্যবহার হয়, এবং শেষে সেই ধারণাগুলিই বাতিল হয়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে শঙ্কর বলেন—“প্রথমে বলা হয়, ব্রহ্মই জগতের কারণ (অধ্যারোপ); পরে বলা হয়, ব্রহ্মের কোনো কারণত্ব নেই (অপবাদ)।” প্রথম বক্তব্যটি শিষ্যর ধারণার স্তরে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন, দ্বিতীয়টি চূড়ান্ত সত্য প্রকাশের জন্য।

এই প্রক্রিয়া “বাধ-বিধেয়” সম্পর্কের মতো কাজ করে—একটি ধারণা অন্যটিকে বিলোপের জন্য আনা হয়। যেমন জাগ্রত জ্ঞান স্বপ্নকে বিলোপ করে, তেমনি অপবাদ পূর্বের অধ্যারোপকে বিলোপ করে, এবং শেষে শুধুমাত্র অদ্বিতীয় ব্রহ্ম প্রকাশিত থাকে।

অতএব, অধ্যারোপ-অপবাদ হলো অদ্বৈত শিক্ষার দার্শনিক সিঁড়ি—যেখানে প্রথমে মিথ্যা ধারণা ব্যবহার করে সত্যের দিকে উঠতে হয়, এবং যখন সেই সত্য উদিত হয়, তখন মিথ্যা ধারণাটিও স্বয়ং বিলীন হয়। এইভাবেই বেদান্ত বলে—“ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।”

‘ভেদাভেদ’ শব্দটি দুটি অংশে গঠিত—ভেদ ও অভেদ। অর্থাৎ পার্থক্য এবং অপার্থক্য, ভিন্নতা ও ঐক্য। এই দর্শনের মূল ভাব হলো, জীব, জগৎ এবং ব্রহ্মের মধ্যে যেমন ঐক্য আছে, তেমনি পার্থক্যও আছে। তারা একদিক দিয়ে অভিন্ন, আরেকদিক দিয়ে পৃথক। তারা না সম্পূর্ণ এক, না সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দ্বৈত ও অদ্বৈতের সমন্বয়ই ভেদাভেদ দর্শনের প্রাণ।

ভেদাভেদ-মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; কিন্তু সেই ব্রহ্ম নিজেকে বহু রূপে প্রকাশ করেছেন। “একস্য বহুভাবঃ”—এই সূত্রের দ্বারা বোঝানো হয় যে, এক ব্রহ্মই নানা-রূপে প্রকাশিত। যেমন সূর্য ও তার কিরণ—কিরণ সূর্যের থেকেই উৎপন্ন, সূর্যেরই প্রকৃতি বহন করে, কিন্তু সূর্য নয়; তেমনি জগৎ ও জীব ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন, তাঁরই শক্তিরূপ, কিন্তু ব্রহ্ম স্বয়ং নয়।

ভেদাভেদ দর্শনের প্রবর্তক ছিলেন ভাস্করাচার্য। তাঁর মতে, ভেদাভেদ উপাধিগত। ব্রহ্ম ও জগৎ মূলত এক, কিন্তু উপাধি বা সীমাবদ্ধতা দ্বারা তারা ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়। যেমন সমুদ্র ও তরঙ্গ—জলের সত্তা এক হলেও আকারের ভিন্নতার কারণে পার্থক্য দেখা দেয়। পরবর্তীকালে যাদবপ্রকাশ এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন স্বভাবগত ভেদাভেদ হিসেবে। তাঁর মতে, ভেদ ও অভেদ ব্রহ্মের স্বভাবজাত ধর্ম; কোনো উপাধি বা বাহ্যিক উপকরণের কারণে নয়।

নিম্বার্কাচার্যের দ্বৈতাদ্বৈতবাদও ভেদাভেদের একটি বিশিষ্ট রূপ। তাঁর মতে, জীব ও জগৎ ব্রহ্মের শক্তিরূপে চিরন্তনভাবে বিদ্যমান। তারা ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন নয়, বরং ব্রহ্মেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা অভিন্নও নয়, আবার পৃথকও নয়। যেমন সূর্য ও আলো—আলো সূর্যেরই বিকিরণ, সূর্য থেকে আলাদা নয়, তবু সূর্যও নয়।

চৈতন্য মহাপ্রভু এই তত্ত্বকে আরও গভীরভাবে রূপ দেন অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ নামে। তাঁর মতে, ভেদ ও অভেদ উভয়ই ঈশ্বরের অচিন্ত্য-শক্তির দ্বারা সম্ভব। ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ক এমন এক অদ্ভুত একত্ব, যা যুক্তি দ্বারা বোঝা যায় না, কেবল ভক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। ঈশ্বর যেমন জগতের কারণ, তেমনি তাঁর অন্তরে জগৎ বিরাজমান। ভক্তির মাধ্যমে জীব ঈশ্বরের সঙ্গে সেই অচিন্ত্য ঐক্যে স্থিত হয়।

ভেদাভেদ দর্শনের মূল নীতি হলো কারণ ও কার্যর সম্পর্ক। জগৎ ব্রহ্মের কার্য, আর ব্রহ্ম কারণ। কার্য কখনও সম্পূর্ণ কারণ নয়, তাই ভিন্ন; কিন্তু কার্য কারণ ব্যতীত হয় না, তাই অভিন্নও। জীব ও জগৎ ব্রহ্মের শক্তি। শক্তি ও শক্তিমান অবিচ্ছেদ্য, কিন্তু প্রকাশের স্তরে শক্তিতে ভেদ দেখা যায়। উপাধি যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ভেদ প্রকাশ পায়; উপাধি দূর হলে অভেদ প্রকাশিত হয়।

অদ্বৈত ও দ্বৈতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, অদ্বৈত বলে, জগৎ মায়িক ও অবাস্তব; দ্বৈত বলে, জগৎ ও ঈশ্বর চিরভিন্ন; ভেদাভেদ বলে জগৎ নির্ভরশীল বাস্তব—সে ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়, আবার তাঁর সমানও নয়। জীব ব্রহ্মের আভাসমাত্র নয়, বরং তাঁর শক্তিরূপ প্রকাশ। মুক্তি এখানে জ্ঞান ও ভক্তি উভয়ের দ্বারা অর্জনযোগ্য—জ্ঞান ঈশ্বর-স্বরূপ উপলব্ধি করায়, আর ভক্তি জীবকে সেই উপলব্ধিতে স্থিত রাখে।

এই তত্ত্ব বোঝাতে নানা উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। সূর্য ও কিরণ, অগ্নি ও শিখা, সমুদ্র ও তরঙ্গ—সবই এক সত্তার নানা প্রকাশ। তরঙ্গ জলেরই রূপ, কিন্তু জল নয়; আলো সূর্যেরই বিকিরণ, কিন্তু সূর্য নয়। একইভাবে জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশ, কিন্তু ব্রহ্ম নয়।

ভেদাভেদ মতে, মুক্তি মানে জীবের ঈশ্বর-চেতনার উপলব্ধি। মুক্ত অবস্থায় জীব ঈশ্বরের সঙ্গে ঐক্যে অবস্থান করে, কিন্তু তাঁর সমান হয় না। জীব ঈশ্বরের শক্তিরূপে চিরন্তনভাবে বিদ্যমান থাকে—ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয়।

ভেদাভেদ দর্শন জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে একটি সমন্বয় সৃষ্টি করে। অদ্বৈতের মতো নিস্পৃহ বুদ্ধিবাদ নয়, আবার দ্বৈতের মতো কেবল ভক্তি-কেন্দ্রিকও নয়। জ্ঞান ছাড়া ঈশ্বর-চেতনা অসম্পূর্ণ, আর ভক্তি ছাড়া জ্ঞান নির্জীব—এই উপলব্ধিই ভেদাভেদের প্রাণ।

এইভাবে ভেদাভেদবাদ ভারতীয় দর্শনের এক সূক্ষ্ম সমন্বয়বাদী ধারা। এটি বলে, সব কিছু ঈশ্বরেরই প্রকাশ, কিন্তু সেই প্রকাশে বৈচিত্র্যও ঈশ্বরেরই শক্তির রূপ। জগৎ ও অভিজ্ঞতার বাস্তবতাকে অস্বীকার না করেই এটি চিরন্তন ঐক্যের তত্ত্ব প্রকাশ করে। ভেদাভেদীয় দর্শন ব্রহ্মের অভেদ-স্বরূপকে যেমন মানে, তেমনি জীব ও জগতের আপেক্ষিক ভিন্নতাকেও গ্রহণ করে। তাই বলা যায়—ব্রহ্মই সব, কিন্তু সবই ব্রহ্ম নয়।

বাধ-বিধেয় সম্পর্ক বলতে বোঝায় সেই শিক্ষাগত/জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—যেখানে একটি পরবর্তী, অধিক সত্য জ্ঞান (বাধক-জ্ঞান) পূর্ববর্তী কোনো প্রত্যয়/উপস্থাপনাকে—যেটি অনিশ্চিত বা আপাতভাবে “বিধেয়” (asserted/স্থাপনকৃত)—অকার্যকর করে দেয়। ফলে বিধেয়টির বৈধতা থাকে শুধু “বাধ না হওয়া” পর্যন্ত; বাধ ঘটলেই সেটি মিথ্যা/নির্ভরশীল বলে ধরা পড়ে, কিন্তু অভিজ্ঞতার স্তরে তার ‘দেখা যাওয়া’ সত্তাটি পুরোপুরি মুছে যায় না—শুধু স্বাধীন বাস্তবতার দাবি হারায় (মিথ্যাত্ব)।

যেভাবে বোঝা যায়—দড়ি-সাপ: “এটা সাপ” (বিধেয়)-কে “এটা দড়ি” এই পরবর্তী সত্য-জ্ঞান (বাধক) বাধ দিয়ে অকার্য করে। স্বপ্ন-জাগরণ: স্বপ্নের সমস্ত বিধেয়কে জাগরণের জ্ঞান বাধ দেয়; স্বপ্ন দেখা গেছে, কিন্তু তার বাস্তবতা বাতিল। জগৎ-ব্রহ্ম: “জগৎ স্বাধীনভাবে বাস্তব” এই বিধেয়কে ব্রহ্ম-জ্ঞান বাধ দেয়—জগৎ তখন ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল আপাত প্রকাশমাত্র।

নীতিটা asymmetric—দুই দিক সমান নয়—একদিকে যা সত্য/কার্যকর, বিপরীতদিকে তা অপরিহার্য নয়—যে-জ্ঞান বাধ দেয়, সে নিজে নিম্নতর জ্ঞান দ্বারা বাধিত হয় না; তবে আরও উচ্চতর জ্ঞান তাকে বাধ দিতে পারে (স্বপ্ন—জাগরণ—ব্রহ্ম-জ্ঞান…এই ধাপে ধাপে বাধ)।

শাস্ত্রব্যবহারে এর প্রয়োগ: অদ্বৈতের অধ্যারোপ-অপবাদ কৌশলে শাস্ত্র প্রথমে কোনো বিধেয় স্থাপন করে (যেমন “ঈশ্বর স্রষ্টা” বলে মনকে স্থির করা), পরে অপবাদ/বাধের মাধ্যমে উপাধি সরিয়ে নির্গুণ ব্রহ্মকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ “বিধেয়”টি ছিল পথ্য-সত্য; “বাধ” হলো চূড়ান্ত সংশোধন।

পথ্য-সত্য (pathya-satya) মানে “উপকারী/চিকিৎসা-ধর্মী সত্য”—যে বক্তব্য বা শিক্ষা সাধকের মঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য বলা হয়, যদিও পরম স্তর থেকে সেটি শেষ পর্যন্ত নিবার্য (বাধিত) বা অতিক্রম্য। “পথ্য” = যেটা রোগীর জন্য উপযোগী খাদ্য/ঔষধ; দর্শনে এর অর্থ—শ্রোতার মানসিক-আধ্যাত্মিক অবস্থার উপযোগী কথা। আর “সত্য” = ব্যবহারস্তরে কার্যকর/প্রযোজ্য সত্য; সর্বোচ্চ (পারমার্থিক) সত্য নয়। অর্থাৎ, পথ্য-সত্য হলো শিক্ষামূলক/উপায়গত সত্য: শাস্ত্র ও গুরু প্রথমে যা বলেন মনকে স্থির ও শোধন করার জন্য; পরে জ্ঞান উদয়ে সেই ধারণা অপবাদে (অপসারণে) ছেড়ে দেওয়া হয়—adhyāropa–apavāda পদ্ধতি।

“ব্রহ্ম জগৎ সৃষ্টি করেছেন”—সাধকের মন নোঙর করতে বলা পথ্য-সত্য; পরমার্থে বলা হয় “ব্রহ্ম নির্বিকার, কর্মী নয়”—এতে আগের বক্তব্য বাধিত হয়। “কর্তব্য আছে, পুণ্য-পাপ আছে”—আচরণকে শুদ্ধ করতে উপযোগী; পরম জ্ঞান হলে দেখা যায় “অহং ন কর্তা; সাক্ষী-চৈতন্যই আমি।” “উপাসনা করলে ঈশ্বর কৃপা দেবেন”—ভক্তিকে দৃঢ় করে; পরে জ্ঞান জাগলে বোঝা যায়, “ঈশ্বর-জীব-জগৎ উপাধি-ভেদমাত্র; এক চেতনা।” ব্যাবহারিক-সত্য চূড়ান্ত-সত্যের একটি শিক্ষামূলক রূপ। বৌদ্ধ দর্শনে, দুই-সত্যে সংবৃতি-সত্যের নিকটাত্মীয়; নেয়ার্থ-বচনের মতো ‘প্রোভিশনাল’ বা ‘থেরাপিউটিক’ টিচিং।

পথ্য-সত্য” ঠিক সেই ধরনের কথা/শিক্ষা, যেটা বৌদ্ধ “দুই-সত্য” তত্ত্বে সংবৃতি-সত্য (saṃvṛti-satya)—অর্থাৎ ব্যাবহারিক/সম্মত সত্য—এর মতো কাজ করে: শ্রোতার মঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য সাময়িকভাবে বলা, কাজে লাগে বলে সত্য, কিন্তু চূড়ান্ত নয়।

সংবৃতি-সত্য: দৈনন্দিন/প্রয়োগযোগ্য সত্য—ভাষা, রীতি, নৈতিকতা, উপদেশ—যেগুলো দুঃখ কমায় ও অনুশীলন এগোয়। পরমার্থ-সত্য: সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি—ধর্মগুলোর শূন্যতা, নির্বাণ ইত্যাদি—যা সব ধারণার অতীত। প্রোভিশনাল/থেরাপিউটিক টিচিং: রোগীর মতো শিষ্যের অবস্থার উপযোগী “উপায়” (upāya) হিসেবে বলা কথা—ওষুধের মতো, পথ্য-সত্য; নদী পার হতে ভেলার মতো—ওপারে গেলে ছেড়ে দেওয়া হয়।

“নীতার্থ-বচন” (nītārtha) বৌদ্ধ টার্মে নির্ণায়ক/চূড়ান্ত অর্থবহ উক্তি—প্রোভিশনাল নয়; “নেয়ার্থ-বচন” (neyyartha), অর্থাৎ ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ/উপায়গত উক্তি—প্রোভিশনাল। যেমন, “আমি”, “তুমি”, “কর্ম”—এসব সংবৃতি-সত্য (আচরণে দরকারি, অনুশীলনে সহায়ক); “সব ধর্ম শূন্য”—এটা পরমার্থ-সত্য (এটা ধরা পড়লে আগের উপায়গত কথাগুলো আর আঁকড়ে ধরা হয় না)। এককথায়, পথ্য-সত্য হচ্ছে, বৌদ্ধ সংবৃতি-সত্য/নেয়ার্থ-বচন ধরনের উপায়গত, চিকিৎসক-ধর্মী শিক্ষা—উন্নতির জন্য সত্য; চূড়ান্ত উপলব্ধিতে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিক্রান্ত। পথ্য-সত্য মিথ্যা নয়—এটি সোপান। সাধনার পর্যায়ে উপকারী বলে মান্য থাকে; পরমার্থিক জ্ঞান উদয় হলে নিজে থেকেই ছেড়ে দেওয়া হয়।