ভামতী শাখা (Bhāmatī School), যার প্রতিষ্ঠাতা বাচস্পতি মিশ্র, একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। তারা মনে করে, জীব (ব্যক্তিগত আত্মা)-ই অবিদ্যার আশ্রয়। কারণ ব্রহ্ম শুদ্ধ চৈতন্য, তার মধ্যে কোনো অজ্ঞানতার স্থান নেই। জীব, যিনি দেহ-মন-বুদ্ধি-অহংকারের সঙ্গে আত্মাকে অভিন্ন ভাবেন, তিনিই অবিদ্যার আধার। এই দৃষ্টিতে অবিদ্যা একটি ব্যক্তিগত মানসিক আচ্ছাদন—প্রত্যেক জীবের নিজস্ব অজ্ঞতা। জীবের উপর আরোপিত অবিদ্যা তাকে “আমি এই শরীর” বলে ভাবায়।
তবে এখানে একটি গভীর দার্শনিক জটিলতা দেখা দেয়—যেহেতু জীব নিজেই অবিদ্যার ফল, তাই অবিদ্যা আবার জীবের মধ্যে কীভাবে অবস্থান করে? এই আপাতচক্র ভামতী শাখা সমাধান করে এভাবে—অবিদ্যা অনাদি (শুরুহীন), অর্থাৎ চিরকাল থেকে আছে। জীবও সেই অনাদি অবিদ্যার দ্বারা প্রকাশিত এক সীমিত চৈতন্যরূপ। ফলে কোনো “প্রথম” কারণ নেই; দুটোই সহাবস্থায় অনন্তকাল ধরে আছে, যতক্ষণ না জ্ঞানের উদয় হয়।
অবিদ্যা অদ্বৈত বেদান্তে এক বিশেষ সত্তাগত অবস্থানে রয়েছে—এটি না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটি মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ এক অভিজ্ঞতামূলক সত্য, যা জ্ঞান দ্বারা নিবারিত হয়। অবিদ্যা দ্বারা সৃষ্ট জগৎ ও দেহ-মন-সত্তা সবই অনির্বচনীয় (anirvacanīya), যা—বলা যায় না যে-“সত্য”, আবার বলা যায় না যে-“অসত্য”। এই ধারণাই অদ্বৈতের “অনির্বচনীয়তা” তত্ত্বের কেন্দ্র, যেখানে মায়া ও অবিদ্যা চেতনার ভেতরে আপাত বাস্তবতা তৈরি করে।
অবিদ্যা কেবল জ্ঞানের অনুপস্থিতি নয়। এটি jñāna-abhāva (জ্ঞানের অভাব)-এর থেকে আলাদা। কারণ নিছক অভাব স্থবির, কিন্তু অবিদ্যা সক্রিয়। এটি এক “সক্রিয় বিভ্রান্তি”—যা আত্মাকে সীমাবদ্ধ দেহ-মন-অহংকারের সঙ্গে ভুলভাবে অভিন্ন করে তোলে। এই ভুল চিহ্নিতকরণই (adhyāsa) সকল দুঃখ, কর্মফল ও পুনর্জন্মের কারণ। যেমন, কেউ অন্ধকারে দড়িকে ভুল করে সাপ মনে করে—এটি নিছক দড়ি না জানা নয়; বরং ভুল জ্ঞান, একটি সক্রিয় ভ্রান্তি। অবিদ্যাও তেমনি—ব্রহ্মকে না জানা নয়, বরং তাকে সীমিত দেহ-মন হিসেবে ভুলভাবে জানা।
‘সক্রিয় ভ্রান্তি’ এমন এক ভ্রান্ত জ্ঞান, যা শুধু ভুল ধারণা নয়, বরং সেই ভুল ধারণার ফলেই মানসিক বা শারীরিক কার্য সম্পাদিত হয়। এটি এমন এক বিভ্রম, যা কার্যকর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, তাই একে “সক্রিয়” বলা হয়।
ধরা যাক, গোধূলির আলোয় দূরে একটি গাছের ডালকে দেখে কেউ মনে করল সেটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এই ধারণাটি আসলে ভুল, কিন্তু সে মুহূর্তে তার মধ্যে ভয়, সন্দেহ বা আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি জাগে—সে হয়তো পিছিয়ে যায়, কাউকে ডাক দেয় বা পাথর ছোড়ে। এখানে ভুল জ্ঞান কার্যপ্রণোদিত আচরণের জন্ম দিয়েছে। এই পুরো ঘটনাই সক্রিয় ভ্রান্তির উদাহরণ।
দর্শনশাস্ত্রের ভাষায়, ভ্রান্তির দুটি দিক আছে—একটি জ্ঞানগত, অন্যটি কার্যগত। জ্ঞানগত ভ্রান্তি মানে কেবল ভুল ধারণা; কার্যগত ভ্রান্তি তখন ঘটে, যখন সেই ভুল ধারণা মানসিক বা শারীরিক প্রতিক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে। সক্রিয় ভ্রান্তি মূলত এই দ্বিতীয় প্রকারের—যেখানে জ্ঞানীয় বিভ্রম ক্রিয়াশীল আচরণে রূপ নেয়।
অদ্বৈত বেদান্ত এই ধারণাকে আরও গভীর ও অধিবিদ্যাগত স্তরে প্রসারিত করেছে। এখানে বলা হয়, সমগ্র জগৎ-প্রতীতি নিজেই এক মহাসক্রিয় ভ্রান্তি। আত্মা (Ātman) স্বরূপত চিরমুক্ত, নির্বিকার, নিস্ক্রিয়। কিন্তু অবিদ্যা (Avidyā) এই আত্মার উপর দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও অহংকারের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, যার ফলে আত্মা নিজেকে “আমি শরীর”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”—এসব ভুল পরিচয়ে দেখতে শুরু করে।
এই ভুল পরিচয়ই অদ্বৈতের ভাষায় সক্রিয় ভ্রান্তির চূড়ান্ত রূপ—যেখানে আত্মা নিজেকে ক্রিয়াশীল বলে মেনে নেয়, এবং সেই ভুল ধারণার প্রভাবে কর্ম, ভোগ, দুঃখ ও পুনর্জন্মের অনন্ত চক্রে জড়িয়ে পড়ে। এই বিভ্রম নিষ্ক্রিয় নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি ইচ্ছায়, প্রতিটি ভোগে সক্রিয় থাকে।
তবে আত্মা আসলে কখনও কর্তা নয়, সে শুধু প্রত্যক্ষকারী (sākṣī)। কিন্তু যতক্ষণ না বিদ্যা (সত্যজ্ঞান) উদয় হয়, ততক্ষণ অবিদ্যা এই সক্রিয় ভ্রান্তিকে বজায় রাখে, যেন দৃষ্টির ভ্রান্তিতে গাছের ডালকে মানুষ ভেবে বার বার প্রতিক্রিয়া দেওয়া। যখন জ্ঞান উদিত হয়—অর্থাৎ যখন জানা যায় “এটি মানুষ নয়, গাছ”—তখন সক্রিয় ভ্রান্তি বিলুপ্ত হয়, প্রতিক্রিয়াও থেমে যায়।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে মুক্তি (mokṣa) মানে এই সক্রিয় ভ্রান্তির সম্পূর্ণ অবসান—যেখানে জ্ঞান উদয় হয়ে প্রকাশ করে, “আমি কর্তা নই, ভোক্তা নই, আমি সেই একক চেতনা, যা চিরমুক্ত, অপরিবর্তনীয় এবং সর্বদা প্রত্যক্ষমান।”
এই ভুল জ্ঞানই সংসারের মূল। কারণ, যতক্ষণ জীব ভাবে, “আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোগী”—ততক্ষণ সে কর্মফল ও দুঃখের অধীন। কিন্তু যখন বিদ্যা (আত্মজ্ঞান) উদিত হয়, তখন জানা যায়—এই সমস্ত অভিজ্ঞতা অবিদ্যার ছায়ামাত্র, চেতনার প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন নেই।
অতএব, অবিদ্যা হলো সেই সূক্ষ্মতম অস্তিত্বগত পর্দা—যা ব্রহ্মের সীমাহীন দীপ্তিকে ঢেকে দেয়, অথচ নিজে কখনও সম্পূর্ণ বাস্তব নয়। এটি এক অনাদি বিভ্রান্তি, যা কেবল জ্ঞানের উদয়ে বিলীন হয়, এবং তখনই আত্মা উপলব্ধ হয় তার স্বরূপে—চিরনির্মল, চিরসচেতন, চিরআনন্দময়।
অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা (অজ্ঞানতা) একক শক্তি নয়; এটি দ্বিবিধ কার্যকারিতাসম্পন্ন—দুটি স্বতন্ত্র অথচ পরস্পরনির্ভর শক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
প্রথমটি হলো আবরণ-শক্তি (Āvaraṇa-śakti)—যার কাজ ব্রহ্মের সত্যস্বরূপকে আচ্ছন্ন করা। এটি আত্মার স্বপ্রকাশিত জ্ঞানকে ঢেকে ফেলে, যেন চিরজ্যোতিষ্মান সূর্য ঘন মেঘে ঢাকা পড়ে। আবরণ-শক্তির প্রভাবে জীব নিজের অন্তর্নিহিত অসীম চেতনাকে দেখতে পারে না, এবং বাস্তবের প্রকৃতি বিকৃত হয়ে যায়। এই আচ্ছাদনই কারণ, জীব বলে—“আমি দেহ”, “আমি চিন্তা”, “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী।”
দ্বিতীয়টি হলো বিক্ষেপ-শক্তি (Vikṣepa-śakti)—যা আচ্ছাদিত ব্রহ্মচেতনার ওপর নানা রূপ ও নাম প্রক্ষেপণ করে, জগৎকে প্রতীয়মান করে তোলে। এটি সেই সৃজনশীল বিভ্রম, যার ফলে এক অদ্বৈত চৈতন্য বহু-বস্তু ও বহু-অভিজ্ঞতার রূপ নেয়। যেমন অন্ধকারে দড়ির উপর সাপের প্রতিচ্ছবি (বিভ্রম) পড়ে, তেমনি ব্রহ্মচৈতন্যের ওপর মায়ার বিক্ষেপ-শক্তি নানা নাম-রূপের ভুবন রচনা করে। এই প্রক্ষেপণের কারণেই জীব নিজেকে কর্তা (doer) ও ভোক্তা (enjoyer) বলে মনে করে, এবং সংসারচক্রে আবদ্ধ থাকে।
এই দুটি শক্তির সম্মিলিত কার্যই জগৎ ও ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে গঠন করে—আবরণ ব্রহ্মকে গোপন করে, আর বিক্ষেপ মিথ্যা প্রতীয়মানতা সৃষ্টি করে।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, মায়া ও অবিদ্যা একই মূল শক্তির দুটি ভিন্ন প্রকাশ। মায়া হলো এর সমষ্টিগত (sāmāṣṭi) বা মহাজাগতিক দিক—যা ঈশ্বর (Īśvara)-এর অধীন, এবং যার দ্বারা গোটা বিশ্বব্যবস্থা (জগৎ) পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, অবিদ্যা হলো এর ব্যষ্টিগত (vyaṣṭi) বা ব্যক্তিগত দিক—যা জীব (jīva)-এর মধ্যে কার্যকর। একটিতে সৃষ্টি ও জগতের শৃঙ্খলা বজায় থাকে, আর অন্যটিতে ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা ও ভ্রান্ত অভিজ্ঞতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে “অধ্যাস” (Adhyāsa) হলো এক মৌলিক এবং ব্যাখ্যামূলক ধারণা, যার দ্বারা সমগ্র জগতের মিথ্যা প্রতীতি বা ভ্রান্ত অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা হয়। অধ্যাস মানে এক সত্তার গুণ বা বৈশিষ্ট্য অন্য সত্তার উপর ভুলভাবে আরোপ করা—অর্থাৎ যা যেখানে নেই, তাকে সেখানে “দেখা” বা “ভাবা”। এটি হলো জ্ঞানের বিভ্রম, কিন্তু সেই বিভ্রম এত গভীর যে, সেটিই আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতার অনুভূতি তৈরি করে।
প্রথমত, আত্মা (Ātman) চিরন্তন, অবিনশ্বর, নির্লেপ এবং চৈতন্যস্বরূপ। এটি পরিবর্তনশীল নয়, জন্ম-মৃত্যুর বাইরে। কিন্তু অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার প্রভাবে আত্মার গুণগুলি—যেমন চেতনা (cit), অস্তিত্ব (sat), এবং আনন্দ (ānanda)—ভুলভাবে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের উপর আরোপিত হয়। ফলে মানুষ মনে করে যে, দেহ সচেতন, মন চিন্তা করছে, ইন্দ্রিয় অনুভব করছে। আসলে এই সচেতনতা আত্মারই প্রতিফলন, কিন্তু অবিদ্যা তা দেহ-মন-এর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় নিজেরা জড়, পরিবর্তনশীল এবং সীমাবদ্ধ। তাদের প্রকৃতি হলো ক্লান্ত হওয়া, অসুস্থ হওয়া, জন্ম নেওয়া, বার্ধক্য ও মৃত্যুপ্রাপ্ত হওয়া। কিন্তু অধ্যাসের ফলে এই পরিবর্তনশীল গুণগুলি আত্মার উপর আরোপিত হয়। তখন মানুষ ভাবে, “আমি অসুস্থ”, “আমি দুঃখিত”, “আমি বয়স্ক”, “আমি মরব”—অথচ আত্মা আসলে কখনোই এসব পরিবর্তনের অধীন নয়।
এই দুই দিকের ভুল আরোপ—একে অপরের গুণ বিনিময়—হলো অধ্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। আত্মার গুণাবলি দেহের উপর, আর দেহের গুণাবলি আত্মার উপর ভুলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়। এটি এক দ্বিমুখী অরোপ—যেমন, আত্মার চেতনা দেহে, আর দেহের পরিবর্তন আত্মায় আরোপিত।
এর ফলেই সৃষ্টি হয় “আমি দেহ”, “আমি চিন্তা করছি”, “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”—এইসব মিথ্যা ধারণা। এখানে “আমি” শব্দটি আত্মাকে নির্দেশ করছে, কিন্তু সেই আত্মা নিজেকে দেহের সীমাবদ্ধতা দিয়ে ভাবছে। এই বিভ্রান্ত পরিচয়ই জগত, কর্ম, ইচ্ছা ও বন্ধনের মূল।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, এই অধ্যাসই সমগ্র সংসার-প্রতীতির ভিত্তি। মানুষ যেভাবে প্রতিদিন জগৎকে দেখে, সম্পর্ক গড়ে, আনন্দ-দুঃখ ভোগ করে, সবই এই আরোপের ফল। আত্মা নিজে কিছুই করছে না—কিন্তু দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে ভুলভাবে একাত্ম হয়ে সে যেন কর্তা ও ভোক্তা রূপে উপস্থিত হয়েছে।
যখন বিদ্যা বা সত্যজ্ঞান উদিত হয়, তখন এই অধ্যাস বিলুপ্ত হয়। তখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, “আমি দেহ নই, মন নই, ইন্দ্রিয় নই—আমি সেই চিরন্তন চেতনা, যার আলোকেই দেহ ও মন প্রতীয়মান।” অধ্যাস মুছে গেলে মিথ্যা আত্মপরিচয়ও মুছে যায়, আর তখনই আত্মা নিজের প্রকৃত রূপে—ব্রহ্মরূপে প্রকাশিত হয়।
অবিদ্যা থেকেই এই অধ্যাসের সূচনা, আর অধ্যাস থেকেই জীব-চেতনা দ্বৈততার জালে বন্দি হয়। কিন্তু যখন আত্মজ্ঞান উদিত হয়—যখন জানা যায়, “আমি ব্রহ্ম”—তখন অবিদ্যার আবরণ ভেদ হয়, প্রক্ষেপিত বিভ্রম মুছে যায়, এবং আত্মা তার নিজস্ব অদ্বিতীয় স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে ‘বিভ্রম’ মানে এমন ভুল জ্ঞান, যেখানে এক জিনিসকে অন্য কিছু বলে মনে হয়। যেমন স্বপ্নে কেউ নিজেকে রাজা বলে মনে করে, অথচ জেগে দেখে, সে সাধারণ মানুষ—এই ভুল প্রতীতি বিভ্রম। একইভাবে, অবিদ্যার কারণে জীব নিজের চিরন্তন আত্মস্বরূপকে ভুলে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক ‘আমি’-কে সত্য বলে মনে করে। “আমি কর্ম করছি”, “আমি সুখ পাচ্ছি”—এই সমস্ত ধারণাই বিভ্রম, কারণ আত্মা কখনোই কর্মকারী বা ভোক্তা নয়।
‘বিবর্ত’ মানে আপাত-প্রকাশ, যা সত্যিকার রূপান্তর নয়। যেমন আকাশে মেঘের উপর সূর্যের প্রতিফলন দেখে কেউ ভাবে—দুটি সূর্য আছে। বাস্তবে সূর্য একটাই, কিন্তু প্রতিফলনের কারণে বহুত্ব প্রতীয়মান হয়। তেমনি ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়, কিন্তু মায়ার আচ্ছাদনে বহুরূপ জগত বলে মনে হয়।
দ্বৈত বা বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন বলে—ব্রহ্ম সত্যিই জগৎ সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু অদ্বৈত বলে—ব্রহ্ম অপরিবর্তিত থেকে কেবল আপাতভাবে (vivarta) জগৎ হিসেবে প্রতীয়মান। এই আপাত-প্রকাশই বিবর্ত।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, বিভ্রম হলো জ্ঞানের ভুল (আত্মাকে দেহ মনে করা), আর বিবর্ত হলো অস্তিত্বের ভুল প্রতীতি (ব্রহ্মকে জগৎ মনে করা)। বিদ্যা বা আত্মজ্ঞান উদয় হলে দুই ভুলই বিলুপ্ত হয়—স্বপ্ন ভাঙলে যেমন রাজত্ব মুছে যায়, তেমনি জ্ঞান জেগে উঠলে জগৎও ব্রহ্মরূপে একাকার হয়ে যায়।
দিঘির জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়লে মনে হয়, সূর্য জলে কাঁপছে। এই যে, “আদতে কাঁপে না, তবু কাঁপছে বলে মনে হওয়া”, এটাই হলো সূর্যের (Vivarta)—অর্থাৎ, আপাত পরিবর্তন। আর সেই “কাঁপছে বলে মনে হওয়া” অনুভবটিই হলো প্রতীতি (Appearance)।
অবিদ্যার দ্বিবিধ শক্তি (আবরণ ও বিক্ষেপ) সংসারের প্রকৃত কারণ, এবং ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ই এর একমাত্র নিবারণ। আবরণ ভাঙে জ্ঞান দ্বারা, বিক্ষেপ লুপ্ত হয় দৃষ্টান্তস্বরূপ উপলব্ধি দ্বারা; এবং যখন উভয় শক্তির কার্য বিলীন হয়, তখনই আত্মা নিজের শুদ্ধ, অনন্ত, অপরিমেয় রূপে প্রত্যক্ষ হয়—এটাই মুক্তি।