অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: ছেষট্টি




এই নির্ভরতা থেকে এই সিদ্ধান্ত আসে যে, কোনো কিছুই তার নিজস্ব শক্তিতে, সহজাতভাবে বা স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নেই। একটি ফুল ফোটে মাটি, জল, সূর্যালোক এবং বীজের ওপর নির্ভর করে—এদের কোনো একটি বাদ দিলেই ফুলের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এটিই হলো মৌলিক আন্তঃসংযুক্ততা। এই সর্বজনীন নির্ভরশীলতাই আমাদের প্রথাগত অস্তিত্বের ধারণাকে ভেঙে দেয়।


আত্মন-এর অস্বীকৃতি—অনাত্মন এবং স্কন্ধের সংগ্রহ: প্রতীত্য-সমুৎপাদের এই কাঠামো মানবসত্তার ওপর প্রয়োগ করলে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত হয়—অনাত্মন (অন-আত্মা) বা নো-সেল্ফ।


স্থায়ী 'স্ব'-এর বিলুপ্তি: যেহেতু সব কিছুই নির্ভরশীল ও ক্ষণস্থায়ী, তাই মানুষের মধ্যেও কোনো স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় 'স্ব' (আত্মা) থাকতে পারে না।


ব্যক্তির সংজ্ঞা: ব্যক্তিকে একটি একক সত্তা হিসাবে না দেখে, মাধ্যমক তাকে পাঁচটি স্কন্ধ (Aggregates)—রূপ (জড় উপাদান), বেদনা (অনুভূতি), সংজ্ঞা (উপলব্ধি), সংস্কার (মানসিক প্রবণতা), এবং বিজ্ঞান (চেতনা)—এর একটি সর্বদা পরিবর্তনশীল সংগ্রহ (সমন্বিত রূপ) হিসাবে ব্যাখ্যা করে। এই স্কন্ধগুলির কোনোটিই স্থায়ী নয়, সবই ক্ষণস্থায়ী এবং অনিত্য। আমাদের 'আমি' বা 'ব্যক্তি'র ধারণাটি কেবল এই ক্ষণস্থায়ী উপাদানগুলির একটি অস্থায়ী মিশ্রণ ছাড়া আর কিছু নয়।


শূন্যতা—নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা নয়, স্বভাবের অনুপস্থিতি: নির্ভরশীল উৎপত্তির চূড়ান্ত উপলব্ধিই হলো শূন্যতা (Śūnyatā)। নাগার্জুন স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে শূন্যতা কোনো 'নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা' (Nihilistic Void) নয়, যেমনটি সমালোচকরা ভুল বোঝেন।


নৈরাত্ম্য (naiḥ + ātmya) হলো “আত্মা-শূন্যতা” বা “নির্বিশেষ আত্মার অনুপস্থিতি”। এটি বুদ্ধের মূল শিক্ষাগুলির একটি—“অনাত্তা” (anattā) বা “No-Self Doctrine”। বুদ্ধ বলেছেন—“যা-কিছুকে তুমি ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলে মনে করো, তা আসলে পঞ্চস্কন্ধ (রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান)-এর সাময়িক যোগফল। এর কোনোটিই স্থায়ী নয়, আর কোনোটিই স্বাধীন আত্মা নয়।” অর্থাৎ, সত্তা বা ব্যক্তি কেবল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—যা নির্ভর করছে কারণ-কার্য সম্পর্কের ওপর (প্রতীত্যসমুত্পাদ)। এই অবস্থানই নৈরাত্ম্যবাদ (Doctrine of No-Self)—যা বলে, স্থায়ী আত্মা বলে কিছু নেই; “আমি” একটি ধারণাগত গঠন, বাস্তব সত্তা নয়।


শূন্যতা (śūnyatā) নাগার্জুনের মাধ্যমে দার্শনিক রূপে পরিণত হয়। তিনি বলেন—“যা নির্ভর করে উৎপন্ন হয়, তাকেই আমরা শূন্য বলি।” অর্থাৎ, সব কিছু পরনির্ভর, কোনো কিছুর নিজস্ব বা স্বতঃসিদ্ধ “সার” (svabhāva) নেই। এই স্ব-সত্তার অনুপস্থিতিই শূন্যতা। শূন্যতা মানে “কিছুই নেই” নয়; বরং “নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নেই”—সব কিছু কারণ-সম্পর্কে, নির্ভরতায়, পরিবর্তনে বিদ্যমান।


নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা (nāirātmya-śūnyatā) হলো বৌদ্ধদের সেই চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে “সত্তার অভাব” (নৈরাত্ম্য) এবং “স্বভাবের অভাব” (শূন্যতা) একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ, শুধু “আমি” বা “ব্যক্তি”-র কোনো স্থায়ী আত্মা নেই তা-ই নয়, বরং কোনো বস্তুরই কোনো স্বতঃসিদ্ধ, নিজস্ব “সার” বা “অস্তিত্ব-স্বভাব” নেই। এইভাবে, নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা ব্যক্তিগত আত্মা ও জাগতিক সত্তা—উভয়ের স্বরূপকে অস্বীকার করে, তবে কোনো নৈরাশ্য বা শূন্য নাস্তি-তায় নয়, বরং মধ্যপথে দাঁড়িয়ে।


অন্যভাবে বলতে গেলে—শূন্যতা হলো সকল জিনিসে আত্মার অভাব, আর নৈরাত্ম্য হলো নিজের মধ্যে আত্মার অভাব। বৌদ্ধ যুক্তিতে এই দুইটি মিলিত হয় একটি গভীর সত্যে—যখন তুমি উপলব্ধি করো যে, “আমি” বলে কিছু নেই, তখন তুমি বুঝতে পারো, “অন্য” বলেও কিছু নেই। তখন সব ভেদ বিলুপ্ত হয়, এবং উদ্‌ভাসিত হয় এক অদ্বৈত শূন্যতা—যেখানে “আমি” ও “অন্য”, “অস্তিত্ব” ও “অনস্তিত্ব” সবই কেবল পরস্পরনির্ভর নামমাত্র ধারণা। এই অবস্থাই নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা—এক সম্পূর্ণ অ-সত্তাবাদী, অ-নাস্তিক, তবু গভীর বাস্তবতা-নির্ভর দর্শন।


নাগার্জুন বলেন—যদি কিছু নিজের মধ্যে স্বতন্ত্র সত্তা রাখে, তবে সেটি পরিবর্তনশীল হতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখি, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। অতএব, সব কিছুই স্বভাবশূন্য। একইভাবে, যদি আত্মা স্থায়ী হতো, তবে মুক্তি বা পরিবর্তন অসম্ভব হতো। কিন্তু পরিবর্তন সম্ভব, তাই আত্মা স্বভাবত নেই। এইভাবেই নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়—অস্তিত্ব ও আত্মা উভয়ের স্বতঃসিদ্ধ সার অস্বীকার করে।


যখন সাধক গভীর ধ্যানে প্রবেশ করে এবং দেখে—সব কিছু নির্ভরতার জাল, কিছুই স্বাধীন নয়, “আমি”-বোধ কেবল একটি ধারণা, তখন সে অনুভব করে সেই গভীর নৈরাত্ম্যশূন্যতা। এ অভিজ্ঞতায় ভয় নেই, শূন্যতা নেই, বরং এক অসীম করুণা ও প্রশান্তি। কারণ যখন “আমি” নেই, তখন কষ্ট, লোভ, দ্বেষ—এসব ধারণাও বিলুপ্ত হয়। সেই অবস্থায় বলা হয়—“সর্বধর্ম নৈরাত্ম্যশূন্যতা-প্রতিপন্ন।” এটি মহাযান প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র-এর অন্যতম গভীর দার্শনিক উক্তি, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “সব ধর্ম (সত্তা, বস্তু, প্রপঞ্চ) আত্মাহীনতা ও শূন্যতা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।”


বৌদ্ধ দর্শনে “ধর্ম” মানে—অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতম গঠনমূলক উপাদান, যা আমরা “বস্তু” বা “অভিজ্ঞতা” বলে জানি। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, এই উপাদানগুলো বাস্তব, কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়—তারা সবাই অনিত্য, পরনির্ভর, এবং কোনো স্থায়ী সত্তাহীন। এতে বাস্তবতার দ্বন্দ্বময় ধারণা (আছে-নেই, জন্ম-মৃত্যু, আমি-অন্য) ভেঙে যায়, এবং দেখা যায়, সব কিছুই এক অন্তর্গত শূন্য নৃত্যের মধ্যে পরস্পর নির্ভর।


নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতা মানে—কোনো সত্তা বা বস্তুই নিজের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধ নয়, সবই কারণ-কার্য, নির্ভরতা ও সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান। এটি “নৈরাশ্যবাদ” নয়, বরং “অহংকারহীন বাস্তবতা-বোধ।” যেখানে আত্মা ও অনাত্মা, থাকা ও না-থাকা, সব দ্বন্দ্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় এক বিশুদ্ধ চেতনায়। এই চেতনা না ব্যক্তিগত, না বস্তুগত, না অস্তিত্ব, না অনস্তিত্ব—এটি কেবল নীরব উপস্থিতি। এই নৈরাত্ম্যবাদী শূন্যতাই মহাযান বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞার চূড়ান্ত প্রকাশ—যেখানে দেখা যায়, সব কিছু যেমন আছে, তেমনই নিখুঁত, কিন্তু কোনো “আমি” নেই, যে তাকে দেখে।


“শূন্যতা (Śūnyatā)” মানে ‘কিছুই নেই’—এমন নয়। এর আসল অর্থ হলো—স্বাধীন, স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় অস্তিত্বের অনুপস্থিতি। যা-কিছু আছে, তা নিজের জোরে টিকে নেই; তার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল। এই স্বাধীন অস্তিত্বের অনুপস্থিতিই হলো শূন্যতা।


স্বভাব (Svabhāva) বা স্বতঃসিদ্ধ প্রকৃতি হলো কোনো বস্তুর নিজস্ব, অপরিবর্তনশীল, স্থায়ী সার বা প্রকৃতি—যা অন্য কিছুর ওপর নির্ভর না করে নিজেই নিজেকে টিকিয়ে রাখে। যেমন যখন আমরা মনে করি যে, “আগুনের স্বভাব তাপ দেওয়া”, তখন বোঝানো হচ্ছে—তাপ যেন আগুনের ভেতরে নিজস্বভাবে লুকিয়ে আছে। কিন্তু বৌদ্ধ যুক্তি বলছে—“স্বভাব” বলে কিছু নেই, কারণ কোনো বস্তু নিজের দ্বারা টিকে থাকতে পারে না। আগুনও টেকে জ্বালানি ও বাতাসের ওপর নির্ভর করে; জ্বালানি না থাকলে তার তাপও নিভে যায়। অতএব, কিছুই নিজের স্বভাবে “স্বতঃসিদ্ধ” নয়।

“শূন্যতা” মানে হলো—কোনো বস্তুর মধ্যে এমন কোনো স্থায়ী, অপরিবর্তনশীল, স্বাধীন সারসত্তা নেই। সব কিছুই কারণ–কার্য সম্পর্কের জালে গঠিত, অর্থাৎ তারা নির্ভরশীলভাবে উদিত (pratītya-samutpāda)। এজন্য নাগার্জুন বলেছেন—“যা নির্ভর করে উদিত হয়, তাকেই আমরা শূন্য বলি।” শূন্যতা মানে অস্তিত্বের অস্বীকার নয়, বরং অস্তিত্বের পরনির্ভর স্বরূপের উপলব্ধি।

শূন্যতার উপলব্ধি কোনো নতুন “অস্তিত্ব” বা “অতীন্দ্রিয় সত্তা” খোঁজার পথ নয়। বরং এটি হলো—অস্তিত্বের প্রতি আমাদের কঠোর ধারণাগুলো ভেঙে ফেলার একটি বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, “এটা আছে”, “এটা চিরন্তন”, “এটা আমি”—এই সমস্ত মানসিক আসক্তি এবং স্থায়িত্ববোধকে গলিয়ে দেওয়া। তাই শূন্যতার পথকে বলা হয় “অ-সত্তা-ভিত্তিক বিশ্লেষণ” (Un-being-based analysis)—যেখানে জোর দেওয়া হয় কোনো কিছুর “থাকা”-য় নয়, বরং “যেভাবে থাকা হয়”, সেই নির্ভরতাতেই।

শূন্যতা মানে কোনো “অতীন্দ্রিয় সত্তা”-র সন্ধান নয়, বরং এই উপলব্ধি যে—সত্য চূড়ান্তভাবে নিহিত থাকে এই আপেক্ষিক নির্ভরতার মাঝেই। চূড়ান্ত বাস্তবতা কোনো পৃথক জগৎ নয়; এটি এই সম্পর্কের মধ্যেই বিদ্যমান। যে-ব্যক্তি তা বোঝে, সে দেখে—কোনো কিছুরই নিজস্ব, আলাদা স্থায়ী সার নেই। এই উপলব্ধির ফল হলো—আসক্তি ভেঙে যায়, কারণ যদি কিছুই স্থায়ী নয়, তবে তাকে আঁকড়ে ধরারও তো কোনো মানে নেই। আর যখন আঁকড়ে ধরা থাকে না, তখন দুঃখের মূল কারণ—তৃষ্ণা—নিভে যায়। এইভাবে শূন্যতার উপলব্ধি হলো দুঃখের বিনাশের পথ।

নাগার্জুন ও তাঁর মধ্য্যমক দর্শন শেষপর্যন্ত ঘোষণা করে—“কোনো স্থায়ী বাস্তবতা নেই; সব কিছুই শূন্য, সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।” এর মানে এ নয় যে, “‘সব কিছু’-র কিছুই নেই”—বরং “সব কিছু কেবল নির্ভরতার মধ্যে আছে।” যদি কারণ-সম্পর্ক না থাকত, তবে কিছুই প্রকাশ পেত না। এই উপলব্ধিই হলো প্রজ্ঞা (Prajñā)—যা মায়া থেকে মুক্তির জ্ঞান, আর এই জ্ঞানই নিয়ে যায় নির্বাণে (Nibbāna)।

এখানে মূল পার্থক্যটি পদ্ধতিগত—অদ্বৈত বেদান্ত বলে, “একটি চূড়ান্ত বাস্তবতা আছে—ব্রহ্ম; সব কিছু তারই প্রকাশ।” অর্থাৎ, এক অনন্ত সত্তা সব কিছুর ভিত্তি। মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শন বলে—“কোনো স্থায়ী বাস্তবতা নেই; সব কিছুই শূন্য, কারণ তারা সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।” অদ্বৈত চূড়ান্ত সত্যকে অস্তিত্বের একত্ব হিসেবে দেখে, আর মাধ্যমক দেখে অস্তিত্বের পরনির্ভর শূন্যতা হিসেবে।

অদ্বৈত বলে—“সবই ব্রহ্ম।” মাধ্যমক বলে—“সবই শূন্য।” কিন্তু উভয়েই শেখায়—চূড়ান্ত সত্য ভাষার বাইরে, ধারণার ওপারে, যেখানে স্থায়িত্ব বা নাশ—দুটোই বিলীন হয়ে যায় এক নিঃশব্দ স্বচ্ছতায়। শূন্যতা মানে অস্তিত্বের অস্বীকার নয়, বরং স্বাধীন অস্তিত্বের অস্বীকার। যা-কিছু আছে, তা অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে; যা নির্ভর করে, তা নিজস্ব নয়; আর যা নিজস্ব নয়, তা “শূন্য”। এই উপলব্ধিই প্রজ্ঞা—যা মনকে মুক্ত করে আসক্তি থেকে, আর সেই মুক্তিই নির্বাণ।

মায়ার জ্ঞানতত্ত্ব: “মিথ্যা” বনাম “স্বভাব-শূন্যতা”

অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শন—উভয় ঘরানাই বলে, আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার জগৎ চূড়ান্ত বাস্তব নয়; কিন্তু “অবাস্তব” মানে দু-পথের কাছে এক জিনিস নয়। অদ্বৈত বলে: জগৎ মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ, এটি দেখা যায়, ব্যবহারযোগ্যও, কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ সত্য নয়। বৌদ্ধ বলে: জগৎ শূন্য (śūnya)—অর্থাৎ, এর কোনো স্বতন্ত্র সার (svabhāva) নেই; এটি সম্পর্কের মাধ্যমে বিদ্যমান। দু-পথের লক্ষ্য এক—অবশেষে সত্য উপলব্ধি, কিন্তু তাদের পদ্ধতি ও ভিত্তি একেবারে ভিন্ন।

অদ্বৈতের জ্ঞানতত্ত্ব বলে—যে-জগৎ আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি, তা “মিথ্যা”; কিন্তু এখানে “মিথ্যা” মানে “পুরোপুরি নেই” নয়। শঙ্করাচার্য এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। “মিথ্যা” (mithyā) মানে—জগৎ অনির্বচনীয় (anirvacanīya)—এটি পরমভাবে সত্যও নয়, আবার একেবারে মিথ্যাও নয়। এটি সত্য নয়, কারণ মুক্তির জ্ঞানে এর অস্তিত্ব লুপ্ত হয়; এটি মিথ্যা নয়, কারণ অজ্ঞান অবস্থায় এটি অভিজ্ঞতার বস্তু হিসেবে দেখা যায়। অর্থাৎ, জগৎ ব্যাবহারিক স্তরে সত্য (vyāvahārika-satya), কিন্তু চূড়ান্ত স্তরে মিথ্যা (pāramārthika-asatya)।

শঙ্করাচার্য বলেন—যেমন কেউ দুর্বল আলোতে দড়িকে ভুল করে সাপ ভাবে, তেমনি অজ্ঞান ব্যক্তি ব্রহ্মের ওপর জগতের প্রতিচ্ছবি আরোপ করে। দড়ি (rajjū) হলো ব্রহ্ম (চূড়ান্ত সত্য), সাপ (sarpa) হলো জগৎ (মায়াময় আবির্ভাব)। যতক্ষণ পর্যন্ত দড়ির প্রকৃতি বোঝা যায় না, ততক্ষণ “সাপ”-এর ভয় বাস্তব মনে হয়; কিন্তু আলো জ্বালালে বোঝা যায়, সাপ ছিল না—তবু দড়ি আছে, ছিল, এবং থাকবে। এভাবেই ব্রহ্ম জগতের অধার (substratum)—অর্থাৎ, বিভ্রমের পেছনে যে ধ্রুব বাস্তবতা, সেটিই ব্রহ্ম।