নাগার্জুন যুক্তি দেন যে, এই চারটি কোটির মধ্যে কোনো একটির দ্বারা বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রতিটি কোটির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং সেগুলি স্ব-বিরোধিতার জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কিছু চিরন্তন অস্তিত্বশীল হয়, তাহলে তার পরিবর্তন বা ক্ষয়ের প্রশ্ন আসে না, যা অভিজ্ঞতার সাথে মেলে না। আবার, যদি সব কিছু সম্পূর্ণভাবে অনস্তিত্বশীল হয়, তাহলে কোনো কার্য-কারণ সম্পর্ক বা কর্মফলের ধারণাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। একইসাথে অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব—এই দুইয়ের সমন্বয়ও যৌক্তিকভাবে অসংগত। আর চতুর্থ কোটি, 'উভয় নয়', এটিও কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না, বরং সবরকম চরম দৃষ্টিভঙ্গিকে বাতিল করে দেয়।
নাগার্জুন ঘোষণা করেন: "চতুষ্কোটি-বিনির্মুক্ত মধ্যপথই একমাত্র সত্য।" এর অর্থ হলো, বাস্তবতাকে এই চারটি চরম দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটি দ্বারাই আবদ্ধ করা যায় না। সত্যিকারের জ্ঞান এই চারটি কোটির ঊর্ধ্বে। এই চতুষ্কোটি থেকে মুক্ত হয়ে, কোনো পূর্বনির্ধারিত ধারণায় না গিয়ে, বাস্তবতাকে যেমনটি আছে, তেমনটিই উপলব্ধি করাই হলো মধ্যম পথ। এই মধ্যম পথই শূন্যতার ধারণার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যেখানে সমস্ত ধারণা এবং নির্মাণকে তাদের অন্তঃসারশূন্যতার কারণে বাতিল করা হয়, তবে এটি নিছক শূন্যতা বা নৈরাজ্যবাদ নয়। এটি একধরনের মুক্তি, যা সকল প্রকার ভ্রম ও ভুল ধারণা থেকে মুক্ত করে।
নাগার্জুনের এই দর্শনই "মধ্যমক" সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, যার মূল ভিত্তি হলো "মধ্যমা প্রতিপদা" বা মধ্যম পথ। এই মধ্যমক দর্শন বৌদ্ধ চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং এর মাধ্যমে মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি শক্তিশালী দার্শনিক কাঠামো তৈরি হয়। এটি মানুষকে চরম বিশ্বাস এবং চরম অবিশ্বাস উভয়ই পরিহার করে, নিরপেক্ষ এবং উন্মুক্ত মন নিয়ে বাস্তবতার অন্বেষণ করতে উৎসাহিত করে।
“মহাযান” (Mahāyāna) শব্দটি মহা (মহান, বিস্তৃত) এবং যান (যান, বা পথ—যা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়), এই দুই অংশ নিয়ে গঠিত; অর্থাৎ, মহাযান মানে “মুক্তির মহাপথ”—যা শুধু ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং সমগ্র জীবসত্তার মুক্তির জন্য নিবেদিত এক আধ্যাত্মিক অভিযান। এর বিপরীতে, পূর্ববর্তী ধারাটিকে হীনযান (Hīnayāna) বা “ক্ষুদ্র যান” বলা হয়, যেখানে মুক্তি ছিল ব্যক্তিগত—নিজের নির্বাণ অর্জনই প্রধান লক্ষ্য।
বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় চার–পাঁচ শতাব্দী পর, বৌদ্ধ সংঘের মধ্যে কিছু ভিক্ষু উপলব্ধি করলেন যে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রাথমিক “অভ্যন্তরীণ” জোর—অর্থাৎ ব্যক্তিগত মুক্তি (অর্হৎ আদর্শ)—মানবতার বৃহত্তর কল্যাণবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁরা বললেন—“যতক্ষণ একটিও জীব দুঃখে আছে, ততক্ষণ আমার মুক্তিও অসম্পূর্ণ।” এই করুণার (karuṇā) দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মহাযান উদ্ভব। এর প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল গান্ধার, কাশ্মীর, নালন্দা, এবং পরে চীন ও তিব্বত। এটি কিছু মৌলিক দার্শনিক ধারণার সমন্বয়ে গঠিত:
(ক) বোধিসত্ত্ব আদর্শ (Bodhisattva Ideal): মহাযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্ব সেই ব্যক্তি, যিনি সম্পূর্ণ জ্ঞানের (বোধি) দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন, তবু নিজের নির্বাণ বিলম্বিত করে সকল জীবের মুক্তির জন্য পৃথিবীতে থেকে যান। অর্থাৎ, তিনি বলেন—“আমি নিজে মুক্ত হব না, যতক্ষণ অন্যরা দুঃখে আছে।” এটি বৌদ্ধ করুণার (karuṇā) ও প্রজ্ঞার (prajñā) সমন্বয়।
(খ) শূন্যতা (Śūnyatā): মহাযানের দর্শনভিত্তি হলো নাগার্জুনের শূন্যতা তত্ত্ব। তিনি দেখালেন—সব কিছুই “স্বভাবত” (নিজস্বভাবে) শূন্য; অর্থাৎ কোনো কিছুর স্বাধীন, স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব নেই। সব কিছুই প্রতীত্যসমুৎপন্ন—পারস্পরিক নির্ভরতায় উদিত। এই শূন্যতা নৈরাশ্য নয়, বরং সম্পর্কের পূর্ণতা—যেখানে সব কিছু পরস্পরকে ধারণ করে।
(গ) দুই সত্য তত্ত্ব (Two Truths Doctrine): নাগার্জুন বলেন—দুটি স্তরে সত্য বিদ্যমান—সাংবৃত সত্য (Conventionally True)—প্রচলিত, আপেক্ষিক সত্য; পরমার্থ সত্য (Ultimately True)—চূড়ান্ত, অদ্বৈত সত্য। মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন উভয়ের সীমা অতিক্রম করে বোঝা যায়—উভয়ই একই বাস্তবতার দুই দিক।
(ঘ) চিত্তমাত্রবাদ (Cittamātra / Yogācāra): অসঙ্গ ও বসুবন্ধু প্রবর্তিত এই শাখা বলে—জগৎ আসলে “চিত্তমাত্র” (Mind-only)। বাইরের বস্তুগুলো আমাদের চেতনারই প্রতিফলন। অতএব, মুক্তি মানে মনকে পরিশুদ্ধ করা।
প্রধান শাস্ত্র ও সূত্রসমূহ: মহাযান অসংখ্য মহৎ সূত্র সৃষ্টি করে, যেমন—
প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র (Prajñāpāramitā Sūtra): এই সূত্রে বলা হয়েছে—সত্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন মানুষ বুঝতে পারে সব কিছুই শূন্য (śūnya), কোনো কিছুর স্থায়ী সত্তা নেই। এটি শূন্যতা ও প্রজ্ঞার ঐক্য শেখায়—“যা-কিছু আছে, তা আসলে নিরস্বভাব।”
লঙ্কাবতার সূত্র (Laṅkāvatāra Sūtra): এখানে মূল ধারণা চিত্তমাত্রবাদ (Mind-only doctrine)—সমস্ত জগৎ আসলে মন বা চেতনারই প্রতিফলন। বাইরে কোনো আলাদা বাস্তব নেই; যা-কিছু দেখা যায়, তা চিত্তের রূপ।
সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্র (Saddharma Puṇḍarīka / Lotus Sūtra): এই সূত্রে বলা হয়েছে—সব জীবই ভবিষ্যতে বুদ্ধ হতে পারে। বুদ্ধত্ব কোনো বিশেষ ব্যক্তির নয়; প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যেই বুদ্ধসত্তা নিহিত।
অবতংসক সূত্র (Avataṃsaka Sūtra): এখানে প্রকাশ করা হয়েছে বিশ্ব-অন্তর্গত ঐক্য ও আন্তঃসম্পর্কের দর্শন। প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি বস্তু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত—সব কিছু এক মহাজাগতিক জালের মতো একে অপরের মধ্যে প্রতিফলিত।
বজ্রচ্ছেদিকা সূত্র (Vajracchedikā / Diamond Sūtra): এই সূত্রে বলা হয়েছে—সত্যকে বোঝা যায় না চিন্তা বা ভাষার মাধ্যমে। চিন্তা যতই সূক্ষ্ম হোক, সত্য তার বাইরে; যে-মন “চিন্তার সীমা অতিক্রম করে”, সেই মনই মুক্ত।
সংক্ষেপে, প্রজ্ঞাপারমিতা—সব শূন্য, লঙ্কাবতার—মনই সব, পুণ্ডরীক—সবাই বুদ্ধ, অবতংসক—সব পরস্পর যুক্ত, বজ্রচ্ছেদিকা—চিন্তা ও ভাষার বাইরে সত্য।
হীনযান ও মহাযান: বৌদ্ধধর্মের দুই প্রধান পথ। বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি এক—বুদ্ধের চার আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, এবং দুঃখ-নিবৃত্তির সাধনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্ম দুটি স্বতন্ত্র দার্শনিক ও সাধনাপথে বিভক্ত হয়—হীনযান (Hīnayāna) ও মহাযান (Mahāyāna)। এই বিভাজন আসলে দার্শনিক নয়, বরং সাধনামুখী; এটি ঘটেছিল মুক্তির লক্ষ্য, পথ, ও উদ্দেশ্য–এর ভিন্ন উপলব্ধির কারণে।
হীনযানের আদর্শ—ব্যক্তিগত মুক্তি (অর্হৎ আদর্শ)। হীনযান অর্থাৎ “ক্ষুদ্র যান”—এখানে “ক্ষুদ্র” মানে সীমাবদ্ধ বা ব্যক্তিগত। এ ধারার সাধক মূলত নিজের দুঃখের অবসান এবং নির্বাণ অর্জনকে লক্ষ্য করে সাধনা করেন। এই ধারায় অর্হৎ (Arhat) আদর্শ কেন্দ্রে—অর্হৎ মানে যিনি সমস্ত তৃষ্ণা, অজ্ঞতা ও দুঃখকে নিবারণ করে ব্যক্তিগত নির্বাণ লাভ করেছেন। তাঁর কাছে মুক্তি মানে ব্যক্তিগত বন্ধনের অবসান, চিত্তের নিস্তরঙ্গ শান্তি।
হীনযানে বাস্তবতাকে দেখা হয় অভ্যন্তরীণ নৈতিক শুদ্ধতা ও ধ্যানের মাধ্যমে। এখানে বুদ্ধকে দেখা হয় একজন পরিপূর্ণ জ্ঞানী মানব হিসেবে, যিনি দুঃখের কারণ ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন; কিন্তু তিনি কোনো “অদ্বিতীয় চেতনা” বা “পরম সত্তা” নন। মুক্তি এখানে ব্যক্তিগত এবং কঠোর সাধনা ও নৈতিক শৃঙ্খলার দ্বারা অর্জনযোগ্য।
মহাযানের আদর্শ—সার্বজনীন মুক্তি (বোধিসত্ত্ব আদর্শ)। মহাযান অর্থাৎ “মহান যান”—যার উদ্দেশ্য সব জীবসত্তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়া। এখানে মুক্তি শুধু নিজের জন্য নয়; বরং অন্যদের দুঃখ মুক্ত করাও মুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধারায় কেন্দ্রীয় ধারণা হলো বোধিসত্ত্ব (Bodhisattva)।
বোধিসত্ত্ব সেই ব্যক্তি, যিনি জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েও নিজের নির্বাণ বিলম্বিত করেন সকল জীবের কল্যাণে। তাঁর প্রতিজ্ঞা—“যতক্ষণ একটিও প্রাণী দুঃখে আছে, ততক্ষণ আমি মুক্ত হব না।” এই করুণাই (karuṇā) মহাযানের হৃদয়, এবং প্রজ্ঞা (prajñā)-র ভিত্তি।
এখানে বুদ্ধকে কেবল এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং চেতনার পরম প্রতীক হিসেবে দেখা হয়—যে-বুদ্ধত্ব (Buddha-nature) প্রতিটি জীবের মধ্যে বিদ্যমান। অতএব, মহাযানে মুক্তি মানে নিজের মধ্যের বুদ্ধত্বকে জাগিয়ে তোলা, এবং অন্যদের মধ্যেও সেই জাগরণকে উদ্বুদ্ধ করা।
দার্শনিক বিস্তার: হীনযান মূলত অভিধর্ম ও বৈভাষিক বিশ্লেষণ-কেন্দ্রিক; তারা বাস্তবতার উপাদানগুলো (ধর্ম) বিশ্লেষণ করে মুক্তি খোঁজে। “অভিধর্ম” (Abhidhamma / Abhidharma) শব্দের আক্ষরিক অর্থ—“ধর্মসমূহের উচ্চতর বা বিশদ বিশ্লেষণ।” এটি ত্রিপিটকের (Tripiṭaka, তিন পিটক—বুদ্ধবাণীর তিন ঝুলি বা তিন বিভাগে বিভক্ত ধর্মগ্রন্থ) তিনটি প্রধান অংশের একটি অংশ।
বিনয় পিটক (Vinaya)—আচরণবিধি, সূত্র পিটক (Sutta)—বুদ্ধের উপদেশ, অভিধর্ম পিটক (Abhidhamma)—দর্শন ও বিশ্লেষণ। অভিধর্মের উদ্দেশ্য হলো অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতম উপাদান (ধর্ম / dhamma)–গুলোকে বিশ্লেষণ করা। এটি এমন একধরনের “বৌদ্ধ মনোবিজ্ঞান ও বাস্তবতত্ত্ব”—যেখানে বলা হয়, আমরা যাকে “ব্যক্তি” বা “আমি” ভাবি, তা আসলে বহু ক্ষণস্থায়ী ধর্মের সমষ্টি। অতএব, অভিধর্ম চায়—অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে দেখা, যাতে বোঝা যায় যে, কোনো “স্থায়ী আত্মা” নেই, শুধু মুহূর্তে-মুহূর্তে পরিবর্তনশীল উপাদান (ধর্ম) আছে।
বৈভাষিক বিশ্লেষণ (Vaibhāṣika Analysis): বৈভাষিক (Vaibhāṣika) হলো সর্বাস্তিবাদ (Sarvāstivāda) সম্প্রদায়ের একটি দর্শনধারা। “বৈভাষিক” মানে—যারা “মহাবিভাষা” নামক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ অনুসরণ করে। এই ধারার ভিক্ষুরা “অভিধর্ম”–এর ধারণাগুলোকে আরও পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন—সব ধর্ম (অস্তিত্বের উপাদান) তিন কালে (অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ) কোনো না কোনোভাবে “অস্তিত্বশীল” (sarvāsti)। অর্থাৎ, অতীত ধর্ম বিলুপ্ত নয়, ভবিষ্যৎ ধর্মও সম্ভাব্যভাবে বিদ্যমান—সবই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এক ধারাবাহিক অস্তিত্ব। এইভাবে তাঁরা বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একপ্রকার “বস্তুনিষ্ঠ অস্তিত্বতত্ত্ব” (realism) তৈরি করেন। তাঁদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত বিশ্লেষণাত্মক ও তাত্ত্বিক।
যখন বলা হয়—“হীনযান অভিধর্ম ও বৈভাষিক বিশ্লেষণ-কেন্দ্রিক”, তখন এর মানে হলো—এই ধারার দার্শনিক অনুসন্ধান প্রধানত অস্তিত্বের উপাদানগুলির বিশ্লেষণ ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা–র ওপর ভিত্তি করে। তাঁরা জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চায় ধর্মতত্ত্বের বিশ্লেষণের মাধ্যমে, যেমন—রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান (পঞ্চস্কন্ধ), এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। এরা অভিজ্ঞতাকে ছোটো ছোটো “ধর্ম” এককে ভাগ করে বোঝায়—যেন মনোবৈজ্ঞানিক ও অস্তিত্বগত রাসায়নিক বিশ্লেষণ। এই দৃষ্টি বিশ্লেষণাত্মক, পদ্ধতিগত, এবং যুক্তিনিষ্ঠ।
মহাযানের সঙ্গে পার্থক্য: অভিধর্ম ও বৈভাষিক ধারা যেখানে জগৎকে বিভাজন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝে, মহাযান সেখানে জগতকে বোঝে সম্পর্ক ও শূন্যতার মাধ্যমে। অর্থাৎ, অভিধর্ম বলে—“সব কিছু বহু উপাদানে গঠিত”, আর মহাযান বলে—“উপাদান বলে কিছুই স্বতন্ত্র নেই।” একটি বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যটি অদ্বৈত-সম্পর্কনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি।
অভিধর্ম ও বৈভাষিক বৌদ্ধ দর্শনের সেই ধারা, যেখানে মুক্তির পথ হলো বাস্তবতার ক্ষুদ্রতম উপাদানসমূহকে (ধর্ম) যথাযথভাবে বোঝা, বিশ্লেষণ করা এবং তাদের অনিত্য-অনাত্ম প্রকৃতি অনুধাবন করা। এটি ছিল বুদ্ধের উপদেশের “বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণধর্মী শাখা”, যার থেকে পরবর্তীতে মহাযান এক অধিবিদ্যাগত ও অদ্বৈত চেতনার দিকে অগ্রসর হয়।
অন্যদিকে, মহাযান দর্শনের দুটি বিশাল শাখা বিকশিত হয়—মাধ্যমক দর্শন (Mādhyamika)—নাগার্জুন প্রবর্তিত, যা “শূন্যতা”-র দর্শন। যোগাচার বা চিত্তমাত্রবাদ (Yogācāra / Cittamātra)—বসুবন্ধু ও অসঙ্গ প্রবর্তিত, যা বলে, জগৎ আসলে চেতনার প্রতিফলন। এইভাবে মহাযান দর্শন কেবল আধ্যাত্মিক নয়, বরং এক গভীর অধিবিদ্যা হয়ে ওঠে—যেখানে শূন্যতা, করুণা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধত্ব একত্রে মিলিত হয়।