অদ্বৈত মতে, জ্ঞান তিন ধাপে বিকশিত হয়: শ্রবণ (Śravaṇa)—উপনিষদের শিক্ষা বা গুরু থেকে ব্রহ্মতত্ত্ব শোনা। মনন (Manana)—যুক্তি দ্বারা সেই শিক্ষাকে গভীরভাবে চিন্তা ও সন্দেহমুক্ত করা। নিদিধ্যাসন (Nididhyāsana)—ধ্যান ও অন্তর্মুখী চেতনায় সেই জ্ঞানকে স্থিতি করা। এই তিনের পরিণতিই হলো—অপরোক্ষানুভূতি—আত্ম-ব্রহ্ম-একত্ব-এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
অপরোক্ষানুভূতি সেই চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা, যেখানে জানা ও জানার প্রক্রিয়া মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সেখানে আর “জ্ঞানী”, “জ্ঞেয়” ও “জ্ঞান”—এই তিনের কোনো বিভেদ থাকে না। শঙ্করাচার্য একে বলেছেন—“Ātman is self-luminous; knowing It is being It.” অর্থাৎ—আত্মাকে জানার মানেই আত্মা হওয়া। প্রত্যক্ষানুভূতি হচ্ছে—ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু বা জগতের সরাসরি জ্ঞান। অপরোক্ষানুভূতি (বেদান্তে) হচ্ছে—আত্মার নিজের প্রকৃত স্বরূপে ব্রহ্মতত্ত্ব উপলব্ধি, যা কোনো ইন্দ্রিয়, যুক্তি বা বাহ্য উপায়ে নয়, বরং আত্ম-চৈতন্যের দ্বারা নিজেই প্রকাশিত।
“প্রত্যক্ষ” (Pratyakṣa)—ইন্দ্রিয়গোচর জ্ঞান—শঙ্করাচার্য প্রত্যক্ষকে মেনে নেন একটি বৈধ জ্ঞানের উৎস (প্রমাণ) হিসেবে। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন—প্রত্যক্ষজ্ঞান কেবলমাত্র ব্যাবহারিক (vyāvahārika) স্তরে সত্য, পারমার্থিক (pāramārthika) স্তরে নয়।
প্রত্যক্ষ মানে সেই জ্ঞান, যা ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে উৎপন্ন হয়—চোখে রং দেখা, কানে শব্দ শোনা ইত্যাদি। এসব জ্ঞান ইন্দ্রিয়, মন ও বহিঃবস্তু-এর পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। কিন্তু শঙ্কর বলেন—যেহেতু এই জ্ঞান মায়াময় জগৎ-সংক্রান্ত, তাই এটি অস্থায়ী ও আপেক্ষিক সত্য (mithyā)। উদাহরণস্বরূপ, মরীচিকা-ভ্রমে “জল আছে” বলে চোখে-দেখা জ্ঞানও প্রত্যক্ষ, কিন্তু পরে বোঝা যায়, সেটা ভ্রম (illusion)। তাই, শঙ্করাচার্য প্রত্যক্ষজ্ঞানকে একমাত্র পরম সত্য বলে গ্রহণ করেন না। এটি মিথ্যা নয়, তবে “সাপেক্ষ সত্য”—যতক্ষণ না উচ্চতর জ্ঞান (অপরোক্ষজ্ঞান) দ্বারা তা বাধিত হয়।
“অপরোক্ষ” (Aparokṣa)—আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্ম-সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা—“অপরোক্ষ” শব্দটি শঙ্করের বেদান্তে একটি গভীর আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যবহৃত। এটি কেবল “পরোক্ষ নয়” বা “ইন্দ্রিয়ের বাইরে” নয়—বরং বোঝায়—যে-জ্ঞান সরাসরি আত্মস্বরূপে প্রকাশিত। শঙ্করের ভাষায়: “Ātmanā eva Ātmanam paśyati”—আত্মা নিজের দ্বারাই আত্মাকে প্রত্যক্ষ করে। এই আত্মসাক্ষাৎ জ্ঞানই অপরোক্ষ।
প্রত্যক্ষ বনাম অপরোক্ষ—শঙ্করের ব্যাখ্যায়:
(১) জ্ঞানের উৎসে পার্থক্য: প্রত্যক্ষজ্ঞান উৎপন্ন হয় ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে, অপরোক্ষজ্ঞান উৎপন্ন হয় আত্ম-চৈতন্যের প্রকাশে।
(২) বস্তু বা বিষয়ে পার্থক্য: প্রত্যক্ষজ্ঞান বহির্বস্তু (জগৎ) নিয়ে, অপরোক্ষজ্ঞান নিজস্ব আত্মস্বরূপ (ব্রহ্ম) নিয়ে।
(৩) সত্যতার স্তরে পার্থক্য: প্রত্যক্ষজ্ঞান আপেক্ষিক সত্য (vyāvahārika-satya), অপরোক্ষজ্ঞান পরমার্থিক সত্য (pāramārthika-satya)।
(৪) জ্ঞানের ফল: প্রত্যক্ষজ্ঞান সাময়িক ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান দেয়, অপরোক্ষজ্ঞান অজ্ঞান-নাশী ও মুক্তিদায়ক জ্ঞান।
শঙ্করের মূল অবস্থান: শঙ্করাচার্যের মতে—ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ও অনুমান কেবল মায়াময় জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান দিতে পারে। কিন্তু ব্রহ্ম-আত্মজ্ঞান, যা মুক্তির কারণ, তা কোনো ইন্দ্রিয় বা অনুমান দ্বারা সম্ভব নয়। সেই জ্ঞান আসে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন-এর মাধ্যমে, যার পরিণতি অপরোক্ষানুভূতি—আত্মার স্বরূপে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
উপনিষদীয় ভিত্তি: শঙ্কর উপনিষদের উক্তি উদ্ধৃত করেন—“ন প্রজ্ঞাতেন, নাপ্রজ্ঞাতেন, কিঞ্চন।”—অর্থাৎ, “ব্রহ্মকে জানা যায় না কোনো বাহ্য প্রমাণ বা ইন্দ্রিয় দ্বারা; তা নিজের দ্বারা নিজেই প্রকাশিত চৈতন্য।” তাই তিনি বলেন—“যে জ্ঞান অপরোক্ষ, সেই জ্ঞানই পরমার্থসত্য।” “যে-জ্ঞান প্রত্যক্ষ, সেটি অবিদ্যাগ্রস্ত দৃষ্টিতে সত্য।”
সংক্ষেপে, প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa): ইন্দ্রিয়গোচর, জগৎসংক্রান্ত, আপেক্ষিক ও মায়াময় জ্ঞান; যেমন দেহ, শব্দ, রঙ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অপরোক্ষ (Aparokṣa): আত্মচৈতন্যে উদিত, ব্রহ্মসংক্রান্ত, চিরন্তন ও মুক্তিদায়ক জ্ঞান; যেমন “আমি ব্রহ্ম” এই অন্তর্সাক্ষাৎ বা আত্মানুভূতি। শঙ্করাচার্যের ভাষায়—পরিবর্তনশীল বস্তু ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ হয়, কিন্তু চিরন্তন আত্মা নিজেই নিজের দ্বারা অপরোক্ষভাবে প্রত্যক্ষ হয়।
মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে জ্ঞান, ভাষা ও শূন্যতার নীরবতা: মাধ্যমক দর্শন আরও র্যাডিকাল। নাগার্জুন বলেন, ভাষা ও চিন্তা কেবল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে—“অস্তিত্ব” বনাম “অনস্তিত্ব”, “এক” বনাম “অন্য”, “সৃষ্টি” বনাম “বিলয়”। কিন্তু বাস্তবতার স্তরে এসব দ্বন্দ্ব অর্থহীন। তাই মাধ্যমক জ্ঞান মানে—এই দ্বৈত-চিন্তার কাঠামো ভেঙে দেওয়া—এবং শেষপর্যন্ত নীরবতায় তাকে প্রতিষ্ঠা করা। নাগার্জুন তাঁর Mūlamadhyamakakārikā গ্রন্থে বলেন, “যে-ভাষা দিয়ে বলা যায়, তা মিথ্যা; যা সত্য, তা বলা যায় না।” অর্থাৎ, পরমার্থ সত্য কোনো প্রস্তাব, সংজ্ঞা বা ধারণায় প্রকাশ করা অসম্ভব। কারণ, ভাষা সর্বদা “কিছু” নির্দেশ করে—আর পরম সত্য হলো সেই “অ-কিছু”, যার কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যই নেই।
মাধ্যমকের “প্রজ্ঞা” তাই কোনো চিন্তন নয়; এটি চিন্তার অবসান। এই অবস্থায় মন সমস্ত ধারণা ও যুক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নীরব হয়। এই নীরবতা কোনো শূন্যতা নয়, বরং শূন্যতার স্বরূপই সচেতনতা। বৌদ্ধরা এই অবস্থাকে বলে nirodha—মানসিক ক্রিয়ার অবসান। এই অবসানই নির্বাণের দ্বার; কারণ সেখানে সব নাম, রূপ ও পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়।
“নিরোধ” (Nirodha) শব্দটি ভারতীয় দর্শনে—বিশেষত যোগ, বৌদ্ধ, এবং বেদান্ত—তিন ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃত ‘nirodha’-র গঠন যদি দেখি—মূল ধাতু: “rudh” (রোধ করা, স্থগিত করা, থামানো), উপসর্গ: “ni” (ভিতরে, সম্পূর্ণভাবে, নিঃশেষে)। তাই Nirodha মানে সম্পূর্ণভাবে রোধ বা অবসান। অর্থাৎ, যে-অবস্থায় মানসিক চঞ্চলতা, চিন্তা, অনুভব, ইচ্ছা, প্রতিক্রিয়া—সব কিছু সম্পূর্ণভাবে নিস্তব্ধ ও অবরুদ্ধ হয়, সেই অবস্থাই নিরোধ।
যোগদর্শনে নিরোধ:
সূত্র: “Yogaś citta-vṛtti-nirodhaḥ.” (পতঞ্জলি যোগসূত্র, I.2)
বাংলা অর্থ: “যোগ হলো চিত্তবৃত্তির নিরোধ।” অর্থাৎ, মনো-বৃত্তির সম্পূর্ণ অবসানই যোগ।
ব্যাখ্যা: চিত্তবৃত্তি মানে—মনের ক্রিয়া, পরিবর্তন, চিন্তা, অনুভব ইত্যাদি। যখন এসব ক্রিয়া একে একে শান্ত হয়ে যায়, এবং চিত্ত নিস্তরঙ্গ হয়—তখন আত্মা (পুরুষ বা দ্রষ্টা) নিজের স্বরূপে অবস্থান করে।
এর পরের সূত্র: “Tadā draṣṭuḥ svarūpe avasthānam.”—তখন দ্রষ্টা (আত্মা) নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ, নিরোধের দ্বারা মন যখন সম্পূর্ণ শান্ত, তখন আত্মা নিজের শুদ্ধ অবস্থায় প্রকাশিত হয়।
বৌদ্ধ দর্শনে নিরোধ: বুদ্ধের “চার আর্যসত্য”-এর মধ্যে একটি হলো—দুঃখনিরোধসত্য (dukkha-nirodha-satya)। এখানে নিরোধ মানে: দুঃখ ও তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি, চেতনার আসক্তিহীন অবসান। অর্থাৎ, কামনা-তৃষ্ণা-আসক্তি—এই মানসিক ক্রিয়াগুলি যখন নিঃশেষে থেমে যায়, তখন দুঃখেরও অবসান ঘটে। এই অবস্থাকেই বুদ্ধ বলেছেন নির্বাণ (Nirvāṇa)। তাই বৌদ্ধার্থে নিরোধ মানে—“মানসিক আসক্তি ও ক্লেশের নিঃশেষ।”
অদ্বৈত বেদান্তে নিরোধ: অদ্বৈত বেদান্তে “নিরোধ” মানে মন-বুদ্ধির ক্রিয়ার সম্পূর্ণ প্রশম। যখন মন ব্রহ্মস্বরূপে স্থিত হয়, তখন চিন্তা ও ভেদবুদ্ধি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। এটাই “নিরোধ” বা “চিত্ত-উপশম”। শঙ্করাচার্যের ভাষায়: “মন নিজের উৎস আত্মায় লীন হলে সেটিই নিরোধ।” অর্থাৎ, নিরোধ মানে মনকে বলপূর্বক থামানো নয়, বরং মন তার আসল উৎস—চেতনা বা আত্মায় ফিরে গিয়ে স্থিত হওয়া।
গৌতম বুদ্ধের "চার আর্যসত্য" (Cattāri Ariyasaccāni) হলো তাঁর সমগ্র শিক্ষার ভিত্তি—সম্যক দর্শনের মূল কাঠামো। এগুলো এমন চারটি সত্য, যা বুদ্ধ স্বয়ং নিজের বোধিলাভের পর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধ হয়েছিলেন এবং মানবজীবনের দুঃখ ও মুক্তির পূর্ণ ব্যাখ্যা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন।
চার আর্যসত্য (The Four Noble Truths):
দুঃখ সত্য (Dukkha Sacca)—দুঃখের সত্য—এই জগতের সমস্ত জীব দুঃখে আবদ্ধ। জন্ম, বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু—সবই দুঃখ। এমনকি যা আমরা সুখ ভাবি, তা-ও অস্থায়ী বলে শেষপর্যন্ত দুঃখে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধ বলেছেন: “জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ।” (Dhammacakkappavattana Sutta)
দুঃখের তিন রূপ—দুঃখ-দুঃখ: শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণা (ব্যথা, অসুখ, কষ্ট)। বিপরিণাম-দুঃখ: সুখ বা প্রিয় জিনিস হারানোর দুঃখ (পরিবর্তনের যন্ত্রণা)। সংখার-দুঃখ: সমস্ত সংযোজিত বস্তুর অস্থায়িত্বজনিত দুঃখ—জীবনের অস্থির প্রকৃতি থেকেই দুঃখ জন্মায়।
সমুদয় সত্য (Samudaya Sacca)—দুঃখের উৎপত্তির সত্য—বুদ্ধ বলেন, দুঃখের মূল কারণ হলো তৃষ্ণা (taṇhā)—আকাঙ্ক্ষা বা আসক্তি। এই তৃষ্ণাই আমাদের পুনর্জন্মের বন্ধন ঘটায়। তৃষ্ণার তিন রূপ:
কামতৃষ্ণা (Kāma-taṇhā): ইন্দ্রিয়সুখের আকাঙ্ক্ষা
ভবতৃষ্ণা (Bhava-taṇhā): অস্তিত্ব বা ধারাবাহিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা
বিভবতৃষ্ণা (Vibhava-taṇhā): অস্তিত্ব বিলোপ বা বিনাশের আকাঙ্ক্ষা
আকাঙ্ক্ষাই দুঃখের মূল। যতক্ষণ তৃষ্ণা থাকবে, ততক্ষণ দুঃখের চক্র (সংসার) চলবে।
নিরোধ সত্য (Nirodha Sacca)—দুঃখের নিবৃত্তির সত্য—যদি তৃষ্ণা দুঃখের কারণ হয়, তবে তৃষ্ণার অবসানেই দুঃখের অবসান। তৃষ্ণার নিঃশেষ মানে নিরোধ—যা নির্বাণ (Nirvāṇa) নামে পরিচিত। বুদ্ধের বাণী: “তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিঃশেষই দুঃখের নিরোধ।” নিরোধ মানে শুধু দুঃখের অনুপস্থিতি নয়, বরং সম্পূর্ণ মুক্তি—মন, কামনা ও অজ্ঞানের নিস্তব্ধ অবস্থা। এখানেই সমস্ত ক্লেশ, কর্মফল ও পুনর্জন্মের অবসান ঘটে।
মার্গ সত্য (Magga Sacca)—দুঃখনিরোধের পথে সত্য। দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করতে হয়—যাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Ariya Aṭṭhaṅgika Magga)—যা কেবল একটি নৈতিক আচরণবিধি নয়, বরং সম্পূর্ণ জীবনপদ্ধতি—যেখানে চিন্তা, বাক্য, আচরণ, মনন, ও ধ্যান—সব কিছু একসঙ্গে পরিশুদ্ধ হয়। এই আটটি পদক্ষেপ হলো:
১. সম্যক দৃষ্টি (Sammā-diṭṭhi)—সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। এটি হলো বৌদ্ধ সাধনার ভিত্তি। সম্যক দৃষ্টি মানে—জগতকে, যেমন আছে, তেমনভাবে দেখা; কোনো মায়া বা বিকার ছাড়া দেখা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত: চার আর্যসত্যের গভীর বোঝাপড়া, কর্ম (কর্মফল) ও পুনর্জন্মের নীতি বোঝা, অনিত্য (অস্থায়িত্ব), অনাত্মা (অহং-শূন্যতা) ও দুঃখ (অসন্তুষ্টি)-র প্রকৃতি উপলব্ধি করা। যে-ব্যক্তি সম্যক দৃষ্টি অর্জন করে, তার মন মায়ার পর্দা ভেদ করে বাস্তবতার স্বরূপ দেখতে শুরু করে।
২. সম্যক সংকল্প (Sammā-saṅkappa)—সঠিক সংকল্প বা মনোভাব। এটি হলো মানসিক পবিত্রতার শুরু। সম্যক সংকল্প মানে—অহিংসা (অন্যকে আঘাত না করা), অনাসক্তি (ভোগলালসা থেকে মুক্তি), করুণা ও মৈত্রীর চেতনা। বুদ্ধ বলেন, চিন্তাই কর্মের মূল। তাই সঠিক চিন্তা মানে হলো এমন মনোভাব, যা দুঃখের উৎপত্তি ঘটায় না—নিজের বা অন্যের।
৩. সম্যক বাক্ (Sammā-vācā)—সঠিক বাক্য। এটি কথার শুদ্ধতা সংক্রান্ত। সম্যক বাক্ মানে—মিথ্যা না বলা, পরনিন্দা বা অপবাদ না করা, কটুভাষণ না করা, অনর্থক বাক্য না বলা। বুদ্ধ বলেন, বাক্য হৃদয়ের প্রতিফলন। সুতরাং বাক্য যেন সত্য, কোমল, ও সদর্থক হয়—তবেই মন শুদ্ধ হয়।
৪. সম্যক কর্ম (Sammā-kammanta)—সঠিক কর্ম। এটি শরীরের দ্বারা সম্পাদিত নৈতিক আচরণ নির্দেশ করে। সম্যক কর্ম মানে—প্রাণীহিংসা থেকে বিরত থাকা, চুরি না করা, কুকর্ম বা অসৎ যৌনাচার না করা। শরীরের প্রতিটি কাজ যেন অহিংসা ও সততার ভিত্তিতে হয়—এটাই এর মূল লক্ষ্য।
৫. সম্যক আজীবিকা (Sammā-ājīva)—সৎ উপার্জন। এটি জীবিকা বা পেশা সম্পর্কে। বুদ্ধ বলেন, জীবিকা যেন অন্যের ক্ষতি করে নয়, বরং নৈতিক পথে হয়। অতএব—হত্যা, প্রতারণা, শোষণ, মদ্যপান, বা অনৈতিক ব্যাবসা এড়িয়ে চলা উচিত। জীবিকা এমন হওয়া উচিত, যা জীবনে করুণা ও সত্যের চর্চা বাড়ায়।