এর ফলে, জগৎ আর কোনো “স্বতঃসিদ্ধ তথ্য” নয়। বরং এটি হয়ে দাঁড়ায় একটি দার্শনিক দায়বদ্ধতা—যাকে রক্ষা করতে হবে যুক্তি, প্রমাণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই প্রাথমিক পদক্ষেপই সমগ্র সমালোচনার ভিত্তি তৈরি করে, যেখানে অভ্যাসগতভাবে গ্রহণ করা দৃশ্যমান জগৎ ধীরে ধীরে তার ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে, আর চূড়ান্ত সত্য হিসেবে ব্রহ্ম উদ্ভাসিত হয়।
একজন মানুষ অন্ধকারে মাটিতে একটি দড়ি দেখে। আলো না থাকার কারণে সে ভাবে—“এটা সাপ!” এখন প্রশ্ন হলো: এই বস্তুটি আসলে কী? সাধারণ বাস্তববাদী বলবে: “আমি চোখে সাপ দেখেছি, তাই সাপ আছে।” কিন্তু দার্শনিক বলবে: “না, এটাকে প্রথম থেকেই বিতর্কিত হিসেবে ধরা উচিত।” এই অবস্থাই হলো বিবাদাস্পদী ভূতঃ—যা দেখছি, সেটিকে সরাসরি সত্য ধরে নেওয়া যাবে না। প্রথম থেকেই এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে।
দায়ভার কার উপর? এখন যদি কেউ দাবি করে—“হ্যাঁ, এটা সত্যিই সাপ।” তাহলে প্রমাণের দায়ভার তার ওপরই পড়ে। তাকে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে দেখাতে হবে যে, এটা সাপ। অন্যদিকে, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ শুধু বলে—“আমি যা দেখছি, তা সন্দেহজনক, বিতর্কযোগ্য।” এভাবে জিনিসটিকে পরীক্ষার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
জগৎ আমাদের কাছে দড়ির মতো, কিন্তু আমরা প্রায়ই এটিকে সাপ ভেবে নিই। সরল বাস্তববাদ বলে: “যা চোখে দেখি, তা-ই সত্য।” কিন্তু বিবাদাস্পদী ভূতঃ বলে: “না, যা দেখা যাচ্ছে, তাকে সত্য ধরে নিলে ভুল হবে; আগে যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে।” অদ্বৈত এই প্রাথমিক সন্দেহকেই ব্যবহার করে। তারা বলে—“যদি দড়ি-সাপ বিভ্রমের মতো ভুল হতে পারে, তাহলে পুরো জগতও তেমন বিভ্রম হতে পারে।” এভাবে ধাপে ধাপে প্রমাণের কাঠামো ভেঙে দিয়ে তারা দেখায়: চূড়ান্ত সত্য কেবল ব্রহ্ম।
তাই “বিবাদাস্পদী ভূতঃ” হলো সেই দর্শন-কৌশল, যেখানে জগৎকে শুরু থেকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো হয়—যেন আমরা “সাপ” বলে ভুল না করি, বরং আলো জ্বালিয়ে “দড়ি” দেখতে শিখি।
এখন চলুন, অদ্বৈত বেদান্তের কৌশল আর বৌদ্ধ দর্শনের “শূন্যতা”-র পদ্ধতি তুলনা করে দেখি। দুটোই জগতকে প্রথমে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ও পদ্ধতি আলাদা।
১. অদ্বৈতের কৌশল: মিথ্যাত্ব ও ব্রহ্ম
মূল বক্তব্য: কেবল ব্রহ্মই চূড়ান্ত সত্য; জগৎ মিথ্যা (mithyā)—না পুরো সত্য, না পুরো অসত্য।
কৌশল: প্রথমে জগতকে বিবাদাস্পদী ভূতঃ—অর্থাৎ বিতর্কযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা। দেখানো যে, ইন্দ্রিয় (প্রত্যক্ষ) ও যুক্তি (অনুমান) সীমিত, তাই তারা জগৎকে চূড়ান্ত সত্য প্রমাণ করতে পারে না। শেষে বলা—শ্রুতি (উপনিষদ)-ই একমাত্র প্রমাণ, যা বলে “তত্ত্বমসি” (তুমিই সেই ব্রহ্ম)।
দৃষ্টান্ত: দড়ি-সাপ বিভ্রম। দড়ি (ব্রহ্ম) চিরন্তন সত্য, সাপ (জগৎ) মিথ্যা প্রতীতি।
লক্ষ্য: ব্রহ্ম-উপলব্ধি—একত্বের অভিজ্ঞতা।
২. বৌদ্ধের কৌশল: শূন্যতা (Śūnyatā)
মূল বক্তব্য: কোনো সত্তাই স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান নয়; সবই শূন্য (śūnya)—পরস্পরনির্ভর।
কৌশল: প্রথমে জগৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করা—“যা আমরা স্বাধীন ও স্থায়ী বলে ধরি, তা আসলে কারণ-কার্যের জালে নির্ভরশীল।”
প্রত্যক্ষ বিশ্লেষণ: প্রতিটি বস্তু অংশে বিভক্ত করলে স্বাধীন সত্তা পাওয়া যায় না।
যুক্তি: কিছুই নিজস্ব স্বরূপে (svabhāva) টিকে থাকতে পারে না।
দৃষ্টান্ত—রথ দৃষ্টান্ত (নাগার্জুন): রথ হলো চাকা, অক্ষ, দণ্ড ইত্যাদির সমষ্টি—রথ নামে আলাদা কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই।
লক্ষ্য: অনাত্ম উপলব্ধি—আসক্তি কাটানো ও নির্বাণলাভ।
“রথ দৃষ্টান্ত” (Cart Analogy) বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন বিশেষভাবে ব্যবহার করেছিলেন শূন্যতা (Śūnyatā) ধারণা বোঝাতে। এর মূল ভাবনা—রথ বলে আমরা যে-জিনিসকে দেখি, সেটি আসলে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়। রথ মানে চাকা, অক্ষ, দণ্ড, জোয়াল, আসন ইত্যাদির সমষ্টি, আলাদা করে “রথ” নামে কিছু নেই—শুধু সেই অংশগুলির মিলিত সমন্বয়কে আমরা রথ বলি। অংশগুলি সরিয়ে দিলে রথ আর থাকে না।
এভাবে নাগার্জুন দেখাতে চেয়েছেন—রথ কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়, বরং নির্ভরশীল সত্তা। যেমন রথ অংশগুলির সমন্বয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সমস্ত বস্তু ও প্রাণী কারণ-কার্য, শর্ত ও সম্পর্কের উপর নির্ভর করে থাকে। তাই কোনো কিছুকেই “স্বতন্ত্র, নিজস্বভাবে বিদ্যমান (svabhāva)” বলা যায় না।
মানুষ—“আমি” নামটি আলাদা কোনো আত্মা নয়; দেহ, মন, স্মৃতি, অনুভূতি, চেতনা—এসব মিলে একসাথে আমরা “আমি” বলি। ফুল—ফুলও নিজে নিজে নেই; বীজ, পানি, সূর্যরশ্মি, মাটি, সময়—সব মিলে ফুল হয়। রথ-দৃষ্টান্ত বোঝাতে চায়—কোনো জিনিসকে “স্বতন্ত্র ও স্থায়ী” ধরে নেওয়া ভুল। সবই পারস্পরিক নির্ভরশীল (dependent origination)। এই উপলব্ধিই “শূন্যতা”—সব কিছুর মধ্যে স্থায়ী, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
অদ্বৈত আর শূন্যতার মধ্যে মিল হলো, দুটোই জগৎকে শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। দুটোই বলে—“যা আমরা চোখে দেখি, তাই চূড়ান্ত সত্য নয়।” দুটোই বিতর্ক ও যুক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আবার অমিল হলো, অদ্বৈত—শেষে এক চূড়ান্ত সত্যে (ব্রহ্ম) প্রতিষ্ঠা দেয়; বৌদ্ধ—কোনো স্থায়ী সত্যে পৌঁছায় না—সব কিছুরই শূন্যতা দেখায়। অদ্বৈত—জ্ঞান (vidyā) দ্বারা মুক্তি—“আমি ব্রহ্ম।” বৌদ্ধ—অনাত্ম উপলব্ধি দ্বারা মুক্তি—“কোনো স্বতন্ত্র ‘আমি’ নেই।” অদ্বৈত হলো আলোর খোঁজে যাত্রা: বিভ্রম মুছে শেষে ব্রহ্ম-সত্য প্রকাশ। বৌদ্ধ শূন্যতা হলো আসক্তি মুছে ফেলার পথ: সব সত্তার শূন্যতা উপলব্ধি করে নির্বাণে পৌঁছানো।
জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক অপ্রতুলতা (প্রমাণ-সিদ্ধত্বাৎ):
প্রচলিত প্রমাণকে প্রশ্ন করা—অদ্বৈত দর্শনের একটি প্রধান যুক্তি হলো—প্রকাশিত জগৎ আসলে প্রচলিত প্রমাণ (pramāṇa) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। আমরা সাধারণত বলি—“আমি চোখে দেখেছি (প্রত্যক্ষ), তাই সত্য।” অথবা “আমি যুক্তি দিয়ে বুঝেছি (অনুমান), তাই সত্য।” কিন্তু অদ্বৈত এই ধারণাকে প্রশ্ন করে। তারা বলে—প্রত্যক্ষ আর অনুমান আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে কার্যকরী হলেও, তারা চূড়ান্ত সত্য (Sat) প্রমাণ করতে পারে না।
কেন এই সমালোচনা? ন্যায় দর্শন বলেছিল—“প্রত্যক্ষ আর অনুমানই যথেষ্ট জগতের বাস্তবতা প্রমাণ করতে।” অদ্বৈত বলে—প্রত্যক্ষ সবসময় সীমিত—চোখ যা দেখে, তা কেবল ইন্দ্রিয়ের আওতাভুক্ত। অনুমান সবসময় শর্তাধীন—যেমন ধোঁয়া দেখে আগুন অনুমান করা। কিন্তু অনুমানেরও ভুল হবার সম্ভাবনা আছে। তাই, যন্ত্রগুলো (প্রমাণ) যদি সীমিত হয়, তবে তারা যে-বাস্তবতা প্রমাণ করে, সেটিও সীমিত হবে।
প্রমাণ-সিদ্ধত্বাৎ-এর অর্থ: এই অবস্থাকে বলা হয় “প্রমাণ-সিদ্ধত্বাৎ”—অর্থাৎ, জগতের অস্তিত্ব প্রচলিত প্রমাণ দ্বারা চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। অদ্বৈতের বক্তব্য—ইন্দ্রিয় আর যুক্তি দিয়ে আমরা জগৎকে ব্যাবহারিক স্তরে সত্য বলে মানতে পারি। কিন্তু জগতকে চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় সত্য (Sat) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এগুলো যথেষ্ট নয়। তাই জগৎ মিথ্যা (mithyā)—না একেবারে শূন্য, না একেবারে সত্য।
সহজ করে বললে—যে-মাপে মাপার ফিতা বাঁকানো বা অসম্পূর্ণ, সেই ফিতা দিয়ে মাপলেও মাপ সবসময় সীমিত হবে। ঠিক তেমনি, আমাদের প্রমাণগুলো সীমিত, তাই তারা জগৎকে কখনও অসীম সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
স্বয়ং-প্রভ বা আত্ম-জ্যোতির্ময়তার মানদণ্ড (Svaprakāśa): অদ্বৈত বিশ্লেষণে একটি মৌলিক বৈপরীত্য তুলে ধরা হয়—জগৎকে প্রমাণ করতে প্রমাণ (pramāṇa) দরকার হয়, কিন্তু আত্মা (ātman) নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু আত্মা কেন স্বয়ং-প্রভ?
অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা: আত্মার অস্তিত্ব আমরা কোনো বাইরের মাধ্যমে জানি না; আমরা সরাসরি, প্রত্যক্ষভাবে তা অনুভব করি।
স্বপ্রকাশ (Svaprakāśa): আত্মা নিজে জ্যোতির্ময়—নিজে প্রকাশিত এবং অন্যকেও প্রকাশ করে। যেমন আলোকে দেখতে অন্য আলোর দরকার হয় না, আত্মাকেও প্রমাণ করার জন্য বাহ্যিক কোনো প্রমাণের দরকার নেই।
অস্বীকার অযোগ্য: আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করাও আত্মার ওপর নির্ভরশীল, কারণ অস্বীকার করার অভিজ্ঞতাও সচেতনতার মাধ্যমে ঘটে। তাই আত্মা সব অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত ভিত্তি।
জগৎ কেন নিচু স্তরে?
জগৎ নির্ভরশীল: জগৎকে আমরা প্রমাণ (ইন্দ্রিয়, অনুমান, সাক্ষ্য ইত্যাদি) দিয়ে জানি। তাই জগতের অস্তিত্ব সবসময় বাহ্যিক বৈধতা চায়। এই নির্ভরশীলতাই তার দুর্বলতা—কারণ যা অন্যের দ্বারা প্রমাণিত হতে হয়, তা কখনো চূড়ান্ত বাস্তব হতে পারে না।
দার্শনিক তুলনা:
আত্মা: স্বতঃসিদ্ধ, স্বপ্রমাণিত, জ্ঞানের মূল উৎস—সর্বোচ্চ স্তরের সত্তা।
জগৎ: বাহ্যিক প্রমাণের উপর নির্ভরশীল, সীমাবদ্ধ—নিম্নস্তরের সত্তা।
আলো-অন্ধকার দৃষ্টান্ত: যেমন অন্ধকারে বস্তু দেখতে টর্চের দরকার হয়, কিন্তু সূর্যের আলোকে দেখতে আরেকটি আলো লাগে না। সূর্যের মতোই আত্মা—নিজেকে ও অন্যকে প্রকাশ করে। অন্যদিকে, বস্তু বা জগৎ—অন্ধকারে দেখা যায় না, তাই সবসময় বাইরের প্রমাণ দরকার। এই বিশ্লেষণ দেখায়: চূড়ান্ত সত্য হতে হলে সত্তাকে স্বয়ং-প্রভ হতে হবে। তাই আত্মা ব্রহ্মের কাছাকাছি, আর জগৎ সবসময় নিচু স্তরে।
এবার অদ্বৈতের “আত্মা স্বয়ং-প্রভ” (আত্মা নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে) ধারণা আর যোগাচার বৌদ্ধের “বিজ্ঞানমাত্র” (চেতনা-প্রধানতা) মতকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তুলনা করি।
অদ্বৈতের দৃষ্টিভঙ্গি—আত্মা স্বয়ং-প্রভ: অদ্বৈত বেদান্তে আত্মাকে ধরা হয় চিরন্তন জ্যোতির্ময় চেতনা হিসেবে। এই আত্মা নিজের অস্তিত্ব জানাতে কোনো প্রমাণের উপর নির্ভর করে না। এটিকে বলা হয় স্বপ্রকাশ (Svaprakāśa)। সমস্ত অভিজ্ঞতা—স্মৃতি, জ্ঞান, সন্দেহ, এমনকি অজ্ঞতাও—আত্মার আলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাই জগৎ নির্ভরশীল, কিন্তু আত্মা নিরপেক্ষ ও স্বতঃসিদ্ধ। যেমন সূর্য নিজের আলোয় জ্বলজ্বল করে, আর সেই আলোয় বাকি জগৎ দেখা যায়।
যোগাচারের দৃষ্টিভঙ্গি—বিজ্ঞানমাত্র (Consciousness-only): যোগাচার বৌদ্ধ দর্শন বলে—স্বতন্ত্র আত্মা বলে কিছু নেই, কেবল চেতনাপ্রবাহই আছে। সমস্ত অভিজ্ঞতাই বিজ্ঞানধারা (চেতনার ধারাবাহিকতা)। বস্তু বা জগৎ আলাদা কোনো সত্তা নয়; তা কেবল চেতনারই প্রতিচ্ছবি। তারা “আলয়বিজ্ঞান” (storehouse consciousness)-এর ধারণা দেন, যেখানে অতীত অভিজ্ঞতা ও সম্ভাবনা সঞ্চিত থাকে এবং ভবিষ্যতের চেতনা হিসেবে প্রকাশিত হয়। সুতরাং আত্মা নামের কোনো স্থায়ী স্বত্তা নেই; আছে কেবল ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানপ্রবাহ। যেমন নদীর জল যেমন প্রতিনিয়ত বয়ে চলে, তেমনি চেতনা একটানা পরিবর্তনশীল।
মূল পার্থক্য ও সাদৃশ্য: অদ্বৈত—চেতনার পেছনে একটি স্থায়ী, স্বয়ং-প্রভ আত্মা আছে; সেটিই ব্রহ্মের প্রতিরূপ। যোগাচার—কোনো স্থায়ী আত্মা নেই; কেবল বিজ্ঞানধারা আছে; সব কিছুই চেতনার নির্মাণ। সাদৃশ্য—দু-জনেই বাহ্যিক জগৎকে স্বতন্ত্র ও স্থায়ী বাস্তবতা মানে না। পার্থক্য—অদ্বৈত আত্মাকে পরম সত্য ধরে রাখে; যোগাচার আত্মাকেও অস্বীকার করে, শুধু চেতনার প্রবাহ রাখে। অদ্বৈতের কাছে আত্মা হলো প্রদীপ—নিজে জ্বলে, অন্যকেও আলোকিত করে। যোগাচারের কাছে চেতনা হলো স্বপ্ন—নিজেই সব কিছু তৈরি করে, কিন্তু কোনো স্থায়ী সত্তা নেই।
আমরা যদি বাস্তবতাকে দার্শনিক যাত্রাপথ হিসেবে ধাপে ধাপে সাজাই—যেন চিন্তার ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে ক্রমশ গভীরতর স্তরে পৌঁছানো যায়, তাহলে কেমন হয়?
ধাপ ১: সাধারণ বাস্তবতা (Naïve Realism): দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা জগতকে স্বাভাবিকভাবে সত্য মনে করি। টেবিল, চেয়ার, গাছ, নদী—সবই বাস্তব বলে ধরা হয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে না, “এগুলো সত্যিই আছে কি না?”
ধাপ ২: অদ্বৈতের মিথ্যাত্ব: অদ্বৈত প্রশ্ন তোলে—যা পরিবর্তনশীল, তা কি চূড়ান্ত সত্য হতে পারে? উত্তর আসে—না। তাই জগৎ মিথ্যা (mithyā)—দেখতে সত্যি, কিন্তু চূড়ান্ত নয়। একমাত্র সত্য: ব্রহ্ম, আত্মা—যা স্বয়ং-প্রভ। দৃষ্টান্ত: স্বপ্ন—ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বাস্তব মনে হয়, কিন্তু জাগরণের পরে বোঝা যায়, মিথ্যা।
ধাপ ৩: যোগাচারের বিজ্ঞানমাত্র: যোগাচার এক ধাপ এগিয়ে বলে, বাহিরে কোনো বস্তুই নেই। যা-কিছু দেখি, সবই চেতনার প্রক্ষেপণ। দৃষ্টান্ত: আবারও স্বপ্ন—কিন্তু এবার জোর দেওয়া হয়: স্বপ্নে যে গাছ, নদী, রথ দেখি—সবই মনের বানানো। তাই, বাহ্যিক বাস্তবতা নেই, আছে শুধু চেতনার প্রবাহ (vijñāna-santāna)।