সৃষ্টি-বিষয়ক বেদবাক্যে আসলে ভেদ (ব্রহ্ম-কারণ ও জগৎ-কার্যের মধ্যে ভিন্নতা) প্রকাশ পায় না। এর কারণ হলো, সেই বাক্যগুলিতে "ভেদ" অর্থবাহী কোনো শব্দ নেই। যে-কোনো বাক্য কেবল সেই অর্থই প্রকাশ করতে পারে, যা তার শব্দগুলো বহন করে—হোক তা শব্দগুলোর পারস্পরিক ব্যাকরণিক সম্পর্কের মাধ্যমে, অথবা কর্তা-কর্ম-বিধেয়ের অভিন্নতা বোঝানোর মাধ্যমে। যদি "ব্রহ্ম থেকে জগতের উৎপত্তি" বাক্যটি ভেদের অর্থ বহন করত, তবে এর শব্দগত বা ব্যাকরণগত কোনো ইঙ্গিত থাকত। যেহেতু এমন কোনো ইঙ্গিত নেই, তাই এই বাক্যটি দ্বারা ভেদ প্রমাণ করা যায় না।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে কর্তা-কর্ম-বিধেয়
১. অদ্বৈত বেদান্তের মূল অবস্থান: চূড়ান্ত সত্যে (পারামার্থিক স্তরে) আত্মা/ব্রহ্ম একমাত্র সত্তা। এই আত্মা নির্বিকার, অকার্য, অদ্বিতীয়, কেবল সাক্ষী (sākṣī)। সুতরাং আসল কর্তা, কর্ম, বিধেয়—কিছুই নেই; এগুলো সবই অবিদ্যা/মায়ার কারণে দেখা যায়।
২. ব্যাবহারিক স্তর (vyāvahārika satya): মায়ার আচ্ছাদনে জগতে আমরা তিনটি বিভাজন দেখি—
কর্তা (Subject / doer): যে নিজেকে মনে করে, “আমি কাজ করছি।” অদ্বৈতে বলা হয়: কর্তা আসলে উপাধি-যুক্ত জীব (শরীর-মন-অহংকারের সঙ্গে আত্মার মিশ্র প্রতীতি)।
কর্ম (Object / deed): যে-বস্তুর উপর কাজ ঘটে। জগতে সমস্ত কর্ম-প্রকৃতি আসলে মায়া-প্রকাশিত; ব্রহ্মের চূড়ান্ত স্বরূপে কোনো কর্ম নেই।
বিধেয় (Predicate / action or attribute): যে সম্পর্ক বা ক্রিয়া দ্বারা কর্তা-কর্ম সংযুক্ত। উদাহরণ: “আমি বই পড়ছি।” এখানে পড়া হচ্ছে বিধেয়। অদ্বৈত বলে: আত্মা নিজে কিছু “পড়ে” না; পড়া হচ্ছে অহংকার-সংযুক্ত অন্তঃকরণের ক্রিয়া।
৩. অদ্বৈতের বিশ্লেষণ: আত্মা কখনও কর্তা নয়, সে শুধু সাক্ষী (দ্রষ্টা)। কর্তার ভূমিকা আসছে অবিদ্যা-জনিত অহংকার থেকে। কর্ম ও বিধেয় আসছে উপাধির (দেহ-মন-ইন্দ্রিয়) কার্যকলাপ থেকে। মুক্তির জ্ঞান হলে বোঝা যায়: কর্তা = অবিদ্যা-সৃষ্ট ভ্রান্ত ধারণা, কর্ম = মায়া-সৃষ্ট জগৎ, বিধেয় = ভ্রান্ত কার্য-কারণ সম্পর্ক।
স্বপ্নে আপনি নিজেকে কর্তা ভেবে কাজ করছেন—স্বপ্নের ভেতরে কর্তা, কর্ম, বিধেয় তিনটিই সত্য মনে হয়। কিন্তু ঘুম ভাঙলে বোঝা যায়—কোনো বাস্তব কর্তা বা কর্ম ছিল না, কেবল চেতনার প্রতীতি। ঠিক তেমনি, অদ্বৈতে জাগতিক কর্তা-কর্ম-বিধেয় আসলে অবিদ্যা-সৃষ্ট ভ্রান্ত প্রতীতি; আত্মা কেবল সাক্ষী। জগৎ যেন এক স্বপ্ন। অদ্বৈত বেদান্তে—আত্মা কর্তা নয়, কেবল সাক্ষী। কর্তা, কর্ম, বিধেয় → সবই অবিদ্যা-মায়ার স্তরে সত্য, ব্রহ্ম-জ্ঞানে মিথ্যা।
অতএব, সৃষ্টি-বিষয়ক বাক্য থেকে কেবল অনুমান করে বলা যায় না যে, জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন। কারণ, এমন অনুমান হবে নিষেধ-বাক্যের পরিপন্থী (যেমন "নেতি নেতি"—"এ নয়, ও নয়")। বেদান্ত দর্শনে শ্রুতি (বেদ) প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে শ্রেষ্ঠ, এবং মানবীয় অনুমান সবসময়ই শ্রুতির প্রত্যক্ষ বচনের কাছে গৌণ। যখন শ্রুতি সরাসরি অভেদ ঘোষণা করে, তখন সৃষ্টিবাক্য থেকে যে আপাত ভেদের ধারণা হয়, তা শ্রুতির মূল শিক্ষাকে অতিক্রম করতে পারে না। বাক্যগুলি দ্বৈততার পক্ষে প্রমাণ নয়, বরং ব্রহ্মকে জগতের একমাত্র কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এবং অন্যান্য ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদকে খণ্ডন করার একটি উপায়। এই বাক্যগুলি চূড়ান্তভাবে অদ্বৈত জ্ঞানকেই সমর্থন করে, যেখানে ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য এবং জগৎ তার একটি আপাতপ্রকাশ মাত্র। বেদের সমগ্র শিক্ষাই অভেদ জ্ঞানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, এবং এই মূল শিক্ষাকে বজায় রাখার জন্য সৃষ্টিবাক্যগুলির সঠিক ব্যাখ্যা অপরিহার্য।
আর যদি বলা হয়—“জ্ঞানে বস্তু প্রয়োজন, এবং জ্ঞান কোনো ভিন্ন অবলম্বন ছাড়া সম্ভব নয়; অতএব জ্ঞাত বস্তু অবশ্যই জ্ঞান থেকে ভিন্ন”—তাহলে উত্তর হবে, এটা কেবল ভিন্নতার ধারণা মাত্র। আসলে, সমস্ত কিছুই ব্রহ্ম-স্বরূপ চৈতন্যে অবস্থিত। বস্তু-জ্ঞান-ভিন্নতার দাবি তাই স্থায়ী বা চূড়ান্ত সত্য নয়। বেদ যখন “সৃষ্টি” নিয়ে কথা বলে, তখন তার উদ্দেশ্য জগতকে ব্রহ্ম থেকে আলাদা করে দেখানো নয়; বরং অন্য মিথ্যা কারণতত্ত্বকে খণ্ডন করে বোঝানো—ব্রহ্মই একমাত্র কারণ, একমাত্র সত্য, দ্বিতীয় কিছু নেই।
একটি বাক্য (vākya) দুইভাবে অর্থ প্রকাশ করে—বিধেয়মূলক (predicative): শব্দগুলির অর্থের মধ্যে কোনো সম্পর্ক (saṃsarga) প্রকাশ করে। অভেদমূলক: শব্দগুলির দ্বারা বোঝানো বস্তুর অভিন্নতাই প্রকাশ করে, যেমন—“তৎ ত্বম্ অসি” (“তুমিই সেই”)।
জ্ঞান ও বস্তু সম্পর্কিত আপত্তি: “জ্ঞান কোনোদিনই বস্তুহীন হয় না।” কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতায় সব জ্ঞানই কোনো বস্তুকে নিয়ে ঘটে। যদি বস্তু না থাকে, তবে কেবল অনির্ণায়ক জ্ঞান (indeterminate cognition) হতে পারে—কারণ নির্ণয়ের জন্য বস্তু প্রয়োজন।
এর উত্তর: এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, বস্তু ছাড়া জ্ঞানের উৎপত্তি, স্থায়িত্ব বা গৌণ জ্ঞান হওয়া—কোনোটিই অসম্ভব নয়।
১. উৎপত্তি প্রসঙ্গে: যদি বলেন, বস্তু ছাড়া জ্ঞানের উৎপত্তিই অসম্ভব—এটা ঠিক নয়। কেননা জ্ঞান (আসলে ব্রহ্ম) তার প্রকৃত স্বরূপে কোনো উৎপন্ন জিনিস নয়। আর যদি ধরে নিই, জ্ঞান উৎপন্ন, তাহলেও বস্তু অপরিহার্য নয়। কারণ জ্ঞান (সত্য বা মিথ্যা যাই হোক) হতে পারে প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি প্রমাণ দ্বারা, কিংবা মিথ্যা প্রমাণ (counterfeit) দ্বারা। কোথাও বলা হয়নি যে, প্রতিটি জ্ঞানই বস্তু দ্বারা তৈরি হতে হবে। যেমন অনুমানে বস্তু প্রত্যক্ষ না হয়েও জ্ঞান ঘটে।
২. স্থায়িত্ব প্রসঙ্গে: বলা যাবে না যে, বস্তু ছাড়া জ্ঞান টিকে থাকতে পারে না। কারণ বস্তু জ্ঞানের আশ্রয় নয়। যদি বলেন, বস্তুই জ্ঞানের আশ্রয়, তবে বস্তু আর “বস্তু” থাকে না, বরং “জ্ঞাতা” হয়ে যায়।
৩. গৌণ জ্ঞান প্রসঙ্গে: যদি বলেন, বস্তু ছাড়া গৌণ জ্ঞান অসম্ভব—কারণ দ্বিতীয় জ্ঞান তো প্রথম জ্ঞানকে জানে বস্তু ধরে; তবে এটাও ঠিক নয়। কারণ জ্ঞান আত্মপ্রকাশমান (self-presentative)। নিজেকে জানাতে অন্য কিছুর দরকার পড়ে না। যদি বলেন, জ্ঞান আত্মপ্রকাশমান নয়, তবে আবার দ্বিতীয় জ্ঞান চাই, দ্বিতীয়ের জন্য তৃতীয় চাই, এভাবে অসীম প্রত্যাবর্তন ঘটবে। এর মানে, জ্ঞান একেবারেই অপ্রমাণিত থেকে যাবে, আর জগত হবে একেবারে অন্ধকার—কিছুই জানা সম্ভব হবে না।
যদি বলেন—“অজ্ঞাত কোনো জ্ঞানই বস্তুকে প্রমাণ করে।” তাহলে সেই অজ্ঞাত জ্ঞানটাই হবে এক মায়া—যেমন মানুষের শিং। কারণ তার অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোনো উপায়ই নেই (কারণ, সেটি আপনি নিজেই স্বীকার করছেন অজ্ঞাত)।
বস্তু কেন দরকার? যদি মেনে নেন—“জ্ঞানকে জানাতে দ্বিতীয় জ্ঞান দরকার,” তবে কেন বস্তু দরকার? শুধু বস্তুর জ্ঞানই যথেষ্ট। আপত্তি ওঠে: “না, বস্তু ছাড়া সাধারণ জ্ঞান নয়, বরং নির্ণায়ক জ্ঞান দরকার—যেখানে বস্তু দ্বারা জ্ঞান নির্ধারিত হয়।”
খণ্ডন: এই আপত্তিও অমূলক এবং জ্ঞানের স্ব-নির্ণায়ক প্রকৃতির গভীর উপলব্ধির অভাব থেকে উদ্ভূত। অন্যান্য দার্শনিক ব্যবস্থায় যেমন “জাতি” (jāti), “গুণ” (guṇa), “কর্ম” (karma) ইত্যাদি বিভাগকে স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃত ও স্ব-প্রকাশিত হিসাবে বিবেচনা করা হয়, ঠিক তেমনই অদ্বৈত দর্শনে জ্ঞানকেও স্ব-নির্ণায়ক (self-differenced) সত্তা হিসাবে দেখা হয়। এর অর্থ হলো, জ্ঞানের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি অনুধাবন করার জন্য অন্য কোনো কিছুর মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয় না; জ্ঞান নিজেই নিজের প্রকাশক।
“জাতি” (jāti), “গুণ” (guṇa), “কর্ম” (karma) ইত্যাদি হচ্ছে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের পদার্থতত্ত্ব–এর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।
১. জাতি (Jāti)—সাধারণত্ব বা Universal—বহু ব্যক্তিতে যে সাধারণ সাদৃশ্য বা অভিন্ন রূপ থাকে, সেটাই জাতি। জাতি হলো এক প্রকার অভিন্ন ধর্ম, যার দ্বারা বহু বস্তু এক জাতিভুক্ত হয়। উদাহরণ: “ঘোড়া”, “হাতি”, “গরু”—সবই আলাদা, কিন্তু এদের মধ্যে একটি সাধারণত্ব আছে—“পশু”। এই “পশু” ভাবটাই জাতি। তেমনি সব ঘড়া, সব টেবিলের মধ্যে “ঘড়াত্ব”, “টেবিলত্ব”—এগুলোই জাতি।
২. গুণ বা Quality (Guṇa)—যে-বৈশিষ্ট্য পদার্থে থাকে, কিন্তু নিজে আলাদা করে কাজ (ক্রিয়া) করে না। গুণ পদার্থকে চেনাতে সাহায্য করে। উদাহরণ: রং, রূপ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ। জ্ঞান, সুখ-দুঃখ, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদিও গুণ হিসেবে গণ্য। যেমন: “ঘড়াটি সাদা,” “জল ঠান্ডা”—এখানে সাদা রং ও ঠান্ডাভাব হলো গুণ।
৩. কর্ম (Karma)—ক্রিয়া বা Action—পদার্থের গতিশীল অবস্থা, যা পরিবর্তন ঘটায়। কর্ম হলো, যে-কারণে একটি বস্তু স্থান বা অবস্থা পরিবর্তন করে। উদাহরণ: গতি (চলা, দৌড়ানো), উত্থান (উঠা), অবতরণ (নামা), সম্প্রসারণ (ফুলে ওঠা), সঙ্কোচন (সঙ্কুচিত হওয়া)। যেমন: “পাখি উড়ছে,” “মানুষ হাঁটছে”—এই ওড়া, হাঁটা হলো কর্ম।
স্ব-নির্ণায়কতার ধারণাটি অদ্বৈত বেদান্তের একটি মৌলিক ভিত্তি। এটি বোঝায় যে, জ্ঞান কেবল বিষয়বস্তুকে আলোকিত করে না, বরং নিজেও আলোকিত। যেমন একটি প্রদীপ অন্ধকার দূর করে এবং নিজেকেও প্রকাশ করে, তেমনি জ্ঞানও অজ্ঞতাকে দূর করে এবং নিজের অস্তিত্বকে সপ্রমাণিত করে। এই স্ব-প্রকাশিত বা স্ব-সিদ্ধতা জ্ঞানের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য, যা এটিকে অন্যান্য অসৎ বা অনিত্য বস্তু থেকে পৃথক করে।
অতএব, জ্ঞানের স্ব-নির্ণায়কতাকে অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ এটি দর্শনের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রজ্ঞা। এটি কোনো আপেক্ষিক বা নির্ভরশীল ধারণা নয়, বরং পরম সত্তার সাথে জ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে তুলে ধরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, জ্ঞানকে কোনো বাহ্যিক উপায়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা অর্থহীন, কারণ জ্ঞান নিজেই সমস্ত প্রমাণের উৎস ও আশ্রয়। জ্ঞান সর্বদা আত্মপ্রকাশমান। বস্তু তার জন্য অপরিহার্য নয়। বস্তু-নির্ভর জ্ঞানকে সত্য ধরা এক ভুল ধারণা।
প্রতিপক্ষের বক্তব্য: তবুও (প্রতিপক্ষ বলে), জ্ঞানের উপস্থিতি থেকেই আমরা বস্তুর অস্তিত্ব অনুমান করি। কারণ সর্বজন স্বীকৃত নিয়ম হলো—যেখানে জ্ঞান আছে, সেখানে জ্ঞানযোগ্য কোনো বস্তু থাকেই।
অদ্বৈতপক্ষের খণ্ডন: না, এমন কোনো সর্বজনীন নিয়ম প্রমাণ করা যায় না। এই দুইয়ের এক স্থানেই সহাবস্থান নেই—জ্ঞানের অবস্থান মানসে, আর জ্ঞানযোগ্য বস্তু বাইরে; ধোঁয়া ও আগুনের মতো (যা একই স্থানে পাওয়া যায়) এরা তো এক স্থানে থাকে না। এমনকি, এদের সমসাময়িক সহাবস্থানও নেই—কেননা আমরা অতীত বা ভবিষ্যতের জ্ঞানও লাভ করি। অতএব, জ্ঞান আর বস্তু সবসময় একসঙ্গে থাকে—এমন প্রমাণ হয় না। অতএব, এমন প্রমাণ নেই যে, জ্ঞান আর জ্ঞানযোগ্য বস্তু আলাদা।
এই দৃশ্যমান জগৎ—চেতন ও জড় যা-কিছুই হোক—চৈতন্য বা জ্ঞান ব্যতীত আর কিছু নয়। যেমন স্বপ্নে সব কিছুই কেবল জ্ঞান (ব্রহ্ম বা চৈতন্য), কিন্তু নানা রূপে জ্ঞান ও জ্ঞানযোগ্য বস্তু হয়ে প্রকাশিত হয়—তেমনি জাগ্রত অবস্থায়ও এই বিশ্ব—চেতন ও জড় সকলই—আসলে ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছু নয়।
সুতো-কাপড়ের উদাহরণ—কাপড়কে যদি সুতো ছাড়া ভাবা হয়, তবে কাপড় একেবারেই অস্তিত্বহীন। তেমনি এই জগৎও, যার “অস্তিত্ব” কেবল প্রতীতি (esse = percipi—অস্তিত্ব মানেই প্রত্যক্ষ হওয়া—To exist is to be perceived.), আত্মা (ব্রহ্ম, চৈতন্য) ছাড়া শূন্য হয়ে যায়।
দড়ি-সাপের উদাহরণ—যেমন অন্ধকারে দড়িকে ভুল করে সাপ মনে হয়, তেমনি মন বিভ্রান্ত হলে আত্মাকেই এই জগত মনে হয়।
আত্মা-লগ্ন-সৃষ্টি—শুধু আত্মাকেই আশ্রয় করে এই প্রতীতি-নির্ভর জগতের উৎপত্তি, স্থিতি আর লয়—পুনঃপুনঃ ঘটে—এটাই প্রতিফলিত জগত। একমাত্র ব্রহ্ম—যাঁর দ্বিতীয় নেই, যিনি নির্জনান্দ (অন্তর্মুখী হয়ে আত্মানন্দ উপলব্ধি করা), নির্মল, পাপ ও দোষমুক্ত—তাঁর প্রতিফলনরূপেই এই তিন জগত (যার অস্তিত্ব কেবল প্রতীতি) প্রকাশিত হয়।
এখানে অদ্বৈত অবস্থান হলো—জগৎ আলাদা কোনো বাস্তবতা নয়। জগৎ মানে কেবল জ্ঞানের (চৈতন্যের) প্রতীতি। স্বপ্ন, মরীচিকা, দড়ি-সাপ, কাপড়-সুতো—সব উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, ব্রহ্ম ব্যতীত কোনো স্বাধীন জগৎ নেই।