খণ্ডন: অদ্বৈত দর্শনে অবিদ্যার প্রকৃতি এবং ব্রহ্মের সাথে তার সম্পর্ক একটি গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়। বিবরণ স্কুল একটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি উত্থাপন করে যে, ব্রহ্মই যদি অবিদ্যার আশ্রয় (Locus) এবং বিষয় (Object) হয়, তাহলে এটি ব্রহ্মের শুদ্ধতা ও অদ্বৈত সত্তাকে খণ্ডন করে। এই আপত্তি মূলত ব্যাবহারিক স্তরের দ্বৈতবাদী যুক্তি—যেমন আলো ও অন্ধকারের সহাবস্থান—ব্যবহার করে উত্থাপন করা হয়, যেখানে আলো ও অন্ধকার যেমন একসঙ্গে থাকতে পারে না, তেমনি ব্রহ্ম এবং অবিদ্যাও একসঙ্গে থাকতে পারে না।
তবে অদ্বৈতের উত্তর এই আপত্তিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে। অদ্বৈতবাদীরা বলেন, অবিদ্যা কোনো বস্তুজাত অন্ধকার নয়। এটি ‘অনির্বচনীয়’ (inexplicable), অর্থাৎ একে সৎ বা অসৎ কোনোটিই বলা যায় না। অবিদ্যা মূলত অজ্ঞানতা, যা জ্ঞান দ্বারা দূর হয়। এটি কোনো বস্তু বা সত্তা নয়, যা ব্রহ্মের সঙ্গে দ্বৈত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। ব্রহ্ম তার নিজস্ব শক্তি, যা ‘মায়া’ নামে পরিচিত, তা দ্বারাই নিজেকে আচ্ছাদিত করে রাখে। এই আচ্ছাদন কোনো প্রকৃত আবরণ নয়, বরং অজ্ঞানতার একটি অবস্থা, যা ব্রহ্মের পারমার্থিক সত্যকে প্রভাবিত করে না। যেমন, মেঘ সূর্যকে ঢেকে রাখলেও সূর্যের অস্তিত্ব বা ঔজ্জ্বল্য তাতে পরিবর্তিত হয় না, তেমনি অবিদ্যাও ব্রহ্মের স্বরূপে কোনো বিকার ঘটায় না।
এই ব্যাখ্যা অনুসারে, ব্যাবহারিক স্তরের এই আপাত অসামঞ্জস্য—যে-ব্রহ্মকে অবিদ্যার আশ্রয় বলা হচ্ছে—তা পারমার্থিক সত্যের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। যখন বলা হয়, ব্রহ্ম অবিদ্যার আশ্রয়, তখন এর অর্থ এই নয় যে, অবিদ্যা ব্রহ্মের মধ্যে অবস্থান করে বা ব্রহ্মের গুণ। বরং এর দ্বারা বোঝানো হয় যে, ব্রহ্মই অবিদ্যার অধিষ্ঠান বা ভিত্তি (substratum)। অবিদ্যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি প্রতীতি মাত্র, যা জ্ঞান দ্বারা অপসারিত হয়। এই অবস্থান অদ্বৈতকে বার্কলের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাববাদ (subjective idealism) থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে। বার্কলের দর্শনে জগতের ধারাবাহিকতা ব্যক্তির চেতনার উপর নির্ভরশীল, যা ব্যক্তির বিলুপ্তির সাথে সাথে জগতের অস্তিত্বকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে। কিন্তু অদ্বৈত দর্শনে জগতের ধারাবাহিকতা ঈশ্বরের (Īśvara) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘মূল-অবিদ্যা’ দ্বারা নিশ্চিত হয়। এখানে ঈশ্বর হলেন অবিদ্যার আশ্রয়, এবং তিনি এই জগতের ধারক ও নিয়ন্ত্রক। ঈশ্বর হলেন সগুণ ব্রহ্ম, যিনি সৃষ্টির, স্থিতির ও প্রলয়ের কর্তা। তিনি অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হন না, বরং অবিদ্যা তাঁরই শক্তি। এই মূল-অবিদ্যাই সমস্ত জীবের ব্যক্তিগত অবিদ্যার মূল উৎস।
সুতরাং, অদ্বৈত দর্শনে অবিদ্যা ব্রহ্মের সত্তাকে খণ্ডন করে না, বরং এটি একটি শক্তির প্রকাশ, যা ব্রহ্মের মহিমাকে আরও উদ্ভাসিত করে। অজ্ঞানতা যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ জগৎ ও তার বৈচিত্র্য সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ হলে এই অবিদ্যা দূর হয় এবং একমাত্র ব্রহ্মই পারমার্থিক সত্য হিসেবে প্রতিভাত হন।
৩। স্বরূপের অনুপপত্তি (Nature Problem: Svarūpa Anupapatti): অবিদ্যার প্রকৃতি নিয়ে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে এক গভীর ও মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। "অবিদ্যা" বলতে এখানে কী বোঝানো হচ্ছে এবং এর প্রকৃত স্বরূপ কী? এই প্রশ্নটি দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে, কারণ অবিদ্যার স্বরূপ নির্ধারণের উপরই অদ্বৈতবাদের ভিত্তি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই আপত্তিকে দুটি প্রধান ভাগে বিশ্লেষণ করা যায়:
অবিদ্যা যদি সৎ (বাস্তব) হয়: যদি অবিদ্যাকে ব্রহ্মের মতোই বাস্তব বা পরম অস্তিত্বশীল বলে স্বীকার করা হয়, তবে তা অদ্বৈতবাদের মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। অদ্বৈতবাদ অনুযায়ী, ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য এবং অন্য কোনো কিছুরই স্বতন্ত্র পরম অস্তিত্ব নেই। যদি অবিদ্যা সৎ হয়, তবে ব্রহ্ম ব্যতীত আরেকটি পরম সত্তার স্বীকৃতি ঘটে, যা অদ্বৈতবাদের "একমেবাদ্বিতীয়ম" (এক এবং দ্বিতীয়হীন) নীতির পরিপন্থী। এক্ষেত্রে, ব্রহ্ম ও অবিদ্যার মধ্যে দ্বৈততা বা ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়, যা অদ্বৈতবাদের মূল প্রতিপাদ্যকে ভেঙে দেয়। এই মতবাদ, তখন অদ্বৈত না থেকে দ্বৈত বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
অবিদ্যা যদি অসৎ (অবাস্তব) হয়: অন্যদিকে, যদি অবিদ্যাকে সম্পূর্ণ অসৎ বা অবাস্তব বলে গণ্য করা হয় (যেমন "বন্ধ্যার পুত্র" বা "আকাশকুসুম"), তবে আরও একটি সমস্যা দেখা দেয়। যে-জিনিসটি একেবারেই অসৎ, তার কোনো প্রকার অনুভব বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্ভব নয়। বন্ধ্যার পুত্র যেমন বাস্তবে নেই, তেমনি তার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতাও হতে পারে না। কিন্তু আমরা জগতের অস্তিত্ব অনুভব করি, জাগতিক দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা লাভ করি। অবিদ্যা যদি সম্পূর্ণ অসৎ হতো, তবে জগৎ এবং জগতের সকল অভিজ্ঞতাই অসৎ হয়ে যেত এবং আমাদের এই জাগতিক অনুভব সম্ভব হতো না। এই যুক্তি অবিদ্যার কার্যকারিতা এবং এর দ্বারা সৃষ্ট জগতের অভিজ্ঞতামূলক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।
এই উভয় ক্ষেত্রেই, অবিদ্যার "অন্টোলজিক্যাল স্ট্যাটাস" বা অস্তিত্বগত অবস্থান নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তৈরি হয়। অদ্বৈত বেদান্ত এই আপত্তির সমাধানের জন্য অবিদ্যার এক বিশেষ স্বরূপ বর্ণনা করে, যেখানে অবিদ্যাকে "সদসৎ-বিলক্ষণ" বা "অনির্বচনীয়" বলা হয়। এর অর্থ হলো, অবিদ্যাকে সম্পূর্ণরূপে সৎ বা সম্পূর্ণরূপে অসৎ কোনোটিই বলা যায় না। এটি ব্রহ্মের পরম সত্তার মতো বাস্তব নয়, আবার বন্ধ্যার পুত্রের মতো অবাস্তবও নয়। অবিদ্যা হলো এমন এক শক্তি, যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত হয়ে জগৎকে প্রতিভাত করে, যতক্ষণ না আত্মজ্ঞান দ্বারা এর নিবৃত্তি ঘটে। এই "অনির্বচনীয়তা" অদ্বৈত বেদান্তের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা অবিদ্যার স্বরূপের অনুপপত্তিকে মীমাংসা করার চেষ্টা করে।
খণ্ডন: অদ্বৈতের মূল উত্তর হলো—অবিদ্যা অনির্বচনীয়। এটি এমন একটি তৃতীয় অবস্থা—মিথ্যাত্ব—যা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয় (তাই অসৎ নয়), কিন্তু জ্ঞান দ্বারা বিনাশযোগ্য (তাই সৎ নয়)। এটি সৎ বা অসৎ কোনোটির মধ্যে পড়ে না, বরং উভয় থেকেই ভিন্ন। এই অবস্থানটি ‘দড়িতে সাপ’-এর দৃষ্টান্ত দ্বারা সমর্থিত হয়—সাপ অনুভূত হলেও তা তার অধিষ্ঠান (দড়ি) থেকে ভিন্ন বা সৎ নয়, এবং জ্ঞান হলে তা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। সাপের মতো, অবিদ্যাও একটি ভ্রম, যা জ্ঞান দ্বারা অপসারিত হয় কিন্তু তার পূর্বে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়।
৪। কারণ ও নিবৃত্তির অনুপপত্তি: অবিদ্যা অনাদি (beginningless) হলে তার কারণ কী? এবং যা অনাদি, তার বিনাশ (termination) কীভাবে সম্ভব? যদি কোনো কিছুর শুরু না থাকে, তাহলে তার শেষ হওয়া কীভাবে সম্ভব?
খণ্ডন: অদ্বৈত উত্তর দেয়, কারণ-কার্য সম্পর্ক কেবল ব্যাবহারিক স্তরে প্রযোজ্য। অনাদি মানে কেবল যার উৎপত্তি জানা যায় না, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তা বিনাশযোগ্য নয়। আত্ম-জ্ঞান বা বিদ্যা দ্বারা অনাদি ভাবরূপ অজ্ঞান অবশ্যই বিনষ্ট হয়। বিদ্যার উদয় হলে অজ্ঞানতার বিনাশ হয়, যেমন আলোকের আবির্ভাবে অন্ধকার দূর হয়। এই বিনাশের প্রক্রিয়াটি কেবল অজ্ঞানকে তার স্বভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায় না, বরং ফল দিয়ে প্রমাণ করে। অজ্ঞানতা যদি অনাদি হয়, তবুও তার বিনাশ সম্ভব, কারণ এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়, জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হয়।
৫। জ্ঞানের অনুপপত্তি (Knowledge Problem): অজ্ঞানতার মধ্যে ডুবে-থাকা জীব কীভাবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবে? বিশ্বের মিথ্যাত্ব জানলে ব্রহ্মের জ্ঞান হবে কেন? যদি জীব অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে, তবে সেই আবরণ ভেদ করে জ্ঞান লাভ করা কীভাবে সম্ভব?
আপত্তির খণ্ডন: অদ্বৈত দাবি করে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য বিশ্বের মিথ্যা জ্ঞান জরুরি নয়; বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপকে (আত্মন) জানা জরুরি। ব্রহ্মজ্ঞান বিশ্বের মিথ্যাত্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেয় না; বরং অজ্ঞানকে ধ্বংস করে আত্মনের স্বরূপ উন্মোচন করে। বিশ্বের মিথ্যাত্ব জানাটা হলো ব্রহ্মজ্ঞান লাভের ফল, কারণ ব্রহ্মের জ্ঞান হলে অন্যান্য কিছুর অস্তিত্বের প্রশ্নই আসে না। এই প্রক্রিয়াটি একটি নতুন কিছু অর্জন (Acquisition) নয়, বরং যা চিরকালই বিদ্যমান, তার উপলব্ধি; অর্থাৎ, আত্মজ্ঞান হলো আত্মাকে নতুন করে জানা নয়, বরং বিদ্যমান সত্যকে উপলব্ধি করা এবং অজ্ঞানতার আবরণকে সরিয়ে দেওয়া।
অনুপপত্তি (anupapatti) শব্দটি মূলত ভারতীয় দর্শনে ব্যবহৃত একটি যুক্তিগত ধারণা। এর আক্ষরিক অর্থ হলো—“যার উপপত্তি (যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা/প্রমাণ) সম্ভব নয়”। দর্শনে ‘অনুপপত্তি’ বলতে বোঝানো হয়—কোনো মতবাদ বা বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হওয়া; অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট দাবি বা প্রস্তাবের পক্ষে যখন কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় না, তখন বলা হয় তা অনুপপন্ন বা অনুপপত্তি-দুষ্ট। বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তের খণ্ডন-প্রতিখণ্ডন প্রক্রিয়ায় ‘অনুপপত্তি’ শব্দটি বার বার ব্যবহৃত হয়। প্রতিপক্ষের বক্তব্য যদি যুক্তিগতভাবে ব্যাখ্যা করা না যায় বা তা আত্মবিরোধী হয়ে পড়ে, তবে বলা হয়—“এই মত অনুপপত্তিতে পতিত।”
যদি কেউ বলে—“আগুন ঠান্ডা”, তবে এর কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা বা অভিজ্ঞতাসিদ্ধ প্রমাণ নেই। তাই এই দাবি অনুপপত্তি। অদ্বৈত দর্শনে বলা হয়—অবিদ্যা থেকে জগতের উৎপত্তি। যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, “অবিদ্যা তো জড়, সে কীভাবে সৃষ্টি করতে পারে?”—তখন এর জবাবে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে না পারলে, ওই আপত্তি অনুপপত্তি হিসাবে গণ্য হবে। সংক্ষেপে, অনুপপত্তি = যুক্তি বা প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা যায় না, এমন অবস্থা/আপত্তি।
অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা-সংক্রান্ত চার প্রকার “অনুপপত্তি” (যেগুলো শঙ্কর-ভাষ্য ও পরবর্তী আচার্যরা আলোচনা করেছেন) বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছি:
১. আশ্রয়-অনুপপত্তি (Āśraya-anupapatti)—প্রশ্ন: অবিদ্যা কোথায় থাকে? তার আশ্রয় (substratum) কে?
যদি বলা হয়, অবিদ্যার আশ্রয় হলো ব্রহ্ম, তবে সমস্যা: ব্রহ্ম তো সর্বজ্ঞ, স্বপ্রকাশমান ও অবিদ্যা-অতীত। তার মধ্যে কীভাবে অবিদ্যা থাকতে পারে? যদি বলা হয়, অবিদ্যার আশ্রয় হলো জীব, তবে সমস্যা: জীব তো নিজেই অবিদ্যা-জনিত। অবিদ্যা থাকলেই জীব ধারণা সম্ভব। তাহলে অবিদ্যা কোথায় ছিল আগে? সুতরাং, অবিদ্যার নির্দিষ্ট আশ্রয় নির্ধারণ করা যায় না—এটাই আশ্রয়-অনুপপত্তি।
২. বিষয়-অনুপপত্তি (Viṣaya-anupapatti)—প্রশ্ন: অবিদ্যা আসলে কী ঢেকে রাখে? এর বিষয় (object) কী?
যদি বলা হয়, অবিদ্যা ব্রহ্মকে আচ্ছন্ন করে, তবে সমস্যা: ব্রহ্ম তো স্বপ্রকাশমান, অবিদ্যা তাকে ঢাকতে পারে না। যদি বলা হয়, অবিদ্যা জীকে ঢেকে রাখে, তবে সমস্যা: জীব তো অবিদ্যার ফলেই প্রকাশিত। ফলে “ঢেকে রাখা” ধারণাটিই অর্থহীন। তাই অবিদ্যার প্রকৃত বিষয় নির্ধারণ করা যায় না—এটাই বিষয়-অনুপপত্তি।
৩. প্রলয়-অনুপপত্তি (Pralaya-anupapatti)—প্রশ্ন: মহাপ্রলয়ে (cosmic dissolution) যখন সবকিছু লীন হয়ে যায়, তখন অবিদ্যা কোথায় থাকে?
যদি বলা হয়, তখন অবিদ্যা থাকে না, তবে সমস্যা: প্রলয়ের পর সৃষ্টিজগত কীভাবে আবার শুরু হলো? যদি বলা হয়, তখনও অবিদ্যা থাকে, তবে সমস্যা: প্রলয়ের সময় তো সকল উপাধি ও বিকার লীন হয়ে গেছে—তাহলে অবিদ্যা কার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রইল? সুতরাং, প্রলয়ে অবিদ্যার অবস্থান যুক্তিগতভাবে নির্ধারণ করা যায় না—এটাই প্রলয়-অনুপপত্তি।
৪. উপযোগী-অনুপপত্তি (Upayogī-anupapatti)—প্রশ্ন: অবিদ্যা যদি থাকে, তবে তা কীভাবে কার্যকর? এর ব্যবহার (utility) কীভাবে বোঝা যায়?
যদি বলা হয়, অবিদ্যা মিথ্যা হলেও কার্যকর, তবে সমস্যা: মিথ্যা কিছুর কার্যক্ষমতা কীভাবে সম্ভব? যদি বলা হয় অবিদ্যা সত্য, তবে সমস্যা: তখন তো ব্রহ্মের অভেদ-সিদ্ধান্ত ভেঙে যাবে। অর্থাৎ, অবিদ্যা কখনও সত্য নয়, আবার মিথ্যা বললেও তার কার্যক্ষমতা অস্বীকার করা যায় না। এই দ্বন্দ্বকেই বলা হয় উপযোগী-অনুপপত্তি।
অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা সংক্রান্ত চার অনুপপত্তি হলো—
আশ্রয়-অনুপপত্তি → অবিদ্যার আশ্রয় নির্ধারণের অসংগতি।
বিষয়-অনুপপত্তি → অবিদ্যার আচ্ছাদনের বিষয় নির্ধারণের অসংগতি।
প্রলয়-অনুপপত্তি → মহাপ্রলয়ে অবিদ্যার অস্তিত্ব নিয়ে অসংগতি।
উপযোগী-অনুপপত্তি → অবিদ্যার কার্যকারিতা বা উপযোগিতা নিয়ে অসংগতি।