বেদ ও ব্রহ্ম: ছয়




এই আলোচনার প্রসঙ্গে আত্মা, যিনি জ্ঞেয় বস্তু, তাঁর ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও অন্য জ্ঞানপ্রমাণের মধ্যে এই ভেদ ধরা যায় না। আত্মাকে নিকটবর্তী কোনো বস্তু হিসেবে দেখা যায় না, আবার দূরবর্তী বস্তু হিসেবেও নয়। এখন, যদি কেউ বলে—শব্দপ্রমাণ কেবল সাধারণ ধর্ম জানায়, আর প্রত্যক্ষ জানায় বিশেষ ধর্ম—তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর মানে দাঁড়ায়, প্রত্যক্ষের যে-বিষয়বস্তু, তা শব্দপ্রমাণ দ্বারা জানা একেবারেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আত্মা সম্পর্কে যদি বলা হয়—শব্দপ্রমাণ শুধু সাধারণ ধর্ম শেখায়, তবে বিশেষ ধর্ম জানার জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দরকার—তাহলে শাস্ত্রের শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ, শাস্ত্র (শ্রুতি) একমাত্র মাধ্যম যা আত্মাকে জানায়। তাই আত্মাকে বোঝার ক্ষেত্রে এই ভেদ ধরা যায় না। এককথায়, আত্মার জ্ঞানে শব্দপ্রমাণই যথেষ্ট, সেখানে প্রত্যক্ষের আলাদা ভূমিকা নেই।

তবে যে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে—ব্রহ্ম শব্দপ্রমাণ থেকে উদিত জ্ঞানের বিষয়বস্তু নয়? অর্থাৎ, শাস্ত্র বা শব্দপ্রমাণ যে-জ্ঞান দেয়, তার সীমা দিয়ে পর্যন্ত ব্রহ্মকে ধরা যায় না। ব্রহ্ম এমন এক সত্তা, যিনি বস্তুর মতো কোনো সাধারণ জ্ঞানপ্রমাণে ধরা দেন না। যদি ব্রহ্মের বিশেষ স্বরূপ শব্দপ্রমাণ দ্বারা জানা না যায়, তবে তার ওপর ধ্যান করা কীভাবে সম্ভব? ধ্যান করতে হলে তো প্রথমে ধ্যানযোগ্য বস্তুকে জানা জরুরি। যদি ব্রহ্মের বিশেষ প্রকৃতি শাস্ত্রেই প্রকাশ না পায়, তবে মানুষ কীসের উপর ধ্যান করবে?

যখন একটি বস্তুর উপর ধ্যান করা হয়, তখন অন্য কোনো বস্তু সরাসরি জানা যায় না। ধ্যান সর্বদা নির্দিষ্ট একটি বস্তুর ওপর হয়। তাই ব্রহ্মের স্বরূপ যদি পরিষ্কারভাবে না জানা যায়, ধ্যানেরও কোনো ভিত্তি থাকবে না। তা ছাড়া, ব্রহ্মের সেই কী স্বরূপ—যার প্রত্যক্ষ উপলব্ধির জন্য যজ্ঞাদি বিধান করা হয়েছে? যজ্ঞাদির বিধান বা injunction তখনই অর্থবহ, যখন ধরে নেওয়া যায়—এগুলো আত্মাকে উপলব্ধ করার উপায়। আত্মা নিজেই ব্রহ্ম, আনন্দস্বরূপ ও দোষমুক্ত—যা শব্দপ্রমাণে বর্ণিত।

যদি মানুষের সর্বোচ্চ কাম্য সেই ব্রহ্ম-স্বভাব আত্মার প্রকৃতি শব্দপ্রমাণ দ্বারা জানা না যায়, অথবা অন্যরকমভাবে জানা যায়, তবে সেই বিধি-বাক্য নিরর্থক হয়ে যায়। যদি শাস্ত্র থেকে আত্মার প্রকৃতি (যা ব্রহ্ম) জানা না যায়, অথবা ভুলভাবে জানা যায়, তবে যজ্ঞাদির বিধানসমূহের উদ্দেশ্যই বৃথা হয়ে যাবে। অতএব, যখন সেই আত্মা—যিনি ব্রহ্মস্বরূপ এবং দোষমুক্ত—শব্দপ্রমাণ দ্বারা স্পষ্টভাবে জানা যায়, এবং যেখানে কোনো সন্দেহ থাকে না, তখন অন্য কোনো উপায়ের প্রয়োজন নেই। শাস্ত্রই আত্মা-ব্রহ্মের স্বরূপ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়। এতে কোনো সন্দেহ থাকলে ধ্যান বা যজ্ঞেরও অর্থ থাকত না। তাই অন্য কোনো মাধ্যম খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। ব্রহ্মকে ধ্যানযোগ্য রূপে চিনিয়ে দেবার কাজ শব্দপ্রমাণই করে দেয়। একবার তা নিশ্চিতভাবে জেনে গেলে যজ্ঞ বা অন্য কোনো বাড়তি উপায় লাগে না।

ধরুন, একটা ঘর অন্ধকার। আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। হঠাৎ আলো জ্বালানো হলো → আপনি ঘরের জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলেন। এখন প্রশ্ন: আলোর পর আবার অন্য কোনো আলো কি লাগবে? উত্তর: না। একবার আলো জ্বলে গেলে জিনিসগুলো দেখা হয়ে যায়। এভাবেই: শব্দপ্রমাণ (শাস্ত্র) হলো সেই আলো। একবার শাস্ত্র আত্মা-ব্রহ্মকে স্পষ্ট করে দিলে, আর আলাদা কোনো উপায় (যজ্ঞ, নতুন জ্ঞানপ্রমাণ) লাগে না। আবার ধরুন, আপনি নিজের মুখ আয়নায় দেখতে চান। আয়নায় মুখ একবার স্পষ্ট দেখা গেলেই কাজ শেষ। আবার অন্য আয়না খুঁজে বের করার দরকার নেই। এভাবেই: আত্মা-ব্রহ্মের প্রকৃতি একবার শাস্ত্র দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেলে, নতুন কোনো উপায় খোঁজা শুধুই অকারণ পরিশ্রম।

ভাবুন, আপনি ঢাকায় বসে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য মানচিত্র দেখছেন। মানচিত্র আপনাকে ঠিক পথ চেনায়। একবার পথ জানা হয়ে গেলে, আরেকটা নতুন মানচিত্র খোঁজার দরকার নেই। এখন কাজ হলো সেই পথেই যাত্রা করা। পথ একবার ভালোভাবে চিনে ফেললে কেউ কি গুগলম্যাপ অন করে রাখে যাত্রাপথে—হোক না সেই অ্যাপ যতই আপডেটেড ভার্সনের? শাস্ত্র (শব্দপ্রমাণ) আপনাকে আত্মা–ব্রহ্মের ঠিক স্বরূপ চেনায়। একবার সেটা বোঝা হয়ে গেলে, আর নতুন কোনো প্রমাণ বা যজ্ঞ খোঁজার দরকার নেই। শাস্ত্রের আলো একবার জ্বলে উঠলে, আত্মা–ব্রহ্মের স্বরূপ পরিষ্কার হয়। তারপর নতুন কোনো আলোক, আয়না বা মানচিত্র খুঁজতে হয় না।

“তত্ত্বমসি” (ছান্দোগ্য, ৬।৮।৭) শুনে ও বুঝে ব্রহ্ম-আত্মার অভেদ জানা গেলেও, পুরোনো সময়ের মতোই ‘বন্ধনের গুণাবলি’ (দুঃখ, ভয়, রাগ-দ্বেষ, কর্তা-ভোক্তা বোধ, অধিকারবোধ ইত্যাদি) অনুভূত হয়। তাই দাবি ওঠে: এই ‘বন্ধন-সুলভ অভিজ্ঞতা’ দূর করতে আরও কোনো উপায় (যেমন অন্য সাধন, রীতিনীতির সহায়তা) দরকার। এই সংশয়ের বিষয়ে সরল ভাষায় বললে: “শাস্ত্র বলেছে ‘তুমি-ই সেই ব্রহ্ম’, কিন্তু আমার জীবনে তো আগের মতোই টানাপোড়েন আছে—তাহলে কি আরও কিছু করা দরকার?”

যে-ব্যক্তি ব্রহ্মকে নিজের আত্মা হিসাবে সত্যিই উপলব্ধি করেছে, অর্থাৎ আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জেনেছে, তার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি-জাত ‘বন্ধনের গুণাবলি’ থাকার কথা নয়। বন্ধন ব্যাপারটা ভুল-জ্ঞান (অধ্যাস/ভ্রান্তি)—“আমি শরীর-মন”—এই পরিচয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। যখন অভেদ-জ্ঞান পাকা হয়—“আমি ব্রহ্ম, এক ও অদ্বিতীয়”—তখন এই ভুল-ভিত্তিক পরিচয়ের জায়গা থাকে না; ফলে ‘বন্ধন-গুণ’ও খসে পড়ে।

শ্রুতি কী প্রমাণ করছেন, দেখা যাক। “ব্রহ্মকে যে জানে, সে ব্রহ্মই হয়ে যায়” (মুণ্ডক উপনিষদ, ৩।২।৯) অর্থ: এখানে ‘হয়ে যায়’ মানে পরিচয়ের ঐক্য প্রকাশ—সে আসলে সবসময়ই ব্রহ্ম ছিল; জ্ঞান শুধু ভুল পরিচয় (অজ্ঞান বা অবিদ্যা) সরিয়েছে। তার ফল: যখন পরিচয় বদলায়—‘আমি দেহ-মন’ থেকে ‘আমি ব্রহ্ম’—তখন দেহ-মন-সংশ্লিষ্ট বন্ধনের গুণ (আসক্তি, ভয়, অহম্‌) আত্মায় আর আরোপিত হয় না।

“যদি মানুষ আত্মাকে এভাবে জানে—‘আমি এই’—তবে কার জন্য, কীসের জন্য সে দেহের সঙ্গে ভোগ করবে?” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪।৪।১২) এর অর্থব্যাখ্যা: “আমি এই”—অর্থাৎ ‘আমি-ই আত্মা/ব্রহ্ম’, আমি কোনো অন্যান্য (দেহ-মন-ইন্দ্রিয়-প্রাণ) নই। যখন এমন অভেদ-দৃষ্টি স্থির হয়, তখন ভোগ-অভোগের চাহিদা (যা সর্বদা ‘অন্য কিছুর জন্য’—নিজেকে অসম্পূর্ণ ভেবে) মিটে যায়। ফলে ‘কার জন্য’ (প্রিয়জন, সম্পদ, মান-অভিমান) ‘কীসের জন্য’ (ইহজন্ম-পারলৌকিক ফল) এই প্রয়োজন-চক্র আর আত্মাকে বেঁধে রাখতে পারে না।

“যিনি দেহরহিত, তাঁকে সুখ-দুঃখ স্পর্শ করে না” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৮।১২।১) ‘দেহরহিত’ মানে কী? এর অর্থ শরীর হারিয়ে ফেলা নয়; বরং, শরীর…আমি—এই ভুল-সাম্যকরণ উঠে যাওয়া। অর্থাৎ জীবন্মুক্তের মতো অবস্থা—দেহ আছে, কার্য-কারণ (প্রারব্ধ) চলছে, কিন্তু ‘আমি’-বোধ দেহে আটকে নেই। এর ফল: সুখ-দুঃখ দেহ-মন স্তরে উঠতে পারে, কিন্তু আত্মা-স্তরে তাদের স্পর্শ নেই—শাস্ত্র এটাই জানায়।

শাস্ত্র অনুযায়ী, মানুষের প্রতিটি কাজ (কর্ম) একটা ফল তৈরি করে। এই কর্মফল সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায় না, বরং সঞ্চিত হয়ে থাকে (সংস্কার বা ছাপ হিসেবে)। সেই কর্মফল পরে জীবনের কোনো সময়, অথবা পরবর্তী জন্মে প্রকাশ পায়। বেদান্তে কর্মফলকে সাধারণত তিন ভাগে বোঝানো হয়: সঞ্চিত কর্ম (Sanchita Karma)—বহুজন্মের জমে-থাকা সব কর্মফল, যা এখনও প্রকাশিত হয়নি। প্রারব্ধ কর্ম (Prarabdha Karma)—সেই অংশ, যা ইতিমধ্যেই ফল দেবার জন্য “পেকে গেছে”। একে বলা হয় এই জন্মের ভাগ্য। দেহ, পরিবার, জন্মস্থান, আয়ু, স্বাস্থ্য, সুখ-দুঃখ—সবই এই প্রারব্ধ কর্মের ফল। আগত বা ক্রিয়মাণ কর্ম (Agami/Kriyamana Karma)—এই জন্মে আমরা যে নতুন কাজ করি, তার ফলে ভবিষ্যতে নতুন ফল জন্ম নেবে। এগুলো ভবিষ্যতে সঞ্চিত কর্মে যুক্ত হয়।

সঞ্চিত কর্ম জ্ঞানপ্রাপ্তির পর পুড়ে যায়—আগুনে তুলো ফেলে দিলে যেমন ছাই হয়ে যায়; কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম জ্ঞানপ্রাপ্তির পরও শেষ হয় না, কারণ এটি ইতিমধ্যেই “চলতে শুরু করেছে”—যেমন ছোড়া তীর আকাশে উড়ে যাচ্ছে, মাঝপথে থামানো যায় না। তাই জ্ঞানী (জীবন্মুক্ত) হলেও তার শরীর, আয়ু, কিছু অভিজ্ঞতা প্রারব্ধের কারণে থাকে; কিন্তু তিনি সেগুলোকে নিজের বলে মনে করেন না—তাই আসলে তিনি অবন্ধন।

ধরুন, একজন কৃষক মাঠে অনেক বীজ বপন করেছে। যেগুলো এখনও মাটিতে আছে (সঞ্চিত), সেগুলো যদি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যায়, আর গাছ হবে না। কিন্তু যেসব চারা ইতিমধ্যেই গজিয়ে গেছে (প্রারব্ধ), সেগুলোর জীবনপ্রবাহ, যতদিন না ফসল হয়, চলতেই থাকবে। আর যেসব বীজ আজকে আবার নতুন করে বপন করা হবে (আগামী), সেগুলো পরের জন্মে ফল দেবে। প্রারব্ধ কর্মের ফল হচ্ছে সেই কর্মফল, যা ইতিমধ্যেই কার্যকারণ সূত্রে ফল দিতে শুরু করেছে, এবং যা এই জন্মে অভিজ্ঞতার আকারে প্রকাশ পায়। জ্ঞানপ্রাপ্তি হলেও দেহের স্থিতি পর্যন্ত এগুলো টিকে থাকে।

অজ্ঞান বা অবিদ্যা (Avidyā / Ignorance) অর্থ: প্রকৃত সত্য (আত্মা-ব্রহ্মের অভেদ) না-জানার অবস্থা। মানুষ নিজের আসল সত্তাকে (চৈতন্য, ব্রহ্ম) না জেনে শরীর, মন, ইন্দ্রিয়—এসবকেই ‘আমি’ বলে ভুল করে। অজ্ঞান কোনো জড় জিনিস নয়; এটি একপ্রকার আবরণ (veil), যা সত্যকে ঢেকে রাখে। উদাহরণ: অন্ধকার রাতে দড়িকে দেখে সাপ মনে হওয়া। আসলে দড়ি আছে, কিন্তু অন্ধকার (অজ্ঞান) দড়িকে ঢেকে দিয়েছে।

অধ্যাস (Adhyāsa / Superimposition) অর্থ: যা আসল নয়, তা ভুল করে আসলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। অজ্ঞান শুধু ঢেকে রাখে না, বরং ভুল কিছু দেখায়। আত্মার উপর দেহ-মনের গুণ চাপিয়ে দিয়ে মানুষ ভাবে—“আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা” ইত্যাদি। উদাহরণ: যখন দড়িকে সাপ মনে করা হয়—দড়ি = আসল সত্য (আত্মা), সাপ = ভুল চাপানো রূপ (অধ্যাস)।

অজ্ঞান + অধ্যাস = বন্ধনের মূল। অজ্ঞান ঢেকে দেয় আত্মার স্বরূপ। অধ্যাস ভুল পরিচয় আরোপ করে দেয়। ফলাফল—মানুষ নিজের প্রকৃত পরিচয় ভুলে গিয়ে শরীর-মনকে “আমি” মনে করে। এখান থেকেই জন্ম নেয় কর্তা-ভোক্তা ভাব, সুখ-দুঃখ, আসক্তি-দ্বেষ, অর্থাৎ সব বন্ধন।

শঙ্করাচার্যের অধ্যাস ভাষ্য (‘ব্রহ্মসূত্র’ ভূমিকায়) বলছে—আত্মার গুণ দেহে চাপানো হয়, যেমন চেতনাকে শরীরের গুণ ধরানো হয়। আবার দেহের গুণ আত্মায় চাপানো হয়, যেমন “আমি মোটা/আমি অসুস্থ/আমি সুখী/আমি দুঃখী” ভাবা। এটিই মিউচুয়াল অধ্যাস (পারস্পরিক ভ্রান্তি), আর এর মূলেই অজ্ঞান কাজ করে। অজ্ঞান = না-জানা → আত্মা-ব্রহ্মের সত্য ঢেকে ফেলা। অধ্যাস = ভুল জানা → শরীর-মনকে ‘আমি’ ভেবে বসা। এই দুই মিলেই মানুষের সংসার-বন্ধন তৈরি করে।

‘বন্ধন-গুণ’ কেন থাকে না—যুক্তির ভাঙনচিত্র থেকে এটি দেখা যাক। বন্ধনের গুণ কী থেকে আসে? → অজ্ঞান + অধ্যাস (‘শরীর’-কে ‘আমি’ ভেবে নেওয়া) অভেদ-জ্ঞান কী করে? → অজ্ঞান-অধ্যাস সরিয়ে নিজ-স্বরূপে স্থিতি আনায়। এর ফলাফল: কর্তা-ভোক্তা বোধ → ক্ষীণ/নিরস্ত। রাগ-দ্বেষ-ভয়-লোভ → অবলুপ্ত/অপ্রাসঙ্গিক। সুখ-দুঃখ আঘাত → কেবল দেহ-মন স্তরে সীমিত; আত্মা-স্তরে অপ্রযোজ্য। তাই, ‘অভেদ-উপলব্ধি’ থাকা সত্ত্বেও আগের মতোই বন্ধন-গুণ থাকে—এ কথা নিজেই প্রমাণ করে যে, তখন সঠিক উপলব্ধি হয়নি বা অস্পষ্টতা/সন্দেহ-দূষণ রয়েছে।

“তত্ত্বমসি” জানার পরও আরও উপায় লাগবে—এই ধারণা কেন ভুল? শাস্ত্রের বক্তব্য এই: ‘তত্ত্বমসি’ সরাসরি পরিচয়বোধ জাগায়—তুমি-ই সেই (ব্রহ্ম)। একে যদি স্পষ্ট, সন্দেহ-বিরোধ-রহিতভাবে জানা যায়, তবে অতিরিক্ত কোনো উপায় (কর্ম/যজ্ঞ/অনুষঙ্গ) দরকার হয় না। কারণ: যা এতদিন বন্ধন-সৃষ্টি করত (ভুল পরিচয়), তা মূল থেকে কেটে যায়। অতএব, ‘বন্ধন-গুণ আছে বলে আরও উপায় লাগবে’—এই দাবি ভ্রান্ত, কেননা সত্য-জ্ঞান থাকলে ওই গুণাবলি থাকে না।

কাদের মধ্যে এখনও বন্ধন-গুণ দেখা যায়? শাস্ত্রীয় ভাষায়, তাদেরই এমন হয়, যাদের জ্ঞান পরোক্ষ (শোনা বা অধীত তথ্য) মাত্র—অপরোক্ষ উপলব্ধি (নিজ-বুদ্ধিতে নিঃসংশয় অভিজ্ঞতা) যাদের হয়নি, কিংবা সন্দেহ/প্রতিবন্ধ (দীর্ঘ অভ্যাস—সংস্কার/বাসনা) যাদের জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করছে। যার মধ্যে আগের মতোই বন্ধন-গুণ আছে, সে অভেদ উপলব্ধ করেনি—অর্থাৎ তার বেলায় ‘জানার’ দাবি খাঁটি হয়নি।