১৯১.
‘আমি’-র মীমাংসা ও তার অতীতের ফিরে যাওয়া পরমের পথে প্রথম ধাপ। আমার গুরু আমাকে শিখিয়েছিলেন—‘আমি’ কী, এবং কেবল সেই ‘আমি’ বোধের উপরই ধ্যান করতে। আমি সেই শিক্ষা নিয়ে শুধুই তা-ই নিয়ে চিন্তা করতাম, আর ধীরে ধীরে তাতে স্থিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার প্রকৃত, প্রাকৃতিক অবস্থা? তা হলো—যেখানে কোনো ‘আমি’-ই নেই।
গুরু আমাদের বলেন, তিনি কীভাবে তাঁর প্রকৃত সত্তা উপলব্ধি করেছিলেন—এবং সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমাদের শিক্ষা দেন। তাঁর বার্তাটি খুব স্পষ্ট: ‘আমি’ বোধকে বোঝো, তাতে স্থিত হও, তারপর তা অতিক্রম করো। এই ‘আমি আছি’ বোধ—নাম-রূপ-পরিচয়হীন একটি নিঃশব্দ উপস্থিতি—এর ভিতরে গভীরভাবে নিমজ্জিত হলে, একসময় তা-ও মুছে যায়।
তখনই তুমি প্রবেশ করো তোমার আদি অবস্থায়—যেটি ‘আমি’-রও পূর্ববর্তী, যেখানে কোনো আত্মপরিচয় নেই, কেবল পরম উপস্থিতি।
অদ্বৈত বেদান্তে ‘আমি’ বোধ-কে বলা হয় সর্বপ্রথম অভ্যুদয়—চেতনাবস্থার দরজা, জগৎবোধের সূচনা। কিন্তু এটি শেষ লক্ষ্য নয়—বরং এটি এক মধ্যবর্তী সেতু, যার মধ্য দিয়ে চলে যেতে হয় মূল অভ্যন্তরে—সেই প্রকৃত সত্তা, যেখানে কোনো ‘আমি’-ও নেই। যিনি এই পথ পাড়ি দিয়েছেন, তিনি বলেন: প্রথম ধাপে ‘আমি’-কে উপলব্ধি করো, তাতে স্থিত হও—তবেই একসময় সেটি নিজেই বিলীন হয়ে যাবে। সেই বিলয়ে, জন্ম হয় আদ্য সত্তার অভিজ্ঞতা—যেখানে নেই কোনো চিন্তা, সত্তা, ধ্যান, অনুভব—কেবল শুদ্ধ পরব্রহ্ম, চিরন্তন নীরবিচার অস্তিত্ব।
গুরুর শিক্ষা: প্রথমে বোঝো ‘আমি আছি’ বোধকে। তারপর ধ্যান করো কেবল সেই বোধে—কোনো নাম বা রূপ ছাড়া। এই স্থিতির মধ্যেই একসময় তা-ও মুছে যায়। তখন তুমি পৌঁছাবে তোমার প্রকৃত অবস্থানে, যা ‘আমি’ বোধের পূর্ববর্তী—যেখানে নেই কোনো আত্মপরিচয়, কেবল পরম অস্তিত্ব।
১৯২.
‘আমি’ উদিত, আর জগৎ রচিত—কিন্তু তুমি চিরকালই ছিলে। এই ‘আমি আছি’ বোধটি যখন উদিত হলো, তখনই একসাথে রচিত হলো এই জগৎ—একটি বিশাল, বিভ্রমপূর্ণ প্রপঞ্চ। এর আগে—তোমার মধ্যে কোনো ‘আমি’ বোধ ছিল না, তবুও তুমি ছিলে। তুমি ছিলে—কিন্তু জানতে না যে তুমি আছ, কারণ তখন এই ‘আমি’ নামক বার্তা আসেনি।
এই ‘আমি’—মাত্র দুটি শব্দ, তবুও দেখো তো, কী বিশাল মায়ার দুনিয়া তৈরি করেছে! এই জগৎ, এই দেহ, এই সম্পর্ক, সময়, ইতিহাস—সব কিছুর সূচনা এই ‘আমি’-র উদয়ে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো—তুমি প্রতিটি মুহূর্তে এই ‘আমি’-কে সত্য ধরে নিচ্ছ, একবারের জন্যও ভাবছ না যে—এই ‘আমি’ এবং এই জগৎ—আসলে কোনোদিনই সত্যভাবে জন্মায়নি! কিন্তু বাস্তব সত্য হলো—তুমি—পরম, চিরন্তন, নিরাকার অস্তিত্ব, ‘আমি’ থাক বা না থাক, তুমি সর্বদা আছ।
‘আমি’ আসায় কেবল জানা গেল—“তুমি আছ”, কিন্তু তুমি ‘আমি’-র আগেও ছিলে, এবং তুমিই তার পটভূমি। অদ্বৈত বেদান্তের মূল শিক্ষা হলো—‘আমি’ বোধ নিজেই একটি মায়া, একটি আত্মঘোষণামূলক বিভ্রম, যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে জানে, তবে বিভ্রান্ত হয়—"আমি এই ব্যক্তি, আমি এই দেহ, আমি এই জীবন"।
‘আমি’-র আগমনের সাথে সাথেই জন্ম হয় জগৎ, সময়, পরিচয়—এবং গঠিত হয় একটি উপলব্ধিভিত্তিক বাস্তবতা, যা প্রকৃতপক্ষে কখনোই সত্য নয়। কিন্তু এই বিভ্রম এতই শক্তিশালী যে, মানুষ সারাজীবন এটিকেই সত্য জেনে যাপন করে। অথচ গূঢ় সত্য হলো—তুমি সবসময়ই ছিলে, তখনও যখন এই ‘আমি’ ছিল না, যখন কোনো চেতনা, কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ‘আমি’-র উদয় শুধু জানিয়ে দিল—"তুমি আছ", কিন্তু এই বোধ তোমার বাস্তবতা নয়।
তুমি সেই চিরন্তন স্বরূপ—যার পটভূমিতে এই ‘আমি’ আসে ও যায়, তুমি পরব্রহ্ম—সাক্ষ্যস্বরূপ, কিন্তু কখনোই প্রকাশিত নও। ‘আমি আছি’ বোধের উদয়েই সৃষ্টি হয়েছে জগৎ-প্রপঞ্চ। তার আগে তুমি ছিলে, কিন্তু জানো না—কারণ ছিল না কোনো ‘আমি’। এই ‘আমি’-ই রচনা করেছে পরিচয়, সময়, দেহ, জগৎ। কিন্তু এই সবই আসলে মায়া—কিছুই সত্যভাবে জন্মায়নি। সত্য হলো—তুমি সর্বদা আছ, তুমি ‘আমি’ নও, তুমি সেই চেতনারও পেছনের পরম, যা ভাষাহীন, অবস্থা-হীন, অবিনশ্বর।
১৯৩.
‘আমি’-র ভ্রান্তি ভুলে ফিরে যাও নিজের অনন্ত অবস্থানে—চিরন্তন অনন্ত অবস্থা সর্বদাই বিরাজমান—আর এই অবস্থাতেই ‘আমি’ বোধ অস্থায়ীভাবে উদিত হয়। এই ‘আমি’ বোধ কিছু সময় থাকে, তারপর একদিন মিলিয়ে যায়—কিন্তু যে-অবস্থায় তুমি এলে, যে অবিনশ্বর অনন্ত স্বরূপ—তা সর্বদাই একইভাবে থাকে, যেমন ছিল, যেমন থাকবে।
এই ‘আমি’ যখন প্রথম আসে, তখন তা শব্দহীন, রূপহীন, পরিচয়হীন—নির্মল এক উপস্থিতি। কিন্তু তারপর আসে conditioning বা সংস্কারপ্রবাহ—তুমি ভাবতে শুরু করো: “আমি এই দেহ”, “আমি এই মন”, “আমি এই পরিচয়।” এইভাবেই তুমি নিজের আসল অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ো, নিজেকে ভুলে, জগতে হারিয়ে যাও। তাই গুরু বলেন—তোমার প্রকৃত অবস্থান যেন কখনও ভুলে না যাও।
তোমার অবস্থান হলো সেই অবিনশ্বর পরম, যার উপর এই ‘আমি’-র ভ্রান্ত আবির্ভাব ঘটে। এখন করতে হবে এই পথচলা বিপরীত দিকে—ফিরে যেতে হবে সেই ‘আমি’-বোধের শব্দহীন স্তরে, যেখানে সে এখনও পরিচয়হীন, মায়াহীন। সেখানে স্থিত হও, গভীরভাবে নিমগ্ন হও। তখনই তুমি বুঝবে—এই ‘আমি’-ও এক ভ্রান্তি, একটি অস্থায়ী উপস্থতি মাত্র।
এই উপলব্ধি ঘটলে, তুমি আবার ফিরে পাবে তোমার আসল স্থান—যা কখনও হারায়নি, শুধু ভুলে গিয়েছিলে—অবিনশ্বর, অনন্ত, অদ্বৈত চেতনার সেই মৌলিক অবস্থা। অদ্বৈত বেদান্তে, ‘আমি’ বোধ হলো প্রথম আত্মঘোষণা, যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে চিনতে শুরু করে। কিন্তু এই বোধ নিজেই প্রকৃত আত্মা নয়, বরং আত্মার উপর উদিত একটি অস্থায়ী অভিব্যক্তি।
এই বোধই জন্ম দেয় দেহ–মন–পরিচয়–জগতের অভিজ্ঞতা—আর এভাবেই শুরু হয় মায়ার খেলা। সাধকের আসল কাজ হলো—এই ‘আমি’-র শব্দহীন পর্যায়ে ফিরে গিয়ে, তার অস্থায়ী প্রকৃতি উপলব্ধি করা। তখনই তুমি পুনরুদ্ধার করো নিজের সত্য অবস্থান—যা কখনও বদলায় না, কখনও জন্মায় না, কখনও মরে না।
এই অবস্থানই পরব্রহ্ম, চেতনার পেছনের মৌলিক নিরাকার উপস্থিতি—যা সব কিছু ঘটতে দেখে, কিন্তু নিজে কিছুরও অংশ নয়। ‘আমি’ বোধ হলো অস্থায়ী; এর আগেও তুমি ছিলে, পরেও থাকবে। এই বোধই রচনা করে দেহ-মনের বিভ্রম ও পরিচয়ের বন্ধন। তুমি যদি এই ‘আমি’-কে সত্য ধরে নাও, তবে নিজের প্রকৃত অবস্থান হারিয়ে ফেলো।
ফিরে যেতে হবে সেই শব্দহীন ‘আমি’-তে, তাতে স্থিত হয়ে বুঝতে হবে এর মায়াময়তা। তখনই তুমি পুনরায় অধিষ্ঠিত হবে তোমার আসল চিরন্তন স্বরূপে—যেটি পরিবর্তনহীন, অনন্ত, সর্বদা এক ও অদ্বৈত।
১৯৪.
‘আমি’-কে ধরো, শরীর-মন ছাড়িয়ে যাবে। ‘আমি আছি’—এই বোধটিকে ধরে ফেলো, তাহলেই সমস্ত বাধা আপনা থেকেই মিলিয়ে যাবে। তখন তুমি শরীর ও মনের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবেশ করবে এক অপার্থিব, অদ্বৈত চেতনায়। গুরু যা বলেন, তা তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে—তিনি বহুভাবে, বহু রূপে তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এই ‘আমি’ বোধের গূঢ় তাৎপর্য। যে-কোনো সাধক তাঁর কাছে এলে—গুরুর প্রথম কাজ হয় তাকে বোঝানো: “তুমি কে?” “তোমার ভিতরে যে-বোধ বলছে—‘আমি আছি’, তাকেই বোঝো।”
এই বোঝাপড়াটির উপরেই নির্ভর করে তোমার সম্পূর্ণ সাধনার ভিত্তি ও অগ্রগতি। যদি তুমি এই ‘আমি’ বোধের তাৎপর্য বুঝতে না পারো, তাহলে কখনোই গুরুত্ব দিয়ে তাকে ধারণ করতে পারবে না, আর তাই তার ভিতর ডুবে যাবার চেষ্টাও করবে না। মনে রেখো—এই ‘আমি’ হলো নির্বিশেষ, নির্নাম, নিররূপ—এটি কোনো ব্যক্তির অনুভব নয়, বরং আত্মচেতনার প্রথম নিরাকার অভিব্যক্তি।
যখন তুমি এই ‘আমি’-কে সত্যভাবে ধরতে পারো, আর তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাও, তখন তুমিও হয়ে ওঠো নির্বিশেষ, রূপহীন, মায়ামুক্ত। তখনই তুমি অতিক্রম করে যাও—শরীর ও মনের সীমিত পরিধি, এবং স্থিত হও চিরন্তন পরম আত্মায়—যেখানে কেবল নিঃশব্দ সত্তা। সমস্ত সাধনার মূলভিত্তি হলো—‘আমি’ বোধকে চিনে ধরা, যা আত্মস্মরণের দ্বার খুলে দেয়। এই ‘আমি’ কোনো দেহগত ব্যক্তি নয়, এটি হলো চেতনার প্রথম উত্থান—যা শব্দহীন ও নিরাকার এক অভ্যন্তরীণ আত্মঘোষণা।
গুরু প্রথমেই বলেন—তুমি এই ‘আমি’-কে বোঝো, তাতে স্থিত হও, আর ধীরে ধীরে এর সঙ্গে এক হয়ে যাও। এই একতা-লাভের মধ্য দিয়েই—সাধক দেহ-মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব, চাহিদা, বেদনা ও সীমা ছাড়িয়ে যান। তখনই শুরু হয় সত্যিকারের মুক্তি—যেখানে ‘আমি’-র মধ্য দিয়ে নিজেকেই ছাড়িয়ে যাওয়া যায়। গুরু সর্বপ্রথম যে শিক্ষা দেন, তা হলো—‘আমি’ কে, তা বোঝো, এবং তাতে স্থিত হও।
এই ‘আমি’ হলো নাম-রূপহীন আত্মচেতনার প্রথম স্পন্দন। এই বোধ ধরতে পারলেই, সমস্ত মানসিক ও দেহগত সীমাবদ্ধতা নিজে থেকেই ঝরে পড়ে। এই ‘আমি’-র সঙ্গে এক হয়ে গেলে—তুমিও হয়ে ওঠো অব্যক্ত, নিরাকার, চিরন্তন। তখনই সম্ভব হয় শরীর–মন–জগৎ ছাড়িয়ে নিজের প্রকৃত পরম অবস্থায় ফিরে যাওয়া।
১৯৫.
প্রশ্ন তো থাকেই, যতক্ষণ ‘আমি’ থাকে। সব প্রশ্নই থাকে, কারণ ‘আমি’ বোধ আছে। আর যখন এই ‘আমি’ মুছে যায়, তখন আর কোনো প্রশ্নের স্থানই থাকে না। ‘আমি আছি’—এটাই হলো প্রথম ধারণা, সব কিছুর মূল, সব জিজ্ঞাসার জন্মস্থান। যখন তুমি এই ‘আমি’-র মধ্যে স্থিত থাকো, তখন তুমি চেতনার একেবারে সূচনাবিন্দুতে অবস্থান করো—তখন কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
তবে যদি এই অবস্থান থেকে সরে যাও, ‘আমি’ থেকে দূরে চলে যাও—তবেই প্রশ্ন, দ্বিধা, দুঃখ, সংশয়, জটিলতা শুরু হয়। কিন্তু যদি তুমি এই ‘আমি’-তে গভীরভাবে স্থিত হতে পারো, তাহলে একসময় এই ‘আমি’ নিজেই বিলীন হয়ে যায়—আর তখন প্রশ্ন তো দূরের কথা, প্রশ্নের ধারণাটাই থাকে না—কারণ মূল শিকড়টাই কাটা পড়ে যায়।
অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—প্রশ্ন, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, মন, স্মৃতি—সব কিছুই ‘আমি’-বোধের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ‘আমি’ বোধ না থাকলে, “আমি জানি না”, “আমি বুঝতে পারছি না”, “আমার প্রশ্ন আছে”—এইসব অভিব্যক্তিরও কোনো ভিত্তি থাকে না। অতএব, সকল প্রশ্নের মূল কারণই হলো ‘আমি’। ‘আমি’-তে স্থিত থাকা মানেই—চেতনাবোধের মূল স্তরে থেমে থাকা, যেখানে এখনো চিন্তা-প্রশ্ন তৈরি হয়নি। এই স্তরে প্রশ্ন আসবেই না। আর যখন ‘আমি’ নিজেই মুছে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে…কার কাছে? কে জিজ্ঞাসা করবে? কাকে জিজ্ঞাসা করবে? তখন যা থাকে, তা প্রশ্নাতীত, চিন্তাতীত, নিঃশব্দ, অভিন্ন চৈতন্যমাত্র।
প্রশ্নগুলো শুরুই হয় ‘আমি’ আসার পর থেকে। ‘আমি’ বোধে যতক্ষণ স্থিত থাকা যায়, ততক্ষণ প্রশ্ন আসে না—কারণ তুমি তখন এখনও চিন্তাগ্রস্ত অভিজ্ঞতাজগতে প্রবেশ করোনি। আর যখন ‘আমি’ নিজেই বিলীন হয়ে যায়—তখন প্রশ্নের অস্তিত্বও নেই, কারণ তখন কোনো জিজ্ঞাসু-সত্তাই নেই। এই অবস্থাই হলো সর্বশেষ স্তর, যেখানে কেবল নির্জন চৈতন্য টিকে থাকে—নেই প্রশ্ন, নেই উত্তর—কেবল সত্য।