এক। মন ও তার তিন রূপ
চেতন ও অচেতন (জড়) — এই দুই সত্তার সংঘর্ষে যে-স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় মন।
১. স্থূল মন — ধারণা
সচরাচর বস্তু ও বিষয়বস্তুর স্থূল অংশ নিয়ে মনের যে-প্রকাশ ঘটে, তার নাম ধারণা। এটি মনের স্থূল রূপ।
২. সূক্ষ্ম মন — সঙ্কল্প-বিকল্প
সঙ্কল্প ও বিকল্পাত্মক অন্তঃকরণের বৃত্তিকেই বলা হয় সূক্ষ্ম মন। সাধক ও যোগীরা একেই সাধারণত ‘মন’ বলে অভিহিত করেন, এবং মন স্থির রাখার প্রসঙ্গও এই সূক্ষ্ম মনকেই ঘিরে প্রচলিত।
৩. কারণ মন — আলোর স্পন্দন
আলোর যে-স্পন্দন, তা-ই মনের কারণ রূপ। এই স্তরেই আত্মা পরমাত্মায় লীন হয় এবং সর্বোচ্চ পুরুষের, অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্ধান সম্পূর্ণ হয়। সাধনা বা যোগপথে এই কারণ রূপ না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সাধক বা যোগীর স্থিতি আসতে পারে না।
উপসংহার
মানবদেহে মনেরই প্রধান প্রভাব বিরাজমান। সুতরাং মন সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন ব্যতীত সাধনপথে অগ্রগতি সম্ভব নয়।
দুই। আত্মবোধ ও নিগমের প্রকৃতি
শিশু মাতৃগর্ভ থেকে বের হওয়ার পর, নাভিচ্ছেদ সম্পন্ন হলে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস নাভিকেন্দ্রিক হয়ে চলতে থাকে। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের সচেতন উপলব্ধিই প্রকৃত বোধ বা আত্মবোধ।
পরে, শ্বাসের মাধ্যমে বহির্জগত থেকে দেহাভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাব ও দৃষ্ট আকার-আকৃতির আগম ঘটে, এবং প্রশ্বাসের মাধ্যমে অভ্যন্তর থেকে নিগম সম্পন্ন হয়।
সবই এই অন্তর্নিহিত বোধের কাজ। কিন্তু মানুষ তা উপলব্ধি করতে না পারায় মনে করে— বোধ বাইরে থেকে আসে, এবং এই ভুল ধারণায় সময় নষ্ট করে।
আসলে, স্বাভাবিক বোধ সর্বত্র সমভাবে বিরাজমান। এই বোধকে উপলব্ধি করতে হলে, সর্বপ্রথম নিজের আত্মবোধ জাগ্রত ও সচেতন করতে হবে।
তিন।
মানবজীবনের লক্ষ্য ও পূর্ণতার পথ
মানবজীবনের প্রথম, প্রধান ও শেষ লক্ষ্য হলো লক্ষ্য-স্বভাব প্রাপ্তি, অর্থাৎ পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন।
যদি জীবনের শুরুতেই এই পূর্ণ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া যায়, তবে পূর্ণ কর্মের মাধ্যমে পূর্ণ জ্ঞান, ভক্তি ও প্রেম অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। অপূর্ণ লক্ষ্য থেকে অপূর্ণ ভাব নিয়ে কর্ম শুরু করলে পূর্ণ লক্ষ্যে পৌঁছানো স্বাভাবিকভাবে বা সম্ভবত কোনো দিনই সম্ভব নয়।
তাই প্রথমেই জানতে হবে— পূর্ণ লক্ষ্য কী, এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য পূর্ণ মনঃশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
মানুষ দেখতে চায় যে, পূর্ণ মনুষ্যত্বের মধ্যে দেবত্ব, ঈশ্বরত্ব, ব্রহ্মত্ব, পরমেশ্বরত্ব ও পরমাত্মতত্ত্বের পূর্ণ জাগরণ ঘটেছে। যদি মানুষ তার স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণদেহের মাধ্যমে এই পূর্ণতা উপলব্ধি করতে না পারে, তবে সে তাকে আগন্তুক, মৃত্যুশীল ও অপূর্ণ বলেই মেনে নেবে— এতে সন্দেহ নেই।
মানব এতকাল ঈশ্বর, পরমেশ্বর, ব্রহ্ম— সকলের উপাসনা করেছে; নিজেকে ভক্ত, সেবক, ত্যাগী, ভোগী, যশস্বী, মাননীয়, কীর্তিমান, লোকমান্য— নানা রূপে সাজিয়েছে। কিন্তু কিছুই তাকে আজ পর্যন্ত পূর্ণতা দিতে পারেনি। তাই আজ মানুষ সর্বত্র ব্যর্থ মনোরথ হয়ে স্বভাব-মানবতার আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয়েছে।
যে-দিন মানুষের মধ্যে পূর্ণ মনুষ্যত্বের জাগরণ হবে, সেই দিনই তার লক্ষ্য পূর্ণ হবে। আর লক্ষ্য পূর্ণ হওয়া মানে হল— দেহ, মন, প্রাণ ও এক বোধের, অর্থাৎ সমস্ত অভাবের পূর্ণতা লাভ।
একমাত্র পূর্ণ লক্ষ্যই মানুষকে পূর্ণতার শেষ সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। পূর্ণ লক্ষ্য কখনও দ্বৈত হয় না। প্রতিটি মানুষের কর্তব্য— এই পূর্ণ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পূর্ণ কর্মের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হওয়া।
এটি একক মানুষের প্রশ্ন। এর পর আসে সমগ্র বিশ্বমানবের প্রশ্ন।
যে-লক্ষ্য ও যে-পথ একজন মানুষের পূর্ণতার জন্য প্রয়োজন, বিশ্বমানবের পূর্ণতার জন্যও সেই একই লক্ষ্য ও পথ প্রযোজ্য। অতএব, যেদিন মানুষ এককভাবে পূর্ণ লক্ষ্যে, পূর্ণভাবে, পূর্ণকর্মে এবং এক বোধে পূর্ণতা লাভ করবে, সেদিনই বিশ্বমানব তথা সমগ্র বিশ্বকে অভিন্নভাবে পরিপূর্ণ বলা যাবে।
সেই দিনই মানবজাতির সকল অভাব, অভিযোগ ও ভেদ— এবং আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক সব তাপের অবসান ঘটবে। এবং এই পরিপূর্ণতাই মানবজাতির একমাত্র স্বাভাবিক, কাম্য ও সর্বোচ্চ লক্ষ্য।
চার।
আত্মসংযম ও পূর্ণতার পথ
আত্মসংযমের উদ্দেশ্য কেবল বাহ্যিক আচরণে নিয়ম মানা নয়—এর অন্তরে রয়েছে চেতনার পূর্ণ বিকাশ। মানুষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় অনন্ত সম্ভাবনা, শক্তি ও জ্ঞানের ভাণ্ডার বিদ্যমান। যখন চিন্তা, অনুভূতি ও কর্ম—সবই সংযত ও সুশৃঙ্খল হয়, তখন সেই সম্ভাবনা ক্রমে প্রকাশিত হয়।
মানবজীবনে আত্মসংযমের সাধনা স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ—এই তিন স্তরের পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে সহায়ক। এই সংযমই অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস, যা সঠিকভাবে বিকশিত হলে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা ও চেতনার পূর্ণ জাগরণ ঘটে।
আত্মসংযমের মূল উদ্দেশ্য হলো—নিজেকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সন্নিবেশিত করা, যাতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য ও পূর্ণতা আসে। যখন এই নিয়ন্ত্রণ কর্ম, চিন্তা ও অনুভূতির স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা একসাথে বৈষয়িক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও স্বতন্ত্র বিকাশ সাধন করে, এবং মানুষ নিজের ভেতরেই অটল শান্তি ও স্থায়িত্ব খুঁজে পায়।
আত্মসংযম শুধু আধ্যাত্মিক পথের ভিত্তিই নয়—এটি জীবনের প্রতিটি দিকের মূলভিত্তি।
প্রাচীনকালে জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়েই নিয়ন্ত্রিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল, যাতে ব্যক্তি সংসারের সংঘাতের বাইরে থেকে চরিত্র, মন ও বোধকে সঠিক পথে গড়ে তুলতে পারে।
তবে কেবল বাহ্যিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া সংযম যথেষ্ট নয়। পূর্ণ আত্মসংযম তখনই আসে, যখন জীবনের লক্ষ্য হয় চূড়ান্ত সত্য ও সত্তার উপলব্ধি—যে মূল উৎস থেকে সমস্ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় উদ্ভূত। এই লক্ষ্য স্থির হলে আত্মসংযম স্বাভাবিকভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং একবার স্থাপিত হলে তা থেকে বিচ্যুত বা বিভ্রান্ত হবার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
এটাই আত্মসংযমের ধ্রুব সত্য—যা মানুষকে অন্তরের পূর্ণতা, স্থায়ী শান্তি ও জীবনের সার্বিক সাফল্যের পথে নিয়ে যায়।
পাঁচ।
সৎচরিত্র ও আত্মসংযমের পূর্ণতা
দৈহিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে সৎচরিত্র, যা মানবস্বভাবের একমাত্র দৃঢ় ভিত্তি। সৎচরিত্র স্থূল, সূক্ষ্ম ও গভীর—এই তিন স্তরের সমন্বিত পূর্ণতা; এর মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত রূপ ও শক্তি প্রকাশ পায়।
মানুষের অন্তরে নিহিত কেন্দ্রশক্তি তার জীবনের মূলধন। এই শক্তি স্বাভাবিকভাবে ধারণ ও সংরক্ষণের প্রবণতাই আত্মসংযমের ভিত্তি। লক্ষ্য সুস্পষ্ট থাকলে এবং কর্ম, চিন্তা ও বোধ সেই লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হলে সংযম স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠা পায়।
পূর্ণতার পথে অগ্রসর হবার সঙ্গে সঙ্গে এই অন্তঃশক্তি স্থিতিশীল হয়, এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে সামঞ্জস্য, স্থিরতা ও সৃজনশীল বিকাশ আনে। কিন্তু লক্ষ্যহীন সংযম দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ইতিহাসে বহু মহাপুরুষের পতনের উদাহরণ তার সাক্ষ্য বহন করে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি স্থূল, সূক্ষ্ম ও গভীর স্তরের সীমা অতিক্রম করে পূর্ণতার সঙ্গে একীভূত না হয়, ততক্ষণ তার সংযম বিপন্ন থাকার সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃত স্থায়িত্ব আসে তখনই, যখন আত্মসংযম চূড়ান্ত সত্য ও স্বভাবের উপলব্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়।
পৃথিবীর স্বভাব পরিবর্তনশীল হলেও, তার মূল সত্তা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। মানবজীবনকে স্থায়ী ও গঠনমূলক করতে হলে সেই স্বভাবের সঙ্গে নিজেকে একীভূত করতে হয়। যেখানে মানুষ, প্রকৃতি ও স্বরূপ এক হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে আর কোনো ভেদ থাকে না—সেখানেই পূর্ণতার আসন।