ইচ্ছা–জ্ঞান–ক্রিয়া




শিশুরা ভবিষ্যতের দাবার গুটি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয়, আমাদের এই জীবনযাপন—আমরা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে একটা পৃথিবী ধার করে নিয়ে বেঁচে আছি। তারা কী উত্তরাধিকার পাবে, তা সম্পূর্ণ আমাদের ওপর নির্ভর করে। তবে এই অধিকার কেবল ভৌত সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, চিন্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চিন্তা বলতে আমি শুধু বস্তুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে বোঝাই না, জীবনের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ককেও বোঝাই। শৈশবে একটা শিশু ধারণার ভিত্তিতে চিন্তা করে না। তদুপরি, সে ভালো-মন্দ আলাদা করতে পারে না। সে স্পঞ্জের মতো চারপাশের মানুষের মনোভাব শুষে নেয়। আর যা সে শুষে নেয়, সেটাই তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

আমাদের অর্জিত সকল জ্ঞানকে শিশুদের শিক্ষার সমান্তরালে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সাজানো যেতে পারে। একদিকে, আমরা অন্তত কিছুটা হলেও যে ‘উদ্ভাবিত’ জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরি বাঁচি—তা অবশ্য ঠিক কাজই, কারণ ভালোবাসার সন্তান হিসেবে সেটিও আমাদের অংশ; আর অন্যদিকে, তার ‘লালন-পালন’ বা ‘উপজ্ঞান’ কীভাবে গড়ে ওঠে, তার দায়ও আমাদের ওপর থাকে—অর্থাৎ, যা আমাদের মাধ্যমে জন্ম নিয়ে আমাদের ভেতরে পরিপক্ব হচ্ছে, তার দায়।

যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি শিশু পৃথিবীর পথে নেমে যায় এবং স্বাধীন জীবনযাপন করে, নিজের উদ্যোগে কাজ করে, তেমনই আমাদের মধ্যে যা সৃষ্টি হয়, তা ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে বাইরে, পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আমি একে একধরনের মৌলিক পুনর্জন্ম বলে মনে করি—যেখানে আমরা নিজেরা নই, বরং আমাদের মনোভাবগুলোই সময়ের বহমানতায় দৌড়ে চলে।

জন্মজন্মান্তরের পুনর্জন্ম নিয়ে আমি বলছি না; আমি আসলে এর ব্যাবহারিক রূপটা বাস্তবে দেখিই না। আমার মনে হয়, এই জীবনকে, যেমন আছে, তেমন দেখাই যথেষ্ট। এখানেও যথেষ্ট ‘রূপগ্রহণ’ বা ‘রূপবদল’ আছে। অন্তত, আমি অতীতে এমন কিছু দেখিনি, যা কোনো না কোনোভাবে বর্তমান নয়; আদতে সেগুলো কেবল প্রজন্মগত পরিবর্তনের নানান প্যাটার্নের মতো। হ্যাঁ, জন্মান্তর এই এখানেই।

আমরা আমাদের জীবনের উপাদানগুলোকে যেভাবে রূপান্তরিত করি, সেখান থেকে সেভাবেই গড়ে ওঠে রূপ, গড়ে ওঠে পরিস্থিতি। এটি শুধু আমাদের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় না, আমাদের চারপাশের বাহ্যজগতেও তা সংগঠিত হতে থাকে। এই সৃষ্টিশক্তি ইচ্ছার গভীরতার সঙ্গে যুক্ত; এখান থেকে-ওখান থেকে বাস্তবতার জন্ম দেয়।

কীভাবে আমাদের চারপাশের বিভিন্ন পরিস্থিতি গড়ে উঠছে, তা মোটামুটি আমাদের ওপরই নির্ভর করে। এই অর্থে, আমরা ‘ভাগ্য’-এর যন্ত্র; নিজের ভেতরের সম্ভাব্যতাগুলোকে যে-দিকনির্দেশ আমরা দিই, তার মাধ্যমেই আমরা লালিত হই। এটি আমাদের তৈরি ও যোগ্য করে তোলে, এবং এর ভিত্তিতেই আমাদের যথাযথ ভূমিকায় স্থাপন করা হয়।

বৌদ্ধ যোগাচারের দিক থেকে, প্রকৃতিতে স্বতঃস্ফূর্ত সংগতি ঘটে—ব্যক্তিকে নয়, বরং জীবনের ‘ক্যানভাস’ ও ‘সংস্কার’কে অধিকতর ধারণ করার মাধ্যমে। শৈব মতবাদের দিক থেকে, শক্তির সম্ভাবনার রূপই ভিত্তি; আর শিব তাঁর চেতনার অবস্থান, স্তর ও অন্তর্গত বিষয়বস্তু অনুসারে সেই সম্ভাবনাকে উন্মোচন করেন। তৎসঙ্গে, ইচ্ছা–জ্ঞান–ক্রিয়া (icchā–jñāna–kriyā) এই ত্রয়ীই আমাদের দৃষ্টির উৎস। এর প্রচলিত অনুবাদ: ‘intention–knowledge–action’; তবে গভীরতর স্তরে ‘ইচ্ছা’ এখানে মানব-সচেতন উদ্দেশ্য নয়, বরং এমন এক ‘দিক’, যা সূক্ষ্ম রূপে গতিশীল ও চক্রাকারে বৃদ্ধি পেয়ে শেষে ‘ইচ্ছা’-য় পরিণত হয়। এই সামষ্টিক বৃদ্ধি ঘটে নিজের মধ্যে বহুবিধ উপাদান প্রক্ষেপ/নির্গমন করে করে সেগুলিকে ধারণ করার মাধ্যমে—যেমন এক মহা-মহাবিশ্ব কেন্দ্রীয় গহ্বর থেকে বিস্ফোরণের মতো আপনা-নির্গত হয়ে মহাবিশ্বগুলো সৃষ্টি করেছিল।

এই ত্রয়ী নিজেও একটি চক্র। সেই ‘দিক’ দৃশ্যমান বস্তুসমূহকে নিজের সঙ্গে সারিবদ্ধ করে; এর প্রভাব হলো—ওই চক্রে সকল বস্তু একধরনের 'আকর্ষণ/আঁকড়ে ধরার শেকল'-এ আবদ্ধ হয়। এভাবে তা নির্দিষ্ট আকার নেয়, এবং এর ভিত্তিতে ধাপে ধাপে ‘দিক’-নির্ভর এক নতুন চক্র শুরু হয়—চক্র থেকে চক্রে আরও বেশি উপাদান আকর্ষিত হয়। ‘ইচ্ছা’ই সকল কম্পন/স্পন্দনের ভিত্তি, যেখান থেকে, সৃষ্টি করা যেতে পারে, এমন সব কিছুই মানুষ আহরণ করে।