সৃষ্টি-তত্ত্ব (Thesis of Creation) আসলে জীবন ও মৃত্যুর সাধারণ চক্রকে বোঝায়। তবে এই তত্ত্বে দেহের অকাল জন্ম বা মৃত্যু নয়, বরং চেতনার ক্ষণিক আবির্ভাব ও লয়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়।
আমরা শুরু করি মানুষের উপলব্ধি থেকে। যদিও এই উপলব্ধি বহুমুখী বিষয়কে ধারণ করতে পারে এবং বস্তুগত জগতের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, তবু এটি মূলত কেন্দ্রীভূত থাকে সেই অভিজ্ঞতার জন্মের দিকে, যা ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে—ব্যাখ্যাত ও অনূদিত হয়েছে—কীভাবে কাঁচা অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে উপলব্ধিতে রূপ নেয়, কীভাবে চেতনার নানান অবস্থার ভেতর দিয়ে চলতে চলতে তা আমাদের জ্ঞানজগতে স্থায়ী হয়।
আমরা জীবনযাপন করি উপলব্ধির দ্বারা। এর উপর নির্ভর করেই আমরা ভাবি, সম্পর্ক গড়ে তুলি, সিদ্ধান্ত নিই, কাজে প্রবৃত্ত বা কাজ থেকে নিবৃত্ত হই। যদিও আমরা আমাদের বিভিন্ন চিন্তার সমন্বয় করি, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, তবুও আমাদের প্রতিক্রিয়া বা অপ্রতিক্রিয়ার ফলাফল সবসময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়—যা অদৃশ্য এবং চলমান প্রক্রিয়ার উপর সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলে না।
একটি ভ্রূণ যেমন মায়ের শরীরকে প্রথমে প্রভাবিত করে এবং তার পরে জন্ম-পরবর্তী পরিবেশকে গড়ে তোলে, তেমনি অভ্যন্তরীণ চেতনার গর্ভাবস্থা—যা চক্রাকার পর্যায়ে ঘটে (এ যেন ফল পাকার আগের নানা প্রস্তুতি)—তা-ও ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে।
আজকাল কগনিটিভ সায়েন্স বা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিভিন্ন যন্ত্র ও মাপজোখের মাধ্যমে উপলব্ধিকে বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান জীবিত অভিজ্ঞতার চেয়ে দামি নয়। ঐতিহ্যগতভাবে, এ ধরনের ক্ষেত্রে ধ্যানের কৌশলকে ব্যবহার করা হয়—যা একদিকে ইন্দ্রিয়ের গ্রহণ-বর্জন-ক্ষমতাকে সূক্ষ্ম করে, অন্যদিকে আমাদেরকে স্বনিরীক্ষণকারী করে তোলে—যেন এক বহিরাগত দর্শকের আসনে বসিয়ে দেয়। মনোবিজ্ঞানের কিছু ধারা, যেমন গেস্টাল্ট (Gestalt) (এই শাখায় বলা হয়, মানুষ অভিজ্ঞতাকে সমগ্র রূপে বোঝে, শুধু খণ্ডাংশে নয়।), অভিজ্ঞতার উপলব্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কেন্দ্র করেই কাজ করে। The whole is greater than the sum of its parts—সমগ্র জিনিসটি আলাদা আলাদা অংশের যোগফলের চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের মন কেবল খণ্ডাংশ দেখে না, বরং সেটাকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করে।
অভিজ্ঞতার জন্ম নিজেই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। অথচ অভিজ্ঞতাই প্রায়শ আচ্ছন্ন হয়ে যায়, কারণ অনেকসময় তা অপ্রয়োজনীয় চেতনা-প্যাটার্ন দ্বারা তৈরি ও প্রভাবিত হয়—যা আত্ম-অস্তিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে চায়।
Threshold experiences (সীমান্ত-অভিজ্ঞতা বা চৌকাঠ-অভিজ্ঞতা) বলতে বোঝানো হয় এমন সব মুহূর্তকে, যেখানে মানুষ এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থায় প্রবেশ করছে—যেন এক “অদৃশ্য চৌকাঠ” পেরিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ অর্থে, এগুলো হলো সেসব ক্ষণস্থায়ী, গভীর অভিজ্ঞতা, যেখানে চেতনা, অনুভূতি বা জীবনের অবস্থায় এক বড়ো পরিবর্তন ঘটে।
উদাহরণ:
ঘুম থেকে জেগে ওঠার ঠিক আগমুহূর্ত
– তখন মনোযোগ জেগে আছে, কিন্তু এখনও কোনো ছবি, শব্দ বা চিন্তা তৈরি হয়নি।
– একেবারে ফাঁকা, অথচ সজাগ অবস্থা।
ধ্যানের গভীরে প্রবেশের সীমান্তে
– যেখানে চিন্তা প্রায় থেমে যায়, আর অভিজ্ঞতার জায়গা হয়ে ওঠে শূন্য কিন্তু সম্ভাবনাময়।
জীবনের বড়ো মোড়
– যেমন মৃত্যু-সন্নিকট অভিজ্ঞতা (Near-death experience), গভীর ট্রমা, বা হঠাৎ পাওয়া তীব্র আনন্দ—যা মানুষকে নতুন এক উপলব্ধিতে নিয়ে যায়।
আধ্যাত্মিক ‘শূন্যতা’-র অভিজ্ঞতা
– যেখানে সব পরিচিত ধারণা বা সংজ্ঞা মিলিয়ে যায়, কিন্তু অনুভূত হয় এক অদৃশ্য সম্ভাবনার ক্ষেত্র।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা: Threshold experience মানে এমন এক সীমান্ত-বিন্দু, যেখানে পুরোনো পরিচিত অবস্থা শেষ হচ্ছে, আর নতুন এক বাস্তবতার দরজা খুলছে। এটিকে একরকম পরিবর্তনের দোরগোড়া বলা যায়।
সহজভাবে, Threshold experiences হলো সেসব ক্ষণিক মুহূর্ত, যখন আমরা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাই—যেমন ঘুম-জাগরণের সীমা, চিন্তা-শূন্য ধ্যান, বা গভীর জীবনের ধাক্কায় পাওয়া এক নতুন উপলব্ধি। চৌকাঠ-অভিজ্ঞতা বা Threshold experiences অস্তিত্বের অনুসন্ধানে মূল ভূমিকা পালন করে। যেমন ভোরে ঘুম ভাঙার আগে ক্ষণিকের জন্য যে-অবস্থা আসে—যেখানে কোনো ছবি নেই, কোনো শব্দ নেই—শুধু সচেতন মনন আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতার উৎপাদনে সহায়ক কিছুই এখনও জন্মায়নি। এ যেন এমন এক প্রান্তর, যেখানে ভূমি নেই, আগুন নেই, ধ্বনি নেই—অর্থাৎ এমন কিছুই নেই, যা বোঝার বস্তু হতে পারে।
এই “কিছু না” আসলে সম্ভাবনা। সম্ভাবনাই হলো প্রকাশের ভিত্তি। তখন প্রশ্ন ওঠে—যা প্রকাশ পাচ্ছে, কেন তা-ই প্রকাশ পাচ্ছে? এখানে আমরা দেখি সিদ্ধান্ত, প্রতিক্রিয়া বা সচেতন নির্বাচন—এদের আবির্ভাব মানেই এদের অস্তিত্ব।
জেগে ওঠার পর মানুষ নিজেকে ক্যালিব্রেট করে—চারপাশের উদ্দীপনা দেখে, শোনে, ঘ্রাণ নেয়, আর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে: সে কোথায়, কে, এবং কী করছে। বাইরে থেকে তাকালে আমরা মুহূর্তের ভেতর এই ক্যালিব্রেশনের ঝলক দেখতে পাই। বাস্তবতার ছবিটি যেন একমুহূর্তেই গড়ে ওঠে, যদিও এটি আসলে ধাপে ধাপে ঘটে।
বৌদ্ধধর্ম—এমন অনেক আধ্যাত্মিক পথই—শুধু ধর্ম ছিল না, বরং অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতীয় অঞ্চলে যুক্তিবাদী বিকাশকে উৎসাহিত করেছিল। সেখানে বহু মতবাদ সংগঠিত হয়েছিল বিভিন্ন শাখায়, গবেষণা হয়েছিল নানা দিক থেকে। এই সময়ে বিজ্ঞান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক পথ পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
“শূন্যতা” (Nothing) বৌদ্ধদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ পশ্চিমে অনেক সময় এটিকে নাস্তিক্যবাদ বা নিহিলিজম হিসেবে ভুল বোঝা হয়। আবার কেউ কেউ এটিকে বিকৃত করে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে ঘোষণা করতে চায়। কিন্তু ধ্যানমগ্ন ধারা (যেমন খ্রিস্টীয় গ্নোসিস) বলে—কোনো চূড়ান্ত সংজ্ঞা নেই, এবং নীরব জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। গ্নোসিস (Gnosis) এসেছে গ্রিক শব্দ gnosis থেকে, যার অর্থ “অভ্যন্তরীণ জ্ঞান” বা “আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষ উপলব্ধি”। এখানে জ্ঞান বলতে কেবল বাইরের পড়াশোনা বা তথ্য বোঝানো হয়নি, বরং বোঝানো হয়েছে অন্তর্যাত্রার মাধ্যমে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা। প্রচলিত গির্জা শেখাত: বিশ্বাস (Faith)-এর মাধ্যমে মুক্তি। গ্নোস্টিকরা বলত: অন্তরের জ্ঞান (Inner Knowledge)-এর মাধ্যমে মুক্তি।
আমাদের ভেতরের কার্যকলাপ প্রকৃতির উপাদানেও প্রতিফলিত হয়। “যেমন ভেতরে, তেমন বাইরে—যেমন উপরে, তেমন নিচে”—এমন প্রাচীন সূত্র এখানেও প্রতিধ্বনিত হয়। অতএব, অস্তিত্বকে বোঝা মানে অতীত জীবন বা ভবিষ্যৎ জন্মের দিকে তাকানো নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতার দিকে মনোযোগ দেওয়া। বুদ্ধ নিজেও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। পাশাপাশি, জন্মের মুহূর্তে যে-প্যাটার্ন যুক্ত হয়, তা আমাদের বর্তমান জীবনের ভেতরও পুনরাবৃত্ত হয়, যেন পুনর্জন্ম চলতেই থাকে। আর আমাদের কাজের অন্তর্নিহিত প্যাটার্নও উত্তরাধিকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
এভাবে বলা যায়—আমরা নিজেকে অস্বীকার করছি না, বরং আমাদের কাজের পেছনের অগ্নিশিখাটিই ছড়িয়ে পড়ছে। যেমন এক প্রদীপের শিখা আরেক প্রদীপে জ্বলে ওঠে। প্রদীপের রূপ আলাদা হতে পারে, কিন্তু আগুন একই থাকে।
মানবিক ও সর্বজনীন সম্পর্ক সীমাহীন। মানুষ যা-কিছু বস্তুনিষ্ঠ ভাবে, তা শেষপর্যন্ত নিজের ভেতর দিয়েই গড়ে তোলে। অস্তিত্ব ও চেতনার অনুসন্ধান এই রহস্যকেই বোঝার চেষ্টা। তথ্য দিয়ে এর সমাধান হয় না—কারণ তথ্য একসময় পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। উপলব্ধি আসলে একধরনের গঠন, যা মনের দ্বারা তৈরি। তাই কোনো নির্দিষ্ট অর্থে আটকে যাওয়াই আমাদের বোঝাপড়ার স্তর। কিন্তু এর মানে অযৌক্তিকতায় ডুবে যাওয়া নয়—বরং উন্মুক্ততায় প্রবেশ করা।
কোনো অনুভূতি, চিন্তা বা ছাপ (impression) যদি আমরা পুরোপুরি চিন্তায় রূপান্তর করতে না দিই, তবে তা অসম্পূর্ণ বা অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। মানে, মনের ভেতরে তা আকৃতি নেয় না, ভাষা পায় না, সম্পূর্ণ ভাবনা হয়ে ওঠে না। সেই অর্ধসমাপ্ত ছাপ একসময় অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনে ফিরে আসে—কোনো পরিস্থিতি, ঘটনার মাধ্যমে। তখন মনে হয় যেন জীবন নিজেই তা আমাদের সামনে হাজির করেছে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক উপায়ে, যাতে আমরা তা থেকে কিছু শিখতে পারি। এটি কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়। এটি কেবল অনেকগুলোর মধ্যে একটি অভিজ্ঞতা। জীবন এমন বহু ছাপ, বহু অভিজ্ঞতার স্রোত দিয়ে আমাদের শেখায়।