অন্তর্মার্গ: ১২




কণ্ঠ ১ (মৃদু জিজ্ঞাসায় প্রশ্ন তোলে): ধ্যান মানে তো চোখ বুজে বসা, রূপ কল্পনা করা, মন্ত্র জপা…তবে ব্রহ্মের ধ্যান কেমন?
কণ্ঠ ২ (স্তব্ধতার গভীর থেকে উঠে আসে): ব্রহ্ম-ধ্যান হলো—ভাবনাহীন এক অনুভব। না চোখে ছবি, না মনে শব্দ, শুধু এক ধ্রুব জ্যোতির উপর স্থিতি—“আমি ব্রহ্ম” এই অনুভবই ধ্যানে পরিণত হয় নিজের মাঝে।
কণ্ঠ ১ (একটু দ্বিধায়): “আমি ব্রহ্ম”—এ তো কেবল ভাবনা…ধ্যানে তো ভাবনাও থেমে যায়?
(কণ্ঠ ২): প্রথমে ভাবনা, তারপর সেই ভাবনাও বিলীন—যেন প্রদীপের শিখা, যা নিজের আলোয় নিজেরই ছায়া খেয়ে ফেলে। শেষে থাকে শুধু এক অনুভব—ভাবনাহীন থাকা।
কণ্ঠ ১ (স্তব্ধ হয়ে যায়, তারপর মৃদু স্বরে): তবে ধ্যান কি কোনো অভ্যাস? না কি তা আপনাআপনিই আসে?
কণ্ঠ ২ (যেন নিজের মাঝেই ডুবে গিয়ে বলে): ধ্যান অভ্যাস নয়—তা তোমাকে ধরে না, তুমি যদি চাও ধরা দিতে। তুমি নিজে যখন নিজেকে ভুলে যাও—তখন ব্রহ্ম নিজেই জেগে ওঠে ধ্যান হয়ে।

দু-জন একসাথে (নিঃশব্দের পাশে দাঁড়িয়ে, গভীর ঐক্যে—ধ্যান-ভরা সুরে, কাঁপা আলোয় উচ্চারিত): “আমি ব্রহ্ম”—এই ধ্যান, এই শ্বাস, এই স্পন্দন। না ভাবনা, না অনুধ্যান—শুধু নিজস্ব চেতনার অমল বসবাস। ধ্যান মানে না দেখা, না ভাবা—ধ্যান মানে নিজেকে ভুলে যাওয়া। “আমি ব্রহ্ম”—এই অনুভব—যখন চিন্তা হয়ে ওঠে অস্তিত্ব, তখন ধ্যান থেমে যায়, ব্রহ্মই জেগে থাকে। ধ্যান নয় কর্ম—ধ্যান নিজেই আত্মার জেগে ওঠা।

কণ্ঠ ১ (ধীর ও গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন তোলে): আমরা ভাবি—ব্রহ্ম এক, নিরাকার, সর্বব্যাপী… জগৎ মায়া, পরিবর্তনশীল… এই ধারণাগুলো কি যথেষ্ট?
কণ্ঠ ২ (নিঃশব্দের অভ্যন্তর থেকে উঠে আসে): না… যা-কিছু ভাবা যায়, যা-কিছু বলার মতো—সবই সীমা। ব্রহ্ম কোনো ধারণা নয়, জগৎও নয় কোনো বস্তু—উভয়ই ধরা দেয় কেবল মনের খেলার ঘূর্ণিতে।
কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ে কাঁপে): তবে কি জগৎ একেবারেই নেই?
কণ্ঠ ২ (মৃদুহাসিতে): নেই—যেমন ঘুমে স্বপ্ন থাকে, জাগলেই তা উধাও হয়। জগৎ শুধুই মানসিক অভ্যাস। যখন মনের স্পন্দন থেমে যায়—তখন জগৎও থেমে যায়।
কণ্ঠ ১ (নীরব আশ্চর্যে): আর ব্রহ্ম? তাকে তো আমি এখনও ভাবছি…
(কণ্ঠ ২): ব্রহ্ম ভাবনার বিষয় নয়। তুমি যত ভাববে, তত দূরে যাবে। যখন ভাবনাও ফুরিয়ে যাবে—তখন ব্রহ্ম নিজে নিজেকে জানাবে—কোনো শব্দ ছাড়া, কোনো অনুভব ছাড়া।

দু-জন একসাথে (চেতনার নিঃশব্দ মিলনে—নীরবতার ঢেউয়ে ভাসা ছন্দে): ব্রহ্ম—না ভাবা, না চাওয়া, জগৎ—না থাকা, না হারানো। সব ধারণা শূন্য, সব ভেবে থেমে যাও—তাহলেই সত্য। ধারণা মানেই দূরত্ব, ভাবনা মানেই সীমা। যেখানে সব ভেবে থেমে যাও, সেখানেই আত্মা নিজের পরিচয় দেয়। ব্রহ্ম নয় বলা, নয় ধরা, নয় ভাবা—সে শুধু থাকা। জগৎ নয় বাহির, নয় ভিতর—সে কেবল স্বপ্ন। সবই শূন্য—তবে সে শূন্যই সব কিছু ধারণ করে।

কণ্ঠ ১ (আত্মস্থ কণ্ঠে, ধীরে ধীরে বলে): আমি দেখেছি জগতের অসারতা; জেনেছি, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য…তবু মাঝে মাঝে মন বাঁধা পড়ে, মন কী কী যে চায়—তখন মুক্তি কোথায়?
কণ্ঠ ২ (অচঞ্চল মৌনে গাঁথা বাণীতে): তুমি যখন বোঝো—মন আলাদা কিছু নয়, এটিই জগৎ, এটিই মোহ…তখন তুমি তার উপর ওঠো না, তাকে বিলীন করো। মনের ইচ্ছা নিঃশেষ হলেই—তুমি নিজের মধ্যে ফেরো।
(কণ্ঠ ১): তবে কি মনের নিয়ন্ত্রণ মানে—তাকে দমন করা?
(কণ্ঠ ২): না…তাকে দমন নয়, তাকে ভালোবাসা নয়, তাকে সত্য জেনে স্বাভাবিকভাবে উপেক্ষা—তবেই সে নিজে নিজেই নিঃশেষ হয়।
(কণ্ঠ ১): আর তখন? তখন কী ঘটে?
কণ্ঠ ২ (শান্ত, দীপ্ত, নিরবিচল কণ্ঠে): তখন—সব কিছু মিলে যায় একে একে। তুমি, জগৎ, ঈশ্বর, মুক্তি, সাধনা—সব মিলে যায় এক নিরাকার আলোয়। তখন আর কিছু বলার থাকে না, থাকে শুধু নিঃশব্দ উপস্থিতি।

দু-জন একসাথে (চরম আত্মবোধে মিশে গিয়ে—চূড়ান্ত তিতিক্ষায় নীরব ছন্দে): সব কিছু বিলীন, আমি-তুমি নিঃশেষ। মন থেমে গেছে, তাই আমি এখন সত্যরূপে জেগে আছি। মুক্তি মানে না ছোঁয়া, না পাওয়া; মুক্তি মানে—মন থেমে যাওয়া। যখন ইচ্ছাও বিলীন, ভাবনাও নিঃশেষ, তখন সব কিছু মিলে যায়—এক নিরাকার নিঃস্বর বিশ্রামে। তখন শুধু ‘থাকা’ নয়—‘আমি’ও থাকে না… থাকে শুধু সত্য।