সব ঠিক হয়ে যায় না

এক। খেয়াল করলে দেখবেন, মাঝে মাঝেই অজানা কোনো এক তীব্র বিষাদ আপনার মন-প্রাণ পাথরের মতন ভারী করে দিচ্ছে। মনে হবে, কলজের ভেতর কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। আপনি হাসছেন, কাজ করছেন, খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন—সবই করছেন, কিন্তু আদতে আপনার ভেতরটায় তীব্র বিষাদে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।

এই যে এমন তুফান বয়ে যাচ্ছে, বাইরে থেকে কিন্তু কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। আপনি কারও কাছে গিয়ে বলতেও পারছেন না, কোন বিষাদে, কোন কষ্টে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই।

এই অকারণ বিষাদের কোনো কারণ কখনও খুঁজে পাবেন না।

এমন কেন হয়?

খুব গভীরভাবে ভাবলে হয়তো বুঝতে পারবেন, পুরোনো কোনো জখম আপনার কলজেতে দাগ করে দিয়ে গেছে, যা সেই দাগটা শুকোনোর পরও মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আপনি ভুলে গেছেন, কিন্তু আপনার মগজ তা ভুলতে পারেনি।

পুরোনো কোনো প্রিয় মানুষের দেওয়া অন্তর্ঘাত, হারিয়ে-ফেলা প্রিয় কোনো খুব শখের মানুষ, ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া খুব যত্নের আদুরে কোনো স্বপ্নের ভাঙা টুকরোয় হয়তো আপনার কলজেটা কেটে-ছিঁড়ে ছারখার হয়ে আছে। ফেটে-যাওয়া ডিমের খোসায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেবার মতনই পুরোনো দুঃখকে জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে ঠিক রেখে বা রাখার অভিনয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন দিনকাল।

আপনি যতই ভুলে যাবার ভান করুন, যতই ‘সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে’ বলে-টলে ট্যাগ লাগান না কেন, কখনো কখনো ভরদুপুরে, মধ্যরাতে বা পড়ন্ত কোনো গোধূলিবেলায় জোড়াতালি দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রাখা আপনার দুঃখের ওপর থেকে ব্যান্ডেজটা খুলে যেতে চায়, শুকিয়ে-আসা ঘা-টা জেগে ওঠে, জেগে-ওঠা পুরোনো জখমে পুরোনো ব্যথাটা চিনচিন করে ওঠে।

আপনি ‘সব ঠিক হয়ে গেছে’ ভান ধরে আছেন, আদতে তেমন কিছুই ঠিক হয়ে যায়নি এখনও। সব আসলে ঠিক হয়ে যায়ও না। কিছু দাগ ধবধবে সাদা কাপড়ে লাগা দাগের মতন কখনোই উঠে যায় না, বসন্তের ফোড়ার দাগের মতন কিছু ক্ষতের চিহ্ন কখনোই মিলিয়ে যায় না। কিছু ব্যথার যন্ত্রণার আবেশ কখনও মিইয়ে যায় না—মৃত্যুর আগ অবধি না।

এজন্যই বোধ করি কখনো কখনো অকারণে বিষাদ জাগে, ভরা জ্যোৎস্নারাতেও দুনিয়াটাকে ঘোর অন্ধকার ঠেকে। গ্যাস্ট্রিক কিংবা বাতের ব্যথা ছাড়াও কখনো কখনো মধ্যরাতে বুকের ভেতর ব্যথায় তোলপাড় হয়ে যায়, নিঃশ্বাস আটকে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে ঠিক যেন বাগানের পুরোনো ফুলটির মতন, যে-ফুল ফুটতে গিয়েও আর ফুটতে পারেনি—শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেছে, যা কেউ কখনও দেখতে পায়নি, কেউ কখনও জানতেও পারেনি। ঠিক তেমনটাই, আপনার ফুটো-হয়ে-যাওয়া কলজেটা কেউ কখনও বাইরে থেকে দেখতে পায় না।

কথা বাড়ানোর সময় কিংবা সুযোগ থাকলে কেউ কি আর বলত: ভালো আছি!


দুই। "সময় সব ঠিক করে দেয়।" . . . এমন আশা নিয়ে কত সময়‌ই তো পার হয়ে যায়, কিন্তু কিছুই আর ঠিক হয় না।

কিছু ক্ষত কখনও শুকোয় না, চিরকালই দগদগে থেকে যায়।

কিছু দাগ কখনোই মুছে যায় না, গুটিবসন্তের ছোপের মতো লেগে থাকে কপালে-গালে।

আসলে সময় কিছুই ঠিক করে দেয় না, সময়ের আবর্তন কেবল পরিস্থিতি মানিয়ে চলা শিখিয়ে দেয়।

যা হবার, তা তো হয়েই যায়! জীবনে আন-ডু বলে কিছু নেই, তবে রি-ডু করার অনেক অপশন আছে!

শেষমেশ, মানুষ অপশনকে চেখে দেখতে পছন্দ করে।

Content Protection by DMCA.com