গৃহ

ভোরের অস্পষ্ট আলোয় নাড় ছেড়ে যে-পাখি সারাদিনের জন্য নিঃসীম আকাশে ডানা মেলে আকাশ-পরিক্রমায় ব্যাপৃত থাকে, সেই পাখি দিনান্তে আকাশের বিশালতার মোহ কাটিয়ে তার কবোষ্ণ নীড়ের মায়ায় ফিরে আসে মাটির বুকে। যে হিংস্র শ্বাপদ তার জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় গহন অরণ্যে, তাকেও সন্ধ্যার আঁধার-ছাওয়া প্রহরে ক্লান্ত পদভরে একটু বিশ্রাম, একটু উষ্ণতার জন্য গুহার মাঝে আশ্রয় নিতে দেখি। প্রতিটি প্রাণীকেই একটা নির্দিষ্ট আশ্রয়ে থাকতে হয়—এটাই তো প্রকৃতির বিধান।

মানুষের সেই আশ্রয়ের নাম ‘গৃহ’। গানের কলির প্রধান কথাটি যেমন অন্যান্য কথার সুরে ঘুরে ঘুরে মনের সামনে ফিরে আসে, আমরাও ঠিক তা-ই—যেখানেই যাই না কেন, আমাদের এই নির্দিষ্ট কেন্দ্রটিতে ফিরে আসতেই হবে। ছোট্ট শিশুর প্রাণটা যেমন বেশিক্ষণ মাকে ছেড়ে থাকলে ব্যাকুল হয়ে ওঠে, আমরাও তেমনি এই পরিচিত পরিধির সীমা থেকে একটু বেশিক্ষণ দূরে থাকলে হাঁপিয়ে উঠি, কেননা আমাদের পরিচিত গৃহকোণে স্নেহ, প্রেম, প্রীতির যে-কুঁড়ি ফোটে, উষ্ণ হৃদয় যে-মমতা ছড়ায়, শ্রান্তির প্রলেপে স্নিগ্ধ হয়ে মন যে সহজ, স্বছন্দ গতিতে এগিয়ে যায়, অন্য কোথাও তেমনটা দেখা যায় না। এই জন্যেই গৃহের জন্য আমাদের এত মায়া, এত ভালোবাসা।

গৃহের এই যে নিটোল শান্তির স্নিগ্ধ পরশ, স্নেহ-মমতার আর উষ্ণতার ছোঁয়া—এ সব কিছুই ন্যস্ত থাকে গৃহের পরিচালিকার উপর। নারী এবং পুরুষ—সৃষ্টির দিক হতে যেমন এদের পার্থক্য আছে, দায়িত্বের দিক থেকেও ঠিক তেমনি। পুরুষের চরিত্র বহির্মুখী, বাইরের পৃথিবীর সাথেই তার কাজ ও তার সংযোগ। নারী অন্তর্মুখী, নিজের স্বামী-সন্তানের আর গৃহের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করাতেই তার সার্থকতা। নিজের হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ-মমতার নির্যাস ঢেলে দিয়ে গৃহের চারিদিক পূর্ণ করতে চায় তার প্রাণ। প্রকৃতির বিধানে নারীর চরিত্রের অলঙ্কার এ-ই। তাই গৃহের প্রতিজনের মুখে হাসি ফোটাতে তার মতো আর কেউই পারে না।

শিশু পৃথিবীর দ্বারে আতিথ্য গ্রহণ করে। সে আমাদের কাছে চিরনূতন, চিরঅজ্ঞাত। অদূর যে-ভবিষ্যৎ, তার প্রকৃতি ও পরিচয় নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত হতে হয়; অথচ সেই অজ্ঞাতলোকের অপরিচয়তা ছাড়িয়ে দেশ-কাল এমনকী নিজগৃহের পরিবেশকেও প্রাধান্য দিয়ে তার জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে নারীরই উপর।

গৃহের প্রতিটি জনের বাইরের পৃথিবীর বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে একটা-না-একটা দায়িত্ব থাকে—নির্ভাবনায় নিঃশঙ্ক চিত্তে তাদের সেই দায়িত্বটুকুকে তারা পালনও করে। কিন্তু আপাতদৃষ্টি ছাড়িয়ে আমরা দেখি, এর মূল প্রেরণা নারী। যে-গৃহের অভ্যন্তরে শান্তি, সেই গৃহের বাসী পৃথিবীর যে-কোনো ক্ষেত্রেই সার্থক। এজন্য বোধ করি প্রাচীন শাস্ত্রে নারীকে শক্তির প্রতীক বলে কল্পনা করা হতো।

সুদক্ষ শিল্পী যেমন করে তালের উচ্চবোলেও সুরের লয়কে সংযত রাখে, তার ভারসাম্য ঠিক কেন্দ্রসীমায় স্থির রাখে—নারীও তেমনি দক্ষতার সাথে গৃহ এবং গৃহের প্রভাবান্বিত সর্বক্ষেত্রে সংহতি বজায় রাখে—যদিও নারীর এই দায়িত্বপালন অত্যন্ত সংগোপনে এগিয়ে চলে।
Content Protection by DMCA.com