প্রিয় স্বরলিপি,
সুস্থ হয়েই প্রথম চিঠিটা তোমাকে লিখলাম। তুমুল কষ্টকর এক দীর্ঘযাত্রা! কী যে ভয়ানক শারীরিক-মানসিক কষ্ট সয়ে সয়ে অবশেষে আজ উঠে দাঁড়ালাম!
প্রথমে অভিনন্দন জানাই তোমাকে যে, তুমি পৃথিবীতে আমার মাঝে তোমার চিহ্ন রেখে গেছ। ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি আমাকে প্রথম মাতৃত্বের অনুভূতি দিয়েছ।
তুমি যে কবে শরীরে দানা বেঁধে বসে ছিলে, বিন্দু-পরিমাণও টের পাইনি। টেস্ট করেও দেখলাম, 'তুমি' নামের অস্তিত্বটা নেগেটিভ। তারপর এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার; এই টেস্ট, ওই টেস্ট…হাজার টেস্ট, হাজার পাওয়াফুল ওষুধ। কোনো কিছুতেই যেন শরীরটা ভালো হচ্ছে না। বার বার আমি কী যেন মিস করে যাচ্ছি। একটা সময় উঠে বসতেও পারছিলাম না।
তারপর এক কাছের বান্ধবীর পরামর্শে আলট্রা করালাম। দেখলাম, তোমার উপস্থিতি আমার শরীরে। ততদিনে অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছ তুমি, টিপটিপ করে নড়ছিলে। হৃৎপিণ্ডটা তোমার ধুকধুক করে ওঠা-নামা করছে; ডাক্তার বললেন, ওই দেখুন, আপনার টুনটুনি পাখিটা আপনার ভেতরে কুটকুট করছে। বাহ্! একদম সুস্থসবল, এই বয়সে দ্রুতই ডেভেলপড হয়ে গেছে তুলনামূলকভাবে। এই বলে ডাক্তার যখনই আলট্রা বন্ধ করলেন, ডাক্তারকে বললাম, ম্যাম, আরেকটু দেখান, আমি আর কিছুক্ষণ দেখি।
ডাক্তার হি হি করে হেসে ফেলে তোমাকে আরও কিছুক্ষণ দেখাল আমাকে। কখন যে চোখে জল চলে এল, বুঝতেই পারিনি। সেই মুহূর্তের অনুভূতি পৃথিবীর কেউই বুঝবে না। মনে হচ্ছিল, হাজার-কোটি বছর পর আমার নিজের বলতে কেউ একজন আছে, একা নই আমি।
তোমার রিপোর্ট ছিল খুবই ভালো।
রুম থেকে বের হয়ে হাসপাতালের দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে পড়েই আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে স্রষ্টার কাছে বললাম, হে খোদা, হয় আমাকে এই তীব্র মায়া কাটানোর শক্তি দাও, নয় ওকে রেখে দেবার মতন কঠিন শক্তি দাও।
সেদিন অসহায়ের মতো আমি মাথা নিচু করে হু-হু শব্দে কেঁদেছি সবার সামনে। নাহ্, তুমি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এসেছ, তার জন্য মোটেও নয়; একটা জলজ্যান্ত মানুষ তুমি, তোমাকে কী করে রাখব আমি…কী করে তোমাকে খুন করব আমি, এইসব হাজারো যন্ত্রণার বিষণ্ণতায়!
জানো, অনেক অনেক বছর পর, তুমি আসার চিহ্ন দেখে, আমি কী যে খুশি হয়েছি! কত হাজার কল্পনা তোমায় ঘিরে, কত লক্ষ-কোটি স্বপ্নে আমার চোখের কর্নিয়ায় কর্নিয়ায় ঠাসা ছিলে তুমি, কত কবিতায়, গল্পে, শব্দে, চয়নে, বয়ানে যে তুমি মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিলে, সে খবর আমি ছাড়া কেউ জানে না। আমার জীবনে তুমিই ছিলে সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে আদুরে স্বপ্ন।
সেই তুমিই কিনা সত্যি সত্যিই এলে! টুকটুক করে নড়ছিলে, ঢিপঢিপ করে ওইটুকুন হৃৎপিণ্ডটি তোমার নাচছিল…আমি নিজের চোখে দেখলাম। কী আশ্চর্য, কী আজব, কী সুন্দর!
তোমার সংবাদটা যখন তোমার বাবাকে জানালাম প্রথম, তোমার বাবার প্রথম কথাটি কী ছিল, জানো?
মেডিসিনে কাজ হবে? না কি অ্যাবরশন লাগবে?
তৎক্ষণাৎ আমার মনটা কী এক তীব্র অজানা বিষাদে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। অথচ তোমাকে নিয়ে কত কত গল্পে তোমার বাবারও ভাগ ছিল সমান সমান!
বুঝলাম, তুমি আসার আগে থেকেই, আমি তোমার মা হয়ে উঠলেও, তোমার বাবা কেবল পুরুষই রয়ে গেছে, তোমার বাবা হয়ে উঠতে আর পারেনি; হতে অবশ্য পারতও না।
তোমার বাবার ভালোবাসতে পারার শক্তিটা ভয়ানক রকমের কম। নিজের পরিবারের মানুষগুলো ছাড়া সে আর কাউকে কখনও ভালোবাসে না, মূলত বাসতেই পারে না। এই যেমন তোমাকে, আমাকে কাউকেই পারেনি। অথচ তুমি তারই বিশুদ্ধ রক্ত। তুমি এলে না, তবু পুরুষ তো চিনলে!
সেদিন বুঝেছিলাম, দুনিয়ায় তোমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই। জন্মালে তোমাকে একাই জন্মাতে হবে, আমার মতন নিঃসঙ্গ-একাকী একটা বিচ্ছিরি জীবন তোমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে তোমাকে টেনে তোলার কেউ থাকবে না, মাথার উপর ছাদ, পায়ের তলায় মাটি বলতে কিছুই থাকবে না সারাজীবন, ঠিক তোমার মায়েরই মতন। তুমি পাবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আমার দারিদ্র্যের ভাগ আর আমার বিষণ্ণতা নামের রোগের ছড়াছড়ি।
চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, আমিও তো বাবা ছাড়াই গোটা একটা জীবন পার করে দিলাম, কিন্তু যে তীব্র যন্ত্রণা, আক্ষেপ আর আফসোস নিয়ে আমি প্রতিদিন মরেছি—বাবার একটুখানি স্নেহ পেতে, বাবার আদর কেমন হয় জানতে যে আমি জীবনভর আক্ষেপে মরেছি—এমন নিকৃষ্ট জীবন তোমার না হোক, তৃষ্ণার এমন কাতরতা তোমার খোঁজ কখনও না পাক। সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমাকে আমি রাখব না।
শোনো অভাগিনি, তোমার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য—তুমি আমার গর্ভে জন্মেছ। আমি সারাজীবনই খুবই বাজে রকমের দুর্ভাগা একটা মানুষ। ছোটোবেলায় মা বলত, আমি নাকি সোনায় হাত দিলে সোনা ছাই হয়ে যায়; আমি যে-প্রদীপে হাত দিতাম, সে প্রদীপের আলো নাকি নিভে যেত। মা ওটা সত্যি কথাই বলত বটে। এটাই তো ঘটতে দেখে এলাম এতদিন।
আমি চাইনি, আমার মতন এমন নিকৃষ্ট একটা জীবন তোমাকে বয়ে বেড়াতে হোক।
প্রিয় সন্তান আমার, তোমার মা তোমাকে খুন করে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আমি সবসময় চেয়েছি, তোমার বাবার চোখে তোমার জন্য ঠিক ততটুকুই মায়া আর টান থাকুক, যতটুকু একজন বাবার তার নিজের সন্তানের জন্য থাকে। আমি অবাক চোখে দেখতাম, তোমার বাবা তোমাকে আদর করবে, স্নেহ করবে, আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব খুব কাছ থেকে। সেই দৃশ্যে বোঝার চেষ্টা করব, আমার বাবাও হয়তো আমাকে ঠিক একইভাবে ভালোবাসত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম, আমার সন্তান তার বাবার আদর পাচ্ছে—স্নেহে, সোহাগে, মায়ায় তোমাকে তোমার বাবা ভরিয়ে তুলছে। আমি শুধু দেখতে চাইতাম, বুঝতে চাইতাম, একজন বাবা তার মেয়েটিকে ঠিক কতটুক, কেমন করে, কীভাবে আদর করে, স্নেহ করে।
নাহ্, যেদিন বুঝলাম, তুমি ঠিক আমার মতোই, একেবারেই জঘন্য একটা ভাগ্যের উত্তরাধিকারিণী হবে, সেদিন, তোমাকে নষ্ট করে ফেলাকেই আমি তোমার প্রতি প্রকৃত সুবিচার বলে মনে করেছি।
প্রিয় কন্যা, ভালোবাসা আমার, তোমাকে আসতে না দিয়ে আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। এই দুনিয়ার নিকৃষ্ট মুখ, এই দুনিয়ার স্বার্থপরতা তোমাকে দেখাতে চাইনি আমি।
তোমাকে শেষমেশ শেষ করে দিলাম। ঢিপঢিপ করে নড়া মাংসপিণ্ড, কুটকুট করে নেচে-চলা তোমার হৃৎপিণ্ডটি চিরতরে বন্ধ করে দিলাম। কী নিষ্ঠুর এক মা আমি! যে আমি কখনও একটা পিঁপড়েও মারি না, সেই আমি কিনা নিজের সন্তানকে অনায়াসেই মেরে ফেললাম…দুনিয়ায় আসার আগেই। আমার এই পাপ খোদা কখনও ক্ষমা না করুক।
প্রিয় জানবাচ্চা আমার,
তুমি আবার এসো আমার জীবনে; হ্যাঁ, তুমিই এসো…আমার গর্ভেই। তবে অবশ্যই এমন বাবার সন্তান হয়ে এসো, যে-বাবা তোমাকে আট-দশটা বাবার মতনই ভালোবাসবে; যার কাছে তুমি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল নও, ভীষণ কাঙ্ক্ষিত এক ফুল—তার চোখে, মুখে, হৃৎপিণ্ডে যেন তোমার ছায়া থাকে, তোমার প্রতি প্রবল ভালোবাসা থাকে; তোমাকে স্বাগত জানাতে যে-মানুষটা অধীর আগ্রহে দিনরাত অপেক্ষা করবে।
তুমি কেবলই আমার সন্তান নয়, যেন বাবারও সন্তান হও। কোনো অনুভূতিশূন্য পুরুষ যেন তোমার জন্মদাতা না হয়, কোনো স্নেহশীল পুরুষ যেন তোমার বাবা…সত্যিই বাবা হয়। তোমার আসার সংবাদ শুনে তার চোখেও যেন জল থাকে, সারামুখে যেন খুশির রেখা ছড়ানো থাকে। তোমার আগমনের সংবাদ তাকে জানাতেই যেন সে বলে, ফুল আনব, না মিষ্টি, না কি দুটোই? হা হা হা…!
তুমি আসার আগ পর্যন্ত আমি কখনোই অত আহামরি ব্যগ্রতায় মা হতে চাইনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর এখন আমার তীব্র চাওয়া…আমি আবারও তোমার মা হব, নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে সত্যিই আমি তোমাকে দুনিয়ার মুখ দেখাব। তোমাকে আমি একজন স্নেহশীল বাবা ও একটা সুন্দর দুনিয়া উপহার দেবো। ততদিন বেহেশতে ফুল হয়ে ফুটে থেকো, বাচ্চা আমার। জেনে রেখো, দুনিয়ার একটা মানুষ অন্তত তোমায় ভালোবাসে, হৃদয়ে ধারণ করে রাখবে আজীবন।
প্রিয় সন্তান আমার, তোমাকে লেখা এ-ই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। তুমি যেদিন পৃথিবীতে আবারও আমারই গর্ভে সন্তান হয়ে জন্ম নেবে সত্যি সত্যি, তোমাকে সেদিন থেকে আবার চিঠি লিখব। আবারও কলম ধরব, কত-কী লিখে লিখে যে ডায়েরির পাতা শেষ করব!
তোমার অস্তিত্বের প্রতিদিনই ডায়েরিতে চিঠি লিখব তোমার নামে। যেদিন তুমি সত্যিই পড়তে শিখবে, অনুভূতি বুঝতে শিখবে, সেদিন ডায়েরিটা তোমার হাতে তুলে দেবো। কী অসাধারণ উদ্যাপন ছিল তোমাকে ঘিরে তোমার মায়ের, তা তুমি পড়ে পড়ে শোনাবে হয়তো তোমার বাবাকে।
এমন একটা দিন, এমন একটা সুন্দর জীবন, এমন একটা গোছানো পৃথিবী আমাদের হোক। তোমার মা থাকুক, বাবাও থাকুক, সুখে-ভরা একটা ঘরও থাকুক। মা তোমায় ভালোবাসে, সোনা; ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসে—সব কিছুর চেয়েই বেশি ভালোবাসে।
তুমি ভালো নেই জানি, মা-ও ভালো নেই। তুমি চলে যাবার পর থেকে বুকটা খাঁ খাঁ করছে সারাক্ষণই। এমন নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, বিচ্ছিরি রকমের অপরাধবোধ আমার গোটা জীবনে আর কখনও কাজ করেনি। বুঝলাম, তুমি থাকলেই বোধ হয় আমার যত অভাব, দুঃখ, না-পাওয়া নব্বই ভাগই ঘুচে যেত।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আজকাল। বার বার যা-ই চোখে দেখি সামনে, সব কিছুতেই তোমাকে দেখতে পাই। ঘুমের ভেতরেও তোমার ঢিবঢিব করে নড়া হৃৎপিণ্ডটা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে বার বার। তোমার নিথর লালরঙের মাংসের টুকরোটা আমার সব দুঃখের ওজন হাজার-কোটি গুণ ভারী করে দিয়েছে।
বাচ্চা, আমার আজকাল বাঁচতে একদমই ইচ্ছা করে না। দুনিয়ার কোনো কিছুতেই সুখ পাচ্ছি না। মনে হয়, বেহেশতের এককোণে ফুল হয়ে ফুটে-থাকা লাল গোলাপগাছটির পাশে হাজার-কোটি বছর শুয়ে থাকি। আমার মতন এমন বাউন্ডুলে বেখেয়ালি একটা মানুষকে কী নিদারুণ স্নেহশীলা মা বানিয়ে ছেড়েছ তুমি!
আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাচ্চা! বোধ করি, দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি, আমার মায়ের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। অনেক বছর ধরেই আমি কাউকেই ভালোবাসতে পারছি না, ভালোবাসিও না। ধরেই নিয়েছি, আমি আর কখনও ভালোবাসতেই পারব না। ভালোই তো ছিলাম। কিন্তু নাহ্, এই প্রথম তোমাকে ভালোবাসছি মনে হলো। আদুরে বাচ্চাটা আমার! মা, তোমাকে খুউব খুউব…!
ইতি
তোমার মা