প্রাচীন মানুষের একটা রীতি ছিল—কোনো কাজের আরম্ভে এবং সমাপ্তিতে ঈশ্বরের নাম নেওয়া; আরম্ভে নাম নেবার উদ্দেশ্য: যাতে কোনো বিঘ্ন উপস্থিত না হয়, আর সমাপ্তিতে: নির্বিঘ্ন সমাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন। তাই ঈশ্বরের নাম নিয়েই শুরু করছি, তবে যা বলব, তাতে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন কি না কে জানে!
সভ্যতার আদিতে ধর্ম মানুষকে শাসন করেছে, দর্শন ও বিজ্ঞানকেও শাসন করেছে এবং শাসন না মানার জন্য কঠোর সাজা, এমনকী প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু দিন এখন বদলে গেছে। এখন ধর্মই বিজ্ঞান ও দর্শনের বিচারাধীন হয়ে পড়েছে। গ্রীক নাট্যকার আরিস্তফানিসের (Aristophanes) একটা নাটকে আছে, জোয়ান ছেলে বুড়া বাপকে ধরে পেটাচ্ছে। বাপ গুরুজন, তাই তাঁকে গায়ে হাত তোলা যায় না—এসব বলে বাপ নিজের দোহাই নিজেই দিচ্ছেন। ছেলে উত্তর দিল, “বাবা, তোমার এটা দ্বিতীয় শৈশব। আমার শৈশবে তুমি যেমন আমাকে শাসন করেছ এবং তোমার কথা মানতে বাধ্য করেছ, তেমনই তোমার এই বর্তমান শৈশবে আমিই তোমাকে শাসন করব এবং তোমাকে আমার কথামতো চলতে হবে।” গল্পটাকে কেবলই গল্পের জায়গায় রেখে আলোচনায় যাচ্ছি।
একদিকে দর্শন-বিজ্ঞান, আর একদিকে ধর্ম—এই উভয়ের সম্পর্কের মধ্যেও তেমনই একটা ওলট-পালট ঘটে গেছে। ধর্মের বার্ধক্যে বিজ্ঞান তাকে নিয়ে খুব বেশি নাড়া-চাড়া আরম্ভ করেছে। তার একটা বিশেষ ধারা দেখা দিয়েছে ইয়োরোপ-আমেরিকার ‘ধর্ম সম্পর্কিত মনস্তাত্ত্বিক’-দের মধ্যে। ধর্মানুভূতি, ধর্মবোধ এবং ধর্মবিশ্বাসও মনস্তত্ত্বের একটা ব্যাপার। সুতরাং মনের অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গেই, ধর্ম সম্বন্ধীয় সমস্ত অনুভূতি, বিশ্বাস ও ক্রিয়া—মনোবিদ্যার অধীনে এমনিতেই আসে। এই মতটা গৃহীত হবার সঙ্গে সঙ্গেই মনোবিদ্যার দিক দিয়ে ধর্মানুভূতি ও ধর্মজ্ঞান ইত্যাদির বিশ্লেষণ আরম্ভ হয়ে গেল।
প্রশ্ন উঠল, ধর্মানুভূতি ও ধর্মের আচার প্রাকৃত জনের যৌন প্রবৃত্তিরই রূপান্তর নয় তো? অনেক প্রাচীন ধর্মে লিঙ্গ, যোনি ইত্যাদির অর্চনা বিহিত রয়েছে এবং ধর্মের অনেক পরিভাষা, অনেক অনুষ্ঠান ইত্যাদি যৌন প্রবৃত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারতে সহজ দৃষ্টান্ত তন্ত্র; প্রাচীন মিশর, আসিরিয়া, গ্রিস, রোম প্রভৃতিতেও মদ্যের এবং অন্যান্য মদ্য জাতীয় পানীয়ের কম-বেশি অর্চনা চলত। আর, ‘যৌন-প্রবৃত্তি’ যদিই-বা ধর্মের মূল না হয়, তবে ‘ভয়’ তো হতেই পারে। প্রকৃতিতে ভয়ঙ্করের তো অভাব নেই; বাত্যা, ভূমিকম্প, বন্যা—কত বস্তুই তো আমাদেরকে ভীত-বিহ্বল করে তোলে। এসব অলোচনা করে অনেকে শেষ পর্যন্ত, ধর্মকে, মানুষের সাধারণ যেসব নীচ প্রবৃত্তি আছে, তারই কোনো একটার একটু মোলায়েম, একটু সরস, একটু ভদ্র রূপ মাত্র মনে করেছেন।
তবে সকলেই এই মত গ্রহণ করেছেন, এমন নয়। ধর্ম যে ধর্মই, এটাই বরং এখনও অধিকাংশের মত। কিন্তু বিরুদ্ধ কথাটা যে উঠেছে, তার দিকে চোখ বন্ধ করে রাখা সাহসের অভাব বোঝাবে। সুতরাং বিরুদ্ধ কথাটাও আমাদের জানা দরকার।
ধর্ম তো এভাবে বৃদ্ধ বয়সে বিজ্ঞানের হাতে তাড়না ভোগ করছে। তাহলে ঈশ্বরের অদৃষ্টে কী ঘটেছে? ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক তর্ক পাশ্চাত্য দর্শনে হয়েছে। সাধারণত ঈশ্বরের অস্তিত্বের যে-প্রমাণ দেওয়া হয়, তা সংক্ষেপে এই কয়টি: (১) ঈশ্বরের ধারণা আমাদের আছে, সুতরাং ঈশ্বর আছেন; (২) জগতের একটা কারণ ছিল—জগৎ কার্য-কারণ ছাড়া হয়নি। সুতরাং জগতের কারণ হিসেবে একজন প্রথম কারণ, যার অন্য কোনো কারণ নেই—এমন একটা কারণ থাকা দরকার। অতএব জগৎস্রষ্টা ঈশ্বর আছেন। (৩) জগতে বুদ্ধির ক্রিয়া দেখা যায়—উপায় দ্বারা উদ্দেশ্যসিদ্ধির চিহ্ন লক্ষিত হয়, সুতরাং সমগ্র জগৎকে উপায়স্বরূপ ব্যবহার করে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে পারেন, এমন একজন ঈশ্বর আছেন। (৪) পাপ-পুণ্যের একজন বিচারক দরকার; ঈশ্বর ছাড়া সে আর কে হবে? সুতরাং ঈশ্বর আছেন। (৫) মানবজাতির মধ্যে অনেক কাল হতে ঈশ্বরে কোনো-না-কোনো প্রকারের বিশ্বাস সৃষ্ট হয়; বিশ্বাসের এই সর্বজনীনত্বও ঈশ্বরের অস্তিত্বের একটা প্রমাণ।
এ সমস্ত প্রমাণের কতগুলি এ দেশের দর্শনেও বিবেচিত হয়েছে। আবার, ঈশ্বর অসিদ্ধ, এমনকী…নেই, একথাও এ দেশের দার্শনিকদের কেউ কেউ বলতে ভয় পাননি। প্রতীচীতেও ঠিক তা-ই ঘটেছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সকল প্রমাণ মিলেও সকলের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করেনি, এটা স্পষ্ট।
ঈশ্বর সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন ইদানীং বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। (১) ঈশ্বর কি সত্যিই খুব বুদ্ধিমান? নির্ভুল সৃষ্টি করতে পারেন? (২) এ জগৎটা কি খুব ভালোভাবে সৃষ্ট হয়েছে? (৩) তিনি কি একাই সব পারছেন? (৪) ঈশ্বর সৃষ্টির আদিতে, না অন্তে?
ঈশ্বর নেই বললে এইসব প্রশ্নের একটাও উঠবে না। তিনি আছেন (অথবা হবেন) ধরে নিয়ে এইসব জিজ্ঞাসা সম্ভব। জিজ্ঞাসা যদি সঠিক হয়, তবে তার কী উত্তর? প্রথমত, ঈশ্বর যে খুব বুদ্ধিমান, এ বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধির পরিচয় হয় কাজে। ঈশ্বরের সৃষ্টিতে এত ভুল দেখানো যায় যে, সেসবের স্রষ্টাকে খুব চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান বলা কঠিন। সাহারার মরুভূমি ও মেরুপ্রদেশের জমাট বরফ একই পৃথিবীতে না করলে চলত না? তাপ ও শৈত্য আর একটু বিবেচনার সাথে বণ্টন করলে আমাদের কত সুবিধা হতো! বেশি দৃষ্টান্ত নেওয়া নিষ্প্রয়োজন। যে-কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি রাশি রাশি দৃষ্টান্ত নিজেই সংগ্রহ করতে পারবেন।
একটা সহজ কথা এই যে, সৃষ্টিতে অনেক দুঃখকষ্ট রয়েছে। সেগুলি সংখ্যায় অসীম, সহজ বুদ্ধিতে মনে হয়, ঈশ্বর ইচ্ছে করলেই সেসবকে দূর করতে পারতেন। কাজেই দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত আসে: জগৎ সৃষ্টিটা খুব ভালো হয়নি। অনেকে অবশ্যই বলেছেন যে, যা যা সম্ভব ছিল, তার মধ্যে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট জগৎ হয়েছে—কিন্তু সর্বশক্তিমান যাঁকে বলা হয়, তাঁর বেলায় আবার সম্ভব-অসম্ভবের প্রশ্ন উঠবে কেন?
আর একটা চাঞ্চল্যকর প্রশ্ন এই যে, ঈশ্বরের সৃষ্টিতে কি কেউ সহায় আছে, না তিনিই একাই স্রষ্টা? মানুষ তো অনেক কাজ করে; বন কেটে শহর করে, পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে রাস্তা করে—জগতের অর্ধেক সৌন্দর্যই তো মানুষের সৃষ্টি! গ্রিকদের সেইসব মূর্তি, মিশরের সেই পিরামিড, ভারতের মন্দির ও তাজমহল—পেরেছেন ঈশ্বর এমন সব সৃষ্টি করতে? হ্যাঁ, অবশ্যই তাজমহলের নির্মাতারা ছায়াপথ কিংবা সপ্তর্ষিমণ্ডল সৃষ্টি করতে পারেনি; তবু তারাও তো স্রষ্টা! ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে, কাব্যে, সংগীতে, ইতিহাসের ঘটনায় মানুষ কি স্রষ্টা নয়? বন্য পশু ও পাখিদেরকে নির্বংশ করে এবং পালিত পশু-পাখিকে আদর করে—বন্য বৃক্ষের উৎপাদন করে, উদ্যান নির্মাণ করে—মানুষ কি জীবনহীন জড় ও জীবনবান জীবে সমানভাবে নিজের সৃষ্টিক্রিয়ার বিকাশ দেখাচ্ছে না? নিজের প্রাচীন রাষ্ট্র ও সমাজ ভেঙে মানুষ কি নূতনের সৃষ্টি করছে না? কী সিদ্ধান্তে আসব? জগৎ অনেকের সমবেত চেষ্টার সৃষ্টি; তবে এই স্রষ্টাবৃন্দের মধ্যে ঈশ্বরই প্রথম ও প্রধান। ঠিক এমনই একটা কথা পাশ্চাত্যে অনেকে বলেছেন।
সাধারণ লোকে ভাবে, ঈশ্বর অসীম, অনন্ত শক্তিমান, সনাতন। এবং, সর্বত্র বিদ্যমান। কেউ কেউ এটাও ভেবেছেন যে, ঈশ্বর ঠিক অসীম নন, তিনি সসীম; তাঁর বুদ্ধি ও শক্তি খুব বেশি, তবে অন্তহীন নয়; তিনি চিরযুবক, মানবজাতির দলপতি বা সেনাপতি—তাদের সাথে একযোগে সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন। জগৎ ক্রমশ উন্নততর হচ্ছে, মানবজাতির বদৌলতে রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতি হচ্ছে এবং তার সাথে সাথে ঈশ্বরও উন্নততর হচ্ছেন, বড়ো হচ্ছেন, অধিকতর শক্তি ও বুদ্ধি অর্জন করছেন। শিশু বড়ো হয়, যুবকও দেহে-মনে বৃদ্ধি পায়, ঈশ্বরের বেলাতেও তা-ই হচ্ছে।
এটা ছাড়াও আর একটা গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন, না জগৎ ঈশ্বর সৃষ্টি করবে! ঈশ্বর সৃষ্টির আদিতে, না অন্তে? একথাও কেউ কেউ সাহস করে বলে ফেলেছেন যে, ঈশ্বর এখনও আবির্ভূতই হননি, তবে জগতের গতি ঈশ্বরত্বের আবির্ভাবের দিকেই চলেছে। এর অর্থ এটাই দাঁড়াবে যে, প্রাচীনেরা যে বলতেন, ‘সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্’—(ছান্দোগ্য উপনিষৎ, ৬।২।১) অর্থাৎ, ‘হে প্রিয়দর্শন, ইহা (:এই জগৎ) অগ্রে (:সৃষ্টির পূর্বে) এক অদ্বিতীয় সদ্রূপেই বিদ্যমান ছিল’ তথা—’আদিতে ঈশ্বর ছিলেন’ ইত্যাদি উক্তি, তা গ্রহণীয় সিদ্ধান্ত নয়। আদিতে জগৎ ছিল, জগৎ এখনও বিকশিত হচ্ছে। এই বিকাশের শেষে ঈশ্বর আবির্ভূত হবেন। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি—জগৎ অ-সৃষ্ট, বরং জগৎই ঈশ্বর সৃষ্টি করবে। জগতের সমস্ত ক্রিয়া ঈশ্বরসৃষ্টির দিকে অগ্রসর হচ্ছে; এটাই জগতের উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। ঈশ্বর জগতের কর্তা বা কারণ নন, জগতের অন্তিম লক্ষ্য!
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আগের তিনটা প্রশ্ন অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। ঈশ্বর যদি এখনও জন্মে না থাকেন, তবে তাঁর বুদ্ধির প্রশ্ন অবান্তর, আর সৃষ্টি যদি তাঁর না হয়, তবে এর দোষ-গুণের বিচারেও তাঁর নাম ওঠা উচিত নয় এবং সৃষ্টি-ক্রিয়ায় কারও সাহায্য তিনি নিচ্ছেন বা নিয়েছেন কি না, সে প্রশ্নও ওঠে না।
ধর্ম ও ঈশ্বরের আলোচনার সাথে আরও একটা প্রশ্ন ওঠে, সেটা পরলোকের প্রশ্ন। আত্মা দৈহিক মরণের সাথে সাথেই মরে না, এটা মানবসমাজে অতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটা বিশ্বাস। ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, এই আত্মা মৃত্যুর পর দেহ হতে দেহান্তরে, এমনকী মানুষের দেহ হতে জীবদেহে কিংবা উদ্ভিদের দেহেও যেতে পারে। এর নাম সংসার। এটাই আত্মার দুঃখ। দার্শনিক জ্ঞানলাভ হলে এই দুঃখ হতে আত্মা মুক্ত হয়। এই মুক্ত অবস্থার নানারূপ বর্ণনা আছে। এরই নাম পরলোক। সাধারণ মানুষের কল্পনায় এই পরলোকের দুইটি ভাগ আছে—স্বর্গ ও নরক। কেউ কেউ এই উভয়ের মধ্যবর্তী একটা স্থানও কল্পনা করেছেন। পাশ্চাত্য চিন্তায়ও এসব কম-বেশি দেখা যায়। তবে দেহান্তরপ্রাপ্তির বিশ্বাস সেখানে খুব অল্প লোকেই গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু আত্মা যে অমর এবং তার যে এই জীবনের পরও আর একটা অনন্ত জীবন আছে, সে কথা অনেককাল ধরেই সব দেশের মানুষই কোনো-না-কোনো আকারে বলেছে। আত্মা যে অমর—ন, হন্যতে, হন্যমানে, শরীরে (গীতা, ২।২০)—শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না—তার নানাবিধ প্রমাণও দেওয়া হয়েছে। একটা বড়ো প্রমাণ হচ্ছে: পাপ-পুণ্যের বিচার। পাপের শাস্তি ও পুণ্যের পুরস্কার হবেই, এটা মানুষ ভাবে। অথচ দেখা যায়, এ জীবনে সবসময় সকলের সকল পাপ-পুণ্যের শাস্তি-পুরস্কার পাওয়া হয়ে যায় না; সুতরাং এই শাস্তি-পুরস্কার যাতে ঘটতে পারে, সেজন্য আত্মার আর একটা জীবন স্বীকার করতে হয়।
তা ছাড়া এটাও দেখা যায় যে, মানুষের মনের শক্তি বার্ধক্যের দিকেই বেড়ে চলে। মৃত্যুই যদি সব কিছুর শেষ হয়, তবে এই মানসিক উন্নতি তো একটা বিরাট নৈসর্গিক অপচয়। কারণ এসব অর্জিত শক্তি তো জগতের কোনো কাজেই—আত্মার নিজেরও কোনো কাজেই লাগল না। কাজেই ধরে নিতে হয়, পরলোকে আত্মার এসব শক্তি আরও বিকশিত হবে এবং তাঁরই উন্নতিতে প্রযুক্ত হবে। পরলোকের অস্তিত্বের এটাও একটা প্রমাণ।
কিন্তু এসব প্রমাণ কি বাস্তবিকই প্রমাণ? এদের বিরুদ্ধে কি কিছু বলা যায় না? পাপের শাস্তি আর পুণ্যের পুরস্কার হবেই। এটা বিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু প্রমাণিত সত্য কি? আর, নিসর্গে অপচয়ের দৃষ্টান্ত এত রয়েছে যে, মানুষের কতটা জ্ঞান বা বুদ্ধি কোনো কাজে লাগল না—এটা দেখেই কল্পনা করা চলে না যে, আর একটা লোক বা জীবন আছে, যেখানে তা কাজে লাগবে। কাজেই শেষ পর্যন্ত অনেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছেন যে, আত্মার অমরত্ব, তার অনন্ত জীবন কল্পনা করা বা বিশ্বাস করা যত সহজ, প্রমাণ করা তত সহজ নয়।
এটার চেয়ে বরং দৈহিক অমরত্ব প্রমাণ করা সহজ। কথাটা আমরা আগেও বলেছি। জীবজগতে এবং উদ্ভিদের জগতে দেখা যায়, দেহ হতে দেহান্তরের উৎপত্তি হয়। ভূমিতে একটা বাঁশ পুঁতলে তার শেকড় হতে অসংখ্য বাঁশের উৎপত্তি হয়। বাঁশের এই বংশবৃদ্ধিতেও একটা অমরত্ব দেখা যায়। জীবের বেলায়ও একদেহের যে-বীজকোষ হতে দেহান্তরের সৃষ্টি হয়, তা ধ্বংস পায় না; কোনো এক রহস্যজনক উপায়ে জননকারী এই বীজকোষ দেহ হতে দেহান্তরের সৃষ্টি করে আবার এই দ্বিতীয় দেহ হতে তৃতীয় দেহতে এবং সেখান হতে চতুর্থ দেহতে যায়। এভাবে তা ক্রমান্বয়ে দেহের পর দেহের সৃষ্টি করে দেহ হতে দেহান্তরে ভ্রমণ করে, অথচ তার মৃত্যু নেই এবং সৃষ্টিতে তার লয়ও নেই—এটা জীববিদ্যার একটা মত। তা যদি সত্য হয়, তবে সেটাও একটা দৈহিক অমরত্বের প্রমাণ। কিন্তু বাঁশটা কেটে ঘরের খুঁটি করলে কিংবা আগুনের ইন্ধন করলে তাতে অবস্থিত আত্মা আর একটা বাঁশে কিংবা জীবদেহে গিয়ে আশ্রয় নেবে কিংবা অন্য এক পৃথিবীতে বা আয়ুতে গিয়ে আর একপ্রকার জীবন লাভ করবে, এটা নেহাতই কষ্টকল্পনা। মানুষের বেলায়ও এটা সহজগম্য সত্য নয়।
প্রেত-তাত্ত্বিকেরা প্রেত-আত্মাকে ডেকে এনে যে মৃত্যুর পর তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান, তারও বিরুদ্ধ মত সম্ভব। প্রেত-আত্মা তার নূতন জীবনের এবং নূতন লোকের বা ঠিকানার সংবাদ খুব বেশি দেয় না—ভালো আছি, সুখে আছি, আসতে কষ্ট হয়—প্রভৃতি ধরনের কথা ছাড়া প্রেতাত্মার কাছে আর কোনো সংবাদ বড়ো বেশি পাওয়া যায় না। অথচ সে যে অমুকের আত্মা, তা বোঝাবার জন্য সেই ব্যক্তির অতীত জীবনের ঘটনা কিছু কিছু বর্ণনা করে। এই প্রকার বৃত্তান্ত যে জানে, এমন লোকের সুপ্ত স্মৃতির পুনরুন্মেষও তো হতে পারে। এসব আলোচনা হতে কোনো নিশ্চিত বা তর্কাতীত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়—এটা অবশ্য বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী উভয়েই মেনে নেয়।
উত্তর যা-ই হোক, আত্মা অমর কি না, এই প্রশ্নটা এখনও টিকে আছে, এর নিশ্চিত সমাধান বা প্রমাণ আমরা এখনও হাতে পাইনি। এর সাথে এটাও বলা উচিত যে, অনন্ত জীবন—যে-জীবনে কখনও দাঁড়ি পড়বে না, এমন জীবন সত্যি সত্যিই কাম্যবস্তু কি না, তা-ও জিজ্ঞাসা করা চলে। কাজের পর বিশ্রাম আমরা চাই, তেমনই জীবনের শেষে জীবনের বিরতি ভাবতে কি সত্যিই চিত্ত অবসন্ন হয়ে আসে? এটা কি ভাবনার দুর্বলতা নয়? অনেকে মনে করেন, এই বিরতি তো বরং আনন্দেরই হওয়া উচিত!
এ সব ছেলেমানুষি বিতর্কসভার প্রশ্ন নয়, গুরুগম্ভীরভাবেই দর্শনে উঠেছে। পক্ষে-বিপক্ষে যে-সব যুক্তি দেওয়া যায়, সে সবের চিন্তায়ই দার্শনিকের আনন্দ। কিন্তু এখানে একটা কথা আমাদের বার বার বলতে হচ্ছে—সেটা পাশ্চাত্যের সাহস। প্রাচীন ভারতেও অনুরূপ সাহস দেখতে পাই; জৈন ও বৌদ্ধরাও ঈশ্বর অস্বীকার করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্যে একটা প্রবল ধর্ম বর্তমান—তার গোষ্ঠী আছে, শাসনশক্তি আছে এবং একসময়ে সে দর্শন ও বিজ্ঞানকে শাসনও করেছে। সেই ধর্মের অবস্থিতিকালে এতটা সাহস কম কথা নয়। আমাদের দেশে বর্তমানে এতটা সাহস সকলে বরদাস্ত করবে কি না সন্দেহ। কোনো অবতার পুরুষের ছবি বা তাঁর সম্পর্কিত তথ্যপ্রমাণ সবার সামনে নিয়ে এসে প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটতে আমরা একাধিক বার দেখেছি, অথচ তা মোটেও ধর্মের বিরুদ্ধ সমালোচনা নয়, না জেনেবুঝে ওই ধর্মের একটা বিধান লঙ্ঘন করা মাত্র। হায়, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধ কথা বলে প্রাণদানের দৃষ্টান্ত মোটেই বিরল নয়! অথচ দেখুন, ইয়োরোপে যিশু সম্বন্ধে এত নিরঙ্কুশ চিন্তা চলেছে, যা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। যে-ধর্মের মানুষের শেষ আশ্রয় বর্বরতা, সেটার দর্শনও বর্বরতা কি না, তা নিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ধর্ম নিয়ে কথা বললে যদি খুন হতে হয়, তাহলে ধর্ম মানুষকে আদতে কী শেখাচ্ছে, তা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা সকল সময়েরই দাবি।
প্রচলিত বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের পক্ষে কথা বলা, তার মহত্ত্বের প্রশংসা করা সহজ, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলা, সাহিত্য বা বিজ্ঞানের বিচারের মতো তার বিচার করা—তত সহজ নয়, তা করতে সংস্কারমুক্ত জ্ঞানের শিখরে উঠতে হয়। দেখবেন, যিশুর ধর্ম সম্বন্ধে এমন এমন কথা বলা হয়েছে, যা শুনলে ধর্মভীরু অনেকেই ভীত ও সন্ত্রস্ত হবেন। খ্রিস্টের ধর্মের ধ্বংস না হলে সভ্যতা আর অগ্রসর হতে পারছে না—এমন কথাও বলা হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্ম মিথ্যা, ঈশ্বরের পূজা আর পুতুলপূজা এক, প্রার্থনার কোনো সার্থকতা নেই, আত্মা অমর নয়, স্বর্গ-নরক আর পুরস্কার ও শাস্তি সত্যি সত্যি নেই—এমন ধরনের কথাও ইয়োরোপ-আমেরিকা বহু বহু বছর ধরে শুনে আসছে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকতে চাইলে চিন্তার অবারিত চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করা চলে না—সেটা ধর্মের পক্ষেই হোক কিংবা বিপক্ষেই হোক। ভয়ের ধর্মের লয়েই সমাপ্তি।
খ্রিস্টের ধর্মের বিলোপ যারা আকাঙ্ক্ষা করে, তারা সকল ধর্মেরই বিলোপ চায়; কারণ অন্য সকল ধর্ম হতে খ্রিস্টের ধর্ম শ্রেষ্ঠ, এটা ধরে নিয়ে যখন এটাকেও মানুষের অগ্রগতির বাধা মনে করা হয়, তখন অন্য সব ধর্মের সম্বন্ধে আলাদা উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। প্রাচীন সমস্ত ধর্মেই উপাসনা, উপবাস, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির উপদেশ রয়েছে; স্বর্গ, নরক ও অমর আত্মায় বিশ্বাস রয়েছে। আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে এই সমস্তেরই প্রাচীন মূল্য টিকবে কি? এই ধরনের ভাব ও ভাষা গ্রহণ না করেও পারা যায়, কিন্তু এতে যে সাহস প্রকাশ পেয়েছে, তা কি বিস্ময়জনক নয়? সে সাহসকে কি কোনো সম্মান দেখানো যায় না? শ্রদ্ধা করা চলে না?
এখন আমাদের কী সিদ্ধান্ত? ঈশ্বর নিজে এসে সব উত্তর দিয়ে আমাদের উদ্ধার করবেন, এর জন্য অপেক্ষা আমরা করতে পারি না। ঈশ্বর সব কিছু সৃষ্টি করে জগৎ হতে সরে পড়েছেন, এটাও ভাবতে পারি না; আর সৃষ্টিনাট্যের শেষ অঙ্কে তিনি আবির্ভূত হবেন, এটাও অকল্পনীয় মনে হয়। অনেকে ভাবতেন, ঈশ্বর সৃষ্টি করেই সরে পড়েছেন, জগৎ তারপর আপনাআপনিই চলছে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে তিনি কখনও আবার এসে একে ঠিক করে দিয়ে যান—ঘুড়িওয়ালা যেমন ঘুড়ি ঠিক করে, তেমনই। তিনি জগতে উপস্থিত নেই—আমরা এমন ভাবতে পারি না।
জগতে দুঃখকষ্ট আছে, ঠিক; তবে সেটা শেষ পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অথবা বোঝার ভুলও হতে পারে। আর দুঃখকষ্ট আছে বলেই স্রষ্টা সৃষ্টিতে উপস্থিত নেই, এমন সিদ্ধান্তই-বা হবে কেন? তাঁকে নির্দয় বলতে হবে, এমনও কোনো যুক্তি নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানে না যারা, তাদেরকেও বলতে শুনেছি—ঈশ্বর নির্দয়। যিনি নেই-ই, তিনি আবার নির্দয় হন কীভাবে? হতে হলে তো আগে তাঁকে থাকতে হবে।
সৃষ্টির বাইরে যেমন স্রষ্টাকে ভাবতে পারি না, তেমনই স্রষ্টা কখনও সৃষ্টি ছাড়া হাত-পা গুটিয়ে বেকার বসে ছিলেন, তা-ও ভাবি না। জগতের ভাঙা-গড়া সনাতন প্রবাহ। যে-জগৎ দেখছি, এটাই প্রথম ও শেষ সৃষ্টি না-ও হতে পারে। আমরা ভুলে যেন না যাই, সক্রিয় শক্তি কখনও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্টি তাঁরই মতো—অনাদি ও অনন্ত।
আর, ঈশ্বর এখনও দেখা দেননি, এটাও ভাবি না। আমাদের মতে—
বেদে রামায়ণে চৈব পুরাণে ভারতে তথা।
আদাবন্তে চমধ্যে চ হরিঃ সর্বত্র গীয়তে।।
(হরিবংশ, ২৫৫)
অর্থাৎ বেদে, রামায়ণে, মহাভারতে, পুরাণের আদিতে, মধ্যে এবং অন্তে—সর্বত্র একমাত্র শ্রীহরিই কীর্তিত হন।
ঠিক একইভাবে, সৃষ্টিতেও ঈশ্বর সর্বত্র রয়েছেন—তবে সৃষ্টির আদিও নেই, অন্তও নেই। তাই ঈশ্বর সর্বত্র ও সর্বকালে রয়েছেন—এটাই ভারতীয় দর্শনের শেষকথা; আর এটাই পাশ্চাত্য দর্শনে এখন পর্যন্ত অধিকাংশের মত—বিরুদ্ধমতসমূহ শক্ত অবস্থানে থাকলেও সর্ববিজয়ী নয়, তাদেরকে বাদ দিলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব তথা চৈতন্যের জাগরণই দর্শনের মূল আশ্রয়।