যে-জীবন মেঘের

“না, না, না, পারব না, পারব না আমি। কিছুতেই পারব না মিথ্যে অপবাদ সহ্য করতে। তুমি আমায় ক্ষমা করো, ভাইয়া। আমি এখানে বেশ সুখেই আছি। আমার জীবনকে আমি সেবার মধ্যে ভুলিয়ে রাখতে চাই। ভুলতে চাই পুরোনো সব দিন। কিছুতেই পারব না আমি নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করতে। তুমি আমাকে মাফ করো।”




“আমি যে অনেক আশা নিয়ে তোর কাছে এসেছি। তুই আমাকে এমনিভাবে নিরাশ করবি?” ভার ভার গলায় বলে জয়নুল।




“সত্যি বলছি, ভাইয়া, তোমাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য আমি খুব দুঃখিত। অনেক ভেবে-টেবে আমি চলে এসেছি। তুমি জানো না যে কতটা নিচুতে নেমে গেছে ও-বাড়ির মন। আম্মা আমাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। আমিও পারি না তাঁকে নিয়ে।”




“কিন্তু বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি একমাত্র তোর। মামি তো কিছুই পাবে না। তোর অভাবে আমরা তোদের বাড়ি যাই না। টুলুর সাথে দেখা হলে তোর কথা বলে কাঁদে। বলে যে, আমরা তোর কাছে এলে তুই হয়তো ফিরে যাবি। ও তো ওর মায়ের জন্য তোর কাছে আসতে সাহস পায় না।”




“হ্যাঁ, আমি প্রায় এক মাস আগে টুলুকে দেখেছি সামনের রাস্তা দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। আমি ওকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কাছে ডাকব, ভাইয়া। একমাত্র ওর জন্যেই আমি ও-বাড়িতে টিকে ছিলাম। ও আম্মার কাছে আমার জন্য বকা খেয়েছে। তুমি অবাক হবে যদি শোনো কেন আমি ও-বাড়ি ছেড়েছি। শুনলে হয়তো কখনও বাড়ি ফিরে যেতে বলবে না। তুমি এখন যাও, ভাইয়া। তোমাকে পরে বলব সব।”




ফরিদপুর। কুমার নদীর পাড়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু কিছু বাড়ি। ভোরের কাকলিতে জেগে ওঠে ছোট্ট শহর। সন্ধ্যার ক্লান্তিতে ঘুমোয় নীরব হয়ে।




মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক সিরাজ খান। সবেমাত্র ল পাশ করেছেন। নূতন সংসার নিয়ে ফরিদপুরে ছোটো একটা বাসা ভাড়া করলেন। মাত্র‌ই পাশ করেছেন, তাই পসার কম। তবু ছোটো সংসার ভালোভাবেই চলে যায়। ক্রমেই তিনি পরিচিত হতে লাগলেন সমস্ত মহলে। তাঁদের সংসারে একটি কন্যাসন্তান হয়ে সংসারের সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে গেল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি অফিসে থাকেন। বাকি সময়টুকু কেটে যায় ছোট্ট রাহেলার সঙ্গে। দিন চলে যায় সুখের স্রোতে।




হঠাৎ স্রোতে ভাটা পড়ল। সিরাজ সাহেবের স্ত্রী লাভলি আক্তার কয়েক মাসের মেয়েকে রেখে পরলোকে পাড়ি জমালেন। সংসারে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা। মা-বাবা’র পীড়াপীড়িতে সিরাজ সাহেব আবার বিয়ে করলেন। দিন যেতে লাগল তাঁর সংসারচক্রকে কেন্দ্র করে।




ছোট্ট রাহেলা আজ আর ছোটো নয়। এখন সে সাত বছরের। একটি ছোটো ভাই সঙ্গী হয়েছে, তার নাম টুলু। দুই ভাই-বোনের গলায় গলায় ভাব। রাহেলা তার নিজের মায়ের কথা কিছুই জানে না। সৎমাকে সে আপন মা বলে জানে। কিন্তু সৎমা মেয়েকে ভালো চোখে দেখেন না। সবসময় কড়া শাসনে রাখেন। দিন কেটে যায় স্রোতের টানে। এখন সিরাজ সাহেব হয়েছেন ফরিদপুরের একজন নামজাদা উকিল। এমন লোক নেই যে তাঁকে চেনে না।




ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে মেয়েটি। স্কুলজীবন ছেড়ে সে কলেজজীবনে গিয়ে ঢোকে। নিত্যনূতন পরিস্থিতিতে সে জানতে পারল, মায়ের ভালোবাসাটা লোক-দেখানো। অত্যাচারিত হলেও কিছুমাত্র‌ও প্রতিবাদ করবার সাহস তার নেই। দিন কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু নিয়তির বিধান কে খণ্ডাবে! অতিরিক্ত রক্তচাপে স্ট্রোক করে হঠাৎ সিরাজ সাহেব মারা গেলেন। বাবাকে হারানোর পর তার সৎমায়ের অত্যাচার সীমা ছাড়াল। তিনি সময়ে-অসময়ে সকলের সামনে তাকে অপ্রস্তুত করতে লাগলেন।




একদিন কলেজ থেকে ফিরে রাহেলা ঘরে ঢুকেছে, অমনিই টুলু বলল, “আপা একটা কথা শুনেছিস, তোর না বিয়ে। আজ তোকে দেখতে আসবে। কিন্তু তুই আমাকে কথা দে যে, এ বিয়েতে তুই কিছুতেই মত দিবি না।” অবাক রাহেলা খুব রেগে বলে, “কে বলেছে তোকে? যত সব বাজে কথা!”




“সত্যি, আপা, বিশ্বাস কর। সব সত্যি।” রাহেলা একটু রহস্য করে বলল, “বুঝলাম তো বিয়ে, কিন্তু রাজপুত্রটি কে?”




“সত্যি, আমি তোর সাথে ঠাট্টা করছি না। ওই যে দুইতলার বাড়িটা আছে না, ও বাড়িতে থাকে লোকটা। আগেও বিয়ে করেছে। অনেক সোনা আর টাকা দেখিয়ে বিয়ে করেছিল, কিন্তু এমন অত্যাচার করে যে, কেউ থাকতে চায় না। প্রথম বউটা তো কেন জানি মরেই গেল!”




“কে বিয়ে ঠিক করল?” গম্ভীর কণ্ঠ রাহেলার।




“আম্মা। তোর দুটি পায়ে পড়ি। আপা, তুই বিয়েতে মত দিস না। ওই লোকটা একটা শয়তান। কথা দে, তুই মত দিবি না।”




“আচ্ছা, তুই এখন যা।” বলে রাহেলা জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সত্যি তার বাবা মারা যাবার পর মা তাকে কারণে-অকারণে গালিগালাজ করেন। তাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছেন টাকা পাবার লোভে। উঃ, এ যে অবিশ্বাস্য! হঠাৎ পায়ের শব্দে ফিরে তাকায় রাহেলা। “আজ বিকেলে বাড়ি থেকো। কয়েক জন ভদ্রলোক আসবেন। আর কিছু নাশতার ব্যবস্থা করে রেখো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হতে পারে।”




কড়া হুকুম দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মা। রাত্রে খাবার টেবিলে বিয়ের কথা তুললেন তিনি। “রাহি, তুমি এখন বড়ো হয়েছ। আর তা ছাড়া তোমার ফুপাতো ভাই জয়নুল যে এ বাড়িতে আসে, তা নিয়ে পাড়ায় অনেক কথা উঠেছে। তাই আমি তোমার বিয়ে ঠিক করতে চাই। যারা দেখতে এসেছিলেন, তাঁরা হয়তো তাড়াতাড়ি তারিখ দিয়ে দেবেন। তুমি তোমার বান্ধবীদের দাওয়াতের জন্য লিস্টি করো।”




তাঁর কথার প্রতিবাদ করল টুলু। “কিন্তু মা, ওই জাফর সাহেব তো লোক ভালো নয়।” “চুপ করো! তোমার কাছে আমার কিছু শুনতে হবে না।” বলে ঘর থেকে বাইরে গেলেন মা।




সে রাতে রাহেলার চোখ থেকে ঘুম বিদেয় হলো। পায়ে পায়ে সে জানালার কাছে এসে পাশের ঘর থেকে শুনতে পেল মায়ের ভাই পরামর্শ দিচ্ছেন, “ওকে বিদেয় করলে বাড়িঘর সমস্ত সম্পত্তি তুই পাবি। এমনিতে কিছুতেই রাজি হবে না, তাই ওকে মিথ্যে অপবাদ দিতে হবে এবং জোর করে বিয়ে দিতে হবে।” এটুকুই সে শুনতে পেয়েছিল। আর কিছু শোনার ধৈর্য তার ছিল না।




আজ টাকার লোভে তার সৎমা তাকে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে। অসম্ভব, এ হতে পারে না! সে চলে যাবে এখান থেকে। এমনি করে করে সে নিজেকে নিঃশেষ করতে পারবে না। ঠিক আছে, নিজের যা গহনা আছে, তা বিক্রি করে সে নিজের খরচ চালিয়ে নেবে। অসহ্য এ বাড়ির জ্বালা! ওর বান্ধবী মিনুর বাড়িতে উঠে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে তাকে।




পরদিন দুপুর। আজ তার ভাগ্য নির্ণয় করার ক্ষণ। বাগানের দরজা পেরিয়ে ও রাস্তায় পা দেয়। পেছন ফিরে বাড়িটাকে দেখে নেয় একবার। আজন্মের লালনভূমি ফুলে-ভরা বাগান আর নারকেলের পাতার দোলাতে কী অপরূপ দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। এ বাড়ির নিভৃতে একটি কক্ষের মন্ত্রণাসভায় আজ তার বিচারপর্ব চলছে। সন্ধ্যায় আকদ্‌-এর শেকলে তাকে সামাজিকভাবে বেঁধে দেওয়া হবে বর্বর একটি অপরিচিতের সঙ্গে। এসব ভেবে রাহেলার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। পোষা কুকুরটা অনেক দূর অবধি কুঁইকুঁই করে এগিয়ে দেয়, তারপর বকা খেয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়।




একেবারেই নিঃসম্বল কি রাহেলা? না, আর্থিক সম্পত্তি নেই, তবে আছে টুলুর ভালোবাসায় মোড়ানো একটি মন, আর দৃঢ়তা নামের একটি শক্তি তার আবরণ। অন্তরালের রাহেলা যদি একাকী কেঁদে কেঁদে মরে, তার খোঁজ তো কেউ পাবে না। কেউই না।
Content Protection by DMCA.com