রাত কটা হবে জানি না। আকাশে আজ তারা নেই। মেঘগুলো যেন সন্ধ্যা থেকেই আকাশটাকে ঘিরে রাখবার চেষ্টা করছিল। আজ যদি আকাশে মেঘ না করত, তবে হয়তো খুব বড়ো চাঁদ উঠত। উজ্জ্বল তারায় আকাশ ছেয়ে যেত। ষোড়শী রাত্রি আজ তার অঙ্গভঙ্গির আবেশে অভিভূত করতে পারল না এই ধূলির ধরণীকে। আজ পূর্ণিমা, কিন্তু রাতের আনন্দোচ্ছ্বাসকে চুরমার করে দিয়েছে মেঘ।
বিছানায় শুয়ে সাহেদের কথা ভাবছি। জানলা দিয়ে স্পষ্ট আকাশ দেখা যায়। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আকাশটা আমাকে তিরস্কার করছে। রাস্তায় পাহারাদার ডাক ছেড়ে চিৎকার করছে আর বাঁশি ফুঁকছে। ঘুমের কোনো লক্ষণই দেখছি না। এমন তো হয়নি কোনোদিন। আমি কি পাপ করেছি? সাহেদের প্রতি কি আমি অবিচার করেছি? সাহেদ তো আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল! সেই কলেজের একাদশ শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আমরা কেউ কারও কাছ থেকে আলাদা হইনি।
সাহেদ হোস্টেলে থাকত, কিন্তু মাসের ৭/৮ দিন আমাদের বাসায় রাত কাটাত। যখন-তখন আমিও হোস্টেলে চলে যেতাম। দু-জন যখন গল্প শুরু করে দিতাম, তখন খাওয়া-দাওয়া সব ভুলে যেতাম। ছোটোবোন মিনু মাঝে মাঝে ঠাট্টা করত; বলত, “তোমাদের দু-জনের একজন মেয়ে হলে এতদিনে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে দিতে।” সাহেদ হাসত।
টেবিলের ওপর ঘড়িটা রেখেছিলাম। কিন্তু কেন জানি উঠে ঘড়িতে সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না। যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর ছটফট করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে। আমার আজ কেন এমন হলো? সন্ধ্যায় চাকর খাবার দিয়েছিল। টেবিলে ঢাকা পড়ে রয়েছে। আজ মিনু নেই। এক বছর আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে থাকলে হয়তো জোর করে তার ভাইকে খাইয়ে দিত। আমি বুঝতে পারছি, সে কাছে থাকলে আমার এ অবস্থা হতো না। সব সমস্যার সমাধান হতো। আমি কি অন্যায় করেছি? আমি হেরে গেছি? বিবেকের কাছে ভীষণভাবে পরাজিত হয়েছি? পাপের প্রায়শ্চিত্ত? কীসের পাপ?
চাদরটা গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি। এ বাড়ির কেউ হয়তো জেগে নেই। কিন্তু আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে রেহানা। রেহানা আমাকে পাগল করে তুলেছে। কিন্তু রেহানার কী দোষ? সে তো ইচ্ছে করে…নাঃ, আর ভাবতে পারি না! জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা-সাধ সমস্ত যেন একমুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল। এমনটা হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি নাহয় পাগল হয়েছিলাম। যৌবনের উন্মত্ততায় বিশ বছরের যুবকের এমন আচরণ বিচিত্র নয়। কিন্তু রেহানা? সাহেদের প্রেমকে সে কী করে অপমান করল? এত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল মন থেকে! সব মেয়ে কি এমনই হয়? আমার বোন মিনু তো এমন নয়। সে যাকে ভালোবেসেছে, তাকে ভুলতে পারেনি, বিয়ে করে ঘর করছে। রেহানাও হয়তো করত, সাহেদ যদি বেঁচে থাকত।
সাহেদ বাংলার ছাত্র ছিল, আর আমি অর্থনীতির। তার লেখা গল্প-কবিতা ক্যাম্পাসে আলোড়ন সৃষ্টি করত।
গত বছরও, তার মৃত্যুর মাত্র একমাস আগে প্রবন্ধ লিখে সে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। সে যে এমনভাবে মরবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। একদিন সন্ধ্যার কিছু পর রাস্তা পার হবার সময় একটা ট্রাক তাকে চাপা দিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার এক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ। আমি আর রেহানা অবুঝ শিশুর মতো কেঁদেছিলাম লাশের উপর পড়ে।
সাহেদ একদিন রেহানাকে বলেছিল, তোমার আমার প্রেম স্বতঃস্ফূর্ত ফল্গুধারার মতো অদম্য গতিতে প্রবাহিত হবে। তুমি আমার জীবনের অনুপ্রেরণা। সমতালে পা ফেলে আমরা অগ্রসর হব জীবনের বন্ধুর পথে। সাহেদের কোলে মাথা রেখে বলেছিল রেহানা, “কোনো শক্তিই আমাদের প্রেমকে নষ্ট করতে পারবে না। আমাদের ভালোবাসা হবে নিষ্কলুষ, পবিত্র। আমরা ঘর বাঁধব। ছোট্ট একটা ঘর।” রেহানার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল টুকটুকে একটি ছেলে।
সাহেদের মৃত্যুর পর রেহানা আসত আমার কাছে। আমিও তাদের বাসায় মাঝে মাঝে যেতাম। আমাদের মধ্যে কথাবার্তা সাহেদ সম্পর্কেই হতো—সাহেদ কী বলত, কী করত, কী তার বেশি পছন্দ ছিল, এইসব আমরা পরস্পর বলাবলি করতাম। দিনে দিনে আমি আর রেহানা ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম। বরাবরই, ছবি দেখার ইচ্ছে হলে সে আমার কাছে চলে আসত। দু-জনে সিনেমায় যাই। হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরি। কী এক অজানা আকর্ষণে আমরা একে অন্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়লাম। আমাদের এই অবাধ মেলামেশা রেহানার ঘুমন্ত চেতনাকে, তার মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা চিরন্তন নারীহৃদয়ের ভালোবাসাকে জাগিয়ে তুলল। তার এই অদ্ভুত পরিবর্তনে আমি নিজের অলক্ষেই বেশ শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম।
একদিন। সন্ধ্যার দিকে সাজগোজ করে আমার বাসায় এল রেহানা। মায়ের সাথে দু-একটা কথা বলে সোজা চলে এল আমার ঘরে। আমি কী-একটা যেন লিখছিলাম। ও এসে আমার কাছ ঘেঁষে বসল। কলমটা রেখে দিয়ে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু এমন করে এই বেশে তো সে কখনও আসেনি। তার আজকের পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যে-ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা এতদিন দেখে-আসা রেহানার মধ্যে খুঁজে পাইনি। উগ্র প্রসাধনীর গন্ধে আমার সারাশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তাকে কী বলব আমি যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কীই-বা বলা যায়?
শুধু একটি বাক্যই আমার মুখ দিয়ে বেরোল, “আজ তোমাকে ভারি সুন্দর লাগছে।” প্রত্যুত্তরে সে আমার চোখে চোখ রেখে হাসল। দু-জনার দৃষ্টি এক সরলরেখায় এসে দাঁড়াল। তার চোখে অনেক প্রশ্ন, অনেক প্রত্যাশা। মনে হল, যেন আজ আমরা পরস্পরের সঙ্গে নূতন করে পরিচিত হলাম। আর-একটু কাছে এসে সে বলল, “কই, দেখি দেখি, কী লিখছিলে! কবিতা-টবিতা নাকি?” “না, এমনি একটু খাতায় হাত চালাচ্ছিলাম আর কি! আমি কিছু লিখতে-টিখতে পারি নাকি?”
সে ঝুঁকে পড়ে আমার লেখা দেখতে লাগল। ওর কাঁধের উপর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ। একখণ্ড সাদা কাপড় তার প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো যৌবনকে ঢেকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আমার সমস্ত শরীরে এক নূতন অনুভূতি, এক জ্বালাময়ী তাড়না মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। নিজের অস্তিত্বকে আমি ভুলে যেতে লাগলাম। আমার হাতটা কেঁপে কেঁপে কাঁধ থেকে পিঠের উপর গড়িয়ে পড়ল।
আমার বিশ বছরের যৌবন যেন নিঃশেষ করে দিতে চাইল এই উষ্ণ পেলব মানবীসত্তাটিকে। কিন্তু এর বেশি আর সাহস করিনি। তার দিক থেকে প্রতিবাদস্বরূপ একটি অস্ফুট শব্দ বেরোল: দুষ্টু!
আজ সন্ধ্যায় সে এসেছিল। ইচ্ছে করেই সে আমার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়নি। অনেকক্ষণ মিশে রইল। তার উষ্ণ বুকের স্পর্শ আমাকে উন্মত্ত-পাগল করে তুলল। দু-জনের দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস এক হয়ে মিশে গেল। আমি আরও অনুভব করলাম, রেহানার সূর্যদীঘল উষ্ণ মনের অঙিনায় একটা অজগর দারুণ রোষে ফুঁসে ফুঁসে উঠল। তার সমস্ত সত্তা, নারীজীবনের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ সে আজ সমর্পণ করেছে একটা লোভী যুবককে।
কিন্তু এ কী! সাহেদ কেন এসে দাঁড়াল আমার পেছনে? আজ? এই মুহূর্তে? হঠাৎ? চিৎকার দিয়ে কেন বলছে: নিমকহারাম, বেইমান, পিশাচ! আমার সম্পদ তুমি ছিনিয়ে নিচ্ছ, লুট করছ? পরক্ষণেই যেন স্বর নীচু করে কাতর স্বরে বলছে, “ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও! তুমিও আমারই মতো জ্বলেপুড়ে মরে যাবে! মরে যাবে!” আমি নিজেকে সামলে নিলাম।
এক বিশেষ ভঙ্গিতে গা এলিয়ে রেহানা যেন মুচকি হাসছে। আমার ভাবালুতা দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে গেল। হঠাৎ করে প্রশ্ন করলাম, “রেহানা, সাহেদকে তোমার মনে পড়ে?” এই মুহূর্তে এমন একটা প্রশ্ন সে আশা করেনি। কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল। “আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি সাহেদকে ভুলে গেছি। ভুলে যেতে চাই। সাহেদের স্মৃতি আমি মুছে ফেলতে চাই মন থেকে। তোমার মাঝেই আমি সাহেদকে খুঁজে পেয়েছি।”
আমার বুকে মুখ রেখে আশ্রয় খুঁজছে এক বুভুক্ষু তরুণী।
“রেহানা, তুমি চলে যাও। তুমি আর এসো না, রেহানা। আমাকে তুমি বাঁচতে দাও, আমাকে বাঁচতে দাও।”
কিছুক্ষণ পর রেহানা চলে গেল। যাবার আগে একটি কথাই বলেছিল: কাপুরুষ!
রেহানা হয়তো আর আসবে না। তাকে আমি চিরদিনের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছি। তার আশা-আকাঙ্ক্ষা আমি চুরমার করে দিয়েছি।
“আমাকে তুমি ক্ষমা করো, সাহেদ। আমি ভুল করেছি। তোমার প্রেমের অমর্যাদা করেছি। বন্ধু হয়ে বন্ধুর এত বড়ো ক্ষতি করেছি। আমি নিষ্ঠুর, পাপিষ্ঠ, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।”