ওরা তিন জন এবং শুধু তিন জনই, কারণ মা-বাবা তো ওদের নেই-ই, তা ছাড়া ভাই-বোন বা স্ত্রী ওসব কোনো কিছুর বালাই নেই। বালাই থাকবেই-বা কোত্থেকে? উপার্জিত পয়সাকড়িতে ওদের নিজেদেরই অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয় না, তার উপর ওসব ‘বোঝা’! হ্যাঁ, ওরা আজকাল ওসবকে বোঝাই মনে করে।
আর উপার্জন! তা-ইবা কত? একজন পাশের বাড়ির এক মহাজনের রিকশা টানে; নাম রাজু। লালুটা এক-দুই-তিন পর্যন্ত শিখেছিল; সে এখন জনৈক ব্যক্তির পানের দোকানের 'ম্যানেজিং ডিরেক্টর'। আর-একজন সমীর। গাড়ির গ্যারেজে গাড়ি মোছার ‘ইঞ্জিনিয়ার’। এবং, ওরা ইত্যাদি ওসব পোস্টে সসম্মানে বহাল আছে।
সমীর ভাবছে, এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে থাকলে কি কোনো কিছুর সুরাহা হবে? “যাক! যা হবার হবে!” বলে সে রাজুকে জাগিয়ে দেয়। “কাল রাত থেকে শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছিল। ঘুম পুরো হয়নি।” বলে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে রাজু এবং একই সময়ে লালুরও ঘুম ভাঙে। তিন জনই দেখতে পায়, তাদের ‘আশ্রয়দাতা’ ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে।
মাঘ মাসের কনকনে শীত। খদ্দরের একটা শার্ট, পুরোনো মডেলের; একটা লুঙি, চেয়ে নেওয়া—তা-ও তালি দিতে দিতে ওতে সুন্দর একটা ‘ডিজাইন’ হয়ে গেছে। এ দিয়ে ওরা শীতের ঠান্ডাকে ঠেকাবে কী করে? তা ছাড়া মাঘ মাসে শীতের সম্পূর্ণ প্রভুত্ব; এবং তিনজনের অবস্থা একই রকম। রাতে যদি ওই ট্রাকটা না আসত, তবে হয়তো রাত কাটানোই দায় হতো।
এদিকটায় মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তাটা বেশ চওড়া হয়ে এসেছে। রাস্তার ডান দিকে একটা বুড়ো বটগাছ আবহমানকালের নির্বাক সাক্ষী হিসেবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর নিচে একটা হোটেল, একটা রিকশা মেরামত করার দোকান ও গুটিকয়েক পানের দোকান। এই সব কিছুকে আড়াল করে বটগাছটা কিছু জায়গা খালি করে দিয়েছে ট্রাকটার জন্য, যার নিচে কিছুটা দূরে আশ্রয় নিয়েছে এই তিনটি প্রাণী।
সকালে ঘুম ভাঙার পর পরই কালো ট্রাকটা ভুরভুর করে একরাশ কালো ধোঁয়ায় জায়গাটা আচ্ছন্ন করে ধীরে ধীরে চলে যায়। আবার ফেরে সেই কোন রাতে, যখন ওরা ঘুমিয়ে পড়ে এবং এভাবেই প্রতিদিন।
রাতে ওরা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন একসময় ট্রাকটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে একান্ত স্নেহময়ী রূপে। যেন বলতে চায়, "ইস, তোরা ঘুমিয়ে গেছিস!" তার পরে অভিমানসিক্ত সেই স্বর: “কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে, তোদের কাছে ঠিক সময়ে আসতে পারিনে। বাছারা আমার! শিশিরে ভিজে উঠলি যে! আয়, আয় কাছে আয়, আরও কাছে।”
ইঞ্জিনের গর্জনে ইতোমধ্যে ওদের হয়তো কারও ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ-মুখ রগড়ে চেয়ে দেখে, ট্রাকটা ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন ওরা যন্ত্রযানটার কাছে এসে তৃপ্তির ঘুম ঘুমোয়। মনে হয় যেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় ওরা আত্মার আত্মীয়ের পাশে।
পরের দিন বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙে ওদের এবং নিয়মমাফিক ট্রাকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। শীতের শিশির ঝরছে আকাশের গা বেয়ে। ট্রাকটার শরীরে বিন্দু বিন্দুভাবে শিশির জমা হচ্ছে। কোথাওবা বিন্দু ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সমীরের পর ওরা দু-জনে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরল এইমাত্র। এসে দেখে, সমীর কী যেন ভাবছে।
“কীরে, অমন গুমরো হয়ে আছিস কেন?” রাজুর প্রশ্ন।
“নাঃরে! মার কথা মনে পড়ে।” সমীরের দীর্ঘশ্বাস এবং কণ্ঠে নির্লিপ্ততা।
“তাহলে ওই ট্রাকটার দিকে চেয়ে আছিস যে?” রাজুর কৌতূহল আরও বেড়ে যায়।
“হ্যাঁ, ও-ই তো আমাদের মা।” বলতে বলতে সমীরের কালো চোখজোড়া বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে রাজু এবং লালু কথাটার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং রুদ্ধকণ্ঠে একইসঙ্গে উচ্চারণ করে: ‘মা’!
হঠাৎ ওরা চমকে ওঠে ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দে এবং তখনই ড্রাইভারের কণ্ঠ শুনতে পায়। “এই যা! সর! দেখতে পাচ্ছিস না? বাপ-দাদা’র ঠিকানা নেই, এখানে আসে ঘুমোতে। সরকারি জায়গা কিনা!” এবং, কিছু মনে না করে ওরা সরে দাঁড়ায়, কারণ অভ্যেস হয়ে গেছে।
সত্যি, ওদের দেখলে মনে হবে যে, ট্রাক এবং ওরা কেমন একটা দৃঢ় সূত্রে আবদ্ধ। ওদের যুক্তি হচ্ছে, উভয়ই তো আশ্রিত!
চিরাচরিত নিয়মে দিন গড়িয়ে রাত এল এবং গভীর হলো। ওরা সবাই ঘুমিয়ে। কে যেন ওদের নীরবে ইশারা করছে সরে যাবার জন্য।
সমীরের ঘুম ভেঙে গেছে। চেয়ে দেখে, দূরে ওদের ‘আশ্রয়দাতা’ ট্রাকটা আছে। হেডলাইট দুটো ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর হচ্ছে…অবশেষে বৃহত্তম। তীব্র আলোয় দেখতে পেলো রাজু, লালু ঘুমিয়ে আছে অচেতনভাবে। সুতীব্র আলোর পর হঠাৎ অন্ধকার। পৃথিবী বুঝি খানিকটা দুলে উঠল। উঃ মা গো…! তারপর আবার নিস্তব্ধ, নিঝুম।
সমীর যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, তাদেরই মতো অসহায় পরাশ্রিত ট্রাকটার মায়াভরা মুখটি মাতৃত্বের অমানুষিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেছে।