সেদিন মিস্টার চক্রবর্তী তাঁর সহকারীর সাথে সোফায় বসে বসে স্থির করলেন, তিন তারিখেই কক্সবাজার রওনা হবেন। আলোচনার শেষে, যে-সব শিল্পীকে সাথে করে নিয়ে যাবার কথা ছিল, খবরটা তাদের পৌঁছে দেবার জন্য উঠে পড়লেন।
তাঁর পুরো নাম অমিয় চক্রবর্তী। বলতে গেলে, এ নামেই দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলে তাঁকে চেনে। শুধু চেনেই নয়, অমিয় চক্রবর্তী পরিচালিত প্রত্যেকটি ফিল্মের প্রশংসায় দেশের গুণীসমাজ আজ পঞ্চমুখ। বিদেশেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। অমিয় চক্রবর্তী—ফিল্ম ডিরেক্টর।
ইদানীং তিনি একটা নতুন ছবি তৈরি করছেন। নাম দিয়েছেন ‘প্রজাপতি’। ছবিটার নব্বই ভাগ শ্যুটিং আউটডোরে হচ্ছে। কাহিনির একটা দৃশ্য চিত্রায়িত করার জন্য তিনি কক্সবাজারে লোকেশন ফেলেছেন। দৃশ্যটা হচ্ছে: গ্রামের মানুষ দুর্দিনে না খেয়ে মরছে। আর সেই মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, তাদেরকে কবর দেবার মতো মানুষও অবশিষ্ট থাকছে না। তাদের কারও লাশ কুকুরে খাচ্ছে। কোনো কোনো লাশ সমুদ্রের তটে পড়ে আছে। জোয়ার এসে সেসব মৃতদেহ দূরে, বহুদূরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দলবল নিয়ে চক্রবর্তী এসে উঠলেন কক্সবাজারের ডাকবাংলোয়। সাথে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মাঝে রয়েছেন জনপ্রিয় নায়িকা শুভ্রা সেন (বর্তমানে ‘প্রজাপতি’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছেন), আর রয়েছেন প্রমিলা দেবী। প্রমীলা দেবী বয়সে চক্রবর্তীর চেয়েও বড়ো। বহুদিন ধরে চিত্রজগতে কাজ করছেন। তিনিও একদিন খুব নামিদামি নায়িকা ছিলেন। এখন বুড়ো হয়েছেন, মা-দিদিমার চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রায়ই কথার ফাঁকে ফাঁকে হেসে বলেন, একদিন যখন…অর্থাৎ সেই আগেকার পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ।
পাঁচ তারিখ চক্রবর্তী দলের সবাইকে নির্দেশ দিলেন, আগামীকাল সমুদ্রসৈকতে শ্যুটিং হবে। আর আগামীকালকের দৃশ্যটা হচ্ছে: সমুদ্রসৈকতে বুভুক্ষু মানুষ মরে পড়ে আছে। জোয়ার এসে সেসব মৃতদেহ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে।
পরদিন সকলে তৈরি হয়ে বসে আছেন জোয়ারের অপেক্ষায়। জোয়ার এলেই কাজ শুরু হবে। চক্রবর্তী ভাবগম্ভীর বেশে ক্যামেরার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছেন। হাতের দামি সিগারেট পুড়ে ছাই হচ্ছে। শিল্পীদের কেউ কেউ এ-কথা ও-কথা বলে সময় কাটাচ্ছেন। তাদের মৃদুগুঞ্জনধ্বনি বাতাসের হালকা ছাওয়ার সাথে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কথার মাঝখানে প্রমীলা দেবী স্বভাববশত নিজের পুরানো দিনের কথা শুরু করলেন। আর শুরুও করলেন তার সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে—একদিন যখন…
তারপর—আমি তখন নতুন অভিনয় করছি। ছোটোখাটো চরিত্রে। বয়সই-বা আর কত ছিল! এই ধর, পনেরো-ষোলো হবে। আমরা তখন থাকতাম নবাবগঞ্জে। 'আমরা' মানে মা, আমি আর আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
সেই আত্মীয়টি একদিন মাকে এসে বলেন, “কলেজের ছাত্ররা মিলে একটা নাটক করছে। ওরা প্রমীলাকে দিয়ে অভিনয় করাতে চায়।” মা ভেবেচিন্তে বলেন, “পয়সাকড়ি কীরকম দেবে?” উনি বললেন, “ছেলেদের হাতে তেমন টাকাপয়সা নেই। তবে টাকা কুড়ি দিতে রাজি আছে।”
এই বলে প্রমীলা দেবী কিছুক্ষণ প্রাণখুলে হাসলেন। একসময় হাসি থামিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, তখনকার দিনে কুড়ি টাকাই ছিল যথেষ্ট পয়সা। আমার মায়ের মুখে তো শুনেছি, তিনি নাকি জীবনের প্রথম অভিনয় করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সর্বসাকুল্যে পাঁচ টাকার একখানি নোট। এখন তো বাবা…থাক, সেকথা।
আমিও রাজি হয়ে গেলাম সেই কলেজের নাটকে অভিনয় করব বলে। কলেজটা আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল। আর সেই নাটকে আমাকে ওরা যে-চরিত্রটি দিয়েছিল, সেটি ছিল একটি বাঈজীর চরিত্র। আমি তাতে খুব ভালো অভিনয় করেছিলাম। বলতে গেলে, ওই নাটকে অভিনয় করেই আমার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই নাটকে অভিনয় করার সময় একটি ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়। তার নাম ছিল মৃণাল। কলেজের বিএ ক্লাসে পড়ত। দেখতে খুব সুন্দর ছিল। টানাটানা চোখ। তার ঠিক উপরে কৃষ্ণকালো ঘন ভ্রূ। শুভ্র ললাটটি ছিল চওড়া। মাথার শুকনো চুল সবসময় অগোছালো থাকত। একটু বাতাসেই উলটে-পালটে কপালে এসে পড়ত। চোখের দৃষ্টিতে মনে হতো, বড়ো সহজ, বড়ো সরল।
মৃণাল আমার বিপরীতে নায়কের রোল করেছিল। এর আগে সে কখনও নাটকে অভিনয় করেনি। তাই অঙ্গভঙ্গি এবং কথাবার্তার মধ্যে বেশ কিছুটা জড়তা ছিল, যেন ঠিক ফ্রি হতে পারছে না। ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লাগত। কেন জানি এক অদৃশ্য শক্তির মতো সে আমাকে টানত। আমার যৌবনে-ভরা প্রাণের সিন্ধুকূলে তার ছবি, তার চিন্তা বার বার ঢেউ খেলে উঠত। আমি মনেপ্রাণে তাকে ফ্রি করে তোলার জন্য সহায়তা করতাম। এমনকি রিহার্সালের শেষে নিজে সেধে তাকে পার্কে কিংবা লেকের ধারে নিয়ে যেতাম। কত কথা বলতাম, কত গল্প করতাম। আর লক্ষ রাখতাম, সে কতটুকু সহজ হতে পেরেছে।
আসলে আমারও ভালো লাগত ওর সাথে দুটো কথা বলতে, ওর দুটো কথা শুনতে। মোট কথা, আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। সে-ও তো যুবক। তারও শরীরের রক্তে তখন উষ্ণ প্রবাহ। ধীরে ধীরে উভয়ের যৌবনের প্রবল তাপে একে অপরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মৃণাল আমার হাত ধরে স্বীকারোক্তি করল, “প্রমীলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” আমি মেয়েমানুষের সেই প্রাচীন কথায় জবাব দিলাম: “বলো, আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না!”
একসময় নির্দিষ্ট দিনে নাটকটির মঞ্চায়নও সমাপ্ত হলো। তবুও মৃণাল আর আমার রোজ দেখা হতো। কিন্তু একটা জিনিস মৃণাল আমার চোখ থেকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আমি দেখতাম, মৃণাল যতক্ষণ আমার সাথে থাকত, ততক্ষণ হয় এদিক-ওদিক সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে বার বার তাকাত, নতুবা পেছনে কোনো কিছুর শব্দ হলেই চমকে উঠত। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেসও করলাম, “আচ্ছা মৃণাল, তুমি অমন চমকে ওঠ কেন?” সে শুধু হাসল আর অস্ফুট স্বরে বলল, “কই না তো!” আমি মুখ ভার করে রইলাম। মৃণাল বুঝতে পারল, আমি অভিমান করেছি। সে আমার মান ভাঙানোর জন্য অবশেষে বলতে রাজি হলো কেন অমন করে চমকে ওঠে। শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
প্রমিলা দেবী কথা থামিয়ে একদৃষ্টে সবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই দৃষ্টিতে তাঁর থ হয়ে যাবার ভাবটি স্পষ্ট ধরা পড়ছিল যেন, এতদিন পরেও। মুখের ওপরে একে তো মেকআপ, তার উপর এই নির্বাক বিস্মিত দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল, প্রমিলা দেবী অভিনয় করছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার শুভ্রা সেনকে লক্ষ করে সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গল্পের বাদবাকি অংশ শুরু করলেন।
জানিস, মৃণাল কী বলল? বলল, তার মা-বাবা’র কানে কেমন করে জানি আমাদের ভালোবাসার কথাটা পৌঁছেছে। আর তাই সে খুব সতর্ক হয়ে চলে, যাতে ওঁদের কারও সামনে ধরা না পড়ে।
প্রমীলা দেবী আবার থামলেন এবং কিছুক্ষণ পর কণ্ঠস্বর চিন্তাভারগ্রস্ত করে বলেন, আসলে মৃণাল আমার প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু গভীরভাবে ভালোবাসতে পারেনি। সবসময় চেষ্টা করত ওর-আমার ভালোবাসার কথা গোপন রাখতে। ভাবখানা যেন এই: আমার সাথে ওর সম্পর্ক একটা অবৈধ সম্পর্ক। লোকে শুনলে যেন গঞ্জনা পেতে হবে। তবুও আমি তাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতাম। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম।
এমনি করে দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন ওর এক বন্ধুর মুখে জানতে পারলাম, ও উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশ যাচ্ছে। পরের দিন তার সাথে দেখা হলে সে নিজেই আগে ভূমিকা দিয়ে বলল, “আমি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি, প্রমীলা! আমাকে আগামী পনেরো তারিখে বিলেত যেতে হচ্ছে। একটা ডিগ্রি নিয়ে বছরতিনেক পরেই চলে আসব।” আমি মাথাটা ওর দুইহাঁটুর মাঝে রেখে চুপ করে রইলাম। মৃণাল আমার শুকনো চুলে হাত দিয়ে সান্ত্বনা বাক্যের মতো কতগুলো শব্দ বলল, যার একটিও আমার কানে ঢোকেনি।
যেখানে আমরা তখন বসে ছিলাম, সেখানটায় একটা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল। তারই কোনো এক ডাল থেকে সমাসন্ন সন্ধেবেলার আভাস পেয়ে একটি দাঁড়কাক ভাঙা ভাঙা ডাক তুলে উড়ে যাচ্ছিল। তারপর অন্ধকার নেমে এলে কেউ কারও মুখ স্পষ্ট করে দেখতে পাইনি। তাই হয়তো মৃণাল বুঝতে পারেনি, সেদিন নীরব ব্যথায় আমার সমস্ত অবয়ব কতটা বিবর্ণ হয়েছিল। আমার প্রতিটি অঙ্গ যেন দেহ থেকে শ্লথ হয়ে আসছিল।
কথাগুলো প্রমীলা দেবী এত দ্রুত বলে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন যন্ত্রণায় জ্বলছেন। তিনি বলে চললেন…
অবশেষে পনেরো তারিখ এল। বুধবার। রাত সাড়ে এগারোটার প্লেনে মৃণালের যাবার কথা। মাকে মিথ্যে কথা বললাম: আমার এক বান্ধবীর বাসায় নিমন্ত্রণ আছে, ফিরতে দেরি হবে। সন্ধেবেলায় এসে এয়ারপোর্টে বসে রইলাম। সময় যেন তার হাঁটু ভেঙে ফেলেছে, তাই খুঁড়িয়ে চলছে। এক-একটা মিনিট যেন এক-একটা যুগের চেয়েও বেশি মনে হতে লাগল। ঠিক সোয়া দশটায় মৃণাল ওর মা-বাবা এবং আরও অনেক লোকজন নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। আমাকে সে প্রথমেই দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু না দেখার ভান করল। এবং দূরে দূরে থাকতে লাগল। তার চোখে-মুখে কেমন যেন একটা শঙ্কার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে সে এড়িয়ে যেতে চায়। তার ভাবগতিক দেখে আমার করুণা হলো। আমিও কাছে গেলাম না।
আগের দিন মৃণাল আমাকে বিমানবন্দরে আসতে বারণও করেছিল। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল, “মা-বাবা সবাই আসবেন। তুমি গেলেও তো দুটো কথা বলা যাবে না।”
আসলে সমাজে আমরা যেন কতগুলো বেআইনি অস্ত্র। আমাদের সাথে আড়ালে-আবডালে ফস্টিনস্টি করা যায়, আমাদের দিয়ে প্রমোদস্পৃহা মেটানো যায়, কিন্তু আমাদের সাথে প্রকাশ্য সম্বন্ধ রাখা মানে ধরা পড়লে নির্ঘাত জেল! আমাদের কেবল অপশন হিসেবেই রাখা যায়, প্রায়োরিটি করা যায় না কিছুতেই।
তারপর প্রমীলা দেবী চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে কাঁপা-কাঁপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মৃণাল সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিয়ে প্লেনে উঠে গেল। আর তাকে তুলে দেবার সময় সঙ্গে-আসা একজন যুবতী মেয়ে তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মৃণাল তার কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলল, বোঝা যায়নি। তবে স্পষ্ট শুনতে পেলাম, বিদায় নেবার সময় সেই মেয়েটিকেই মৃণাল বলে, “লক্ষ্মীটি, মন খারাপ কোরো না।” আমার দিকে একটি বারও তাকাল না।
কিন্তু আমি নিমেষহারা চোখে ওকে দেখছিলাম। এমনকী সে প্লেনের ভেতর ঢুকে গেলেও আমি ফিরতে পারছিলাম না। ধীরে ধীরে প্লেন যখন তার পাখা চালাল, আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই শব্দ আমার কানে এসে প্রবলভাবে বাজছিল। যেন বুকের পাঁজরগুলোর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে হু-হু করে বয়ে চলেছে সেই আওয়াজ। আমার বুকের শ্বাস বুকে চাপ খেয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি শীতল বেদনায় মুহ্যমান হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম হুঁশ ছিল না। চেতনা ফিরলে দেখি, রাত সাড়ে বারোটা।
বিমানবন্দরের বাইরে তখন কতগুলো রিকশা-স্কুটার সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভাররা হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করছে। একটা রিকশায় উঠে বসলাম। যাকে আমি তারই আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে আমার পুরো পৃথিবী বানিয়ে বসে আছি, আমি তার পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি অংশ বাদে আর কিছু নই। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এই রোগ যেন আর সারবে না। চোখে সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছিল। নির্জন রাস্তার পাশ দিয়ে তখন দু-একটা কুকুর অলস পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আর ট্রাফিক পুলিশের দাঁড়াবার সেই শূন্য জায়গাগুলো অসীম অন্তরীক্ষের দিকে উদাস চোখে চেয়ে চেয়ে কী যেন ভাবছে।
এমন সময় হঠাৎ মিস্টার চক্রবর্তী চেঁচিয়ে উঠলেন। “সবাই তৈরি হও! ওই দ্যাখো, জোয়ার আসছে।” বলেই ক্যামেরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।