অণুস্মৃতি

পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক প্রথমে নাকটা মুছলেন, তারপর বেঁকে-যাওয়া বুড়ো দেহটাকে একটু সোজা করে বললেন, “কিন্তু বাবা, আসল কথা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। আমাদের যুগে লোকে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন’কে চিনত। দেখলে কুশল জানতে চাইত। বাপ-মা’কে সম্মান দেখাত। এখন সে সবের ধার কেউ ধারে না। সব স্বার্থপর, ঘরকুনো জানোয়ার! ছোঃ!”




“ঠিকই।” সায় দিলাম।




“তোমাদের দেশে মনে হয় কৃত্রিমতা এতটা নেই?” বুড়ো বললেন আবার।




“না, অন্তত আমেরিকার মতো নেই।” স্বীকার করলাম।




“এ-ই আর কি! বয়স সত্তর পেরুল। এখন এসব আজগুবি চাল দেখার জন্য একা একা বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সবাই তো গেল। এখন আমি শুধু অপেক্ষা করছি কাঠের বাক্সে শুয়ে চার্চে যাবার জন্য। অপেক্ষা আর অপেক্ষা।”




হেঁটে চলছিলাম আমরা গ্রাম্য পথে। দু-দিকে কখনো ফসলের খেত, কখনো পতিত জমি, কখনো ঝোপ-ঝাড়। যে-দেশেরই হোক, গ্রাম হচ্ছে গ্রাম‌ই। সেই একইরকম আপন, সহজ, সুন্দর।




প্রবাসী আমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছুটিতে চলেছিলাম ‘হিচহাইকিং’-এ। হঠাৎই দেখা পাওয়া এই বৃদ্ধের সাথে—কাঁধে তার ছোট্ট এক ঝোলা। তাঁর চলায়, তাঁর বলায় সহজ-স্বাভাবিক গ্রাম্য সরলতা।




আমেরিকানরা বাদামি চামড়া দেখলে আশ্চর্য হয়। তবে এখানকার গ্রামাঞ্চলে উগ্র বর্ণবাদ মোটেই নেই, ফলে কেউ নাক সিঁটকায় না। তেমন লোক হলে তো বেশ খাতিরই জমে যায়। এই বৃদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। অল্পই সময় লাগল খাতির জমতে।




বৃদ্ধ আমাকে শুধু বলেই চললেন। তাঁর সব কথার সার এই যে, দুনিয়াটা তাঁকে বিদায়-সালাম জানিয়ে দিয়েছে—ট্রেন আসতেই যা বাকি। “দেখো,” বুড়ো বললেন, “ঈশ্বর নাকি ছয় দিনে দুনিয়াটা সৃষ্টি করে সাত দিনের দিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ঈশ্বরই হয়রান হলেন। আর আমি তো আমি। আমি মস্ত একজীবন কাটিয়ে এখন ক্লান্ত।”




একসময় আমার দিকে একটা রসালো আপেল বাড়িয়ে বললেন, “নাও, বাবা, অ্যানির নিজের গাছের আপেল। চমৎকার!” দ্বিধা না করেই নিলাম, তাঁকে খুশি করতে; তবে আসলেই ফলটা চমৎকার।




ওদিকে বৃদ্ধ শুরু করলেন অ্যানির কথা। “সে একটা সেরা মেয়ে। জানো? তার বয়স ছেষট্টি, কিন্তু এখনও সে গাছে উঠতে পারে।” স্বীকার করতেই হলো যে, এটা একটা যা-তা কথা নয়। অ্যানির কথা চলতেই থাকল। এত উৎসাহের সাথে তিনি বলছিলেন যে, আমি সেই অপরিচিতা বৃদ্ধা মহিলার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখিয়ে পারলাম না।




“তাহলে ছেলে তাঁর দুটো?”




“আরে হ্যাঁ, আর মেয়েও একটা আছে, কিন্তু তা বলে কে খোঁজ রাখে ওই বুড়ির? বড়োদিনের সময় আসে, অন্য কোনো বড়ো উৎসবেও আসে, ব্যস ওই পর্যন্তই।”




“আপনার ছেলেপিলে আছে না?” হঠাৎ প্রশ্ন করেই একটু সঙ্কুচিত হলাম। “আছে। ছেলে একটা, মেয়ে একটা; দুটোই আস্ত ইবলিশ। চুলোয় যাক সব।” প্রসঙ্গটা চাপা পড়ল।




পথেই পড়ল একটা জিপসি ক্যারাভান। বিশ্রাম নিচ্ছে গ্রাম্য পথের পাশে। তাদেরই কেউ বেহালা বাজিয়ে গাইছে:




ভেবেছিলে গাছটা গেছে মরে,
আজ দেখো তার ডালপালাতে
এসেছে সবুজ পাতা।




একটা দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে বুড়ো আমার কথা জানতে চাইলেন, কিছু বললাম। যখন যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন এটা মনে করে যে, তাঁর পাশের এই বাদামি চামড়ার ছোকরা সম্পর্কে তাঁর বেশ জানা হয়ে গেছে, তখন বুড়ো আবার তাঁর নিজের দিকে তাকালেন।




“বুঝলে,” বলে চললেন তিনি, “এক হিপ্পি ছিল বড় রোমান্স আর সঙ্গপ্রিয়, থ্রিলের ভক্ত। অসুন্দর ছিল তার প্রিয়, কুপরিবেশ ছিল তার জন্য আরামপ্রদ। একমুহূর্ত‌ও কার‌ও সাথে কথা না বলে, কোন হ‌ইচ‌ই না করে, উত্তেজিত না হয়ে সে থাকতে পারত না। তারপর তারও তো একদিন মৃত্যু হলো। খুশি হয়ে চলল সে জাহান্নামের দিকে। আহা! ভাবল সে, কত নতুন উত্তেজনাই-না সেখানে অপেক্ষা করছে!”




“আচ্ছা।”




“কিন্তু বেরসিক ঈশ্বর তাকে পাঠিয়ে দিলেন স্বর্গের নিভৃততম, সুন্দরতম, জনহীন পরিবেশে। বেচারা কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারল না। যন্ত্রণার একশেষ। এখনও সে নাকি সেখানে ভোগ করছে নরকযন্ত্রণা!”




“আমেরিকানরা ভালো কৌতুক বলে।” হাসতে হাসতে বললাম।




“না, বাবা, কৌতুক নয়।” হাসতে হাসতেই তিনি বললেন, “ওই হিপ্পিটার মতো আমিও এই দুনিয়াতে বড় বেখাপ্পা—নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি দিনরাত।”




সমস্ত জগতের প্রতি বৃদ্ধের অভিমান। তাঁর সাথে খাপ খায়, এমন কিছুই নেই। তাঁকে বুঝতে পারে, এমন কেউই নেই। যেন এক বৃদ্ধ একদিকে, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সমস্ত দুনিয়া।




“কিন্তু অবশ্যই অ্যানি বাদে!—এ কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম!"




“আমি আর সে তো একই রকম, কেউ তাকায় না আমাদের দিকে।”




পথে এক ছোট্ট কাঠের সেতু। তার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনা একটা। আশেপাশে সবুজ গাছ। চেরি, চেস্টনাট, একটা ফার—আশ্চর্য সুন্দর।




কিছু দূরে দেখা গেল, একঝাঁক যাযাবর পাখি হল্লা করছে। পাখিগুলো সাদা, লম্বাটে গলা। ওদের গলাফাটানো হ‌ইচ‌ই শুনে মনে হয়, ইসরাফিল শিঙায় ফুঁ দিয়ে ফেলেছে। “দেখতেই এরা খাসা,” বৃদ্ধ বললেন, “কিন্তু খেতের পর খেত এরা সাবাড় করতে পারে। আর চিৎকার দেখেছ? মনে হয়, ঈশ্বর দুনিয়াটা এদের কাছে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে দিয়েছেন। বরং আমরাই এখানে উটকো!”




এরপর আমরা চলে এলাম শান্ত এক জায়গায়। “তোমাকে বলেই ফেলি।” বৃদ্ধ গলা একটু উঁচুতে চড়িয়ে বললেন, “আমি আজ বিকেলে অ্যানির কাছে যাব আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আজকের দিনটা বড়ো সুন্দর।” অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। বুঝতে পারলাম না, সে বৃদ্ধ, না তরুণ।




রাস্তায় থেমে তিনি তাঁর ঝোলা থেকে একটা মেয়েলি হ্যাট বের করলেন। “দেখো তো অ্যানিকে মানাবে কি না।”




“বেশ মানাবে।” খুশি হয়ে বললাম, যদিও জীবনে তাঁকে আমি দেখিনি।




“আমরা চলে যাব আমার ছোটো বাড়িতে। সেখানে বেশ সময় কাটবে, হয়তো শেষদিন পর্যন্ত।” বেশ শান্তভাবে তিনি বললেন। আমি জানি, তিনি পরিকল্পনা আঁটছেন অনেক কিছুর আর সেইসব দিনের, যে-সব দিন তাঁদের দু-জনের কাটবে স্মৃতি রোমন্থন করে করে। গলফ খেলবেন, কিংবা শাক-সবজির খেতে পানি দেবেন দু-জন। সকালে খবরের কাগজ পড়বেন, দুপুরে অল্প ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলে হাঁটতে বেরুবেন, রাতে টিভি দেখবেন। শান্ত, নিরুদ্‌বেগ জীবন।




এরপর আর তেমন কথা হয়নি। সবজিখেতের পাশ দিয়ে চলেছি। দু-পাশে প্রচুর টম্যাটো, বাঁধাকপি আর মটর। বাতাসে দুলছে গাছগুলোর সবুজ পাতা আর মুকুল। সবখানে যেন জীবনের গান।




পথের বাঁকে আমরা বিদায় নিলাম। আমাকে ধন্যবাদ দিলেন তিনি তাঁর কথাগুলো শোনার জন্য। আমার জন্য তাঁর ঈশ্বরের আশীর্বাদ কামনা করলেন। চললাম যে যার পথে। সে-ই প্রথম, সে-ই শেষ—তাঁর সাথে আর কোথাও কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু সেই চমৎকার স্মৃতি আজ‌ও অম্লান।
Content Protection by DMCA.com