কিছুক্ষণ আগেও রোদ ছিল। ছিল সূর্যের প্রখরতা। হঠাৎ করেই রাশি রাশি কালো মেঘ কোত্থেকে এসে আকাশটা ভরে দিল। সূর্যটা যেন মেঘের অরণ্যে হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে সূর্যটা একটু যেন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। রোদের প্রচণ্ড তাপে যাদের গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল, শীতল হাওয়ার সংস্পর্শে এসে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
কাশেমও মনে মনে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। কাশেম একটা টিফিন-ক্যারিয়ারে সাহেবের অফিসে ভাত নিয়ে যাচ্ছিল। প্রখর রোদের তাপে তার শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছিল। আকাশে কালোমেঘ জমে ভারী হচ্ছে। মৃদু শীতল হাওয়া বইছে। অবস্থা বুঝে মনে হচ্ছে, যে-কোনো সময় প্রবল বেগে বৃষ্টি নামতে পারে। বাতাসের বেগটা ক্রমশ বেড়ে চলছে। কাশেম বার বার আকাশের দিকে তাকায়। সে দ্রুত পা চালাচ্ছে।
বারো বছরের ছেলে এই কাশেম প্রতিদিন অফিসে সাহেবের ভাত নিয়ে যায়। আপনজন বলতে তার একমাত্র মা। মায়ের রোজগারে সংসার ঠিকমতো চলে না। সেজন্য কাশেমকে অফিসে সাহেবের ভাত নিয়ে যেতে হয়। মা-ছেলে’র রোজগারে পেটে-ভাতে তাদের দিন একরকম চলে যায়। কাশেমের বাবা থাকলে হয়তো তাকে খাটতে হতো না। মাঝে মাঝে তার মনটা বিতৃষ্ণায় আর আক্রোশে ভরে ওঠে। কোথায় সে দিন-রাত মনের আনন্দে হেসেখেলে বেড়াবে, ওদের এলাকার নাজিরের মতো পড়া-লেখা করবে; তা না, তাকে কাজ করতে হয়। অথচ তার সাথের আর সব ছেলে সারাদিন মার্বেল-হাডুডু-তাস খেলে দিন কাটায়। নাজির, রশিদ, মাইনকা, কালা, বেঙ্গা সকলের তো বাবা আছে। ওদের কোনো চিন্তাই নেই, কিন্তু কাশেমকে ভাবতে হয়।
একদিন কাশেম তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা মা, হগ্গোলের বাপ আছে, কিন্তু আমার বাপ কই, মা?” কাশেমের মা রেগে তিক্ত-স্বরে জবাব দিয়েছিল, “তোর বাপে চইল্যা গ্যাছে। হেয় আমারে তালাক দিছে।”
“হেইডা আবার কী জিনিস, মা?”
কাশেমের মায়ের মেজাজটা এমনিতেই খিটখিটে ছিল। ছেলের এই কথায় সে আরও রেগে যায়। চেঁচিয়ে, গাল দিয়ে বলে, “তোর বাপে আর-একটা বিয়া কইর্যা আমারে খাওয়াইতে-পরাইতে না পাইরা ছাইড়্যা দিছে, বুজছস?”
“হালার বাপ!”
কাশেমের কচি মনে তার বাবার প্রতি একটা ঘৃণা জেগে ওঠে। কাশেম দ্রুত পা চালায়। আকাশে মেঘ ভারী হয়ে জমেছে। যে-কোনো সময় প্রবল বেগে বৃষ্টি নামতে পারে। পথ চলতে চলতে কাশেমের মনে তার অসুস্থ মায়ের স্নেহভরা করুণ মুখখানি ভেসে ওঠে। মায়ের স্নেহের ছায়াতলে থেকেই তো সে আজ জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ। লেখা-পড়া করার খুব শখ তার। কিন্তু যে-হাতে থাকত কলম, সেই হাতে সে তুলে নিয়েছে জীবনধারণের হাতিয়ার। নাঃ! কাশেম বেশ চিন্তিত। বেশ কয়দিন থেকে তার মা জ্বরে ভুগছে।
পথ চলতে চলতে কাশেম মাকে ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবে—তাকে ওষুধ কিনে খাওয়াতে হবে। কিন্তু হাতে যে কোনো টাকা-পয়সাই নেই। কীভাবে যে কী করবে, সে কিছু বুঝতে পারে না। মাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সে আশেপাশে অনেকের কাছে টাকা ধারও চেয়েছিল। কিন্তু কেউ দেয়নি, দেবেই-বা কেন? সবাই যে ওদের কাছে কিছু-না-কিছু পায়। তার উপর প্রায় সবাই-ই তো অভাবী, কে কাকে কী দেবে! একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে কাশেম।
“মার চাইর দিন ধইরা জ্বর। ডাক্তার দেখাইতে হইলে অনেক টেকা লাগে। হালার সরকারি ডাক্তারখানায় লইয়া গেলে একশিশি পচা লাল পানি আর হস্তা দামের কতগুলি টেবলেট দেয়। হেইডা খাইলে কুনু কাম হয় না।” ভাবনার একঝাঁক পায়রা কাশেমের মনের মাঝে এলোপাথারিভাবে উড়ছে। সে কোনো কিছু স্থির করতে পারছে না। কাশেমের কেন যেন মনে হয়, তার মা আর বাঁচবে না। “মা যদি মইরা যায়, তাইলে আমি থাকমু কার কাছে? কেডা আমারে আদর করব?” অজানা অমঙ্গল আশঙ্কায় কাশেমের বুকটা দারুণভাবে নাড়া খায়। তার কচি মনে বার বার ভেসে উঠছে মায়ের মলিন মুখখানি।
একদিন রাতে কাশেম তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা মা, কও তো দেহি, মানুষ কেমনে মরে?” “হুন কাশেম, আল্লার হুকুম অইলে আজরাইল নামে একটা ফিরিশতা মানুষের বুকের থনে জানডা ছিঁইড়া লইয়া যায়।” তখন কাশেম আঁতকে উঠেছিল ভয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে একটা বাসস্টপের কাছে এসে পড়ে কাশেম। ইতোমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। কাশেম জোরে দৌড় দেয় বাসটা ধরার জন্য। হয়তো বাসটা ধরতে পারলে সে বৃষ্টি থেকে বেঁচে যাবে। আগে অনেক বার বাসে চড়ে সে অফিসে গিয়েছিল, কিন্তু পয়সা না থাকলে কন্ডাক্টর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। সেজন্য কাশেম পয়সা ছাড়া বাসে উঠত না।
কিন্তু আজ তাকে উঠতেই হবে। বৃষ্টি ভালোভাবে শুরু হলে হয়তো সে যেতেই পারবে না। সে দৌড়ে এসে উঠতেই বাস ছেড়ে দেয়। চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল ধরে ওঠার সময় হেলপার তাকে “অই হালার পুত, নাম!” বলে একটা ধাক্কা দেয়। হ্যান্ডেল থেকে হাত ফসকে কাশেম রাস্তার উপর পড়ে যায়। তখন প্রবল বেগে বৃষ্টি নামে। কাশেমের হাত থেকে টিফিন-ক্যারিয়ারটাও ফসকে পড়ে যায়। ত্বরিতগতিতে উঠে কাশেমের চোখে পড়ে, তালাবন্ধ টিফিন-ক্যারিয়ারটা বাসের চাকার তলায় পড়ে চেপটে গেছে।
টিফিন-ক্যারিয়ারের এই অবস্থা দেখে তার ভেতরটা কেমন জানি করে ওঠে। সাহেবকে সে কী জবাব দেবে? পড়ে গিয়ে হাঁটু-কনুই ছড়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে কোনো নজর নেই। চ্যাপটা টিফিন-ক্যারিয়ারটা তাড়াতাড়ি তুলে সে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখে ঠিক করা যায় কি না। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষে ভিজে ভিজে আবার সামনের দিকে পা বাড়ায়। হাঁটুর চোটটা বেশিই হয়েছে। চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কাশেম মনে মনে ভাবে, সাহেব কী বলবে তাকে? আবার ভাবে, সাহেব বড়োলোক, হয়তো তাকে কিছুই বলবে না। সেই সঙ্গে তার ভাবনার আর-একটা বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, টাকা পাবে কোথায়? সাহেবের কাছে টাকা ধার চাইব? মনে মনে নানান ভাবনায় জর্জরিত হয়ে কাশেম একসময় সাহেবের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ায়। অফিসের প্রকাণ্ড লোহার গেইটের একপাশে এসে কাশেম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বৃষ্টিতে ভিজে তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে। মনে মনে সে ভেবে নেয় সাহেবকে কী বলবে।
গেইটের ভেতর কয়েক পা যেতেই তার ভেতরটা হঠাৎ কেন যেন কেঁপে ওঠে। সে আবার থমকে দাঁড়ায়। যদি সাহেব তাকে মারধর করে! কাশেমের মনের উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বইছে। সে তার মনের অবস্থা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এই সময় কাশেমের মনে পড়ে আর-এক সাহেবের কথা।
“ইস্ যদি হগ্গোল সাব এমনই হইত!” নিজের মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে যায় কথাটা। একবার কাশেমের মায়ের ভীষণ জ্বর হয়েছিল। দু-দিন ধরে তার মা জ্বরে প্রলাপ বকেছিল। শরীর দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছিল। কাশেম তার মায়ের শিয়রে বসে মাথায় পানি ঢালছিল। কিছুক্ষণ পর তার মা চোখ খুলে তাকায়। কাঁদো কাঁদোভাবে কাশেম জিজ্ঞেস করে, “অ্যাহন কেমন লাগতাসে, মা? তুমি দুই-দিন থেইক্যা কিছু খাও নাই, মা। তোমার কী খাইতে মনে লয়, আমারে কও, মা।” কাশেমের মা তখন তার দিকে শুধু অসহায়ভাবে তাকায়। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু। কাশেম মায়ের হাত ধরে ভরসা দেয়।
“তুমি কান্দো ক্যান, মা? কিছু হইব না। আল্লারে ডাহো, হেই তোমার হগল বালামছিবত দূর কইরা দিব।” এই কচি অবুঝ বালকের সান্ত্বনার কথা শুনে অবলা নারীর অন্তরে লুকিয়ে থাকা অশ্রু যেন কোনো বাঁধ মানে না। কাশেমকে জড়িয়ে ধরে সে অঝোরে কেঁদে ওঠে। সেই বুভুক্ষু মাতৃহৃদয় ভাবে কাশেমের কথা। সে যদি মরে যায়, তবে কাশেমের কী হবে? কার কাছে রেখে যাবে তার বুকের টুকরোকে? চোখের কোণ দিয়ে জননীর অশ্রু গড়াচ্ছে। কাশেম আবার জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী খাইতে মনে লয়, মা আমারে কও।”
কাতর কণ্ঠে ধীরে ধীরে কাশেমের মা বলে, “কী আর খামু, বাপ! আমাগো কপালে কি আর ভালা খাওন আছে? মনে লয় একটা আপেল খাইতে, অসুখ হইলে সাহেবেরে দেখছি, কত আপেল খায়!” “ঠিক আছে, আমি তোমারে আপেল কিন্যা দিমু।”
কাশেম আর দেরি করে না। বাজারের উদ্দেশে রাস্তায় নেমে পড়ে, রাস্তায় এসে সে ভাবছে, হাতে তো একটা কানাকড়িও নেই। আপেল কিনবে কী দিয়ে? হাঁটতে হাঁটতে কাশেম বাজারের একটা ফলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। দোকানে কত ফল থরে থরে সাজানো রয়েছে। কাশেম সব ফলের নামও জানে না। লোলুপ দৃষ্টিতে সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কোন ফলের নাম আপেল, সে দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে সাহসও পায় না। যদি সে তাকে তাড়িয়ে দেয়! কাশেম যে এভাবে দাঁড়িয়েছিল, দোকানি এতক্ষণ তা লক্ষ করেনি। এখন কাশেমকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠল। “অই হালার পুত! গেলি? চুরি করবার লাইগ্যা খাড়াইয়া রইছস। ভাগ এইখান থেইকা।”
কাশেম ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়ে। এ মুহূর্তে সে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে করে। একটা চাপা কান্না তার অন্তরে গুমরে গুমরে ওঠে। ফলের দোকানির তাড়া খেয়ে কাশেম একটা চালের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একজন সাহেব চাল কিনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা কুলি খুঁজছিল। কাশেম বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সাহেবের কাছে যায়। “আমারে দেন, সাব, আমিই নিমু।” “তুই তো ছোটো! আধমণ চাল তো তুই নিতে পারবি না।” “না, সাব, আমি পারমু, সাব। আমারে পারতেই হইব!” একপ্রকার মরিয়া হয়ে কাশেম চালের বস্তা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। নিরুপায় হয়ে সাহেব বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে, তুই নিস। কিন্তু কত দিতে হবে বল?” কাশেম একপ্রকার তাড়াতাড়িই বলে, “কত দিবেন আর, সাব! একটা আপেলের দাম যা হয়, তা-ই দিবেন!”
সাহেব যেন একটু ভ্রূ কুঁচকে আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কেন রে? একটা আপেল দিয়ে তোর কী হবে?” “সাব, মায়ের খুব জ্বর। মা একটা আপেল খাইতে চাইছে।” এ কথা শুনে সাহেবের মনে যেন এই গরিব অসহায় বালকটার প্রতি একটু করুণার উদ্রেক হয়। সাহেব শেষে কাশেমকে এক হালি আপেল কিনে দেয়। কাশেম যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। সে খুশিতে সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
“আল্লায় আপনারে অনেক দিবো, সাব! আল্লায় আপনারে অনেক দিবো।” আজ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই সাহেবের কথা মনে পড়ে। সে ভাবে, সব সাহেবই যদি এমন হতো!
বুকের মধ্যে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে ভাবে, সাহেবকে সে কী জবাব দেবে। আর টাকার কথাটা কীভাবেই-বা বলবে! কিন্তু টাকা যে তার চাই-ই চাই! ধীরে ধীরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে ভগ্নহৃদয়ে সাহেবের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা ধাক্কা দিয়ে কী ভেবে সে আবার দু-পা পিছিয়ে যায়। তার বুকটা আজ কেন যেন কাঁপছে। ভেজা শরীর নিয়েও সে রীতিমতো ঘামছে। বাইরে মেঘের গর্জন। মেঘের গর্জনের প্রতিধ্বনি যেন তার হৃদয়ের মধ্যেই হচ্ছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সে দরজা ঠেলে সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়।
কাশেমের ভাত আনতে দেরি হওয়াতে সাহেব এমনিতেই বসে ফোঁস ফোঁস করছিলেন। কাশেমকে এই অবস্থায় বিশেষ করে টিফিন-ক্যারিয়ারটার এমন করুণ অবস্থা দেখে ক্ষুধার্ত পশুর মতো কাশেমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। “হতভাগা, হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা!” বলেই জোরে একটা চড় কষিয়ে দেয় সাহেব। নির্বোধ বিমূঢ়ের মতো কাশেম তাকিয়ে থাকে সাহেবের দিকে…তার সব কথা কোথায় যেন তলিয়ে হারিয়ে যায়।