অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান (৪)


চৈত্র মাসের বারো তারিখ। বড়ো আপাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে; যদিও আপার তখন বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। বাবার কথা ছিল, দেখতে আসবে, এ আর এমন কী! বিয়ে তো দিয়ে দিচ্ছি না! সেসময় মেয়েদের মতামতের জন্য কেউ খুব একটা অপেক্ষা করত না। আপার ইচ্ছে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে আগে দু-এক বছর চাকরি করবে; এতদিন পরিবার তাকে দিয়ে গেছে, এবার সে কিছু দিতে চায় পরিবারকে, তারপর ধীরেসুস্থে বিয়ে-থা করবে। বাবা বুঝল না! আপা তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী! পাত্রপক্ষ মোটামুটি আমাদের সমপর্যায়ের। ছেলে পড়াশোনা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন মুন্সীগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রভাষক।

দেখতে-শুনতেও ভালোই। বাবার পছন্দ হয়ে যায়। নানুরও খুব ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর আগে বড়োআপা ছোটোআপার বিয়ে দেখে যাবেন। তাই প্রথম দিনের সাক্ষাতেই এনগেজমেন্টের দিন ঠিক হয়ে গেল। বড়োআপা আর হবু দুলাভাইকে কিছুক্ষণের জন্যে কথা বলতে দেওয়া হলো। যদিও বড়ো আপা প্রথমে মুখ ভার করে রেখেছিলেন, তবু কথাবার্তা বলার পর দেখলাম, আপার মনের ভাব একেবারেই বদলে গেল! কী থেকে কী হলো কিছুই বুঝলাম না! বাবা অবশ্য আর কারও মতামত না নিলেও মায়ের মতামত নিলেন। যেহেতু বড়ো আপার পছন্দ হলো আর মতের‌ও পরিবর্তন হলো, সেহেতু মায়ের তরফ থেকে হ্যাঁ-সূচক মতামতই এল।

পরিবারের সবাই মোটামুটি খুশি। সবার সম্মতিতে আমাদের গাজীপুরের বাসায়, চৈত্র মাসের বাইশ তারিখ দু-জনের এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। আমার হবু দুলাভাইয়ের নাম রেজাউল করিম। দুই ভাই আর বাবা-মা নিয়ে তাদের ছোট্ট পরিবার। থাকেন কলাবাগানের ২৩ নম্বর বাড়িতে। তিনতলার প্রাচীন আমলের বাড়িটা জনাব শফিউল করিম অর্থাৎ বড়ো আপার শ্বশুরমশায়ের বাবার তৈরি করা। সেই বাড়িতেই ওঁরা এখনও থাকেন; অবশ্য বড়ো ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে মেরামত করে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন।

বাড়ির উত্তর দিকে একটা আমবাগান ছিল। মোজাইক-পাথরে-করা বাড়ির বিশাল হলরুমটা বেশ কয়েক সেট সোফা, টি-টেবিল, মাথার উপরে ঝাড়বাতি, নানারকম দেয়ালচিত্র, ফ্লাওয়ার-ভাস আর ভাস্কর্যে সুসজ্জিত! সিঁড়ি-বারান্দা পেরিয়ে উপরে উঠলে চারদিকে অনেকগুলো শোবার ঘরের দেখা মেলে, আর মাঝখানে চা-বিলাসের জন্যে কয়েকটা চেয়ার-সমেত একটা টেবিল পাতানো। প্রত্যেকটা ঘরেই আলাদা আলাদা বুকশেলফ, আর ওগুলির প্রতিটিই বইয়ে ঠাসা! পুরো বাড়িতে এই একটা ব্যাপার আমার ভীষণ পছন্দ হলো। বইগুলো পড়তে পারব ভেবেই খুব খুশি হয়ে উঠলাম। আরও একটা ব্যাপার ভালো লেগেছে, ওঁদের পরিবারের সবাই বইপ্রেমী; বিশেষ করে আন্টি, মানে আপার শাশুড়ি। উনি গোয়েন্দাসিরিজ পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন। বই নিয়ে অনেক গল্প করলাম আমরা। খুব অমায়িক একজন মানুষ তিনি। বরাবরই দেখে এলাম, যারা বই ভালোবাসে, তারা অন্যসব সৃষ্টিকেও ভালোবাসতে জানে। যে-মানুষটা বই ভালোবাসে না, বই পড়ে না, তার মধ্যে আবিষ্কারের তেমন কিছু নেই, গভীরতা বলে কিছু নেই। এমন মানুষ একটা জড় পদার্থের মতো। আমাদের পরিবারের সবাই যেমন বইপ্রেমী, তেমনি তারাও সবাই বইপ্রেমী। ভালোবাসার সঙ্গে আত্মার সংযোগ বোধ হয় এভাবেই ঘটে।

আমার টেস্ট পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে আপার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করা হলো জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহে। এর মধ্যেই পুরো বাড়িতে বিয়ের আমেজ। চারিদিকে কেমন একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বিয়ের আনন্দে পরীক্ষার টেনশন কিছুটা হালকা হলো। ব্রেইন মোটামুটি শান্ত রেখেই টেস্ট পরীক্ষা শেষ করলাম। এর মাঝে অবশ্য কমলিকার সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা হলো। বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি, তবে আসা-যাওয়ার পথে একটুখানি দেখা হবার আনন্দও কম নয়। কিন্তু তখনও আমি নিজেকে গুছিয়ে উঠতে পারিনি! এতগুলি দিন হয়ে গেল ঢাকায় এসেছি, ঢাকার পরিবেশ, আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, কত জ্যোৎস্না, কত অমাবস্যা, কত-কী-না পার করেছি, তবুও আমি খাপছাড়া বাউন্ডুলেই রয়ে গেলাম। সব কিছুতেই কেমন জানি বেমানান বোধ করি! কত চেয়েছি, দু-চারটে বান্ধবী বানাব, অথচ যখন কেউ সেধে আমাকে বন্ধু বানাতে চাইল, তখনই কিনা আমি এমন পিছ-পা হলাম! কেন নিজের ভেতর থেকে সাহস পাই না? ভেতরটা কেন এমন শুষ্ক? এই শহরের জাঁকালো পরিবেশ, অমন উষ্ণ আলোর ছটা আমার কাছে এমন স্তিমিত মনে হয় কেন! এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই! হয় এই শহর আমায় আপন করতে পারেনি, নয় আমিই চাইনি কখনও আপন হতে!

শাওনের কাছে শুনেছি, এসএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষায় কমলিকা বিশেষ একটা ভালো করতে পারেনি। পারিবারিক কোনো একটা জটিলতার কারণে নাকি এমনটা হয়েছে। কথাগুলো শোনার পর কমলিকার জন্য খারাপ লাগছিল। কত বার চেয়েছে কথা বলতে, কিন্তু আমি ভালো করে কথাই বললাম না! মতিঝিলের আবাসিক এলাকাটা আমার একলা দিনের সঙ্গী, কলেজশেষে সময় পেলে প্রায়ই হাঁটতাম ও-পথ ধরে। অনেক বার মনেও হয়েছে ওর কথা। কিন্তু ও কোথায় থাকে, তা-ই কখনও জানা হলো না। প্রত্যেক বার হাঁটার সময় মনে হতো, হুট করে যদি দেখা হয়ে যেত সেদিনের মতো! তা-ও কথা বলে যে জেনে নেব, ওতেও আমার আলসেমির শেষ নেই। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার-স্যাপার আমার বরাবরের মতোই ভালো লাগে। ছোটোবেলা থেকে প্রত্যাশা করতে শিখিনি তো, তাই! অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে প্রত্যাশা করব, এমন স্পর্ধা দেখাতে আছে নাকি! পাপ হবে না?

টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার দিন-দুয়েক আগে এমনই এক দুপুরের শেষে হাঁটছিলাম আবাসিক কলোনি ধরে; হাতের বাঁ-দিকে নয়নতারা নামের একটা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের চারতলার বারান্দা থেকে কিছু বাদামের খোসা আমার মাথার উপরে পড়ছে, মেজাজটা তাই হঠাৎ তেতে উঠল; উপরের দিকে তাকাতেই দেখি, কমলিকা ইচ্ছে করে বাদামের খোসাগুলো আমার মাথার উপরে ফেলছে। তার এমন কর্মকাণ্ডে আমি রীতিমতো অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম! তার উপর রাগ করা উচিত, না হাসি দিয়ে কথা বলা উচিত, না চলে যাওয়া উচিত, কিছুই বুঝতে পারলাম না! তার কাজকর্ম সব আমার চিন্তাভাবনার এক-শো গজ দূরেই থাকে! এর মধ্যে সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল।

- এ বাবা, আপনার চুল তো একদম চড়ুই পাখির খুপরি হয়ে গেছে!
- বানানোর জন্যই তো খোসাগুলো ফেলেছ! তা হবে না?
- বেশ করেছি ফেলেছি। তাতে আপনার কী, হ্যাঁ? আমাকে যে এড়িয়ে চলেন, এটা হচ্ছে তার শাস্তি! আবার যদি এড়িয়ে যেতে চান, তাহলে মাথায় খোসা ভেঙে ডিম ফেলব!
- আমি যে তোমার শাস্তির প্রেমে পড়ে গেলাম!
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা-ই তো! নাকের জন্যে চোখে দেখেন না, শাস্তির প্রেমেই পড়বেন! আপনার কপালে ওই শাস্তিই জুটবে!
- তা ভালোবাসা দেবে কে!? শাস্তিই বরং ভালো!
- ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বেড়ালে ভালোবাসা পাবেন কীভাবে?
- ভালোবাসা এসেছিল‌ই-বা কবে?
- চাইলেই আসবে!
- চাই-ই তো, খুব করেই চাই; কিন্তু আসে আর কই?
- মুখে চাইলেই হয়?
- ভেবে দেখিনি।
- হয়েছে! আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না!
- নিজে যাবেন না ঠিক আছে, অন্যকে অন্তত আসতে দিন!
- দরোজা খোলাই আছে! গুগলম্যাপ দেখে আসতে পারলেই হলো!
- হায় আল্লাহ্! এ আমি কোন মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে কথা বলছি! কাকে কী বলি! শিক্ষিকা হিসেবে আমি আগাগোড়াই ব্যর্থ!

ওর কথা শুনে না হেসে পারলাম না! তখন কমলিকা বলেছিল, “এই প্রথম আপনাকে প্রাণখুলে হাসতে দেখছি!” কমলিকার স্মিত হাসি আর স্তম্ভিত নয়নে জমে-যাওয়া অনেক অভিমানের খোলা চিঠির পসরা যেন ওর সারামুখে ভেসে উঠেছিল তখন। দেখে খুব মায়া লাগছিল। সময়টাও যেন হঠাৎ করেই আটকে গেছে ঘড়ির কাঁটায়, সেখান থেকে বেরোতে চাইছিলাম খুব করে! প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করছিলাম, হয়তো ওকে বলতে চাইছিলাম কিছু, কিন্তু ঠিক পেরে উঠছিলাম না। একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছিল। এই অনুভূতি থেকে আমি সবসময়ই পালিয়ে বেরিয়েছি।

জন্মের পর থেকেই ‘অপরাধবোধ’ নামের অনুভূতিটা ছায়ার মতো আমার পিছু নিচ্ছে। আমি কি শুধুই ভুলের বীজ নিয়ে এসেছি পৃথিবীতে? যেখানেই পা পড়ছে, একটা করে বীজ বুনে আসছি! আমার কল্পনা, ইচ্ছে, অনিচ্ছে, পরিকল্পনা, স্বপ্ন, বাস্তব, সব কিছুই বেয়াড়া—যেন সব কিছুর সাথেই আমার জন্মগত বিবাদ, কোনো কিছুই আমার সাথে খাপ খায় না! আমার সাথে আমার জীবনের এত অমিল কেন? কীসের এত পরাধীনতা আমার? কমলিকা, বিশ্বাস করো, আমি বলতে চেয়েছি সেদিনও, আমি বলতে চেয়েছি তোমায় . . .
কমলিকা, হেসেছি আমি বহু বার,
কথায় কথায় লুকায়েছি তা প্রতিবার!
অবুঝ বালিকা, দ্যাখোনি তুমি, দিয়েছি
মণিহার…জড়ায়ে গলেতে তোমার,
পরায়ে শাড়ি কুঞ্জলতার!
একখানা দোপাটি খোঁপাতে গুঁজায়ে
কৃষ্ণচূড়ার রঙে দুটি ওষ্ঠ রাঙায়ে!
ভোরের শিউলি গেঁথে বানায়ে নূপুর
যতনে পরায়েছি, কাটেনি তো ঘোর!
পত্রলেখায় এঁকেছি চুমু, প্রশস্ত কপোল!
কমলিকা, আমি অশান্ত যত, ততোধিক কোমল!

কিন্তু বলতে পারিনি কিছুই! আমি পারিনি! আমি পরাধীন, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণ এক! আমার স্বপ্নরা যে আমার থেকেই স্বাধীনতা চায়, কমলিকা! আমার কল্পনাগুলো আমার থেকেই পালিয়ে বেড়ায়। আমার ইচ্ছেরা কথা বলে না বহুদিন হলো! অজ্ঞাত সংবিধানে অপরাধী আমি—বাস্তবতা আমায় স্মরণ করায় প্রতিদিনই! এত ধোঁয়াশা নিয়ে আমি কী করে তোমার স্বচ্ছ প্রাণে জড়াব নিজেকে, কমলিকা? আচ্ছা কমলিকা, বলতে পারো, রাতেই কেন আকাশে চাঁদ ওঠে? আলোর তৃষ্ণা অন্ধকারের একার কেন?

কেন যে-আকাশে সূর্য তার প্রখরতা দেখায়, সেই আকাশেই চাঁদ তার কোমলতা ছড়ায়? সূর্যের তো অন্ধকারকে নিজের জৌলুস, নিজের ক্ষমতা, নিজের প্রাখর্য দেখানোর কথা, তাই না? চাঁদের কীসের এত দায়, কমলিকা? অবশ্য দায় ব্যাপারটা প্রিয়জনদেরই থাকে; প্রয়োজন যাদের, তাদের যে শুধুই অভিযোগ থাকে!
Content Protection by DMCA.com