আমার পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় নানুর কাছেই। পড়ালেখা শেখাতে নানুকে বেশি বেগ পেতে হয়নি, অবশ্য আমাদের তিন ভাই-বোনের জন্যে কাউকেই এ ব্যাপারে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। মগজটা আল্লাহ ভালোই দিয়ে পাঠিয়েছেন। বড়ো বোন সাভেরা হলিক্রস স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে, ছোটো বোন নাভেরা মানবিক বিভাগের ফার্স্ট গার্ল, সামনেই প্রবেশিকা পরীক্ষা! বাবা খুব গর্ব করেন তাদের দু-জনকে নিয়ে। পড়াশোনার ব্যাপারে তারা একেবারেই আপোশহীন!
মাকে কখনও বলতেও হয়নি, সাভেরা, নাভেরা, গিয়ে পড়তে বোস! যখনই দেখে, দেখে, তারা টেবিলেই মুখ গুঁজে পড়ে আছে!
আমি অবশ্য এতটাও মরিয়া হয়ে পড়তাম না, তবে পড়ব...এটা বলে ছেড়েও দিতাম না!
নানু পড়াতেন, আমিও তার মুখে মুখে পড়তাম। ব্যস্ এরপর আর মুখস্থ করতে হতো না! আমি বরাবরই মুখস্থবিদ্যার ঘোরবিরোধী! এটা আমাকে গেলানো সম্ভব নয়! যতক্ষণ না সন্তুষ্টচিত্তে কোনো বিষয় ঘটে ঢুকবে, ততক্ষণ অবধি আমার অনুসন্ধান জারি থাকবে! হ্যাঁ, এটাই আমার অর্ধ-বর্ধিত মননের শুদ্ধতম নীতি! তবে ফাঁকি যে দিতে চাইতাম না, তা কিন্তু নয়, সুযোগ পেলেই পড়া ফেলে দৌড়! মাঝে মাঝে নানু হাতে খুন্তি নিয়ে রান্নাঘর থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন; আমার আবার পড়তে বসলেই দু-মিনিট পর পর হিসু পেত, পানির তেষ্টা পেত, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেটেব্যথা সব দলবেঁধে হাজির হতো—সোজা কথায়, প্রথমসারির অভিনেতা ছিলাম, যত রকমের ফন্দিফিকির করা যায় সবই করতাম!
ময়মনসিংহ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্টার মার্কস পেয়ে প্রথম হলাম—জীবনের প্রথম অর্জন! এর পুরো কৃতিত্বই নানু আর মামাদের। সেবারই প্রথম বড়ো আপারা আমাকে কাছে ডেকেছিলেন, প্রথম বারের মতো তাদের মনে হলো, আমি তাদের ভাই! আমারও অবশ্য প্রথম বারের মতো মনে হলো, তারা আমার বোন, রক্তের সম্পর্কের বোন! বাবা সেদিনও নড়লেন না, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শব্দটা তাঁর মাথায় জেঁকে বসে ছিল!
আমি তখনও তাঁর কাছে লবণ ছাড়া তরকারির মতোই বিস্বাদ ছিলাম!
তা-ও আমাকে সঙ্গে নিয়েই গাজীপুরের বাসায় ফিরলেন তিনি। কারণ নানুর ইচ্ছে ছিল, ঢাকার নামকরা কলেজে পড়াবে আমাকে। নটরডেম কলেজ সে সময়ের সেরা কলেজ ছিল, এখনও সেরাই আছে। গেলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে; ছোটো মামা আর ছোটো আপাও সাথে গেলেন। পরীক্ষা ভালোই দিলাম, সিলেক্টেডও হয়ে গেলাম, কিন্তু নটরডেমে কোনো মেয়ে পড়ে না দেখে ভীষণ মর্মাহত হলাম!
সত্যি কথা বলতে, নানু বলে, আমার নাকি কন্যারাশি!
আমার আবার মেয়েদের সাথে কথা বলার অত শখ-টখ নেই, বাপু! তবে কোনো মেয়ে যদি বন্ধু হতে চায় তো হতে পারে!! সে যা-ই হোক, আহত মনে কলেজে যাবার কিছুদিন পর খেয়াল করলাম, নটরডেম কলেজের বিপরীতেই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ! নটরডেমের ছেলেদের সাথে মতিঝিল আইডিয়ালের মেয়েদের সখ্যও ছিল দেখার মতো! ছুটির পরে দেখি, বাসের সিটে সব জোড়ায় জোড়ায় মৌমাছির ঝাঁক, বাসে উঠলে নিজেকে তখন এতিম, অসহায়, সম্বলহীন টোকাই মনে হয়!
আমার অবস্থা অনেকটা ইলেকট্রনবিহীন কক্ষপথের মতো! প্রতিক্রিয়া যা-ই আসুক, ক্রিয়া-বিক্রিয়া আর হয় না! মনে মনে ঠিক করে নিলাম, রাদারফোর্ডও নয়, নিলস বোরও নয়, আমাকে ম্যাক্সওয়েলের মতো নানুর দেওয়া মতবাদের সত্যতা যাচাই করতেই হবে! স্কুলজীবন থেকে রসায়ন ছিল পছন্দের বিষয়, বন্ধন ভাঙা-গড়ার খেলা, আকর্ষণ-বিকর্ষণের সীমারেখা, সংযোজন-বিয়োজনের সমীকরণে জারণ-বিজারণ ঘটিয়ে টাইট্রেশনে রঙিন হয়ে সুন্দরীতমাদের প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় এনে যুগলায়ন বিক্রিয়ার সূচনা করা—সে এক চরম প্রেমের পরম পাওয়া!
আহা! অণু-পরমাণুর মধ্যেও সে কী চমৎকার রসায়ন, ঠিক যেন জীবন্ত প্রেমের কপোত-কপোতী! রসায়নের রস প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবেই আস্বাদন করে আসা আমারই যদি বন্ধন গঠনের জন্যে ইলেক্ট্রনই না থাকে, তাহলে এই লজ্জা আমি রাখব কোথায়, আপনারই বলুন! শূন্য গ্রুপের সদস্যপদ আমাকে মানায় না, এই মর্মে আজই পদত্যাগ করলাম!
নটরডেম কলেজে পড়াশোনায় তুমুল প্রতিযোগিতা চলত, মেধাতালিকায় একেক জনের স্থান আবহাওয়ার মতো বদলে যেত! কেউই তার স্থান বেশি সময়ের জন্য ধরে রাখতে পারত না। পড়াশোনার চাপ এত বেড়ে যেত লাগল যে, আমার সাধের মৌচাক গড়ার ফুরসতই পেলাম না! নটরডেমের সেকেন্ড বয় হিসেবে নিজের জায়গা ধরে রাখার জন্যে কলুর বলদের মতো খাটতে লাগলাম! বিনা বেতনে পড়াশোনার কাছে চব্বিশ ঘণ্টার কামলা বনে গেলাম, একগাদা বইখাতা আর শিট নিয়ে কাঁধে তিন সের ওজনের ব্যাগ ঝুলিয়ে যন্ত্রমানবের মতো যাও আর আসো, ব্যস্!
এমনিতেই আমি খর্বকায়, ব্যাগের ভারে মনে হয় দৈনিক ০.১ সেমি করে কমতে লাগলাম। যদিও নানুর চেষ্টা আর আল্লাহর ইচ্ছায় দু-পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম, কিন্তু জন্মগত শূন্যতা পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি, একটু কষ্ট করেই হাঁটতে হতো আমাকে। শাপলা চত্বর থেকে নটরডেম অবধি এই দশমিনিটের পথ ভারী ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে মোটামুটি চিকনঘাম বের হয়ে যেত আমার!
একদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ নিয়ে মন্ত্রপূত সাপের মতো ফিজিক্স স্যারের বাসায় ছুটছিলাম, হঠাৎই পেছন থেকে কেউ একজন জোরে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠল।
- এই যে রাজি সাহেব, শুনছেন?
- আপনার একটা শিট পড়ে গেছে।
ফিরে দেখি, একটা মেয়ে ডাকছে। গোলাগাল চেহারার, বয়স ষোলো-সতেরো হবে! পাতলা গড়নের, গায়ের রংটা সোনালি, ইংরেজিতে যাকে গোল্ডেন টোন বলে, ঠিক ওরকম।
কাছে গিয়ে কিছু না বলেই মেয়েটার হাত থেকে শিট নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলাম, কিছুদূর গিয়ে মনে পড়ল, মেয়েটা আমাকে ‘রাজি সাহেব’ বলে সম্বোধন করল কেন! আর আমিই-বা কেন ওই ডাকে অমন দাঁড়িয়ে গেলাম! আমার নাম সাফরাত শাহরিয়ার রেজওয়ান, রাজি তো নয়! মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে দেখি, মেয়েটা আগের জায়গায় একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছে! আমার আশ্চর্যের সীমা রইল না! আমাকে ফিরে আসতে দেখেই, মেয়েটা হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে উঠল…
কী, রাজি সাহেব! আবার ফিরে আসতে হলো তো! আমি জানতাম, আপনি আবার ফিরে আসবেন, তাই আমি দাঁড়িয়ে আছি।
চোখদুটো গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? আর আমাকে বার বার ‘রাজি সাহেব’ বলে সম্বোধন করছ কেন? আমার নাম রেজওয়ান।
আবারও সেই বিজ্ঞের মতো হাসি ছুড়ে বলল, আমি জানি, আপনার নাম সাফরাত শাহরিয়ার রেজওয়ান। আপনি নটরডেমের সেকেন্ড বয়, ম্যাথ আর কেমিস্ট্রিতে টপ স্টুডেন্ট। আপনাদের কলেজের দেয়ালিকাতে আপনার নাম দেখেছি, আপনার সম্পর্কে লেখা ছিল কিছু, তা-ও পড়েছি। আপনার নামটা বড্ড আনাড়ি গোছের, তাই ভাবলাম, ডাকনাম ধরে ডাকব, কিন্তু তা-ও পারলাম না; হিসেব করে দেখলাম, আমার ০.২ কিলোক্যালরি শক্তি খরচ করতে হবে। রেজওয়ানকে কেটেছেঁটে তাই ‘রাজি’ বানিয়ে নিলাম, ব্যস্!
একনাগাড়ে এতগুলো কথা মেয়েটা ঝড়ের বেগে বলে গেল!
আমার মনে হলো, আমার বলার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট রাখল না মেয়েটা। কিছু না বলে আবারও আচাভুয়োর মতো হেঁটে স্যারের বাসায় ঢুকে গেলাম। সেদিন স্যারের লেকচার আমার মাথার তিনফুট উপর দিয়ে গেছে!
কোনো কাজ না করেও প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল, তবে শরীরের চেয়ে ব্রেইনটাই বোধ হয় বেশি ক্লান্ত ছিল! আজকের ঘটনাটা আমার কাছে ফিজিক্সের গতিবিদ্যা আর বায়োলজির ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া থেকেও জটিল মনে হলো। এতদিন ভাবতাম, গতিবিদ্যার অঙ্ক আর ৩৮ অণু এটিপি তৈরির প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে কঠিন আর কিছু নেই; আজ মনে হলো, নারীচরিত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে কঠিন আর কিছুই হতে পারে না! ফিজিক্স, বায়োলজি তার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু। বেচারা আমার ব্রেইনটার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল মনে হয়!
এসব বোঝা আমার কম্ম নয়! অবশ্য আমার বন্ধুরা প্রায়ই বলে, তুই শালা আর যা-ই করিস না কেন, প্রেম করতে পারবি না, প্রেমিকাকে ছাত্রী ভেবে কেমিস্ট্রির লেকচার আর বায়োলজির বদনাম করতে লেগে যাবি, তার উপহারস্বরূপ দু-চারটে থাপ্পড় খেয়ে আসবি! এর চেয়ে বরং সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যা! দেখিস না আমাদের স্যারদের, আইনস্টাইনের টাইম ডিলেশনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ একেকটা! যদিও ওরা ভুল কিছু বলে না, তারপরও নানু বলেছে, আমার কন্যারাশি, এর উপরে আর কোনো যুক্তি চলবে না! এসব বলে-টলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই আর কি!
হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা বোধ হয় মতিঝিল আইডিয়ালের ছাত্রী হবে। আমার সম্পর্কে মেয়েটা এত খোঁজখবর রাখে, কারণটা কী? আমি ফিরে আসব, তা-ও জানত; ‘রাজি’ বলে ডাকলে আমি দাঁড়াব কীভাবেই-বা বুঝল! ইসসসস্…বড্ড আফসোস হচ্ছে, কেন তখন ভালো করে মেয়েটার সাথে কথা বললাম না! ওর নাম জানতে চাইলাম না, কোথায় পড়ে, কী করে, কোথায় থাকে, আমায় চেনে কীভাবে, কিছুই তো জানা হলো না! আবার যদি দেখা হয়, এই ভুল আর করব না—নিজের কাছে নিজেই শপথবাক্য পাঠশেষে জম্পেশ একটা ঘুম দিলাম!