সিলেট ডায়েরি (১)


(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই লেখাটি পড়ার পর পরই সত্যি সত্যি সিলেটে যাবার জন্য ব্যাগ গোছানোর প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগতে পারে!)


বাংলাদেশে ২ ধরনের দুর্ভাগা আছে: যারা সিলেটে জন্মায়নি। যারা সিলেট ঘোরেনি।


সরকারি চাকরি স্থায়ী হবার অন্যতম শর্ত: বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে। আমরা কয়েক জন বাংলাদেশ লোক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ৫৮তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে প্রায় ২ মাস ফিল্ড অ্যাটাচমেন্টে সিলেটে ছিলাম। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় সিলেটকে প্রথমে রাখার একমাত্র কারণ ছিল: সিলেট ঘুরে দেখা। জানি না, কথাটা অতিরঞ্জন শোনাবে কি না, তবুও বলছি, সে সময় আমি সিলেট যতটা ঘুরে ঘুরে দেখেছি, খুব কম সংখ্যক সিলেটিই বোধ হয় অতটা সিলেট ঘুরেছেন। বর্ষার সিলেট দেখার পাশাপাশি সে সময়ে ট্রেনিংয়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, এনজিওতে যেতে হয়েছিল। নানান বিচিত্র অনুভূতির সেসব কথা শেয়ার করেছি ফেইসবুকে বিভিন্ন পোস্টে। সেই সময়ের সেইসব পোস্টকে একসাথে জড়ো করে ডায়েরি আকারে রাখলাম।


পড়ে দেখুন। ভালো লাগলে শেয়ার করুন। ভালো না লাগলে, স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে নিঃশব্দে মুড়ি খান।


March 27
...off to Sylhet, the Daughter of Nature. I'll have to stay there for 7 weeks as a part of our foundation training course ...looking forward to meeting my friends, well-wishers, fans & followers. I'll be available on ***********... Hello Sylhet!!


March 28
এক। Good Morning, Sylhet!


দুই। Feeling ... সুপারহ্যাপি!
জাফলংয়ের পথে . . . এরপরের গন্তব্য তামাবিল, জৈন্তাপুর, শ্রীপুর, লালাখাল . . .


তিন। Feeling crazy at Jaflong, Sylhet
ধোঁয়াশায়-ঘেরা পাহাড়, হঠাৎ ক্ষেপে-ওঠা নদী, মায়ায়-জড়ানো বৃষ্টি। ইসস্!! . . . চলো, ভিজি!!


চার। Happiness is . . . পাথুরে পাহাড়ি নদীর কনকনে ঠান্ডা হাঁটুজলে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে হেঁটে বেড়ানো আর ঢং করে করে 'মুখ বেঁকিয়ে দাঁত কেলিয়ে' ছবি তোলা!
গুডবাই, জাফলং। আজ তুমি বৃষ্টিতে ভিজিয়েছ; রোদেও! লালাখালের পথে . . .


পাঁচ। লালাখালে ... আচ্ছা, এটা কিছুটা কাপ্তাই লেকের মতো না? কাপ্তাই অবশ্য আরও অনেক বেশি সুন্দর! বরং এটা কিছুটা বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর মতন।


March 29
এক। Feeling... খাদক at Panshi Restaurant
পানসী-তে খেলুম, দাদা! সিরাম!! ভুঁড়ি কী আর এমনিই বাড়ে দাদা!


দুই। এমসি কলেজে . . . পুরোনো আবহ, পুরোনো গন্ধ


তিন। আমাদের যেমন বাতিঘর আছে, তেমনি এদের আছে বইপত্র। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর আমি তো এসেছি মাত্র সিলেটে। এত এত ঘুরে বেড়াব, অথচ শহরের সবচাইতে বড়ো বইয়ের দোকানে আসব না, এ তো হয় না! . . . সিলেটের সবচাইতে বড়ো বইয়ের দোকান ‘বইপত্র’-এ সময় কাটাচ্ছি . . .


March 30
এক। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে . . . উত্তমকুমারের ‘আনন্দ আশ্রম’-এর কথা মনে হচ্ছে। মুভিটা দেখেছেন তো? ওতে দেখানো ডাক্তারের অফিসটাও কিছুটা এরকম। প্রকৃতি আর সেবার নিবিড় মেলবন্ধন। ওখানে একটা মাঠ ছিল, এখানে ওটা নেই। এই যাহ্‌! . . . একটা গাড়িতে দেখছি লেখা আছে, জরুরি ঔষধ। পুরোনো ভাঙাচোরা গাড়ি। ওতে কিছু আগাছা টাইপের গাছও জন্মেছে। ঔষধ আর অক্সিজেন, দুই-ই আছে! জীবনরক্ষার সব ব্যবস্থাই আছে দেখছি! গাড়িটা চলে না, তাই ওটা কারও জীবন নেবে না! মানে, এই নখদন্তহীন গাড়িটিও জীবনরক্ষাকারী!


দুই। আহা, চা-বাগান! এমন একটা বিকেল কাটানোর জন্যও তো বেঁচে থাকা যায়! এই অপার্থিব সুন্দরের মাঝে নিজেকে বড়ো বেশি অসুন্দর ভাবতে ইচ্ছে করে! সুন্দরের শক্তি এমনই!


তিন। কাজীর বাজার ব্রিজটা সুরমা নদীর ওপরে। ব্রিজ থেকে নদীর দিকে তাকাচ্ছি আর…মন নয়, মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হচ্ছে। সুরমাকে লোকজন বুড়িগঙ্গা বানিয়ে ফেলেছে। নদী পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। এত এত ময়লা-আবর্জনার স্তূপ সুরমায় ভাসছে! নদীও এর প্রতিশোধ নিচ্ছে। If we rape Nature once, it will rape us hundred times or even more! মানুষ এত অকৃতজ্ঞ বদমাইশ হয় কীভাবে? দু-দণ্ড শান্তির খোঁজে তো এই নদীর তীরেই ফিরে ফিরে আসতে হয়! যে-মায়ের স্তন্যপান করে বেড়ে ওঠে, সে মাকেই কিনা বড়ো হয়ে খুন করে!


একটু মজা করতে ইচ্ছে করছে। করি, কেমন?
৩০তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন এসেছিল: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নদীর ভূমিকা লিখুন। . . . প্রশ্নটা আমার কমন আসেনি, তবুও উত্তর করেছিলাম। মানে, করতে হয়েছিল। ওটার অলটারনেটিভ ছিল সংবিধান থেকে একটা প্রশ্ন। সংবিধান তো আর পারি না। অগত্যা, কী আর করা! কোন কায়দায়, কীভাবে রীতিমতো পয়েন্ট কোটেশন ডাটা দিয়ে ওটার উত্তর করেছিলাম, সে বুদ্ধিটা আমার ক্যারিয়ার আড্ডায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা জানেন। সে আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু বলব, হে নদী! তুমি আমাকে মার্কস দিয়েছ, আমি তোমায় কিছুই দিতে পারিনি! আমার অক্ষমতাকে ক্ষমা করো।


একটা কাপলকে দেখলাম, এই প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিনেও রৌদ্রতপ্ত ব্রিজের ফুটপাথের ওপর বসে বসে ছাতা মাথায় ডেটিং করছে। প্রার্থনা করি, হে ঈশ্বর! তুমি এই বেকার যুবকটিকে ওর প্রেমিকা যুবমহিলাটিকে নিয়ে একটা এসি রেস্টুরেন্টে শান্তিময় ডেটিংয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানদাতা একটা চাকরি দাও। অথবা, নিদেনপক্ষে একটা বেটার ডেটিং প্লেস ঠিক করার বুদ্ধি দাও। . . . ওদের এই 'গরম গরম' সম্পর্ক কখনোই ঠান্ডা না হয়ে যাক।

April 1
ভোজনবাড়ীতে খেলাম। কয়েকরকমের ভাজি, মাছ, মাংস, আমার অতিপ্রিয় দই। সিম্পলি সিরাম! নরকের মতোই ভয়ংকর সুন্দর! নরকে যেতে পাপ করা যায়, ভোজন করতে এখানে আসা যায়। পাপে নরক, ভোজনে ভুঁড়ি। ইচ্ছেমতো পাপ না করতে পারার আফসোস আর খুশিমতো ভোজন না করতে পারার আফসোস, দুটোই সমান পীড়া দেয়। আমি বরং নরকে যাব, সব মজার মানুষ ওখানে আছে। বোরিং মানুষের সাথে থাকতে ভালো লাগে না। আমি বরং ভালো রেস্টুরেন্টে যাব, সব মজার মজার মজার খাবার ওখানে আছে। মজার খাবার থেকে দূরে থাকতে ভালো লাগে না। আরে ভাই, খেলেও মরব, না খেলেও মরব। তো খেয়েই মরি! কী আছে আর জীবনে এই একটু খেয়ে-দেয়ে বেঁচে-টেচে থাকা ছাড়া!


April 2
এক। কারও কারও প্রকৃতিবর্ণনা পড়ার সময়ে মনে হতে থাকে, এই বুঝি কচি পল্লবটা ছুঁয়ে দেখছি যেন, বুনোফুলের ঘ্রাণ যেন সত্যিই মাতাল করে দিচ্ছে, বৃষ্টির নরোম ধারা অশান্ত ঠোঁটযুগলকে শান্ত করে দিল বলে, বাগিচার সবকটা ফুলের বাহারি রঙে এ দু-চোখ জুড়োল, স্যাঁত-সেঁতে পাতায় পাতায় সবুজ পোকারা ওদের পথের রংটাকেই ফাঁকি দিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে চোখের সামনেই, এত এত রকমের সবুজ জেগে জেগে ওঠে, সব পাখিই হয়ে ওঠে কাকভেজা, এরকম আরও কত-কী!


আমার সাহিত্যপাঠের ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি নিয়ে গেছেন, এমন দু-জনের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর বুদ্ধদেব গুহ। এই দুই মহান স্রষ্টার লেখা যতটা পড়া যায়, তার চাইতে অনেক বেশি হৃদয়-মন দিয়ে ছোঁয়া যায়। পালামৌ-সহ আরও দু-একটা সৃষ্টির কথা মাথায় রাখলে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সাহিত্যসারল্যের জাদু এতটা নিবিড়ভাবে আর কোথাও পাই না অতটা। বুদ্ধদেব পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমাদের পরম সৌভাগ্য আর দশটা পেশাজীবীর মতো উনি শুধু নিজের পেশাতেই আড়াল হয়ে থাকেননি। ঘুরেছেন প্রচুর—ওরকম তো অনেকেই ঘোরেন; উনি লিখেছেনও। ‘ঋভু’ পড়ে জেনেছি, উনি যে পরিমাণ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন, এর ফাঁকে এ বিপুলায়তন লেখালেখি করাটা সহজ ছিল না। ওঁর সব লেখাই ভালো! ‘সবিনয় নিবেদন’-এর ঋতিকে খুব বেশি মনে না ধরলে বুদ্ধদেবের কাছ থেকে আমরা সুনীলের ‘সুদূর ঝর্নার জলে’, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’-র মার্গারিটা কিংবা মুজতবার ‘শবনম’-এর মতো কোনো অনন্যাকে পাইনি বটে, তবু যা পেয়েছি, সে ঐশ্বর্যের তুলনা চলে না।


প্রকৃতিসঙ্গমের সুখ সমস্ত শরীর-মনকে কাঁপিয়ে দেয়। এই যেমন শুধু একটা স্থবির পাহাড়ও নতুন করে বাঁচতে-ভাবতে-ভালোবাসতে শেখাতে পারে। সিলেটের বৃষ্টি দেখতে পারাটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সেরা উপহারগুলোর একটি। সিলেটের বৃষ্টির প্রকৃতি বুদ্ধদেব গুহর প্রকৃতি। গুহ পড়েছি, ভালোবেসেছি, তাই বড়ো আপন মনে হয়।


ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে সিলেটে এলাম এক সপ্তাহ হল। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি অফিস পরিদর্শন করি। যাই আর শুনি, দেখি ওরা কী করে, কীভাবে করে। এখন আছি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিসে। পৃথিবীর ২টা বিষয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এক। যা আমার দরকার নেই। দুই। যাতে আমার আগ্রহ নেই। . . . আজকের অফিসার ভদ্রলোকটি ভালোমানুষ গোছের। উনি বলেই যাচ্ছেন আর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমিয়েই যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, এই ঝিমোনোর সাথে রাতে ঘুম হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। আমি মূলত ওদের দলে। আজ ভাবলাম, ঝিমোনোর চাইতে লেখালেখি করা উত্তম। তা ছাড়া আমি তো দুটোই পারি। আজ পরেরটায় গেলাম। কেন গেলাম? এ কদিনে আবিষ্কার করলাম, বেশিরভাগ সরকারি অফিসের ওয়াশরুমগুলোর ছিটকিনিতে সমস্যা থাকে। আজকেরটাতেও আছে। এ নিয়ে লিখব ভেবে-টেবে কীসব নিয়ে লিখে ফেললাম। আমার প্রায়ই এমন হয়। বৃষ্টি, সিলেট; সাথে আমিও। সবচে বড়ো কথা, মোবাইলে চার্জও আছে। বৃষ্টিতেই সিলেট অপরূপা। ইচ্ছে আছে এমন একটা বৃষ্টিভেজা দিন চা-বাগানের বাংলোয় কাটাব। দেখা যাক, কেউ দয়া করে ব্যবস্থা করে দেয় কি না!


আরও লিখতে ইচ্ছে করছে। পারছি না। জানি, পরে এ লেখা আমার আরও অনেক না-লেখা লেখার মতোই হারিয়ে যাবে। যে-শিশুটি না জন্মেই চলে গেল, তার মৃত্যুর ব্যথা মেনে নেওয়াটা বড়ো বেদনার। চাকরি বড়ো বিশ্রী জিনিস। খেয়ালখুশি-মতো লিখতে দেয় না, পড়তে দেয় না, দেখতে দেয় না, শুনতে দেয় না। জীবিকার যন্ত্রণা বড়ো যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য হলেও চাকরিটা ছেড়ে দিই!


দুই। হ্যাপিনেস ইজ . . . রাতের হিমেল হাওয়ায় শহরের নৈঃশব্দ্য চিরে বাইকে ঘুরে বেড়ানো। . . . ক্বীন ব্রিজের নিচে সুরমার পাড়ে . . . Life meets me here!


April 3
এক। চাঁদের গা ঘেঁষে ধোঁয়াটে মেঘের ভেসে যাওয়া দেখছি। ইউটিউবে বেজে চলেছে একের পর আরেক রাতের গান। আহা! এ দৃশ্য দেখার জন্যও বেঁচে থাকা যায়! পৃথিবীতে রয়ে গিয়েছিলাম বলেই আজ দেখছি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কত কিছু হয়! সেদিন মরে গেলে কিছু মানুষের করুণা-ধিক্কার আর কাছের মানুষের কষ্ট-কান্না ছাড়া কীই-বা পেতাম! মৃত মানুষ কারও ভালোবাসা পায় না। মৃত চোখ এই সুন্দর দেখতে পায় না। আজ বুঝি, নিজহাতে নিজেকে খুন করে ফেলার সবচাইতে বড়ো শাস্তি হলো ও-ই! এই আমিও মরতে চেয়েছিলাম! বেঁচে থাকার উপহার যে কত বড়ো, সেটা…বড্ড অভিমানে চলে গেলে কেই-বা বুঝতে পারে! বেঁচে থাকলে চাঁদের রুপোলি আলোয় গা ধুয়ে নেওয়া যায়। হোক একা একা, তবুও! আজ শপথ করছি, আর কোনোদিনই সুইসাইড করার কথা মাথাতেও আনব না! এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়েও কেউ যায়! অভিমানের শক্তি কি তবে ভালোবাসার দায় থেকেও বড়ো? আমি বলছি, কিছুতেই না, কিছুতেই না! . . . প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথা—কারও হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একথা বলতে না পারার কষ্ট আর অসহ্য রকমের সুন্দর এ রাত ... এ দুই মিলেমিশে একাকার হয়ে কী এক হাহাকারে কিছুতেই ঘুমুতে দেয় না! এ রাত না ঘুমোনোর রাত।


কিন্তু হায়! হাত বাড়িয়ে দিলেও কেউ এ হাত ধরে না, শুধু মশারা ঘিরে ধরে; আজও! প্রেয়সীর মতো নিষ্ঠুর মশারাও নয়! রক্ত খেয়ে নিচ্ছে? নিক! ফিরিয়ে না দিলে আমি শেষ রক্তবিন্দুটুকুও হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারি।


দুই। ছোট্ট একটা জীবন! এতেই এত এতকিছু! এক জীবনে মানুষ আর কতটুকুই-বা পায়! এতটা ভালোবাসা পেয়ে গেলে জীবনটা একেবারে খারাপ না! দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়!


সাস্টে ঘুরে বেড়ালাম, অর্থনীতি বিভাগের স্টুডেন্টদের সাথে আড্ডা দিলাম, ছোটোভাইদের সাথে দেখা হলো, কথা হলো, একসাথে ছবি তোলা হলো। ওরা ভালোবাসল, আমিও ভালোবাসলাম। ওদের বিশ্বাস করালাম, ওরাও পারবে!


তিন। একটু আগে হুমায়ূন ভাই ফোন দিলেন। উনি সাস্টে গেছেন ঘুরতে। বন্ধুদের সাথে টংয়ে বসে চা খাচ্ছেন, এমন সময়ে দেখলেন, পাশে কিছু ছেলেমেয়ে বসে আমার কিছু কথা কোট করছে আর সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। ওরা বলছে, ভাইয়া মাঝেমধ্যে আমাদের ক্লাস নিলে খুব ভালো হত, উনি অনেক প্রশ্নের উত্তর কত সহজেই দিয়ে দেন। কেউ কেউ বলছে, ভাইয়া সাইকোলজিক্যাল ডক্টর। হুমায়ূন ভাই বললেন, ভাই, আপনি আসলেই একটা মাল। এভাবে করে সবার উপকার কইরেন। সবাই তো আর এটা পারে না।


গতকাল সাস্টে ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে ওদের স্টুডেন্টদের সাথে একটা মোটিভেশনাল সেশনে অনেকক্ষণ কথা বললাম।. . . একটা সময়ে ভার্সিটির টিচার হবার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতাম না, রেজাল্ট ছিল অতি খারাপ (২.৭৪), পড়ানোর বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও আমার ছিল না। এই একটা আফসোস ছাড়া আমার জীবনে আর তেমন কোনো আফসোস ছিল না। এখন তা-ও আর নেই। বিভিন্ন ভার্সিটিতে আমন্ত্রিত হয়ে কথা বলতে যাই, স্বপ্ন দেখতে শেখাই। সবচাইতে বেশি স্টুডেন্ট ছিল রাজশাহী ভার্সিটির প্রোগ্রামে, অন্তত ২৫০০। (পরবর্তীতে অবশ্য জগন্নাথ ভার্সিটির প্রোগ্রামে ছিল প্রায় ৪ হাজার, বেগম রোকেয়া ভার্সিটির প্রোগ্রামে ছিলেন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার দর্শক-শ্রোতা।) ওরা বসে থাকে, ৫-৬ ঘণ্টা ধরে কথা শোনে। আমি ভাবি, এ বয়সে এত সময় ধরে বসে থাকে কীভাবে? স্যাররাও শোনেন। ওঁরা বলেন, এ সব কিছু ভার্সিটিতে শেখানো হয় না। আপনি শেখান, আমরা সাথে আছি। স্যারদের ধন্যবাদ। . . . আমি চোখের কোনায় জমে-ওঠা জল লুকোতে লুকোতে ভাবি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কত কিছু পাওয়া যায়! জীবন কাউকেই খালিহাতে ফেরায় না। As I can't teach how to get grades, I've decided to teach how to live life. সবাই তো আর সব কিছু পারে না। হাতি গাছে চড়তে পারে না বলে যদি আমরা বলি, “ও তো কিচ্ছু পারে না!”, তবে সে দোষ তো আর হাতির নয়।


গতকাল এক ছেলে ফোন করল। ওর এবং ওর আশেপাশের সবার বিশ্বাস, ও জীবনে কিছু করতে পারবে না। কেন? জন্মগতভাবে ও বাম চোখে কিছু দেখতে পায় না, ডান চোখে একটু একটু দেখে। এরকম যারা, ওদের কেউ ভালোবাসে না, শুধু করুণা করে। ওর ক্ষেত্রেও সবসময়ই এ-ই হয়ে আসছে। মানুষের অবহেলা ওকে পথের কাঙাল করে ছেড়ে দেয় প্রতিমুহূর্তেই। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন করে একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে, তেমনি করে একটুখানি ভালোবাসার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে! ওকে কেউ কখনো ভালোবাসেনি। এর ফলে ও সবসময়ই এসব নিয়েই ভাবতে অভ্যস্ত—ওর যা-কিছু নেই, কোন কোন চাকরি ওর জন্য নয়, ওর কাউকেই কোনো কিছু দেবার নেই। ওর সমস্ত ভাবনার শতকরা আশিভাগই কী কী ওর জন্য নয়, তা নিয়ে। প্রচণ্ড হতাশা, কষ্ট আর বিষণ্নতায় ওর প্রায়ই মনে হয়, চলে যাই! যাকে এ পৃথিবীতে কেউই চায় না, সে থাকেই-বা কীভাবে? . . . ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। ওকে শেখালাম, কীভাবে করে সেই আশিভাগকে বিশভাগে নিয়ে এসে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়। এ পৃথিবীতে শুধু কান্নাই ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমান। কান্না সবার সাথে ভাগাভাগি করতে হয় না। সবাই আপনার কষ্টের দাম বুঝবে না। থাকুক না কিছু কান্না ব্যক্তিগত! কষ্টের শক্তি অনেক বড়ো। এর খোঁজ করতে জানতে হয়। . . . এমন আরও অনেক কিছু বললাম। ওকে এটা বিশ্বাস করিয়ে দিলাম, পৃথিবীতে ওর মূল্য অনেক। যাদের কাছে ওর দাম নেই, তাদেরকে ইউজড টিস্যুপেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। সাহসী হতে শেখালাম, শক্তি চিনতে শেখালাম। দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলে হেরে যাবে কেন? আমি চাই, কেউই হারিয়ে না যাক। যখন ওকে বললাম, ভাই, তুমি চাকরি পাবার পর প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে কিন্তু! তখন সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি জানি, চোখের জল কখনও মিথ্যে বলে না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, ও পারবেই!


April 4
এক। ছাতকে ঘুরতে এলাম। অনেক সময় নিয়ে সুরমা দেখলাম। পড়ন্ত বিকেলে নদীর রূপটাই অন্যরকম। নদী আর আকাশ কখনও পুরোনো হয় না, বদলায় আর বদলায়। নদী পেরুলেই লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। নৌকোয় গেলাম, ঘুরলাম। সুরমার পাড়েই এটা। অতি চমত্কার স্থাপনা। হলিউডি শ্যুটিং স্পটের মতো একটা আবহ আছে। এখানে অ্যাকশন মুভির শ্যুটিং হলে মন্দ হতো না। বন্দুক উঁচিয়ে নায়ক আর ভিলেন টম অ্যান্ড জেরি স্টাইলে জিগজ্যাগ ট্র্যাকে দৌড়োচ্ছে, নায়কের গায়ে গুলি লাগছে, কিন্তু নায়কের কিছুই হচ্ছে না—এই টাইপের কিছু-একটা বানানো যায়। বাংলাদেশি মুভিতে নায়ক ইনজিউরড হলে নায়িকার দায়িত্ব কান্নাকাটি করা, আর হলিউড মুভিতে নায়ক ইনজিউরড হলে নায়িকার দায়িত্ব আরেকটা বন্দুক হাতে নিয়ে নেমে পড়া। এখানে দুটোই করা যাবে, নো প্রবলেম। নায়িকার কান্নাকাটি করার সুব্যবস্থা আছে। সিমেন্টের ব্যাগের উপর বসে বসে নায়িকা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করবে। নায়িকার কান্না দেখে ক্যামেরাম্যান যথারীতি হি-হি-হা-হা করবে—সেটা অবশ্য দর্শক দেখবে না। ব্যাপারটা ইনোভেটিভ না? . . . ওদের কনভেয়ার বেল্টটা ১৭ কিমি দীর্ঘ, এর ১০ কিমি এখানে, ৭ কিমি ইন্ডিয়াতে। এটা দিয়ে ইন্ডিয়া থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল আসে, এই বেল্ট কখনও বন্ধ হয় না। রাত বাড়ে, আমদানি বাড়ে। দেখলে মনে হয়, একটা ব্রিজ সোজাসুজি চলে গেছে কোথায় যেন . . .


কর্পোরেট সেক্টরের হাউজিং প্ল্যান দেখার মতো। আমি সাউথ কোরিয়াতে স্যামসাংয়ের হাউজিং ঘুরে দেখেছি। অদ্ভুত রকমের সুন্দর। দেখলেই থেকে যেতে ইচ্ছে করে। ও রাজ্য সব-পেয়েছি'র রাজ্য। ওখানে সব পাওয়া যায়—হায়! বাংলাদেশ ছাড়া। যে-স্বর্গে বাংলাদেশ নেই, সে স্বর্গকে আমি হাসিমুখে গুডবাই বলে দিতে পারি। এত কম্প্রোমাইজ করে বাঁচা যায় নাকি? জীবনটা ছোটো তো! ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও দিব্যি থাকেন। ওদের ফ্যাসিলিটিস সত্যিই মুগ্ধ হবার মতো। ফরেইন ইনভেস্টমেন্টের প্রতিষ্ঠানগুলোর এই দিকটা নিয়ে ভাবলেও ভালো লাগে। কত ঝকঝকে অফিসে ওরা কাজ করে! বাসার কথাই বলি না কেন! এত সুন্দর বাসায় থাকতে দিলে এমপ্লয়িদের মন তো এমনিতেই ভালো থাকে, কোম্পানির জন্য খুব খেটে কাজ করতে ইচ্ছে করে।


আমরা যারা সরকারি চাকরি করি, তারা…এত কিছু যে পাওয়া যায়, এটা ভাবতেও পারি না। . . . ওদের গাড়িতে করে প্ল্যান্টগুলো ঘুরে দেখেছি। হাইলি সফিস্টিকেটেড। সব কিছু দেখছি আর ভাবছি, সরকারি চাকরি করতেই হবে কেন? ভালো থাকা নিয়েই তো কথা! যা-ই করি না কেন, আফসোস না থাকলেই হলো। ভালো চাকরি বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো, ভালো থাকা। আমরাও কিন্তু খুব একটা মন্দ নেই। কাস্টমসে চাকরি না করলে এই 'জামাই আদর' (পড়ুন, অফিসিয়াল প্রটোকল) পেতাম নাকি? সবাই মিলে অনেক রংঢং করে করে ছবি তুলেছি। রাতে দেবো।


Thank you Lafarge Surma Cement Ltd for your warm reception! আমাদের এতটা আন্তরিকভাবে সময় দেবার জন্য হীরা ভাইকে ধন্যবাদ। এ মানুষটি চমত্কারভাবে হাসিমুখে হাসতে পারেন।


দুই। ছাতক থেকে ফিরছি। ঝুম চৈতালি বৃষ্টি। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ওড়া। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ চমকাচ্ছে। এ বৃষ্টি বজ্রবৃষ্টি। আকাশ ভেঙে রুপোলি রেখায় চারদিক ঝলসে উঠছে। হেডলাইটের তীব্র আলোয় রাস্তা আর বুনো জলের কলহ। গাড়িতে ছোটোভাইয়েরা চিৎকার করে গাইছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে। একটু আগে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। গাড়ি থেমে রইল। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে ভয়ংকর শব্দ। মনে হচ্ছিল, ঝড় বুঝি এক্ষুনি গাড়িকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পুরোপুরি নির্জন রাস্তা। কেউ এসে আমাদের গুম করে ফেললেও আর কেউ টেরই পাবে না। রাগি ঝড় গাড়ির কাচ এই ভেঙে ফেলল বুঝি! ভয় পেতেও ভয় হচ্ছে—যদি সত্যি সত্যিই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়!


সব ঝড়ই একসময় থেমে যায়। গাড়ি আবারও চলছে। ভেতরে চলছে জীবনের গান। সিলেটের আবহাওয়া বড়োই বিচিত্র। এই বৃষ্টি, এই রোদ। এখন আর ঝড় নেই, শান্তধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। গাছের বড়ো বড়ো ডাল-পাতা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কেউ কেউ ছাতা মাথায় গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে। গরু হবার বড়ো জ্বালা—কেউ মাথায় ছাতা ধরে না। এ হিমেল সন্ধে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার সন্ধে। ঘুমের কথা ভাবছি, ঘুম পাচ্ছে না, মাঝে মাঝে গাড়ির কাচ নামিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছি।
Content Protection by DMCA.com