স্তব্ধতার জাদু

স্তব্ধতার জাদু বিস্ময়কর। যেখানে নৈঃশব্দ্য নেই, সেখানে সবচাইতে আশ্চর্য শব্দমালাও নিরর্থক। শুনতে না জানলে পৃথিবীর সুন্দরতম কথাও কারও মনের ক্ষত সারাতে পারে না। কখনো কখনো দূরত্বের অনুপস্থিতি নিরবধি নৈকট্যকে অর্থহীন করে দেয়। হৃদয়ের বোঝা কমিয়ে নিজেকে হালকা করে স্রষ্টার অনুগ্রহলাভের জন্য প্রস্তুত করতে স্তব্ধতার কাছে বার বার ফিরতে হয়। স্রষ্টার কাঁধে নিজের সকল বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করে যাওয়াই প্রার্থনা। তখন একই দেহে দুটো ভিন্ন সত্তা কাজ করে। একটা সত্তা স্রষ্টার হয়ে বোঝা বহন করে, আরেকটা সত্তা হালকা কায়ায় নিরলস কাজ করে যায়।

আমরা যখন জাগি, তখন এক আলোকিত মশাল পৃথিবীতে আলো ছড়ায়। সে আলোয় আমাদের আত্মার শুদ্ধি আসে। আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার পরিকল্পনা আমাদেরকেই করতে হয়। যদি আমাদের জীবনের ছকটা আমরা নিজেরা না সাজাই, তবে অন্য কেউ সে ছকটা সাজিয়ে নেবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি, না জাগি, তবে আমরা একসময় অন্য কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস হিসেবে নিজেদের দেখতে পাবো। স্রষ্টার নির্দেশ প্রকৃতপক্ষে নিজের বিবেকের সুপ্ত স্বর্গীয় অনুজ্ঞা। নীরব চিত্তে ভালোবাসা আর মানবপ্রেমকে উপজীব্য করে বিবেকের অনুশাসন শুনতে হয়। মনের ঐশ্বর্যের উদ্‌বোধনের মাধ্যমেই অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। অবিচারের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে শক্ত করে, আপাত সুখকে বিসর্জন দিয়ে, দয়া আর দরদকে সাথী করে স্রষ্টার কৃপা গ্রহণ করতে হয়।

নিরাশার নিরালোক রাত সরিয়ে জীবনে আশার আলো খেলে, ভোরের মাহেন্দ্রক্ষণে ক্ষয়িষ্ণু হৃদয় সতেজ হয়ে ওঠে, স্রষ্টার সৌন্দর্য আর উৎকর্ষের ছোঁয়ায় নীরবিন্দুও সাগরের বিশালতা লাভ করে, ঐশী আলোর স্পর্শে জোনাকির ক্ষীণ আলোককণাও তেজোদীপ্ত তারকার চাইতেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। এমন সব ইন্দ্রজালে নিজেকে বাঁধতে হয় হৃদয়ের ঐকান্তিক বিশ্বাস আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। যে-মানুষ নিজের শক্তি সম্পর্কে উদাসীন, তার সাথে শক্তিহীনের পার্থক্য অতি সামান্যই। চিরন্তন সত্যের পথে মুসাফির হয়ে চলতে নিজের ভ্রান্ত সত্তার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার অসীম সাহস আর ধৈর্য লাগে। সে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের মুহূর্তেও মৃত্যুর নিশ্চিন্ত দুর্নিবার আকর্ষণ পিছু ডাকে। সদ্যগত অতীত সবসময়ই বর্তমানের পায়ে শেকল পরিয়ে দিতে চায়।
Content Protection by DMCA.com