যাঁর পদধূলির কাছে বসে শিখে নিজেকে আলোকিত করা যায়, তেমন একজন গুরু পাওয়া পরম-ভাগ্যের ব্যাপার। পাওয়া গেলে তো খুবই ভালো, যদি না যায়, তবে উপনিষদসমূহকে (বেদের জ্ঞানকাণ্ড) গুরুর স্থানে বসিয়ে, কিংবা অত সময় বা সুযোগ না পেলে সকল উপনিষদের সার গীতাকে গ্রন্থগুরুর আসনে রেখে সেই গুরুর উপদেশ ও নির্দেশ মান্য করে চললে জীবনে আর কিছুই লাগে না। গীতামৃত সঠিকভাবে আস্বাদন করার প্রয়োজনে উপনিষদের সকল শিক্ষা এমনিতেই গ্রহণ করতে হয়, তাই এক গীতা পড়লেই বেদের জ্ঞানকাণ্ডের মোটামুটি পুরোটাই আত্মস্থ হয়ে যায়।
রইলে গীতা শরণে,
ভয় কী আর মরণে?
তাৎপর্য না বুঝেই গীতার ৭০০ শ্লোকে তোতাপাখি হয়ে লাভ নেই; তার চাইতে বরং ৭টি শ্লোক খুব ভালো করে ভাষ্য ও তাৎপর্য বুঝে পড়ুন। গীতার দর্শন বেশ দুরূহ, তাই এটি সহজে পড়া গেলেও সহজে বোঝা যায় না। গীতাব্যূহ ভেদ করতে চাইলে গীতাভাষ্য লাগবেই লাগবে। গীতা আমাদের মুখে নয়, আত্মায় রাখার বস্তু। আজ পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ‘শুদ্ধ উচ্চারণে’ গীতাপাঠের এত আয়োজন, অথচ আমাদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উন্নতি হচ্ছেটা কোথায়? গীতার আসল স্থান আসনে নয়, মননে। শুদ্ধ বোধে গীতা পড়তে হবে, শুধুই শুদ্ধ উচ্চারণে পড়লে কী লাভ হবে?
না বুঝে গীতা পড়লে আপনি এই জ্ঞানের যথার্থ অধিকারী কে, সেটাই ধরতে পারবেন না। আমার এক স্কুলফ্রেন্ড জীবনের বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাতের তাড়নায় কোনো একটি সম্প্রদায়ের সাধু হয়ে সেখানেই জীবন কাটাচ্ছে। বেশ ভালো। তো একদিন সেই মন্দিরে তার সাথে দেখা। আমাকে পেয়ে সে তো মহাখুশি, আমিও পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় যারপরনাই খুশি। বন্ধুর অসীম আন্তরিকতায় প্রসাদ পাবার পর দু-জন মিলে যখন গল্প করছি, তখন কথাচ্ছলে সে আমাকে বলল, গীতার একটি বিশেষ অনুবাদ না পড়লে নাকি গীতা পড়েই কোনো লাভ নেই। ওটা বাদে বাকি সব গীতাই ভ্রান্ত, মায়াবাদী চিন্তাভাবনাসম্পন্ন। আরও জানাল, গীতা পড়লে অবশ্যই কোনো সাধুর কাছে ওই অনুবাদটিই পড়া উচিত। অন্যথায়, গীতাপাঠ যথাযথ হয় না। আমি চাইলে ওই ব্যাপারে সে আমাকে সাহায্য করতে আগ্রহী। আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, আমি তার কাছে গীতার শাঙ্করভাষ্য পড়তে চাই। সাথে সাথেই উত্তর পেলাম—ওটা তো মায়াবাদী ভাষ্য, ওটা বোগাস! এই রায় কোনোমতে হজম করে বললাম, আচ্ছা, পরাবিদ্যা লাভ করতে চাইলে আমাদের কী করা উচিত বলে তুমি মনে করো? সে তখন ওই অনুবাদের নামোল্লেখ করে সেটা পড়লেই সব কিছু লাভ করা হয়ে যাবে বলে জানাল। ইচ্ছে ছিল, অচিন্ত্য-ভেদ-অভেদ তত্ত্ব নিয়ে বন্ধুকে একটু খোঁচাব। পরে ভাবলাম, থাক, বন্ধু মানুষ, কী দরকার! ফেরার সময় আমতা আমতা করে প্রস্তাব দিলাম, বন্ধু, তুমি অনেক চমৎকার একজন মানুষ। যদি কিছু মনে না করো, তোমাকে ড. রাধাগোবিন্দ নাথের লেখা তিন খণ্ডের ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন’ গ্রন্থটি উপহার দিই? ওটা পড়লে তোমার সত্যিই অনেক উপকার হবে। “না, না, বন্ধু, আমাদের ওগুলি লাগে না। আমাদের এখানে অনেক গ্রন্থ। এর বাইরে আর কিছুর দরকার নেই।”—এই উত্তরটা পেয়ে মনে হলো, সে যেমন তার জ্ঞানের যথার্থ অধিকারী চিনতে পারেনি, আমিও তো সেই একই ভুলটাই করলাম! তাহলে আমাদের দু-জনের মধ্যে পার্থক্য আর রইল কোথায়? যা-ই হোক, বন্ধুর কাছ থেকে সেদিনের মতো হাসিমুখে বিদায় নিলাম।
গায়ে পড়ে গীতা শেখাতে চান, এমন লোক আপনি রাস্তাঘাটে ভূরি-ভূরি পাবেন। তাই ভালো করে যাচাই করে নিন। গীতা সকল দর্শনের আকরগ্রন্থ, তাই সঠিক উচ্চারণে গীতা পড়ার পাশাপাশি সঠিক বোধে গীতা পড়ার উপর বেশি জোর দিলেই নিজের ও পৃথিবীর মঙ্গল। শুরুটা নাহয় ওভাবে হলে হোক—তবে ধীরে ধীরে তো বোধের ঘরে ঢুকতে হবে, তাই না? আমরা যেন ভুলে না যাই: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত গীতা রামসুন্দর বসাকের 'বাল্যশিক্ষা' কিংবা দাশু রায়ের পাঁচালি নয় যে, একলা বসে বা সবাই মিলে সুর করে পড়লাম আর হয়ে গেল! দর্শন বড়ো গভীরের বস্তু, অগভীরে তার কিছুই নেই। গীতা প্রতিদিনই পড়ছেন, অথচ এক দিনও পড়ছেন না, এমন মানুষ অসংখ্য। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কিছুতেই পুণ্যলাভের মেশিন নয়, বরং জ্ঞানলাভের ম্যাজিকবক্স।
পড়লে গীতা না বুঝে মর্ম,
না হয় পুণ্য, না হয় ধর্ম।