ডেটলাইন ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ আজ ভোরে ঘুম ভাঙল শেয়ালের চিৎকারে। দূর থেকে তীব্র বিদঘুটে চিৎকারে কান পাতাই দায়। এই ভূতুড়ে চিৎকার উপেক্ষা করে ঘুমিয়ে থাকা দুষ্কর। আজকের চিৎকারে কুম্ভকর্ণেরও নিশ্চিতভাবে নিদ্রাভঙ্গ হতো, আমি তো কোন ছার! ভোরের শাদায় নিজেকে ঢেকে রিসেপশনে গিয়ে দেখি, লাল-হলুদ-সাদা রঙের জারবেরি, চন্দ্রমল্লিকা আর কসমস ভোরের শিশিরে-ভেজা নরোম পাপড়ি মেলে আমাদের সুপ্রভাত জানাতে হাসি-হাসি মুখে অপেক্ষায় আছে। ওদের দেখে মনে হলো, ওরা বড়ো ভালো। শাদা রাজহাঁসের পাল চলতে শুরু করেছে, দু-পাশে পামগাছের সারি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওদের ঘুম ভাঙে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে ওরা ক্রমশই পেছনে সরে আসে। আমরা হাঁটছি। ওয়াকিং ট্র্যাকের দু-ধারে ঘন সবুজের সজ্জা। সেখানে পাখির কলকাকলিতে আর কিচিরমিচিরে আজকের ভোরের পুরো পরিবেশটাই মুখরিত হয়ে উঠল। ওদের ভাষায় ওরা অবিরাম বকেই চলেছে আর বকেই চলেছে। ওরা কী বলছে জানতে পারলে বেশ হতো! ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’ বইয়ের শুরুতেই দেখি, “আশা আছে, এই বইয়ের পাতায় ভালোই থাকবে বিপন্ন পাখিরা, যদি না লক্ষ লক্ষ উইপোকা এর নাগাল পেয়ে যায়, অথবা আপনার শিশু এর ওপরে হিসু করে দেয়, কিংবা আপনি একে নদীতে ছুড়ে ফেলেন, যে-নদীতে মরে গেছে সব মাছ, পালিয়ে বেঁচেছে পাখি, ব্যাঙাচিও নেই।” পাখি বিশারদ অভিযাত্রী-লেখক ইনাম আল হকের বিষাদমাখা সুর আমিও সেদিন অনুভব করেছি জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে। যে-হ্রদের জল একটা সময়ে পাখির ডানার ভিড়ে মুখ লুকিয়ে ফেলত, সেখানে আজ পাখির বিচরণ হাতে গোনা যায়। আমরাই ওদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। ওরা আর আগের মতো আসে না। যে-কিশোরের শঙ্খচিল-শালিখের বেশে এই বাংলায় ফিরে আসার স্বপ্ন দেখার কথা ছিল, সে বড়ো হতে থাকে বিষণ্ণধূসর এক বাংলায়, যেখানে পাখির ডাক শুনে কেউ বেড়ে ওঠে না। পাখিরা নেই, তাই সুন্দরও নেই। ‘অশ্বত্থে সন্ধের হাওয়া যখন লেগেছে’-তে জীবনানন্দ এই ব্যথায় সন্দিহান হয়ে গেছেন...কালীগহে ক্লান্ত গাঙশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়...এই আকালের সময়ে আজ ভোরের পাখিদের মধুময় কোলাহল দিনের শুরুটাতে অন্য এক ধরনের দ্যোতনা দিল যেন! ঝিরিঝিরি পাতার গাছের এদিক-ওদিক হাওয়ায় দোলা, এরই ফাঁকে ফাঁকে আলসে মিষ্টি সূর্যের আটকে-পড়া, ধুলোমাখা মেঠো পথ—এই সব কিছু মিলেমিশে পথের বাঁকগুলোকে পাহাড়ি পার্কের শোভা দিয়ে রেখেছে যেন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং কমপ্লেক্সের সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ করে লাগানো বাহারি জাতের ফুলের গাছ আর ওই পুরোটাকে ঘিরে-থাকা সীমানা-প্রাচীরের মতো কাঁটামেহেদির ঝোপের দাঁড়িয়ে থাকা বার বার মনে করিয়ে দেয়…”ওখানে যাওয়া নিষেধ, তাই যেতে হবে।” পিটি শেষে আমরা এমনভাবে শেয়ালের মতো অদ্ভুত গলায় হাসছিলাম যে, শেয়ালও কাছে আসতে ভয় পেত হয়তো। ওরা ভাবত, “ও বাবা! এরা আবার কারা!” আমরা যে কী ছেলেমানুষ! ঘুমিয়ে আছে পিতার শিশু সব পিতারই অন্তরে... আমার অভ্যেস, কখনোই গরম জলে স্নান না করা; শীতেও না। এর কারণ, কনকনে ঠান্ডা জলে স্নান করলে নিজেকে সাহসী সাহসী মনে হতে থাকে। হিমশীতল ঠান্ডা জলে ‘সাকসেসফুলি’ স্নান করে ফেলতে পারলে শীতও একটু কম লাগে। বাথরুমে ঢুকে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে গলা ফাটিয়ে সংগীতযন্ত্রণা সৃষ্টি করে শরীরে ইচ্ছেমতো ঠান্ডা জল ঢালতে থাকায় সেইরকম সুখ। যে-পুরুষ এই শীতে শাওয়ার নিয়ে এসে হাতে-পায়ে লোশন লাগায়, ঠোঁটে লিপজেল দেয়, সে-ই যথার্থ অনলস পুরুষ। মায়ের শত অনুরোধ সত্ত্বেও এই কাজটি আমি এই জীবনে আর করতে পারলাম না। রাতে মা ফোন করলে জিজ্ঞেস করেন আমার হাত-পা-ঠোঁট ফাটছে কি না। বাসায় থাকলে মা ক্যাটক্যাট করে কখনো কখনো লোশন-লিপজেল দিতে বাধ্য করেন। আচ্ছা, পৃথিবীর কোনো ছেলেই কি এই কাজগুলো নিজ দায়িত্বে করে না? আমি রুম থেকে ক্লাসের জন্য বের হই একটু দেরি করে। প্রায় প্রতিদিনই সকালের নাস্তাটা আলসেমি করে আর করা হয় না। সাড়ে ৮টায় ক্লাস, আমি বের হই সোয়া ৮টার দিকে। ওই সময়টাতে ডরমেটরিতে কেউ থাকে না, সবাই থাকে নাস্তার টেবিলে। আমাদের রুমবয়রা পুরো ডরমেটরি ফাঁকা পেয়ে এই সময়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। সারাটা বারান্দায় বাচ্চাদের মতো দৌড়োতে থাকে, নিজেদের মধ্যে কাদেরকে যেন নকল করে মিমিক্রি করে, উলটাপালটা সুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইতে থাকে, বাংলা সিনেমার ডায়লগ আওড়াতে থাকে, একজন আরেকজনকে দুষ্টুমি করে ঝাড়ি মারে, বিভিন্ন প্রাণীর ডাক নকল করে ডাকতে থাকে। আমি রুম থেকে মজা করে এসব শুনি আর হাসি। বের হয়ে ওদের সামনে দিয়ে যাবার সময় ওরা খুব অপ্রস্তুত হয়ে সালাম দেয়, কেউ কেউ কোনো কারণ ছাড়াই ‘সরি, স্যার’ বলে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে সালামের জবাব দিয়ে হেসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই। টলস্টয়ের ‘আনা কারেনিনা’-র শুরুর লাইনটা এরকম: All happy families are alike; each unhappy family is unhappy in its own way. আমার মনে হয়, কথাটি শুধু পরিবারই নয়, সব মানুষের ক্ষেত্রেও সত্যি। পৃথিবীর সব মানুষেরই ‘সুখ-আনন্দ-ভালোবাসা’-র চেহারাটি কমবেশি একই ধরনের। সিঁড়ির নিচে একটা বিশাল আয়না আছে। ওতে ওপরের দিকে লেখা, “Am I looking fine?” প্রতিদিন ক্লাসে যাবার সময় ওটাতে নিজেকে একবার দেখে নেই, সব ঠিকঠাক আছে কি না। আমি ‘প্রথমে দর্শনধারী’ নীতিতে বিশ্বাসী, তাই পরিপাটি থাকার ব্যাপারে বেশ খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। এই আয়নাকে ধন্যবাদ। আহা! আয়না যে কত মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়! আয়নাতে সবাই নিজেকে শাহরুখ-ঐশ্বরিয়াই দেখে। এই আয়না মিথ্যে না বললে কী যে ভীষণ রাগ হয়! শুধু এই এক আয়নার মিথ্যে-বলাতে মানুষ কোনো রাগই করে না। প্রতিদিন সকালে আমার মাথায় একটা গান সেট হয়ে যায়। ওটাই গুনগুন করতে থাকি, সারাটা সময়জুড়ে ওটাই আমাকে ঘিরে-ছেয়ে রাখে। আজ বাজছে মান্না দে। এই আছি বেশ...আমার মতে এই গানটি মান্না দে’র সবচাইতে ‘স্মার্ট গান’। ভালো কথা, 'স্মার্ট গান' কথাটার কোনো মানে নেই। আমার কাছে স্মার্ট মনে হলো, তাই আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। এই গানটা-সহ আরও কিছু গান শুনতে আমি আপনমনে দুষ্টু-দুষ্টু স্টাইলে হাসতে থাকি। আরেকটা উদাহরণ দেই। শ্রীকান্তের ‘ধিন তা না না না’ গানটা শুনলেও আমার কাছে স্মার্ট স্মার্ট লাগে। কিশোরকুমারের ‘পারি না সইতে’ গানটাও স্মার্ট গান। মান্না দে’র গানটা শুনলেই আমি আপনমনে মিষ্টি-মিষ্টি মুচকি হাসতে থাকি, দুষ্টু-দুষ্টু চাহনিতে তাকাতে ইচ্ছে করে, চারপাশটা সুন্দর মনে হতে থাকে, আরও কী কী সব যেন হয়! করিডোরে হাঁটতে লাগলাম। এই আছি বেশ...উফফ! গানটা এত বেশি জোস কেন? প্রথম ক্লাসটা রেক্টর স্যারের। সব সেকশনের কমন সেশন, অডিটোরিয়ামে; এটিকেটস অ্যান্ড ম্যানারস নিয়ে। কিছু কথা মনে আছে। এই যেমন, # বসের রুমে যাবার সময় যদি আর কোনো কলিগকে সাথে করে নিয়ে যাও, তবে যাবার আগে অবশ্যই বসের পারমিশন নিয়ে নেবে। # পুলিশে দেখেছি, একই ব্যাচের একজন কমিশনার হয়েছেন, আরেকজন ডেপুটি কমিশনার রয়ে গেছেন। বিসিএস পরীক্ষার মেরিটলিস্টে ডেপুটি কমিশনার ছিলেন আগে, কমিশনার সাহেব ওঁকে সুপারসিড করেছেন। অথচ এটা নিয়ে ওঁর মধ্যে কোনোদিনও কোনো ধরনের রাগ কিংবা ক্ষোভ দেখিনি; উনি বরং সবসময়ই কমিশনারকে ওঁর প্রাপ্য সম্মানটা দিতেন। # জুনিয়র সিনিয়রের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য আগ বাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দেবে না। সিনিয়রদেরকে সবসময় সম্মান করতে হবে। # সবসময় সব কথা মনে রাখতে নেই। সবসময় সব কথা বলতে নেই। # জুনিয়র কলিগ সিনিয়র কলিগকে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলার সময় বলবে, “আমার ওয়াইফ” আর সিনিয়র কলিগ জুনিয়র কলিগকে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলার সময় বলবে, “আপনার ভাবি”। শিষ্টাচার সম্পর্কিত ক্লাসে আমরা কী শিখলাম? আমরা ক্লাসের মাঝখানে ব্রেকের সময়টাতে দলে দলে মিছিলে মিছিলে ওয়াশরুমে যাই। সেখানে কঠিন-তরল-প্লাজমা বিসর্জনের লাইন পড়ে যায়। আজ লাইনে দাঁড়িয়ে একজন বলছিলেন, সিনিয়রের আগে জুনিয়রের বাথরুম করা শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। আপনি আপনার সিনিয়রকে একদিন আগে ছোটো বাথরুম করতে দিন, আপনার সিনিয়র আপনাকে আরেকদিন আগে বড়ো বাথরুম করার সুযোগ করে দেবেন। বুঝুন অবস্থা! সেশনশেষে যথারীতি প্রশ্নোত্তর পর্ব। কখনো কখনো সেখানে চলে তৈলমর্দন প্রতিযোগিতা। কে কার চাইতে কত বেশি ইনিয়ে-বিনিয়ে তেলবাজি করতে পারেন। দু-একজন প্রশ্ন করার ছলে অতিবিরক্তিকরভাবে তেল দিতেই থাকেন আর দিতেই থাকেন। ওদের প্রশ্ন আর কমেন্ট করার ধরন দেখে আমরা নিজেরাই বিব্রত হই। এই ধরনের তেলবাজকে একটা রেক্টর মেডেল দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যায় না? আমরা চাই, পিএটিসি’তে একটা কামারশালা খোলা হোক। মাঝে মাঝেই মেডেলের দরকার হবে। (বন্ধুদের জন্য বলছি, পিএটিসি’তে যিনি ফার্স্ট হন, ওঁকে রেক্টর মেডেল দেওয়া হয়।) দেড় মাস পরে ফিল্ড অ্যাটাচমেন্ট প্রোগ্রাম শুরু। বাংলাদেশের যে-কোনো একটা জেলার বিভিন্ন সংস্থায় ২ মাস হাতেকলমে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। পরের ক্লাসের শুরুতে আমাদেরকে একটা করে ফর্ম দেওয়া হলো। সেখানে ৩২টি জেলার নাম দেওয়া আছে। আমাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ৩টি জেলার নামের পাশে ১, ২, ৩ লিখতে হবে। নিজের জেলা, কর্মস্থল আর শ্বশুরবাড়ির জেলা পছন্দ করা যাবে না। আমার প্রায়োরিটি ছিল এরকম: কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ। ক্লাস শুরু হলো, ঘুম শুরু হলো। আমরা কেউ কেউ রীতিমতো বর্ন-স্লিপার হয়ে উঠেছি। হেলান দিয়ে কিংবা সোজা হয়ে বসে, মুখ খোলা কিংবা বন্ধ রেখে সুখনিদ্রায় ক্লাসে ‘প্রেজেন্ট’ থেকে কখন ১ ঘণ্টা শেষ হবে, সেটার জন্য ওয়েট করতে থাকা। যাঁদের চোখে চশমা, তাঁরা এই কাজে কিছু বাড়তি সুবিধা পান। ওদেরকে দেখলে চট করে ধরা যায় না। অবশ্য, যাঁদের ক্লাসে ঘুম আসে, তাঁরা বেশিরভাগই উদার মনের হয়ে থাকেন, ঘুমোলে কিছুই বলেন না। ওরা তো জানেনই যে, স্টুডেন্টরা ওঁদের ক্লাসে ঘুমায়। যে ঘুমাচ্ছে, সে ঘুমাক না! ও তো আর কাউকে বিরক্ত করছে না। ওকে কিছু-একটা বলে সবাইকে এটা জানিয়ে দেবার কী দরকার যে, আমার ক্লাসে পাবলিক ঘুমায়? সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, আর ক্লাস ঘুমের হয় স্পিকারের গুণে। বর্ন-স্লিপারদের কথা অবশ্য আলাদা! আমার ব্যাচমেটদের জন্য একটা ক্যুইজ দিয়ে লেখা শেষ করছি। পিএটিসি তো আমাদের ডানপন্থী হতে শেখায়। মানে, করিডোরে, সিন্ডিকেট বিল্ডিংয়ে, লেকচার থিয়েটারে—সব জায়গাতেই আমাদেরকে ডান দিকে হাঁটতে হয়। ডান দিকটায় নিচে একটু পর পর অ্যারো আঁকা আছে। ভুল পথে হাঁটতে গেলে বেখাপ্পা লাগবেই। আচ্ছা, করিডোরের একটা জায়গাতে একটা অ্যারো ভুলে উলটোভাবে আঁকা হয়েছে। বলতে হবে, অ্যারোটা কোথায়? দেখি, কারা বলতে পারেন!