একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখো, দিনশেষে তুমি কারও কাছেই শান্তি পাবে না। যে-শান্তির খোঁজ তুমি রোজ রোজ এখানে-ওখানে করে মরছ, সে-শান্তিটা আসলে পৃথিবীর কোত্থাও নেই। কখনো সুযোগ হলে পৃথিবীর দর্শনীয় কোনো সুন্দর জায়গায় ঘুরতে যেয়ো, পৃথিবীতে দামি দামি যে খাবার আছে, সেগুলোর কোনোটি টেস্ট করে দেখো কিংবা সব থেকে দামি দেখতে সুন্দর ড্রেসগুলোর কোনো-একটা পরে দেখো; মন চায় তো অবসর থেকে কিছুটা সময় একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির কাছে কিংবা খুব সৎ একজন মানুষের সাথে কাটিয়ে দেখো; দেখবে, প্রথম কিছুদিন বেশ ভালো লাগবে, কিন্তু আস্তে আস্তে সেটি তোমার কাছে বিরক্তিকর আর একঘেয়ে হয়ে উঠবে। আমরা শান্তির জন্য যে প্যারামিটার তৈরি করেছি, তার কোনোটাই আসলে চিরন্তন নয়। শান্তির উৎস সময়ের সাথে বদলায়। তাই কখনো শান্তির প্রয়োজন হলে একপৃথিবী ক্লান্তি নিয়ে দিনশেষে কিছুটা সময়ের জন্য নিজের কাছে ফিরে যেয়ো। দেখবে, যে শান্তির জন্য তুমি পৃথিবী ওলট-পালট করতে বসেছিলে, সেই শান্তি আসলে কেবল তোমার ভেতরেই নিহিত। পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই, কথাটা কখনো কখনো বিশেষ অর্থে ভুল। নিজের ভেতরের শান্তি ঠিক থাকলে বাইরের শত অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা কিংবা অপ্রাপ্তিও হালকা মনে হয়। কিন্তু ভেতরের সেই শান্তির জন্য মানুষকে নিজেকে চেষ্টা করে যেতে হয়। সেটা এক দিনে কিংবা এক যুগেও হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করতে করতে একটা সময় সেই চেষ্টা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে ভেতরের শান্তিটা ক্রমশ তৈরি হতে থাকে। আশেপাশের ব্যক্তি, স্থান, পরিস্থিতি কোনো কিছুই তখন আর কাউকে বিচলিত করতে পারে না। কারও প্রতি কিংবা এই জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্রও অভিযোগ আর আসে না। তখন মানুষ প্রত্যাশার ঘর শূন্য করে দেয়। এই জাগতিক সব কিছুর কাছ থেকে নিজেকে কিছুটা দূরত্বে সে রেখে দেয়। তখন মানুষ বুঝতে শেখে, জাগতিক সব কিছুই এক-একটা উপকরণ মাত্র, এদেরকে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু এদের কাছে নিঃস্বার্থভাবে কিছুই পাওয়া যাবে না। কেননা, এমনকী ভালবাসার বিনিময়েও মানুষ কিছুটা ভালোবাসা প্রত্যাশা করে। যে ব্যক্তি তোমাকে কারণে-অকারণে রোজ দু-দণ্ড শান্তি দিয়ে যাচ্ছে, সে-ও হয়তো একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন সে তোমার কাছে এমন কিছু-একটা চাইবে, যা তাকে শান্তি কিংবা স্বস্তি এনে দেবে বলে সে বিশ্বাস করে। এর থেকে বরং তুমি আত্মমুখী হও। এক নিজের আত্মার কাছে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও কোনো শান্তি নেই। কখনো কখনো সুখ, শান্তি, ভালোবাসা, চাহিদা এগুলো কেবলই মানসিক অবস্থান। এই বিষয়গুলো অন্যের থেকে পেতে চাইলে তার প্রতি একপ্রকারের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়ে যায়। তখন কখনো কখনো সেই ব্যক্তির কাছে এগুলোর জন্য জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। তখন নিজের অপছন্দের কাজগুলোও তাকে খুশি করার জন্য করতে হয়। কী দরকার নিজের আত্মাকে এতটা বিক্রি করার? যার অন্তর্দৃষ্টি যত বিস্তৃত, সে আকাশকে তত বিশাল দেখে। অন্তর্দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গেলে বিস্তৃত আকাশটাও নিজের কাছে সংকীর্ণ হয়ে আসে। তখন খুব হাঁসফাঁস লাগে। কোলাহলের চাইতে আমার নীরবতা ভালো লাগে; সেই ছোট্টবেলা থেকে আজ অবধি এত এত শব্দ শিখেছি, তবুও কেন জানি না আমার নৈঃশব্দ্যই বেশি প্রিয়। কিছু না বলেই সব বলা যায়। কিছু না জানতে চেয়েও সব জানা যায়। শতসহস্র শব্দমিছিল যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, নৈঃশব্দ্য তখন কথা বলে। নৈঃশব্দ্য তখন শেখায়, কখনো কখনো জীবনের হাজারো প্রাপ্তিও সামান্য সুখটুকু এনে দিতে ব্যর্থ হয়, তখন কোনো এক সামান্য অপ্রাপ্তি মানুষকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখটি এনে দেয়। আমরা পেয়ে হারাতে শিখেছি, হারিয়ে পেতে আজও শিখিনি।