আসুন, বাঁচাই!

চারিদিকে বাড়ছে আত্মহত্যার মিছিল। আসুন, সচেতন হই, বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষের কিছু চিহ্ন চিনে নিই।

যদি দেখেন, আপনার উচ্ছল সদাহাস্যোজ্জ্বল বন্ধুটি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গেছে, তার ব্যাপারে খোঁজ নিন। নিভে যাবার আগে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপটিও অনুজ্জ্বল ও স্তিমিত হয়ে যায়।

আপনার পরিচিত কাছের মানুষটিকে, যাকে সবসময় গাইতে, লিখতে, নাচতে অথবা আঁকতে দেখতেন, যে-কাজগুলো না করে সে থাকতেই পারত না, হঠাৎ যদি সে-কাজগুলি করা সে ছেড়ে দেয়, তার ব্যাপারে সতর্ক হোন। সৃষ্টিশীল মানুষেরা আর্ট ছাড়া বাঁচে না। প্রাণচঞ্চল মানুষটা যদি আপনার বোধগম্য কারণ ছাড়াই হুট করে চুপ হয়ে যায়, পরিচিত কোনো আর্টিস্ট যদি আর্টের সঙ্গে বাঁচা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ঠিক বুঝে নেবেন, মানুষটা ভেতরে ভেতরে মারা গেছে, সুযোগ পেলেই সে প্রাণটাকে দেহ থেকে আলাদা করে দেবে।

আপনার পরিচিত কিংবা আপনজন মানুষটা হুট করেই কিংবা ধীরে ধীরে কাছের মানুষ, বন্ধুবান্ধব সবার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে কিংবা বন্ধ করে দিয়েছে; তার কাছে গিয়ে খোঁজ নিন, সে হয়তো চাইছে, তাকে ছাড়া সবাই বাঁচতে শিখুক, সে হয়তো জীবন থেকে পালানোর ফন্দি মনে মনে এঁটে ফেলেছে।

আপনার বেকার বন্ধুটি প্রচণ্ড অর্থকষ্টে ভুগছে কি না খোঁজ নিন, কর্মজীবনের চাপে বাধ্য হয়ে আপনার কাছের মানুষটি মানসিক চাপে পিষ্ঠ হয়ে আছে কি না খেয়াল করুন, সাংসারিক জীবনে আপনার বোন কিংবা বউ আপনার অগোচরেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন। বাঁচতে খুব বেশি কষ্ট না হলে কেউই মরতে চায় না।

হয়তো ওদের প্রত্যেকেই মনে মনে হাল ছেড়ে দিয়ে, কোথাও পালাতে না পেরে, কোনো বন্ধুত্বের হাত না পেয়ে জীবন থেকে পালাতে মৃত্যুর কাছে ধর্না দেবে। জীবন যাকে ফিরিয়ে দেয়, মৃত্যু তাকে বুকে টেনে নিতে চায়। আপনি একটু হাত বাড়ালেই অনেকেই ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়। একটু সহায়তা করে টেনে তুললেই কেউ কেউ হারিয়ে যাওয়া থেকে পথ খুঁজে পায়।
কেউ মরে যাবার পর তার জন্য টানা একবছর মায়াকান্না না কেঁদে মানুষটি বেঁচে থাকতেই তার জন্য একদিন কেঁদে দেখুন। মরে যাবার পর আপনার কান্নায় মৃত ব্যক্তির কিছুই আসে যায় না, কিন্তু ওই ব্যক্তি জীবিত থাকতেই তার জন্য আপনার কিছু সহায়তা, দু-চারটে দয়ার্দ্র কথা, সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা, অথবা তার কথাগুলো শোনা ... মানুষটাকে হয়তো আত্মহত্যার মতো ব্যাপার থেকে বাঁচিয়ে দেবে।

আপনি সামর্থ্যবান হলে বেকার বন্ধুটিকে মাঝে মাঝে টাকা ধার দিন বিনা শর্তে; বুকে টেনে ধরে বলুন, আরও টাকা লাগলে বলিস, সামর্থ্য অনুযায়ী দেবো। চিন্তা করিস না, আমি আছি তোর পাশে।

যে-বোনটির মাথায় সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আপনি সংসার করতে বাধ্য করেছেন, তার কাঁধে একবার শুধু হাত রেখে বলুন, "আমি আছি, তুই ওই সংসার ছেড়ে এখানে চলে আয়।"

আপনার যে প্রিয় মানুষ চাকরিজীবনের চাপে ভুগে দিনরাত্রি ঘুমোতে পারে না, তার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলুন, "জীবনটাই দামি বেশি, চাকরি নয়। চাকরিটা নাহয় ছেড়ে দাও, নতুন কিছু ঈশ্বর নিশ্চয়ই মিলিয়ে দেবেন।"

বিষণ্ণতায় ভোগা পরিচিত লোকটির দুর্ব্যবহার সহ্য করে হলেও বারবার ফোন করুন, তার আস্থা অর্জন করুন, তার বলতে-না-পারা কথাগুলো ধৈর্য ধরে শুনুন। শরীরে মানুষের রক্ত প্রবাহিত হলে ওদের জাজ করবেন না।

ব্যস্, এতটুকুই! এইটুকুন সহায়তাও একটি মানুষকে আত্মহত্যার হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

প্রচণ্ড কালবৈশাখীর গভীর রাতও ঘনিয়ে শেষে একদিন ভোর আসে, জোয়ারে চর ডুবিয়ে দিয়ে যাওয়া স্রোতও সময় হলে ভাটা হয়ে নেমে যায়। কেবল গভীর অন্ধকার রাতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতন একটা খুঁটি পেতে হয়, ভেসে না যাবার মতন তীরে একটা বাঁধা নৌকা পেতে হয়।

প্রবল বৈশাখী ঝড়েও ভেঙে না পরার সেই খুঁটিটি আপনি নিজেই হোন, স্রোতের টানে ডুবিয়ে নিতে না পারার সেই নৌকাটি আপনি হয়ে যান। দেখবেন, বাঁচতে বড়ো ভালো লাগছে।

জোয়ার-ভাটা'র মতন জীবন একদিন ঠিকই ফুরিয়ে যায়, কিন্তু অসময়ের জোয়ারে ভেসে কোনো ফড়িং যেন জলে ভেসে না যায়।