অভাব

তখন আমি ভারি ছোটো। দারিদ্র্যের উচ্চশিখরে বসে মা তখন আমাদের ভাঙাচোরা সংসারটার ভার একাই কাঁধে তুলে নিয়ে জীবনের চরম দৈন্যে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। তিনি তখন সারাক্ষণই আমাদের পাঁচটি ক্ষুধার্ত মুখের অন্নসংস্থানে শশব্যস্ত। মাকে দেখে শিখেছি, আর কিছুই নয়, কেবল দু-মুঠো ভাত জোগাড় করার জন্য মানুষ কতটা পাগলের মতো হয়ে যেতে পারে! বাজারের সবচে’ সস্তা চাল, তার সঙ্গে শুধুই লবণ আর অর্ধেকটা পেঁয়াজ দিয়ে এক ডেকচিভর্তি ঝোলে-ভরা আলুতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের ক্ষুধানিবৃত্তির ত্রিসীমানা। আমরা সেই সীমানা পেরিয়ে যেতে পারিনি কোনোদিনই।




পাতিলের ওই বিস্বাদ পেটকে বাকি সবাই বিরিয়ানির তৃপ্তিতে গোগ্রাসে গপাগপ চিবিয়ে গিলে খেলেও আমি নবাবজাদি ওটা খেতে চাইতাম না। বিলাসিতা করে একটু শুঁটকি কিংবা একটুকরো ছেঁড়া ডিমভাজি চাইতাম। আমার ওই সামান্য আবদারটুকু রক্ষা করতে না পারায় তখন মায়ের কেমন যন্ত্রণাবোধ হতো জানতে পারিনি কখনও; কখনও বুঝিইনি, ওই অক্ষমতায় আমাদের মায়ের দু-চোখের কোনায় নিজের প্রতি কত বিতৃষ্ণা, কত ব্যথা, কত দুঃখবোধ জমে থাকত।




নিজের সন্তানকে খেতে দিতে না-পারা মায়েরাই এ পৃথিবীর সবচাইতে তীক্ষ্ণ তীরে ক্ষতবিক্ষত প্রাণী। ওঁদের চেয়ে দুঃখী আর কে হয়! একজন ক্ষুধার্ত নারী ক্ষুধার জ্বালায় চাইলেই আত্মহত্যা করতে পারে, কিন্তু একজন ক্ষুধার্ত মা শত চাইলেও, ক্ষুধায় মরতে মরতেও, নিজেকে শেষ করে দিতে পারে না। মেডিক্যাল সায়েন্সের কল্যাণে মা হওয়া সহজ হলেও মা হয়ে ওঠা অনেক অনেক কঠিন।




চরম অভাবের ঘরে নিয়ম, আইন-শৃঙ্খলা, ভালোবাসা কিংবা স্নেহ বলে তেমন কিছু থাকে না; থাকে শুধুই ক্ষুধা, ক্ষুধা এবং ক্ষুধা! ক্ষুধার শহরে নিয়মের কোনও ব্যারিকেড থাকে না, থাকে না ভালোবাসার কোনও সূচিপত্র। থাকে শুধুই নুনে-মাখা একথাল সাদাভাত! ক্ষুধার ঘরে ক্ষুন্নিবৃত্তির নামই প্রার্থনা, ভাতের নামই প্রেম।




তাই অমন করে ডিমভাজির ছেঁড়া টুকরো কিংবা কখনোবা মাছের ঝোল খেতে চাওয়ার মতো অতটা বিলাসিতা দেখানোর চরম পাপের মোচন মা কখনও কখনও সারতেন কষে চড়থাপ্পড় কিংবা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। এভাবেই দিনের পর দিন ওই ছোট্ট অবুঝ আমি’টা ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিলাম অমন তীব্র কষ্ট এবং জীবনশিক্ষায় বিদ্ধ হতে হতে।




দারিদ্র্যে-ঠাসা ক্ষুধার থালায় কীসের অত আবদার?




তখন ছোট্ট আমি প্রায়ই ভাবতাম, আমার মায়ের মতন নিকৃষ্ট মা এই পৃথিবীতে আর নেই যে কিনা নিজের সন্তানকে খাবার চাইলে মারে! বুঝতাম তো আর না, আমি চাইলে মা আমাকে নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিতে পারেন হাসিমুখে, কিন্তু ওই খাবার দেবেন কোথা থেকে!? প্রাণটা নাহয় নিজের হাতে, কিন্তু খাবারটা যে নিয়তির হাতে!




দেখতাম, আমাকে ইচ্ছামতো পিটিয়ে অন্য রুমে গিয়ে মা অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখতেন। মা রুম থেকে বের হলে দেখতাম, মায়ের চোখদুটো টকটকে লাল আর ফোলাফোলা। কী জানি কেমন যন্ত্রণাবোধ হতো মায়ের! অদৃষ্টের দোলাচলে দুলছে যে জীবন, তার দিনলিপি যে এমনই!




ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিলাম।




বুঝলাম, আমাদের পুরো পৃথিবীটা মূলত চারদিকে অভাবের উঁচু উঁচু দেয়াল দিয়ে তৈরি। এখানে আসো আর ওখানেই যাও, এপাশ ওপাশ চারপাশেই অভাব আর ক্ষুধার শক্ত খুঁটিতে আমাদের জীবন বাঁধা। এই খুঁটি থেকে বাঁধনমুক্তি যেন কিছুতেই মেলে না।




সকালে রং-চা দিয়ে মুড়ি, দুপুরে আর রাতে পুকুরপাড় থেকে কুড়িয়ে-আনা শাক কিংবা কচুর লতিতেই যেন আমাদের তিনবেলার পেট এক অচ্ছেদ্য চক্রে বাঁধা। কোথাও কাউকে একটুকরো মাছ খেতে দেখলেও মনে হতো, আহা, সে কী বেহেস্তি খানা!




ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম, চায়ে দুধ-চিনি কমিয়ে দিলে এক কাপ চা বাড়তি বানানো যায়, তরকারিতে পেঁয়াজ-রসুনের পরিমাণ একটু কমিয়ে দিলে তা দিয়েই পরের বেলায় আর-একটা তরকারি বাড়িয়ে রাঁধা যায়। কখনোবা অর্ধেক সেদ্ধডিম ভাগ্যে জুটলে তা অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খুব আরাম করে খেতাম। এভাবেই আমার জীবনকে চেনা, যুদ্ধকে বোঝা।




অনুভব করলাম, এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো শিক্ষকই হলো দারিদ্র্য, যে কিনা নিজেই হাতে-কলমে জীবনের সব অলিগলি, অঙ্ক, হিসাব-নিকাশ আগাগোড়াই শিখিয়ে দিয়ে যায়। কখনও দারিদ্র্য দেখেনি যে, সে যেন ভুল করেও দাবি করে না বসে, জীবনকে সে পুরোপুরি চেনে!




পৃথিবীকে সভ্য করার জন্য নাকি সাহিত্যের দরকার হয়! ক্ষুধায় লেপটে-যাওয়া যে পেট, সেই পেটে কি সাহিত্য আঁটে আদৌ? ওসব সাহিত্য-ফাহিত্য তো ভরাপেটি লোকেদের জন্য! খালিপেটে সাহিত্য হজম হয় না, খালিপেটে লাগে শুধুই খাবার, খাবার এবং খাবার।




যারা সাহিত্য রাঁধে আর যারা সাহিত্য গেলে, তারা তো সবাই সেই সাহিত্যভোজের আগে ঠিকই পেটভর্তি করে নেয়! খালিপেট থেকে সাহিত্য বেরোয় না, বেরোয় কেবলই দীর্ঘশ্বাস।




তোমরা তো বলোই, এই পৃথিবীটাকে সভ্য করতে চাই! কিন্তু কখনও কি ভেবেছ, ভাঙাচোরা ঘরের ক্ষুধায়-ঠাসা ওই অসভ্য মানুষগুলো তোমাদের সভ্যতাকে দিনে তিনবেলা পায়ের তলায় পিষে মারে? সেই পৃথিবী কীসের সভ্য, যে পৃথিবী আজও ক্ষুধায় কাঁপে!?




পৃথিবীকে সভ্য করতে সাহিত্য, সভ্যতা কিংবা আইনকানুন নয়, পৃথিবীকে সভ্য করতে দরকার হয় ভাত, ভাত এবং ভাত! যে সভ্যতা ভাতে নয়, ইটে গড়া, অচিরেই সেই ইটই সেই সভ্যতার মাথা ফাটিয়ে চৌচির করে দেয়।




হে সমাজপতিরা, পৃথিবীটাকে সভ্য করার আগে ক্ষুধামুক্ত করুন। পেট সভ্যতা বোঝে না, বোঝে কেবল সাদাভাত। ক্ষুধাকে জিইয়ে রেখেই সভ্যতার লালন, এমন স্বপ্ন দেখার চাইতে বড়ো অসভ্যতা আর হয় না।




ভাবতাম, একদিন আমিও অনেক বড়ো সভ্য মানুষ হব। খুঁজে খুঁজে সভ্য মানুষদের দলেই আমিও নাম লেখাব। আমি ক্ষুধায় বড়ো হয়েছি, সভ্যতায় নয়। তাই সভ্য হবার সাধটা আমার মধ্যে সবসময়ই ছিল।




আজকাল আমি বড়ো হচ্ছি, বড়ো হতে হতে তো এখন বুড়িয়েই যাচ্ছি! এখন আমার আগের সেই দারিদ্র্য আর নেই। তবে দারিদ্র্যের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত-হওয়া চামড়াটা আজও আছে। জীবন থেকে দারিদ্র্য চলে যায় জীবনে দারিদ্র্যের দাগ রেখেই। সেই দাগই মানুষকে জীবন চেনায়।




সেই ছোটোবেলায় সভ্য মানুষ-খোঁজা আমি এখন শুধুই মানুষ খুঁজি; ক্ষুধার্ত মানুষ খুঁজি, যার পেটে রাশিরাশি ক্ষুধা, কেবলই ক্ষুধা, ক্ষুধা এবং ক্ষুধা! ক্ষুধার্ত থেকে গিয়ে বাঁচতে খুব কষ্ট হয়, আমি জানি।




পৃথিবীর বড়ো বড়ো সাহিত্য তো ক্ষুধার যোনি ছিঁড়েই বের হয়। আমি তাই মানুষ খুঁজি, অলিতে-গলিতে হন্যে হয়ে মানুষ খুঁজি।




আমি আজ আর সভ্য মানুষ খুঁজি না, সংস্কৃতিমনা মানুষও খুঁজি না, আমি কেবলই ক্ষুধার্ত মানুষ খুঁজি। একথালি পাতে দু-মুঠো সাদাভাত দেবো বলে আমি আজ কেবলই ক্ষুধার্ত মানুষ খুঁজি। ক্ষুধাকে জিইয়ে রেখে সভ্যতা আর সংস্কৃতি কখনোই এগোতে পারে না।




আজ দেখছি, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই বড্ড অভাবী। বড়ো বড়ো সমাজপতির বড়ো বড়ো নামি-দামি গাড়ির ভিড়েও আরও…আরও গাড়ি-বাড়ির অভাব বাড়ছে! বড়ো বড়ো মন্ত্রী-উপমন্ত্রী আর বড়ো বড়ো নেতার বড়ো বড়ো চালের বস্তার বড়ো অভাব! কোটি টাকায় ব্যাংকভর্তি কোটিপতিদের আরও…আরও কোটি টাকার অভাব। প্রবল ক্ষমতাশীল দোর্দণ্ড প্রতাপধরদের আরও…আরও প্রতাপের অভাব। এইসব অভাবের যেন শেষই নেই!




যার যত বেশি আছে, তার তত বেশিই অভাব। চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। এত এত নামি-দামি অভাবীর ভিড়ে কিছু মানুষের, আর কিছু নয়, শুধুই তিনবেলা দু-মুঠো ভাতের অভাব। বড়ো বড়ো সকল ধরনের অভাবী ওসব মানুষ পায় সবই…যা যা ওরা চায়, কেবল ভাতের অভাবীরাই দু-মুঠো ভাত পায় না। সত্যিকারের আপেক্ষিকতা বুঝতে হলে অভাবের দিকে তাকাতে হবে।




এই পৃথিবীর সর্বজনীন ভাষা দুইটি: যৌনতা এবং অভাব।
Content Protection by DMCA.com