একজন আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলছি। গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে রাস্তা। আমাদের গাড়ি যে সময়ে এ রাস্তা ধরে ছুটছিল, তখন রাস্তা দিয়ে হাতি চলাচল করে। হ্যাঁ, হাতি চলাচলের রাস্তা দিয়ে হাতি চলাচলের সময়েই দিগলাকোনা মিশনে পৌঁছলাম। বেশ ভালো রকমেরই সম্ভাবনা ছিল খুব কাছে গিয়ে হাই-ফাইভ দিতে না পারলেও হাতিমামাদের সঙ্গে একটু দূর থেকে হাই-হ্যালো করতে পারার। সুযোগটা অবশ্য শেষমেশ আর হয়ে ওঠেনি। ওঁরা আসেননি। গারো-অধ্যুষিত গ্রাম দিগলাকোনা। আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়ঘেরা একটি গ্রাম। আফসোস, এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। শ্রীবরদী হয়ে এখানে আসার এবং এখান থেকে ফিরে যাবার কামালপুর সীমান্তঘেঁষা যে রাস্তা, তা দিনের আলোয় নিঃসন্দেহে ভীষণ চমৎকার দেখাবে। দিনের আলোয় ঘুরে দেখার জন্য এখানে দু-দিন কাটাতে আবার আসার ইচ্ছে রইল। অবশ্য কাঁটাতারের সীমান্তের ওইপারে সারি সারি সন্ধের আলো দেখতে দেখতে এইপারে ছুটে চলাও খুব চমৎকার একটি অনুভূতির জন্ম দেয়। মিশনে পৌঁছে দেখি, মিসা (একধরনের প্রার্থনা) চলছে। সুপার দাদা বললেন, চলুন, একটু ঘুরে দেখি আশেপাশে। আমি, সুপার দাদা এবং সজীব ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ি গ্রাম্য আঁধারের নৈঃশব্দ্যে মিশে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। মেঠোপথের সোঁদা গন্ধ, বাতাসের পাহাড়ি ঘ্রাণ, রাজ্যের পোকাদের অবিশ্রান্ত মৃদুডাক গায়ে মেখে মেখে বড়ো এক পাহাড়ের পাদদেশে টিলার উপর অবস্থিত একটি কুঁড়েঘরে পৌঁছলাম। ঘরে একজন গারো আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভদ্রমহিলা ছিলেন। খুবই আন্তরিক স্বভাবের ছোটোখাটো গড়নের এই আদিবাসী নারীর নাম মিলন মারাক (দাংগ)। পরনে বিবর্ণ পোশাক, ঘরে দৈন্যের ছাপ সুস্পষ্ট। তবু মুখে হাসি, কথাবার্তায় সারল্য। আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনি একধরনের মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন। চোখে-মুখে একধরনের নির্ভীক প্রত্যয়, দৃপ্ত আত্মবিশ্বাস। অতীতের রোমন্থনের সময় তাঁর কণ্ঠে ও দৃষ্টিতে যেন পাহাড়সমান তৃপ্তি। তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা এভেন্দ্র সাংমা (মানখিন) কিছুদিন আগে ক্যানসারে মারা গেছেন। ১১ নম্বর সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার 'অপরাধে' তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে প্রায় ১৪ বছর। এই পরিবারটির আয়ের একমাত্র উৎস মাসিক ২০ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধাভাতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ এমন অসংখ্য পরিবারের ভরণপোষণের এই গুরুদায়িত্বটি বহন করার জন্য। এই ভদ্রমহিলার দুই সন্তান পর পর মারা গেছে। একমাত্র ছেলেটি কোনও একটি চাকরির চেষ্টায় আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার কিংবা তাঁর পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গে দেখা হলে আমার বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার বাবাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাবা অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা-সার্টিফিকেট গ্রহণ করেননি। কেন করেননি, তা অন্য একটি লেখায় বলেছি। বাবার দর্শন এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সঙ্গে গল্পশেষে মিশনে ফিরে এলাম। ফাদার ডমিনিক সরকার, ফাদার খোকন এবং সিস্টারগণ ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এই মিশনের ডাইনিং-রুমের ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি পাহাড়ি ঝরনা। ফাদার এবং সিস্টারগণের সঙ্গে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ঝরনার জলধারার কলকল ধ্বনি উপভোগ করছিলাম। ফাদার ডমিনিকের আন্তরিক আপ্যায়ন, সিস্টারগণের আতিথেয়তা এবং আমাদের হৃদয়মথিত আলাপচারিতায় ভীষণ উষ্ণ একটি সন্ধে কাটল বুনো পাহাড়ি আদিম আবহে। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর একটি কথা মনে গেঁথে গেছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই পাহাড়-জঙ্গলে থাকতে আপনার ভয় করে না? তাঁর উত্তর ছিল, কীসের ভয়? আমার গ্রাম, আমার ঘর। আমার কীসের ভয়? আমরা সবাই এই বিশ্বাস এবং সাহস নিয়ে বাঁচতে চাই। এই গারো ভদ্রমহিলার স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশ তাঁর। আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশ আমার। আপনার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশ আপনার। আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি, বেঁচে আছি। এই দেশ হিন্দুদের, এই দেশ মুসলমানদের, এই দেশ বৌদ্ধদের, এই দেশ খ্রিস্টানদের, এই দেশ আদিবাসীদের। হ্যাঁ, এই দেশ আমাদের সবার পৈতৃক সম্পত্তি, আমরা এই মাটির ভূমিপুত্র। এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কোনও দাঙ্গাবাজের ঠাঁই এখানে অতীতেও হয়নি, আজও হবে না। এই সহজ কথাটি বুঝতে যাদের অসুবিধে হবে, সময়ই তাদের সমুচিত জবাব দেবে।