মানুষ যেভাবে জয়ী হয়


আপনার মনের শক্তি কম? যদি বলি, প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে শপিং-এ যান, যা খরচ, সব আমার, তবে তো এক্ষুনি একলাফে বেরিয়ে পড়বেন! সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফেরার পর রাত জেগে ক্লাব-ফুটবল দেখে তো পরের দিন ঠিকই সময়মতো অফিসে পৌঁছোতে পারেন! অথচ অনেক জরুরি কাজই, মনের শক্তি কম, এই অজুহাতে ফেলে রাখেন। ব্যাপারটি কী আসলে? মনের শক্তির অভাব? না কি যা করতে চাইছেন, সেটির জন্য মনের শক্তির অভাব? সারারাত না ঘুমিয়ে মনের জোরে ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছোতে পারেন যিনি, তাঁর মনের শক্তি মোটেও কম নয়। অথচ সেই ব্যক্তিটিই অনেক কাজেই আগ্রহ অনুভব করেন না মনের শক্তির অভাবে! ব্যাপারটা রহস্যের জন্ম দেয়!


অতীতের দিকে তাকান। জীবনে এমন অনেক কিছু করেছেন, যা করার পর নিজের উপরে নিজেই খুশি হয়ে উঠেছিলেন! হয়নি এমন? অন্যরা খুশি হলো কি হলো না, সেটি বাদ দিন। নিজের সাফল্য যখন নিজের প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে যায়, তখন সেটির চাইতে আনন্দের আর কী আছে? মনের শক্তির ঘাটতি থাকলে কি সেই কাজটির পেছনে অতটা শ্রম দিতে পারতেন? যখন কেউ টানা পর পর ক্লাস নিতে থাকেন কিংবা কোনও সেমিনারে কথা বলতে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কোনও ক্লান্তি বা বিরক্তি ছাড়াই, তখন নিশ্চয়ই তিনি যে শক্তির কারণে ওরকম পরিশ্রমের কাজও হাসিমুখে করে যেতে পারেন, সেটি মনের। মনের শক্তিতে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। যে হতদরিদ্র মা তাঁর ওজনের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ ভারী বিকলাঙ্গ সন্তানটিকে কাঁধের উপর বয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভিক্ষে করেন, তাঁর এই শক্তির উৎস দেহ নয়, মন।


যখন কোনও কাজে মনে অনীহা আসে, তখন আসলে মনের মধ্যে কী ঘটে? এ কাজ কি আমাকে দিয়ে হবে? কাজটি শেষ করতে পারব তো? মাঝপথে আবার ছেড়ে পালাতে হবে না তো? কাজটি যে উদ্দেশ্যে করছি, তা যদি সফল না হয়? এসব মনে আসার মূল কারণটি হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। কাজটি শুরু করার আগেই মনের এমন অবস্থা কাজটি শুরু করতেই দেয় না। এক্ষেত্রে প্রস্তুতি নিয়ে কাজটি শুরু করে দেওয়া যায়। শুরু করাই হচ্ছে যে-কোনও কাজের সবচাইতে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যদি এমন হয় যে আপনি অতীতে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলেও মনের মধ্যে নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে।


দেখুন, অতীতে যদি আপনি কাজটিতে এক বার ব্যর্থ হয়েই থাকেন, তবে আমি বলব, আপনি ইতোমধ্যেই অনেক এগিয়ে আছেন। অন্যরা যা ভুল করবে, আপনি তা করবেন না। শুরুটা কীভাবে করতে হয় কিংবা কীভাবে শুরু করা যাবে না, তা অন্যরা না জানলেও আপনি জানেন। অতীতের অভিজ্ঞতা যেন আপনাকে দুর্বল না করে উলটো উৎসাহিত করে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। সবই জানেন, বোঝেন, প্রস্তুতিও আছে, তবু কাজটি করতে ভয় পাচ্ছেন। কেন পাচ্ছেন? সামনে গেলে যদি বাঘে খেয়ে নেয়? বাঘ তো এখনও আসেইনি, তবু মনে মনে সে এসে গেছে! বনের বাঘের আগেই মনের বাঘ এসে হাজির! কোনও ব্যাপার না। বাঘ তো আসেনি, আপনিই বাঘকে এনেছেন। এখন সেই বাঘকে তাড়িয়ে দিলেই তো হয়! এখন কথা হচ্ছে, তাড়াবেনটা কী করে?


অতীতের ব্যর্থতা মনের জোর কমিয়ে দেয়। কাদের মনের জোর কমিয়ে দেয়? যারা অতীত থেকে ইতিবাচক কিছু শেখার বদলে ভয় পেতে শেখে। পরিস্থিতি কিন্তু একই রকমের থেকে যায় না। এমনও হতে পারে, অতীতে আপনি যে পরিস্থিতিতে কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এখন পরিস্থিতি ওরকমই নয়। আপনার অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতি নতুন পরিস্থিতিকে একতুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে হয়তো, যা আপনি জানেনই না। কাজটি যদি ভয়ে শুরুই করতে না পারেন অতীতের কথা ভেবে ভেবে, তবে কাজটি সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য যে পরিকল্পনা দরকার, তা-ই তো করতে পারবেন না! অতীতের আপনি আর এখনকার আপনি তো ভিন্নও হতে পারেন, তাই না? মানুষ অনেকসময় নিজেও বুঝতে পারে না, সে কী করতে পারে আর কী করতে পারে না। নিজের মনের অজান্তেই মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা চলে যায়। ভয় না পেয়ে শুরুটা করে দিন। সেই শুরুর প্রথম ধাপ হোক প্রস্তুতিগ্রহণ। বাকিটা এমনিতেই হয়ে যাবে।


আরেকটা কাজ করতে পারেন। অতীতে যে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, সে কাজটা সম্পর্কে দু-লাইন লিখুন। তখন আপনার কী কী সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলি লিখুন। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এসেছিল, তা লিখুন। তখন কী কী করলে ব্যর্থ হতেন না, তা লিখুন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যর্থতার কারণগুলি কোন রূপে আবারও আসতে পারে, একইসাথে সম্ভাব্য আর কী কী কারণ এসে হাজির হতে পারে, এক এক করে সবই কাগজে লিখে ফেলুন। এখন সময় নিয়ে ভাবতে থাকুন ও পরিকল্পনা করুন, এই মুহূর্তে কী কী পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখলে আপনি ওসব সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবেন। ব্যস্‌! এখন আর ভয়ের কীসের? যা-কিছু অনিবার্য, তা-কিছুর মুখোমুখি দাঁড়াতে যদি আপনি পুরোপুরিই তৈরি থাকেন, তবে কাজটি শুরু করতে আর বাধা কোথায়? যে-কোনও কাজ শুরু করার আগে এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় আগামপ্রস্তুতি মানসিক শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। এতে বিপদ সহজও হয় না, কঠিনও হয় না, বিপদ বিপদের মতোই থেকে যায়। এমনও তো হতে পারে, বিপদ এলই না! তবে বিপদ আসেও যদিও, আপনার ওই ডায়েরিটা আপনাকে বিপদের চোখে চোখ রেখে সামনের দিকে এগোতে অনেক সাহায্য করবে।


যা হবে বলে ভাবছি, তা হবে কি হবে না, তা-ই এখনও জানি না, তবু তা নিয়ে ভয় কিংবা আশঙ্কা আমাদের থামিয়ে রাখে। একেক পরিবেশে ও সমাজে মানুষ একেক নিয়মে বড়ো হয়। এক সমাজে যা ভয়ের, আরেক সমাজে তা-ই হয়তো স্বাভাবিক। এক পরিবেশে যা অসম্ভব, আরেক পরিবেশে তা-ই হয়তো সহজ। এর মানে, কোনও কাজের সহজ বা কঠিন হওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরিই নির্ভর করে মানুষের বেড়ে ওঠার নানান অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও অভ্যাসের উপর। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্কুল-কলেজ, বিত্ত-দারিদ্র্য, ধর্ম-বিশ্বাস, রীতিনীতি, পরিবার-সমাজ ইত্যাদি বিষয় মানুষের ভেতরকার বিন্যাস তৈরিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। তাই আপনার চোখে যা সত্য, আমার চোখে তা সত্য না-ও হতে পারে। আমি যা ভয় পাই, আপনি তা ভয় না-ও পেতে পারেন। আপনি যা অপরিহার্য মনে করেন, আমি তা অপ্রয়োজনীয়ও মনে করতে পারি। কোনটা যে বাস্তব, আর কোনটা যে কল্পনা, তা নির্ভর করে ব্যক্তির কিছু নিজস্বতার উপর।


একটা সমস্যার সামগ্রিক অংশ বিশ্লেষণ না করে যদি আমাদের মন কেবল তার একটি অংশ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তবে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। সেই অংশের সমাধান আমার জন্য সহজ হলে আমি পুরো সমস্যাটিকেই সহজ ভাবব। কিংবা সেই অংশের সমাধান আমার জন্য কঠিন হলে আমি পুরো সমস্যাটিকেই কঠিন ভাবব। এমনও তো হতে পারে, একটা অংশের সমাধান অন্য অংশে বিদ্যমান। সব অংশ নিয়ে না জানলে সমাধানটা মাথায় আসবে কী করে? আবার এমনও হতে পারে, সব অংশ নিয়ে না জানার কারণে আমি সমস্যাটিকে এতটাই সহজ ভেবে বসে রইলাম যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিই নিলাম না! ধরুন, আপনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেবেন। আপনি জানেন না, শেষ পর্যন্ত চাকরিটা আপনি পাবেন কি না। স্বাভাবিকভাবেই এই অনিশ্চয়তার কারণে আপনার মনে ভয় ও সন্দেহ তৈরি হবে। কীরকম? যদি চাকরিটা না পাই? এই ‘যদি’র বিপরীত ‘যদি’টাও তো ঘটতে পারে, তাই না? চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই-ই তো আপনার মতো এরকম একটা ‘যদি’তেই বাস করে। তার মানে কি চাকরিটা কেউই পাবে না? পাবে যারা, তাদের মধ্যে আপনি থাকবেন না কেন? এই মুহূর্তে তাদের সবাই-ই কি আপনার চাইতে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন?


চাকরিটা না পেলে কী হবে? আচ্ছা, চাকরিটা পেলে কী হবে? সামাজিক সম্মান, চাকরির নিরাপত্তা, ভালো বেতন পাবেন, কাছের সবাই খুশি হবে, সবার কাছে আপনার মর্যাদা বাড়বে। তো এত কিছু পাওয়ার আশা যেখানে আছে, সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা খুব সহজ হবে, এটা মাথায় আসছে কেন? এ পৃথিবীতে যা-কিছু পেলে গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়, তা-কিছু কখনওই সহজে পাওয়া যায় না। অন্যরা যা পাওয়ার জন্য লড়াই করতে রাজি, তা আপনি বিনা লড়াইয়ে পাবেন কী করে? মনে আসতে পারে, এত পরিশ্রম করার পরও যদি চাকরিটা না পাই, তখন কী হবে? কী আর হবে! অন্য চাকরি করবেন! ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি যা যা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন, তার সবকিছুই কি পেয়েছেন? সুখে ও সমৃদ্ধিতে আছে যারা, তাদের সবাই-ই কি বিসিএস ক্যাডার? চাকরি না পেলে কি মরে যাবেন? যারা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের সবার জীবন কি ধ্বংস হয়ে গেছে? হয় কী জানেন, মানুষ যা নিয়ে বেশি ভাবে, তা-ই সে চোখের সামনে সারাক্ষণ দেখে আর দেখতেই থাকে। অন্য কিছুই তার চোখে তখন পড়ে না। এই সাময়িক অন্ধত্বের কারণে চোখের সামনের অর্জনটাই যে জীবনের সবকিছু নয়, তা-ই সে ভুলে বসে থাকে!


পাশের বাসায় আপনার মামা থাকেন। হঠাৎ মামি স্ট্রোক করলেন! কী করবেন তখন? পালিয়ে যাবেন? ব্যস্ততা দেখাবেন? যদি সত্যিই মানুষ হন, পারবেন অমন করতে? হাসপাতালে কখনও যাননি? রোগীকে কীভাবে কোথায় ভর্তি করাতে হয় জানেন না? এসব কি কেউ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে, না কি ঠ্যাকায় পড়লে বাধ্য হয়ে শিখে নেয়? ইংরেজি দেখলেই আপনার গায়ে জ্বর আসে! সামনে একটা চাকরির পরীক্ষা। ইংরেজি না পারলে চাকরিটা পাবেন না। কী করবেন তখন? পরের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করবেন? আছে এমন একটাও চাকরির পরীক্ষা, যেখানে ইংরেজি লাগে না? না কি পরের পরীক্ষার সময় ইংরেজিটা সহজ হয়ে যাবে? অন্য কিছু বাদ দিলাম। একটা ডিম সেদ্ধ করতে হওয়ার ভয়ে পাউরুটিটা জলে ভিজিয়ে খেয়েই কাটিয়ে দেন, এমন অনেক মানুষ আছেন।


করতে ইচ্ছে করছে না, দেখতে কঠিন লাগছে, এ ধরনের অজুহাতে কাজকে সবসময়ই এড়িয়ে যায় যারা, তাদের জীবনেই মনের শক্তির অভাব বেশি দেখা দেয়। শক্তি সবার মনেই থাকে। একদমই সচেতনভাবে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও দরকারি কাজটা নিজের শরীরকে দিয়ে করিয়ে ফেললে ধীরে ধীরে সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন আর কাজ দেখলে পালাতে হয় না, আর এই ব্যাপারটিই হচ্ছে মনের শক্তি। পরিস্থিতি কঠিনও হয় না, সহজও হয় না, পরিস্থিতি পরিস্থিতির মতোই হয়। একই পরিস্থিতি যদি অন্য কেউ সামলে নিতে পারে, আর আপনি সেটি এড়িয়ে চলেন, তবে তা আপনার মনের শক্তির অভাব নয়, অভাসের অভাব। মানুষ গায়ের জোরে নয়, মনের জোরেই পৃথিবী জয় করে।


যা যা আপনার কাছে কঠিন মনে হয়, সেগুলির একটা তালিকা করে ফেলুন। সেই তালিকার মধ্যে সবচাইতে জরুরি তিন-চারটি কাজ, ভালো লাগুক না লাগুক, ইচ্ছে করুক না করুক, উৎসাহ আসুক না আসুক, শরীরের জোরে করতে থাকুন। প্রথম দিনের পর দ্বিতীয় দিন, এরপর তৃতীয়, চতুর্থ এভাবে করতেই থাকুন, যতক্ষণ পর্যন্ত কাজটির ভেতরে আপনি ঢুকে যেতে না পারছেন। পড়তে যাদের ইচ্ছে করে না, তারা যদি নিজেকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও জোর করে চেয়ার-টেবিলে আটকে রাখতে পারেন দিনের সাত-আট ঘণ্টা, এবং একইসাথে মন দিয়ে পড়া ও লেখার অভিনয়টা চমৎকারভাবে করে যেতে পারেন, তবে খুব শিগ্‌গিরই দেখবেন, আপনি পড়াশোনার অভ্যাসে নিজের অজান্তেই টুক্‌ করে ঢুকে গেছেন। এরকম করতে থাকলে দিন দিন কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ ও দক্ষতা বাড়বে। এটা একধরনের সাধনা। বলাই বাহুল্য, এ পৃথিবীতে কেউই সাধনার সময়টাতে ফেইসবুকিং করে বা মোবাইল টিপে সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি।


নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনার মধ্যে কোন প্রবৃত্তিটি সবচাইতে বেশি কাজ করে? রাগ? লোভ? অহেতুক অহংকার? ঈর্ষা? অন্যের সমালোচনা? কারও পেছনে লেগে থাকা? অন্যদের ছোটো করে দেখার বদভ্যাস? সততার সাথে উত্তর দিন। ধরে নিলাম, আপনার উত্তরটি হচ্ছে: ঈর্ষা। এখন মনে মনে শপথ করুন, আজ সারাদিনে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনি কাউকে ঈর্ষা করবেন না। যদি মৃত্যুও সামনে এসে উপস্থিত হয়, যদি আপনার অনেক বড়ো কোনও ক্ষতিও হয়ে যায়, যদি মন অবিরত বিদ্রোহ করতেই থাকে, যা হয় হোক, আপনি ঈর্ষাকে মনের মধ্যে আসতে দেবেনই না। এসেও যদি যায়, ওকে পাত্তা দেবেন না। পাত্তা পেলে ক্রোধ ও ঈর্ষা, দুই-ই বাড়ে। কারও সাফল্য, কারও চেহারা, কারও উন্নতি, কারও বিশেষ কোনও গুণ, কারও খ্যাতি ইত্যাদি দেখে যদি আপনি ঈর্ষায় পুড়তে পুড়তে ছাইও হয়ে যান, তবু এমন কিছুই প্রকাশ করবেন না, যা দেখে আপনার ঈর্ষার বোধটি খুশি হয়ে বাড়তে থাকে।


যাকে ঈর্ষা করতে মন চায়, তার জন্য প্রার্থনা করুন, তার ভালো ভালো দিক নিয়ে ভাবুন, তার সমৃদ্ধির কথা নিয়ে লোকের সাথে গল্প করুন। মানুষ কখন ঈর্ষা করে? যখন সে সচেতন বা অবচেতন মনে এমন কিছু চায় যা সে পায় না, তখন। এরকম হতেই পারে। হলে কী করবেন? আপনি যা পেতে চাইছেন, তা যে পেয়েছে, তার পথ অনুসরণ করুন। দেখবেন, আপনার সমস্ত ঈর্ষা আপনাআপনিই সমীহতে পরিণত হবে। ঈর্ষাকে অবদমন করার এসব কাজ দুই সপ্তাহ ফাঁকি না দিয়ে একাগ্রচিত্তে করতেই থাকুন। দেখবেন, আপনার মধ্য থেকে ঈর্ষা ধীরে ধীরে বিদেয় হচ্ছে। একই টেকনিকে বাকি প্রবৃত্তিগুলির হাত থেকে আপনি সহজেই মুক্তি পেতে পারেন। এই ব্যাপারটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে না। এটা ঘটবার জন্য অপেক্ষা করে থেকে কোনও লাভ নেই। নিজেকেই এই কাজটি সচেতনভাবে করতে হবে।


অনুপ্রেরণা দেয় যে বইগুলি, যে মুভিগুলি, যে লেকচারগুলি, যে মানুষগুলি, তাদের কাছাকাছি নিজেকে রাখুন। সেসব বই পড়ুন, সেসব মুভি দেখুন, সেসব লেকচার শুনুন, সেসব মানুষের সাথে মিশুন। এই কাজগুলি করার সময় নিজে নিজে পণ্ডিতি করবেন না। কীরকম পণ্ডিতি? যে উৎস থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়, সে উৎস নিয়ে কখনওই একটিও প্রশ্ন তুলবেন না। পৃথিবীতে যে যত বেশি জাজ করে, সে তত বেশি পিছিয়ে থাকে। যে যত বোঝে, যে তত ভোগে। বেশি বোঝা লোকজন, দিনশেষে, নিজের জন্যও বোঝা, বাকিদের জন্যও বোঝা। ওদের এড়িয়ে চলুন। একদমই অন্ধের মতো করে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করুন ও নিজের জীবনে কাজে লাগান। দেখবেন, এসব নিয়ে অনেকে গবেষণা করে ও আজেবাজে কথা বলে। যে-কোনও মূল্যে ওদের এড়িয়ে চলুন। ‘নিজেকে পণ্ডিত-ভাবা ওসব লোকজন জীবনে বেশিদূর যেতে পারে না।’ আমার কথা বিশ্বাস না হলে আগের বাক্যটি কোথাও লিখে রাখুন। আজ থেকে দশ বছর পর মিলিয়ে নেবেন। অনুপ্রেরণায় অবশ্যই অবশ্যই কাজ হয়! যাদের মধ্যে বিশ্বাস কম, তর্ক বেশি, তাদের বেলায় অনুপ্রেরণায় কাজ কম হয়। কাজ কীভাবে হলো, তা বোঝাটা জরুরি নয়, কাজ হওয়াটাই জরুরি।


জীবনের সবচাইতে বড়ো সম্পদটির নাম দুঃখ। যার জীবনে কোনও দুঃখ নেই, সে হয় মিথ্যে বলে কিংবা সে দুঃখটা চিনতেই পারেনি। দুঃখকে চিনতে পারাটা খুব জরুরি। দুঃখকে চিনতে পারে না যারা, দুঃখ কখন যে ওদের গ্রাস করে ফেলে, তা ওরা নিজেরাও বুঝতে পারে না। দুঃখ এলে কী করবেন? পালিয়ে যাবেন? যদি পালাতে না পারেন? যদি দুঃখটা নিজের অস্তিত্বের সাথেই জড়িয়ে থাকে? যদি দুঃখটা সুখের রাস্তায় হাঁটার প্রথম ধাপটিই হয়? যদি দুঃখটা সবচাইতে প্রিয় মানুষের কাছ থেকেই আসে? যদি দুঃখটাকে সরাতে গিয়ে নিজের প্রিয় কিছুকে বিসর্জন দিতে হয়?


এ পৃথিবীতে অনেক কিছুর ট্রেনিং হয়, কিন্তু দুঃখ সহ্য করার ট্রেনিং কোথাও হয় না। এই ট্রেনিংটা নিতে হয় জীবনের কাছ থেকে। দুঃখ সহ্য করতে জানার চাইতে বড়ো আশীর্বাদ আর নেই। শান্ত মনে দুঃখকে গ্রহণ করলে মনের শক্তি বাড়ে। মনের মধ্যে দুঃখকে থাকতে দিলে তা মনের ভেতরে ক্রমাগত ধাক্কা দেয় আর দিতেই থাকে। এতে করে সেই দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রেরণা তৈরি হয়। দুঃখ গিলে ফেলতে পারে যে যত বেশি, সহ্য করার শক্তি তার তত বেশি। অনেককেই দেখবেন, প্রতিকূল পরিবেশেও হাসিমুখে থাকে, লোকের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেলেও চুপ করে সহ্য করে। ওদের দেখে আমরা ভাবি, ওদের বোধ হয় দুঃখ নেই, ওদের মনে কেবলই সুখ আর সুখ! আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ওরা জীবনে এত বড়ো বড়ো দুঃখ সহ্য করেছে যে, এই ছোটোখাটো দুঃখ ওদের স্পর্শই করতে পারে না। ওরা দুঃখ চিনে, আর চিনে বলেই দুঃখের সাথে দেখা হলে ওরা হাসে। দুঃখের যাপন সুখের যাপনের চেয়ে অধিক মঙ্গল বয়ে আনে। আমি এ কারণে প্রায়ই বলি, জীবনে কিছুই না পাওয়ার চাইতে দুঃখ পাওয়াও অনেক ভালো।


যে আপনাকে সহ্যই করতে পারে না, কিংবা আপনি যাকে সহ্যই করতে পারেন না, একদিন সময় করে তার সাথে দেখা করুন। দেখা করার সুযোগ না পেলে তাকে ফোন করুন, তার খোঁজখবর নিন। সে যা-ই বলুক না কেন, আপনি কোনোভাবেই রিঅ্যাক্ট করবেন না। দাঁতে দাঁত চেপে তার সমস্ত দুর্ব্যবহার সহ্য করুন। নিজের সহ্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই টেকনিকটা ভালো কাজে দেয়। নিজের সবচাইতে প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর কথা ভাবুন। মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে ভয় না পেলেও প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর কথা ভাবলে মানুষ ভীষণ ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। যত খারাপই লাগুক, স্থির মনে ভাবতে থাকুন, মানুষটি সত্যি সত্যি মরে যাওয়ার পর কী কী ঘটতে পারে। নিজের মনের উপর তার মৃত্যুর প্রভাব নিয়ে নিয়ে ভাবুন। দেখবেন, মনের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। অনেক ছোটোখাটো ব্যাপার আপনাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না।


প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অসীম শক্তি নিহিত আছে, এবং এটি ব্যবহার করে মানুষ এমন কিছু জয় করে ফেলতে পারে, যা সে নিজেই কখনও ভাবতে পারেনি। এই শক্তি বাড়াতে কিংবা বাইরে নিয়ে আসতে সচেতনভাবে চেষ্টা করা যায়, এবং এ চেষ্টায় ভালো ফল আসে। সমস্যা দেখে তা থেকে পালিয়ে না গিয়ে ধৈর্য ও কৌশলের সাথে তার মুখোমুখি দাঁড়ালে সমাধান মিলে যায়। তবে যে সমস্যার সমাধান অন্য সমস্যার সূচনা করে, তা সমাধান না করাই ভালো। মনের শক্তি দিয়ে এমন অনেক কাজ করে ফেলা যায়, যা সাধারণ যুক্তিতে অনেকটাই ব্যাখ্যাতীত। মনে তীব্র ইচ্ছে থাকলে শক্তি ভূতে জোগায়! এমন কিছু কাজ আছে, যা করার সুযোগ পেলে আমরা সময় বের করে হলেও কাজগুলো করি, যদি শরীর খুব অসুস্থ না থাকে। (নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, এমন কী কী কাজ আছে, যা করার সুযোগ পেলেই আপনি খুশিতে লাফিয়ে উঠবেন!) তখন তো মনের শক্তির অভাব হয় না আমাদের! মজা পেলেই করব, না পেলে করব না, এই মানসিকতা থাকে যদি, তবে জীবনে বড়ো হওয়া কঠিন, কেননা যা-কিছু করা খুব জরুরি, তার বেশিরভাগই মজার কোনও কাজ নয়। আমাদের সুবিধেমতো তো আর কাজের গুরুত্ব নির্ধারিত হয় না, তাই না? তাই যে কাজের জন্য মনের ইচ্ছে ও শক্তি তৈরি করতে পারব না, সে কাজের ফলও আমরা ভোগ করতে পারব না, এটাই স্বাভাবিক।


মানুষ যখন মনের শক্তিতে চলে, তখন সে প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস ও চিন্তার একধরনের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়, যা থেকে কোনও অবসাদ আসে না, যার কোনও নিঃশেষ নেই। এ কারণেই মানুষ যা করতে ভালোবাসে, তা সে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করেও করতে পারে। যা করতে না পারলে কারও অস্তিত্ব টেকানোই কঠিন হয়ে পড়ে, তা সে এমন আসুরিক শক্তিতে করে ফেলতে পারে অত্যাশ্চর্য দক্ষতায়, যা স্বাভাবিক মানুষের কল্পনাতেও হয়তো আসবে না। এ সমস্ত ব্যাপার জাগতিক অভিজ্ঞতার অনেক ঊর্ধ্বে। ভেতরটাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে, ভেতরের মানুষটাকে দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করিয়ে নিতে পারলে, মনের শক্তির অমিতপ্রবাহে নিজেকে চালনা করতে পারলে মানুষ পুরো পৃথিবীকে বিস্ময়কর সব কাজ করে দেখাতে পারে।